এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার জবানবন্দি

আকতার হোসেন
Published : 28 Oct 2014, 11:07 AM
Updated : 28 Oct 2014, 11:07 AM

স্বাধীনতার ডাকের গুরুত্বপূর্ণ দুটি অংশ আজ বারবার মনে পড়ছে। 'তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে'। 'তোমাদের কাছে আমার নির্দেশ রইল'। এই 'তোমাদের'এর সংজ্ঞায় ধর্ম বর্ণ, লিঙ্গ, উচ্চতা, যোগ্যতা, বয়স সব কিছু মিলেমিশে আছে। খুব স্পষ্ট একটি বোধের উপর এখন ধূম্রছায়া এসে পড়তে শুরু করেছে।

কেউ কি বলতে পারবেন যে, ১৯৭১ সালে কোনো কিশোর শুধুমাত্র বয়সের কারণে যুদ্ধে যাব কি যাব না এমন দ্বন্দ্বে ভুগেছিল? মোটেই নয়। যুদ্ধের ডাক সবার জন্য প্রযোজ্য ছিল। যে সুযোগ পেয়েছে সে-ই তার পবিত্র দায়িত্ব পালন করেছে। সত্য-অসত্য বা প্রমাণাদি যাচাই বাছাই করে সনদ দেওয়ার অধিকার কর্তৃপক্ষের অবশ্যই আছে, কিন্তু বয়সের বেরিকেড বৈষম্যের সামিল বলে মনে করি।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে আমার মা ঠিক করলেন, একমাত্র পুত্রসন্তানকে তিনি যুদ্ধে পাঠাবেন। মায়ের সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল দ্বিগুণ। পিতা-পুত্র এক নৌকাতে চড়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। আব্বা ছিলেন একটি ট্রানজিট ক্যাম্পের ইন-চার্জ; আর আমি ছিলাম অন্য ক্যাম্পের খুদে মুক্তিযোদ্ধা।

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এখন বয়সের যে ভেদাভেদ দাঁড় করানো হল, তেতাল্লিশ বছর আগে কোনো বালক সেটা মেনে নিত কিনা সন্দেহ। 'জামুকা' অর্থাৎ জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল, এবং মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের মতে, অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়, সরকার-প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে চায়; তাই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে ১৯৭১ সালে যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে ছিল তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হবে না।

বয়সের এই মাপকাঠির কারণে এখন থেকে আমি আর মুক্তিযোদ্ধা নই! সার্টিফিকেট অনুসারে ১৯৭১ সালে আমার বয়স যদি ১৫ হত, তাহলেও অসুবিধা হবার কথা ছিল না। কিন্তু ১৪ বছরের ছিলাম বলে, তখন যে ভূমিকাই রেখে থাকি না কেন, নিজেকে 'মুক্তিযোদ্ধা' বলার অধিকার নেই আমার!

গোলটেবিলের সিদ্ধান্ত যেমন করে নিতে হয়, মন্ত্রী এবং তাঁর দলের লোকেরা সেই 'গোল' সিদ্ধান্তটাই নিয়েছেন। 'জামুকা'র গোলটেবিলের চারপাশের লোকজনের কেউ হয়তো ১৯৭১ সালে ১৫ বছরের নিচের বয়সী ছিলেন না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ১৫ বছরের উপরের লোকেরাই শুধু যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। এ রকম একটা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার আগে বিভিন্ন লোকের মতামত নেওয়া উচিত ছিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা যাচাই-বাছাই না করে এভাবে বয়সের কোপ মারা ঠিক হয়নি। পরবর্তীতে কি তাহলে এমনও ঘোষণা আসতে পারে যে, একাত্তরে নির্যাতিতা শিশু-কিশোরীদের মধ্যে যাঁদের বয়স ১৫ বছরের নিচে ছিল, তাঁদের কাউকে 'বীরাঙ্গনা' বলা যাবে না!

নিজের জন্য দুঃখ নেই, শুধু মা-বাবার কথা ভাবছি। জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, আত্মারা কি কষ্ট পায়? আমি সাতাশ বছর ধরে দেশের বাইরে, মুক্তিযোদ্ধার গেজেট বা সনদ দিয়ে আমি কী করব? কিন্তু অগণিত কিশোর মুক্তিযোদ্ধার অবদান অস্বীকার করা এবং বরাদ্দকৃত সুযোগ-সুবিধা থেকে কাঙ্ক্ষিত কাউকে বঞ্চিত করা সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মেনে নিতে পারছি না। নিজ হাতে যে নারী তাঁর স্বামী এবং সন্তানকে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শেখ হাবিবের হাতে (মোল্লাহাট, খুলনা– বর্তমানে চিতলমারি, বাগেরহাট) তুলে দিয়ে বলেছিলেন,`উপরে আল্লা আর নিচে আপনি, আপনার হাতে এদের তুলে দিলাম'– তাঁর আত্মা কি এখন কষ্ট পাচ্ছে না!

মুক্তিযোদ্ধা শেখ হাবিব ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে তিনি ভারতে গিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। এক সময় খুলনার মোল্লাহাটের কিছু অঞ্চলের দায়িত্ব নিয়ে দেশে ঢুকে পড়েন। আমাদের প্রথম ট্রেনিং তাঁরই ক্যাম্পে। তাঁর দলের সঙ্গে বিভিন্ন অপারেশন করেছি, পথে-ঘাটে অস্ত্র হাতে ঘুরে মানুষের মনোবল বৃদ্ধি করেছি।

শেখ হাবিবের দলে ছিল আমার চেয়েও দু'বছরের ছোট এক গ্রাম্য বালক। তার নাম মনে করতে পারছি না বলে দুঃখিত। সেই বালকের সাহস ছিল অন্য অনেকের চেয়ে অনেক বেশি। মচন্দপুর খালপাড়ের অপারেশনে বন্দুক ঠেকিয়ে এক রাজাকারের বুকে গুলি করেছিল সে।

কমান্ডার হাবিবের গোলা-বারুদ শেষ হবার লক্ষণ দেখা দিতেই তিনি একটি দল ভারতে পাঠান অস্ত্রের চালান আনতে। নওশের নামের একজন মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্বে ভারতে যাওয়া সেই দলের সঙ্গে আমি, আমার পিতা, বড়বড়িয়া ইউনিয়নের মন্নু ডাক্তার, পাটগাতির সিরাজুল ইসলাম (সিরু কাকা)সহ প্রায় পনের-ষোল জনের একটি দল ভারতে যাই। ওখানে পৌঁছানোর পর ধলতিথা কম্পে গিয়ে আমি এবং সিরু কাকা নাম রেজিস্ট্রেশন করালাম। সেখানে দেখা হল 'ইপিআর'এর জোয়ান (শ্রীরামকান্দির এবং আব্বার দূর সম্পর্কের ভাগনে) মোমেন ভাইয়ের সঙ্গে।

এই ধলতিথা ক্যাম্পে আরেক দফা ট্রেনিং নিতে হল। একদিন লাইন ধরে ভারতীয় মুদ্রায় এক টাকা পঁচিশ নয়া পয়সা বেতন আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। ক্যাম্পের দাপ্তরিক কাজে নিয়োজিত সাতক্ষীরা কলেজের বাংলার অধ্যাপকের নিকট (দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, হালকা পাতলা গড়নের সেই অধ্যাপকের নামও এখন আর মনে করতে পারছি না। সম্ভবত সকলে তাকে 'হক স্যার' বলে ডাকত। হয়তো শামসুল হক ছিল তাঁর নাম) সাক্ষর দিয়ে বেতন নিয়েছিলাম। মুজিবনগর সরকার বেতন দিয়েছে, অতএব দলিলে নিশ্চয়ই নামও থাকবে।

খুলনা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য বারী সাহেব ছিলেন ধলতিথা ক্যাম্পের ইন-চার্জ। একদিন তিনি আমাকে আর কিছু ছেলেকে জিপে বসিয়ে পাঠিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন সুলতানের বাকুণ্ডিয়া ক্যাম্পে। এই সুলতান সাহেব পরবর্তীতে জাসদের 'সুলতান সাহেব' নামে পরিচিত হন। যদিও তাঁর বড় পরিচয়, তিনি ছিলেন নৌবাহিনীর সদস্য এবং আগরতলা মামলার একজন আসামি। বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে তিনি কিছু যুবক মুক্তিযোদ্ধাকে যোগাড় করেছিলেন একটি তথ্যচিত্রের শুটিংএর জন্য। বাবুল চৌধুরী ছিলেন সেই ফিল্ম ক্রুর প্রধান। ভদ্রলোক দেখতে একদম জহির রায়হানের মতো। ১৯৭২ সালের পর বলাকা সিনেমা হলে একটা সিনেমা দেখতে গিয়ে সেই ডকুমেন্টারি দেখে খুব গর্ব বোধ করেছিলাম।

মুক্তিযুদ্ধের চড়াই-উতরাইয়ের এই লগ্নে বাকুণ্ডিয়া ক্যাম্প ইন-চার্জ ক্যাপ্টেন সুলতান সাহেব আমাকে রেখে দিলেন তাঁর ক্যাম্পে। আমার সঙ্গে থেকে গেল অন্য ক্যাম্প থেকে আসা বরিশালের আবদুর রব সেরনিয়াবতের ভ্রাতুষ্পুত্র সিরাজ। বাকুণ্ডিয়া ক্যাম্পে আমার সবচাইতে কাছের বন্ধু ছিল সিরাজ, যাকে ক্যাম্পজীবনের আগে কখনও দেখিনি এবং ক্যাম্পজীবন শেষেও নয়। বরিশালের এক মুক্তিযোদ্ধা সালাম সাহেব থাকেন টরেন্টোতে। তাঁর কাছে শুনলাম কয়েক মাস আগে নাকি সিরাজ মারা গেছে।

সুলতান সাহেবের পরিকল্পনামাফিক আমাদের মাঝেমধ্যে সীমান্তে গিয়ে অ্যামবুশ করতে হত। আবার কখনও কখনও পাহারা দিতে হত ক্যাম্প। বয়সের কারণে আমাকে অনেক সময় হালকা কাজ করতে দিতেন নায়েক আবদুর রশিদ। বেশ কয়েকদিন অস্ত্রাগারও পাহারা দিয়েছিলাম।

জমিদার রাধা কিশোর ঘোষ ছিলেন ১৯৭১ সালে পশ্চিম বাংলার বিধান সভার সদস্য। তাঁর জমিদারিতেই গড়ে উঠেছিল বাকুণ্ডিয়া ক্যাম্প। জমিদারদের বাড়িঘর সেই প্রথম কাছ থেকে দেখা। পুরনো দোতলা বাড়ি। তিন চারটে পুকুর। বিশাল এলাকা। জমিদার বাড়ির মন্দিরের পাশেই ছিল আমাদের তাঁবু খাটানো। যেমন উঁচু ছিল মন্দিরটি, তেমনি ছিল মূর্তির আকার। আমি বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে অবাক বিস্ময়ে মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সেই প্রথম আমার মন্দিরে প্রবেশ। মন্দিরের কোনো একটা বন্ধ দরজার ভেতরে থাকত আমাদের অস্ত্র। একটা নদী ছিল কিছুটা দূরে, যার নামও মনে নেই। সেই নদী পাড়ি দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশ ঢুকে গোলাগুলি ছুঁড়তে হত। এসব করা হত পাকিস্তানি সৈন্যদের আতঙ্কের মধ্যে রাখার জন্য।

আমি যে তাঁবুতে থাকতাম সেখানে নাকি শেখ জামাল আর বঙ্গবন্ধু পরিবারের শেখ মারুফ থাকতেন। আমি যেদিন বাকুণ্ডিয়া ক্যাম্পে গেলাম, সেদিনই সকালে তারা চলে যান সেই ক্যাম্প থেকে। তবে আমার উপস্থিতিতে কয়েক সপ্তাহ পর একই তাঁবুতে এসে উঠলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে (ইনটু বা শাফায়েত, পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিগ্রেডিয়ার এবং শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বকালের পিএপিএম অর্থাৎ 'মিলিটারি সেক্রেটারি টু প্রাইম মিনিস্টার' হয়েছিলেন), অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের দুই ভাগ্নে (রুনু এবং মিনু ভাই, পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর হয়েছিলেন দুজনেই), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের ছাত্র এমদাদ ভাই, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের ভাগ্নে ভুলু, নারায়ণগঞ্জের জোহা সাহেবের ছেলে নাসিম ওসমান। এরা সকলে দুই সপ্তাহের ট্রেনিং নিয়ে অন্যত্র চলে যান। আমি ছোট ছিলাম বলে তাদের সকলেই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। পরবর্তীতে তাঁরা সবাই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন। অথচ সেই স্বীকৃতি থেকে এখন আমি বঞ্চিত!

যুদ্ধের শেষের দিকে নভেম্বর মাসে ক্যাপ্টেন সুলতান ঠিক করলেন আমাদের সকলকে বাংলাদেশের ভেতরে পাঠিয়ে দেবেন। সময়টা খুব থমথমে ছিল। যে কোনো দিন ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের মধ্যে ত্রিমুখী যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। সীমান্তরেখা দিয়ে তখন বেশ উত্তেজনা। গেরিলা যুদ্ধ আর ত্রিদেশীয় যুদ্ধের মধ্যে একটা পার্থক্য অবশ্যই রয়েছে। তাই আমাদের একটা উন্নততর ছোট আর্মসের ট্রেনিংএর ব্যবস্থাও করলেন তিনি যেটা শেষ হতে হতে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পার হয়ে গেল। মেজর জলিলের সাক্ষর করা একটা সার্টিফিকেট এখনও আমার কাছে সযত্নে রাখা আছে।

আজকের এই লেখায় আরও একজনের কথা না বললেই নয়। তিনি ছিলেন খুলনার মোল্লাহাট থেকে নির্বাচিত এমএনএ (মেম্বার অব ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি কিংবা এমএলএ-ও হতে পারে) খায়ের মাস্টার। স্বাধীনতার অনেক পর শুনতে পেলাম তিনি খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আব্বা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি আব্বাকে বললেন, 'বাবলুকে একটু পাঠিয়ে দেবেন, ওকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে'।

পরের দিন আব্বার সঙ্গেই তাঁকে দেখতে গেলাম। বিছানা থেকে উঠে তাঁর সে কী দোয়া-দরুদ পড়া। এক একটা দোয়া পড়েন আর আমার গায়ে ফুঁ দেন, যেন আমি হাজার বছর বেঁচে থাকি। তাঁর বিস্ময়, সেই অল্প বয়সে আমি কী করে মা'কে ছেড়ে এসএলআর, থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতাম। তা-ও সেই ছেলে যে নাকি কখনও সাপ জোঁক কিছুই দেখেনি!

১৯৭১ সালে একবার অসুস্থ হয়ে আমাকে কোলকাতা যেতে হয়েছিল। তখন ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে অবস্থিত বাংলাদেশ সরকারের প্রধান দপ্তরের দোতলার এক রুমে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তখনও তিনি এই বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।

আজও মনে আছে, সেদিন সেই রুমে অনেকের মধ্যে গোপালগঞ্জের ফরিদ ডাক্তারের ছেলে কামরুল হাসানও ছিলেন। যিনি বাংলাদেশ অ্যামবেসি, নিউ ইয়র্ক-এ কর্মকর্তা থাকাকালীন কয়েক বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন। সেদিন হাসপাতাল থেকে চলে আসার সময় তিনি আমাকে দাঁড় করিয়ে বালিশের নিচে হাত দিলেন। তারপর বের করলেন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সদস্য প্যাড এবং সিল (দেশ স্বাধীন হবার পরও তিনি এমপি হয়েছিলেন)। নিজ হাতে ইংরেজিতে লিখলেন:

This is to certify that S. M. Aktar Hossain @ Bablu s/o Janab Sakawat Hossain of Vill and PO Rahmatpur, Upazilla Mollahat DT Bagerhat, is personally known to me. At preset, he lives… He is a freedom fighter. He took military training during the liberation movement in the year 1971. Dated 12-7-86.

তারপর সেই কাগজটি আমার হাতে দিয়ে বললেন, 'কত লোক কত কিছু চেয়ে নিল, তোমার বাবা কখনও কিছু চাইল না। তুমিও তো কোনোদিন এসব নিয়ে ভাববে না। তাই নিজ থেকে আমি সাক্ষী দিয়ে গেলাম, জানি না কোনো দিন কোনো কাজে লাগবে কিনা'।

এর কিছুদিন পর আমি কানাডায় চলে আসি। একদিন ডাকযোগে বাংলাদেশ থেকে চিঠিতে আম্মা একটা কাগজের কাটিং পাঠিয়ে দিলেন। 'দৈনিক ইত্তেফাক'এ প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকায় আমার নাম ছাপা হয়েছে। কমান্ডার শেখ হাবিবের নামের সঙ্গেই লেখা আকতার হোসেন, মোল্লাহাট। এখানে বলে রাখা ভালো যে, আমি জন্ম নিয়েছি ঢাকার পাতলা খান লেনে। জন্ম থেকেই ঢাকায় বড় হয়েছি। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের এক পর্যায়ে গ্রামের বাড়িতে (রহমাতপুর, মোল্লাহাট, খুলনা) আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকেই ভারতে চলে যাওয়া।

অস্ত্র যুদ্ধ শেষ হয়েছে ১৯৭১ সালে অথচ সেই থেকে আজও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বাকযুদ্ধ করে যাচ্ছি। আজ বয়সের কারণে আমি 'অ-মুক্তিযোদ্ধা' হয়ে গেলাম। যেদিন সকালের সূর্য আর দেখা হবে না সেদিনের জন্য তাই রেখে গেলাম আমার এই সত্য জবানবন্দি। এর সঙ্গে রয়ে গেল গত বিশ পঁচিশ বছর যাবত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আমার বিভিন্ন লেখা। সেগুলোও সাক্ষ্য দেবে।

যুদ্ধের পুরো সময়টা আমার মা একবারও কাঁদেননি। আমি এক ক্যাম্পে ছিলাম, আর আব্বা ছিলেন অন্য ক্যাম্পের ইন-চার্জ (শাকচুঁড়া ক্যাম্প, বসিরহাট, চব্বিশ পরগণা) সেই ক্যাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন খায়ের মাস্টার। ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে আমরা যখন একত্রে ফিরে এলাম, ঠিক সেই দিনই আম্মা প্রথম কেঁদেছিলেন। বালিশে মুখ লুকিয়ে সে কী কান্না! সবাই বলল, 'এখন কাঁদছেন কেন। যুদ্ধ তো শেষ। আর ভয় কী?'

শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলেছিলেন, 'সবাই শুধু বলে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, এখন ঘরে ফেরার পালা। আমি সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতাম। সবাই ফিরে আসবে আমার বাবলু যদি ফিরে না আসে'।

আমার মায়ের খুশির কান্না একসময় থেমে গিয়েছিল বটে, তবে আজ যদি তাঁর আত্মা আবার কেঁদে ওঠে, সেটার দায়ভার কে নেবে? তিনি যদি স্বপ্নে এসে জিজ্ঞেস করেন এসব কী হচ্ছে।

আমি কি তখন তাকে জনাব খায়ের মাস্টারের চিঠিটি পড়ে শোনাব?– দিজ ইজ টু সার্টিফাই দ্যাট এস এম আকতার হোসেন…

ওহ হ্যাঁ, ওনার পুরো নাম এমএ খায়ের। কিন্তু সকলে তাঁকে খায়ের মাস্টার বলেই ডাকত। কেননা তিনি আমার পিতাসহ অনেকের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত ছাত্রের নাম ছিল শেখ মুজিবুর রহমান, গ্রাম টুঙ্গিপাড়া।