নিজামীর রায়: সন্তুষ্টির সঙ্গে উদ্বেগ

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী
Published : 29 Oct 2014, 07:30 PM
Updated : 29 Oct 2014, 07:30 PM

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের পুরো পরিবারের জন্য একদিকে যেমন গর্বের, অন্যদিকে তেমনি অনেক কষ্টের। আমি আমার স্বামীকে হারিয়েছি এই সময়ে, দেশকে ভালোবাসার মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে। আমার প্রয়াত স্বামী ডা. আলীম চৌধুরীসহ এদেশের অনেক বুদ্ধিজীবীকে মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল পাকবাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার ও আলবদররা। সেটা ছিল জাতির জন্য কালিমামাখা একটি অধ্যায়।

একাত্তরে চালানো পরিকল্পিত সব গণহত্যার জন্য ঘৃণ্য দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজটি চলছে। মুক্তিযুদ্ধকালে যার পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছিল, সেই মতিউর রহমান নিজামীকে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ফাঁসির রায় দিয়েছেন। তারই নির্দেশে আমার স্বামীকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তিন দিন পর তাঁর ক্ষতবিক্ষত লাশ মিলেছে রায়েরবাজার বধ্যভুমিতে। নিজের চোখে দেখেছি আমি, শনাক্ত করেছি তাঁকে। সেই নিজামীর ফাঁসির রায় আমাদের জন্য অত্যন্ত সন্তুষ্টির কারণ নিঃসন্দেহে।

আমরা তখন থাকতাম পুরানা পল্টনে। আমার স্বামী ডা. আলীম চৌধুরী ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই এ বাসায় এবং চেম্বারে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার সুযোগ করে দিতেন। একাত্তরের ২৫ মার্চ 'অপারেশন সার্চ লাইট' শুরু হওয়ার পর থেকে অনেক কবি, সাহিত্যিক, নেতা, কর্মীসহ মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছি। আবার তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেওয়ার কাজটিও করেছি আমরা।

এদেরই একজন ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তিনি আবার আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ২৫ মার্চ রাতে রাতে তিনি নিজের বাসা ছেড়ে আমাদের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবে এ বাসা তাঁর জন্য নিরাপদ ছিল না।। কারণ তাঁর আত্মীয়ের বাসা বলে তাঁকে খুঁজতে পাকবাহিনী এখানে চলে আসতে পারে, এমন আশংকা তো ছিলই। তাই তাঁকে ছদ্মবেশ ধারণ করিয়ে আমার ভাই রিকশায় করে হোসেনী দালানে পৌঁছে দিলেন। ওখান থেকে পরে তিনি ভারতে চলে গিয়েছিলেন।

নানা কারণে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই অবরুদ্ধ ঢাকায় অবস্থান করে আমরা গোপনে বিভিন্ন জায়গা থেকে চাঁদা তুলে, অর্থ সংগ্রহ করে তা মুক্তিযুদ্ধের কাজে লাগাতাম। চাল-ডাল, ওষুধ সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছি। শীতের শুরুতে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্য আমি নিজ হাতে যেসব শীতবস্ত্র বুনতাম সেসব মুক্তিযোদ্ধারা এসে নিয়ে যেতেন।

যেভাবেই হোক, মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পরিবারের এসব সমর্থনের খবর পাকবাহিনী এবং তাদের দোসরদের কাছে পৌঁছেছে নিশ্চয়ই। তাই জুলাইয়ের একদিন আমাদের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিলেন মওলানা মান্নান, ইনকিলাবের সেই মান্নান।

এরপর এল ১৫ ডিসেম্বর। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আলবদরদের একটি গাড়ি এসে থামল আমাদের বাড়ির সামনে। তখন ঢাকা শহরে বোম্বিং হচ্ছিল। আমার স্বামীসহ ঘরের সবাই বারান্দায় বসে সে দৃশ্য দেখছিলাম। এর অনেকক্ষণ পর আমার বাড়ির উত্তর দিকের দরজায় প্রচণ্ড ধাক্কার শব্দ শুনতে পেলাম। জানালা দিয়ে দেখি তিনজন লোক অস্ত্র হাতে নিয়ে আমাদের দরজায় লাথি মারছে। এ সময় আমি ও আমার স্বামী ভয় পেয়ে গেলাম। আলীম তখন নিচে মান্নানের বাসার দরজায় আঘাত করতে লাগলেন। এত ধাক্কাধাক্কির পরও সে দরজা খুললই না। ভেতর থেকে বলে দিল, 'আপনি যান, কোনো ভয় নেই।'

এরপর আমার স্বামী উপর তলায় উঠছিলেন। এ সময় আল-বদর বাহিনীর একজন বলল, 'হ্যান্ডস আপ'। আমার স্বামী তাদের বলেন, 'কী ব্যাপার?' তখন তারা বলল,''আমাদের সঙ্গে চলেন। গেলেই জানতে পারবেন। আল-বদর বাহিনীর প্রধান নিজামীর নির্দেশে আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।''

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে আমার স্বামীর লাশ পাওয়া যায়। সেখানে আমার স্বামীর সঙ্গে ডা. ফজলে রাব্বী, সাংবাদিক সেলিনা পারভীনসহ বুদ্ধিজীবীদের লাশ পড়েছিল।

একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়নসহ মানবতাবিরোধী নানা অপরাধের অভিযোগে আটক জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছি আমি। আজ তাই তার বিচারের কাঙ্ক্ষিত রায় পেয়ে আমি আনন্দিত। সরকারকে অনুরোধ করব যেন যথাসময়ে রায় কার্যকর করা হয়।

এখানে সামান্য একটু শঙ্কার কাঁটা রয়ে গেছে। যেহেতু আইনে আসামিপক্ষের আপিল করার সুযোগ রয়েছে এবং ওরা বলছেও যে ওরা আপিল করবে, সেটা উদ্বেগের ব্যাপার বটে। আমি ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের এই দুঃসাধ্য কাজ সম্পন্ন করার জন্য ধন্যবাদ জানাই। পাশাপাশি, তাঁদের অনুরোধ করব যেন ওই ঘৃণ্য অপরাধীদের বেলায় কোনো রকম ক্ষমা বা করুণার ব্যাপার না থাকে। ওরা তো ন্যূনতম মানবিকতা দেখায়নি তাদের প্রতি। তাই ওদের সর্বোচ্চ সাজা যেন বহাল রাখা হয়।

আরেক ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদীর বিচারের আপিলের রায় হয়েছে গত সেপ্টেম্বর মাসে। আগের রায়ে তার ফাঁসির দণ্ড হলেও আপিলের রায়ে তাকে দেওয়া হয়েছে আমৃত্যু কারাদণ্ড। এটি আমাদের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। তার মতো অপরাধীর জন্য প্রাপ্য ছিল সর্বোচ্চ শাস্তি। কারণ এ শাস্তির কিছু সমস্যার দিক রয়েছে। আজ যুদ্ধাপরাধের বিচার করছেন যে সরকার সেটি ক্ষমতায় না থাকলেই সাঈদী মুক্তি পেয়ে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে বেরিয়ে এসে এরা একাত্তরের মতোই হিংস্র হয়ে উঠতে পারে আবার।

সেই বাস্তবতা সামনে রেখেই নিজামীর ব্যাপারে একই আশঙ্কা ঘুরেফিরে আসছে। এমনিতেই আমরা শহীদ ও মুক্তিযুদ্ধে স্বজনহারাদের পরিবারগুলো কয়েক দশক ধরে যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের আস্ফালন সয়ে গেছি। এই মতিউর রহমান নিজামী একসময় মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। দেখেছি জাতীয় পতাকাবাহী গাড়িতে চড়ছেন এক পতাকাবিরোধী অপরাধী, এদেশকে স্বাধীন দেখতে যে চায়নি। সেটা দেখা যেমন কষ্টের ছিল, তেমন কষ্টের হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান নেতা গোলাম আযমের লাশ নিয়ে এমন শোকোৎসব যেটা মাত্র ক'দিন আগেই হয়ে গেল।

এসব সয়ে আমরা আজ এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সামনে। অপরাধীরা দণ্ড পাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার করার ব্যাপারে সরকার তার কমিটমেন্ট রেখেছেন। তাই নিজামীর মতো অপরাধীদের আপিলের বেলায় এই রায় যেন বহাল থাকে সেটাই আমাদের চাওয়া থাকল।


শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী:
লেখক, শিক্ষাবিদ।