নিজামীর মৃত্যুদণ্ড: যুদ্ধাপরাধ বিচারের গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন

আসিফ মুনীর
Published : 30 Oct 2014, 12:47 PM
Updated : 30 Oct 2014, 12:47 PM

পেশাগত এবং ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার একজন কর্মী ভাবতে চেষ্টা করি অনেক বছর ধরে। সেই হিসেবে একটা দোটানা অনুভূতি অনেক সময় সংশয়ে ফেলে দেয়, একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে বসে থাকে। ইংরেজি ভাষায় বহুল ব্যবহৃত দুটো বচন দিয়ে এই দোটানার একটা ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করি।

'আই ফর অ্যান আই', নাকি 'টার্ন দ্য আদার চিক'? সহজ ব্যাখ্যা হল, ''অন্যায়ভাবে মার খেলে পাল্টা মার দেব, নাকি চুপ করে থাকব বা মুখ বুজে সহ্য করে যাব?''

বাংলায় আরও একটু খোলাসা করতে গেলে বলতে হয়, ''আমার অধিকারের সীমানা কতটুকু–- অন্যায়ের প্রতিকার চাওয়া নাকি মুখ বুজে সয়ে যাওয়া এই ভেবে যে অন্যায়ের জন্য সে কোনো না কোনো দিন অনুতপ্ত হবে বা নিজের অপকর্মের শাস্তি ভোগ করবে?''

এই সিদ্ধান্তের মূলে দ্বিধা হল-– অন্যায়কারীরও আত্মপক্ষ সমর্থন করে ক্ষমা পাওয়ার অধিকার আছে কিনা, বা কার অধিকার বড়, অন্যায়কারীর নাকি যে সেই অন্যায়ের ভিকটিম, তার, নাকি সমাজের ঘাত-প্রতিঘাত, অনিয়মের কারণে অন্যায়কারী অন্যায় করেছে, সে পরিস্থিতির শিকার, তাই তার দোষের চেয়ে সমাজ ব্যবস্থারই দোষ বেশি?

তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধাপরাধের ক্ষেত্রে এই দ্বিধার অবকাশ থাকা উচিত নয় কোনো বাংলাদেশি বা বাংলাদেশির বংশধরের। বিশেষ করে যদি তার কিছুটা হলেও বিবেক, মনুষ্যত্ববোধ এবং দেশাত্মবোধ থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ বৈষম্যের আন্দোলনে যে দুটি পক্ষ সংঘাতময় পরিস্থিতিতে ছিল, বর্ণবৈষম্য অবসান এবং নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে দুটি পক্ষকে প্রতিপক্ষের জায়গা থেকে সমঝোতার জায়গায় আনতে শুরু হয়েছিল 'ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েসন' প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়ায় ম্যান্ডেলা সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গকে, সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ (শাসক এবং শোষক) সেটেলারদের ক্ষমা করার অবস্থায় নিয়ে যেতে পেরেছিলেন।

পাকিস্তান ও পাকিস্তানপন্থী এদেশীয়রা, বিদেশিরা অনেক সময় বলেন, এত পুরনো ঘটনা নিয়ে টানাটানি না করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই ভালো। অর্থাৎ প্রকারান্তরে ক্ষমার ইঙ্গিত! কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা পৃথিবীর নিকৃষ্টতম অপরাধের পরেও দেশে থেকে রাজনীতি করেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যান আর অকপটে যুদ্ধাপরাধের জলজ্যান্ত প্রমাণ অস্বীকার করেন, তাদের অপরাধ ভুলে বিবেকবান বাংলাদেশি কখনও-ই তাদের সানন্দে বরণ করে নিতে পারবে না।

আমার বাবার মতো আরও সকল শহীদের হত্যার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তির কৃতকর্মের বিচার ও প্রাপ্য শাস্তি দাবির মাধ্যমে সুবিচার চাওয়া আমার, আমাদের ন্যায্য অধিকার। এই দাবি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির জন্য নয়। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এখানে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা ও সুবিচার প্রাপ্তির অধিকার রাখি আমরা।

এই বিবেক, মনুষ্যত্ববোধ এবং দেশাত্মবোধ, তিনটে শুধু মুক্তিযুদ্ধে স্বজন-হারানো পরিবারগুলোর নয়, স্বদেশি-প্রবাসী সকল বাংলাদেশির থাকা উচিত। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যারা সরাসরি হত্যা, ধর্ষণ আর লুঠ করেছে, নির্দেশ দিয়েছে, বা ইন্ধন যুগিয়েছে-– কোন অধিকারবলে তারা এইগুলো করেছিল যে, আজ কেউ কেউ তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকারের প্রশ্ন তোলেন? দেশে কিছু বিশ্লেষক এবং অধিকাররক্ষার আপাত ধারক-বাহক পশ্চিমা বিশ্বের কাছে প্রশ্ন করা যেতেই পারে।

তবে আইনি প্রক্রিয়ায় কাঠগড়ায় দাঁড় করানো ব্যক্তিটির পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলার আইন-কানুন যখন রয়েছে, তখন আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলতে দেওয়া উচিত। আবার এটাও ঠিক, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে একটি বিশেষ আইনের আওতায়, বিশেষ আদালতে। প্রচলিত আইনি মানদণ্ড, এমনকি অন্যান্য দেশে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য চলেছে, তার মানদণ্ডের সঙ্গে কেন অনেকটাই মিল থাকতে হবে বুঝি না। সাংঘর্ষিক না হলেই হল।

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের জন্য আইন প্রণয়ন ও সংশোধনকারীবৃন্দ, ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়ায় জড়িত উভয় পক্ষের আইনজীবী, বিচারকমণ্ডলী-– কেউই নিরেট মূর্খ নন বা বিশ্বের আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে অজ্ঞ নন। এই আইনি প্রক্রিয়ায় সন্দিহান হলে আসামিদের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়াই হত না। এটা সাজানো নাটক হলে এতদিন ধরে কি সত্যি এই বিচারকাজ চালানো যেত?

আমি অন্যত্র আগেও বলেছি, নিজে ট্রাইব্যুনালে আমার বাবার হত্যাসহ অন্যান্য বুদ্ধিজীবী হত্যার আসামি চৌধুরী মুঈনউদ্দীনের বিচারে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আমার দৃঢ়বিশ্বাস হয়েছে যে, এটা কোনো সাজানো নাটক নয়। তবে এই বিচারপ্রক্রিয়া একেবারে ত্রুটিমুক্ত নয়, সেটাও আমি অন্যত্র বলেছি এবং এখনও বলছি।

সম্প্রতি দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মতিউর রহমান নিজামীর বিচারপ্রক্রিয়াও নিয়মমাফিক চলেছে বলেই মনে করি, যদিও হয়তো সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। শুধু সংখ্যা থেকেই একটা বিশ্লেষণ দিই। নিজামীর বিরুদ্ধে মামলায় আনা হয়েছিল ১৬টি অভিযোগ, তার মধ্যে ৮টি অর্থাৎ অর্ধেক প্রমাণিত। ৪টির জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে, আর বাকি ৪টির জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে দেখে প্রশ্ন হল, যে ৮টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি, সেগুলোর সঙ্গে কি নিজামীর যোগ ছিল না? বুঝলাম, আইনসম্মতভাবে দাখিল করা প্রমাণে মাননীয় বিচারকমণ্ডলী সন্তুষ্ট হননি।

কিন্তু তাহলে প্রশ্ন হল, যথেষ্ট দৃঢ় প্রমাণ দাখিল করা গেল না কেন যাতে ১৬টি অভিযোগের বেশিরভাগ প্রমাণিত হয়? একজন শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী যার কৃতকর্মের নথিপত্র ও সাক্ষী অনেক সহজে পাবার কথা, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগই যদি নড়বড়ে হয়, তাহলে সে সময়ের পাতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ যদি শুরু হয়, তখন তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ, সাক্ষ্য-প্রমাণ আরও দুর্বল হতে পারে, এই ধারণা অমূলক হবে না। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলের দ্রুত সচেতন দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।

জনমনে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে পক্ষে বিপক্ষে স্পষ্ট দুটো ভাগ আছে, কিন্তু সংশয় কোনো পক্ষেই নেই। ছোটবেলা থেকে গোলাম আযম আর নিজামীর নাম শুনে আসছি। বড় হবার পর তাদের জঘন্য অপকর্মের অনেক ঘটনা আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য পড়ে আর জেনে আসছি। সেগুলোকে কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই শহীদ পরিবার, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারসহ অধিকাংশ বাংলাদেশি সত্য বলে জেনে এসেছি। না হলে কয়েক বছর আগে নিজামীর মন্ত্রিত্ব-প্রাপ্তিতে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেছিল কেন? কেন অনেকেই বলেছে যে, একজন রাজাকার রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে থাকার চেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে জাতির জন্য?

দেশের এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের আইনে মৃত্যুদণ্ড যখন সর্বোচ্চ শাস্তি– জামায়াত-এ-ইসলামীর ওই সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সেনা আর রাজাকার, আল-বদর বাহিনীর পালের গোদা হিসেবে নিজামীর ওপরেই যুদ্ধাপরাধের একটা বড় দায় বর্তায়। এইজন্য নিজামীর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তি, বলা যেতে পারে, বাংলাদেশে চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে অর্থবহ রায়। বাংলাদেশের সকল যুদ্ধাপরাধীর নেতা গোলাম আযমের বিচারের রায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য বলা হলেও 'মানবিক' কারণে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান না করাতে রায়টি অর্থবহ মনে হয়নি।

সে ক্ষেত্রে মতিউর রহমান নিজামী ওরফে 'মতিয়া দালাল'এর বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পরিকল্পনা করা, উদ্বুদ্ধ করা, উস্কানি দেওয়া, নির্দেশ দেওয়া-– কোনোটাই বাদ ছিল না। তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এক নতুন অধ্যায় সূচনা হল বলা যেতে পারে।

আসামিপক্ষের আপিলের পর এই রায়ের চূড়ান্ত পরিণতি কোনদিকে যায় তার উপর নির্ভর করবে ভবিষ্যতে যদি এই বিচারপ্রক্রিয়া চলতে থাকে, তবে আরও চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের পরিণতি কোন দিকে যেতে পারে।

আসিফ মুনীর: শহীদ-সন্তান; সহ-সভাপতি, প্রজন্ম '৭১।