একটি উত্তেজনা ও অতিআবেগের পোস্টমর্টেম

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 23 Oct 2014, 04:59 AM
Updated : 23 Oct 2014, 04:59 AM

ভাবতে অবাক লাগে আমাদের দেশে সালাহউদ্দীন আহমেদের মতো মানুষ জন্মেছিলেন। ভাটি বাংলার নাড়িতে কত যে খ্যাতিমান মানুষের প্রাণ বাঁধা সে কথা আজ গল্পের মতো মনে হয়। এই মানুষটি টিভিতে এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন নামাজের পর তিনি কবিতার পংক্তি পড়ে দোয়া করতেন। কৈশোরে তিনি একদিন তাঁর মাকে প্রশ্ন করেছিলেন সে প্রার্থনা সফল বা কবুল হতে পারে কিনা। মা কয়েকদিন সময় নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন কী সে কবিতা। রবীন্দ্রনাথের 'ভক্তি' পর্যায়ের কবিতা শোনার পর মা সরল মনে বলেছিলেন, এ প্রার্থনা খোদার দরবারে না পৌঁছানোর কারণ নেই!

এমন দেশের মানুষ আজ কত তুচ্ছ আর ছোট ছোট বিষয়ে বিবদমান। আগে আমরা যে কোনো মৃত্যুতে শোকাহত হতাম, ভেদাভেদ ভুলে আত্মার শান্তি ও সন্তুষ্টি কামনায় একত্রিত হতাম। আমাদের সে শক্তি ও সমবেত প্রার্থনায় ঈশ্বরের টনক নড়ত কিনা জানি না, সমাজ এগুত। সমাজের মানুষ নিজেদের ভেতর ভালোবাসার ঘর বেঁধে জীবন পাড়ি দেবার শক্তি পেত। সে কারণে পাকিস্তানিদের মতো দানবেরাও আমাদের সঙ্গে লড়াই করে জিততে পারেনি।

সেই ঐক্য আজ কথার কথা, সে ভালোবাসা অস্তমিত। বদলে আমরা এখন উগ্র আর বিধ্বংসী জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছি। এর কারণ ও সমাধান বের না করলে অচিরেই আমাদের পরিচয় বদলে আমরা হয়ে উঠব জেদী ও আত্মবিনাশী এক সহিংস জাতির প্রতীক। যা কারও জন্যে মঙ্গলের হবে না।

গোড়াতেই বলে রাখি, মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাস আমাদের সুবর্ণ সম্পদ। একে অবিতর্কিত রাখা ব্যতীত আমাদের কোনো পথ খোলা নেই। কিন্তু এর ধারক আসলে কারা? যারা মনে করেন আওয়ামী লীগই এর ট্রেজারার বা ধারক তাদের কাছে প্রশ্ন রাখি, মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী, এ কে খন্দকার বা আইনমন্ত্রী আনিসুল হকরা কোন দলের মানুষ ছিলেন বা আছেন? জিয়ার কথাও যদি বলি, তিনিও বাকশালে যোগ দেওয়া সেনাপতি। সবাই কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী ঘরানার ভেতরে থেকে তারপর যার যার ভূমিকায় বিচ্ছিন্ন বা অন্য পথের পথিক। ফলে আওয়ামী লীগ কি এই দায় এড়াতে পারবে?

রাষ্ট্র চালানো আর ইতিহাসের পাহারা দেওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি বিষয়। প্রথমটিতে সফল বা চালু ভূমিকা রাখলেও পরেরটিতে আওয়ামী লীগ ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার ফাঁক গলে গড়ে উঠেছে বিপরীতমুখী শক্তি ও মিডিয়া-বলয়। আজ দেশের যে কোনো দিকে তাকালেই এর সত্যতা চোখে পড়বে। স্বাধীনতাবিরোধী নামে পরিচিত সিলড বা মার্কা-মারা মিডিয়ার কথা কেউ বিশ্বাস করে না, পড়ে না, দেখেও না। 'ইসলামী টিভি' বা 'দিগন্ত টিভি' বন্ধ হবার পর তা নিয়ে তেমন কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে ওঠেনি। 'আমার দেশ' , 'দিনকাল' , 'সংগ্রাম' এর অবস্থাও তাই। থাকলেও যা না থাকলেও তা।

তবু ফরহাদ মজহার বা কাদের সিদ্দিকীদের লেখা বা মতামত প্রকাশের জায়গার অভাব হয়নি। একদা বাম আদর্শের ধারক কমিউনিস্ট পার্টির কাগজ 'একতা' এর সম্পাদক মতিউর রহমান আর যাই হোন, স্বাধীনতাবিরোধী কেউ নন। তাঁর কাগজের বিরুদ্ধে গণজাগরণ মঞ্চ বা আওয়ামী লীগের যে রাগ তাতে কি এটাই প্রমাণ হয় না যে, আমাদের মেধা ও মগজের অনেক চেনা জায়গাই এখন আর আগের অবস্থানে নেই? এই বদলে যাওয়ার ব্যাপারটা যদি সময়ের হাত ধরেই হয়ে থাকে তাহলেও এর একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সেটা না করে ব্যক্তিবিরোধিতা আর কথায় কথায় উগ্রতার পরিচয় দেওয়ার ভেতর সমাধান নেই।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের মহত্ত্ব এতটা দুর্বল বা হীনবল নয় যে, গুটিকয় মানুষের কথার তোড়ে তা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। ভালো করে ভেবে দেখুন, মিডিয়ার সংখ্যা যেমন বেড়েছে গ্রহণ-বর্জনের জায়গাও ততটাই ব্যাপক আর গর্জনমুখী হয়ে ঊঠেছে। এর একটা কারণ হতে পারে, মতামত দেবার স্বাধীনতা ও পথ খুলে যাওয়া। কিন্তু কে বলছে কারা বলছে বা কী বলছে সেটা ছাপিয়ে যখন সবকিছু নিজেদের মতো করে দেখার চেষ্টা আর পকেটে ঢোকানোর প্রয়াস দেখি তখন প্রশ্ন জাগে আমরা কি আসলে গণতন্ত্র বুঝি? না মানি?

জানি অনেকেই গণতন্ত্রের মানে কী বা এর নানাবিধ সংজ্ঞা নিয়ে কথা তুলবেন। আমি এটাও বলছি না, টকশোওয়ালা বা মিডিয়া তার ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করছে। অনেকটা একদিকে উস্কানি দেওয়ার প্রবণতা আরেক দিকে 'মার মার কাট কাট' করে দেশ গরম করার এক উগ্র অভিপ্রায়। কোনটা মানছি আমরা? লাখ লাখ মানুষের রক্তে অর্জিত দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি ঘোষণার পর দাঙ্গা হয়নি? পুলিশের মাথা ফাটেনি? হিন্দুদের বাড়িঘর, আওয়ামী লীগ ও প্রগতিশীল মুসলমানের কপাল পোড়েনি? রাজাকারদের বংশধররাও কি ছাড় পেয়েছে?

রাষ্ট্র কি পেরেছে নিরব থাকতে? একবার তাকে শাহবাগ পাহারা দিতে হয়েছে, শাপলা সামলাতে হয়েছে, এখন শুনি জামাতকেও নাকি আগলে রাখতে হচ্ছে। মানে এই দেশ বা সরকার চাইলেই এর দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারে না।

আমাদের রাজনীতি ভুলে যায়, উস্কে দিলে ভোট বা আবেগের জায়গাটা হয়তো প্রশ্রয় পায় কিন্তু শান্তি ও সংহতি তখন বেসামাল হয়ে উঠতে পারে। এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অন্যতম পুরোধা জিন্নাহ সাহেব দ্বিজাতি-তত্ত্বে পাকিস্তান কায়েম করার দিনই ঘোষণা দিয়েছিলেন: "আজ থেকে এই দেশে মুসলমান বা হিন্দু বলে কেউ নেই, আমরা সবাই পাকিস্তানি।"

ভেবে দেখুন, কত রক্ত আর মৃত্যুর ওপর দাঁড়িয়ে তাঁকে একথা বলতে হয়েছিল। অন্যদিকে গাঁধী তাঁর জীবনে ও ধর্মে আদর্শিক হিন্দু হবার পরও পাকিস্তানের পাওনা দেবার জন্য অনশন করেছিলেন।

এই যে রাজনীতি, এর ভেতর একদিকে যেমন নিজের আদর্শ বা চেতনাবোধ, অন্যদিকে সম্প্রীতি আর সহাবস্থানের কামনাই মূখ্য।

আমরা সে কথা ভুলে এখন মরিয়া হয়ে উঠছি। মনে হতে পারে, আমি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তামাশা করার মানুষদের দিকে ঝুঁকছি। মোটেই নয়। আমাদের বুঝতে হবে, মানুষ নয়, মূলত তার প্রবণতাই আমাদের টার্গেট। সে দৃষ্টিকোণে সমাজগর্ভে জন্ম নেওয়া প্রয়াত পিয়াস করিম বা যে কোনো কেউ আমাদের চোখে ঘৃণার হলেও আমরা তাদের ঠেকাতে পারিনি। কারণ পুরো সমাজটাই এখন নিয়ন্ত্রণহীন।

দেশ বা রাষ্ট্র একটি কাঠামো, একে মানুষ যেভাবে চলতে দেয় সেটি সেভাবেই বেড়ে ওঠে। সমাজের সর্বত্র হানহানি মারামারি দুর্নীতি আর ধর্মান্ধতা। উঠতে বসতে চলতে ফিরতে ধর্মের এমন অপব্যবহার আগে কখনও দেখা যায়নি। পদ্মাপাড়ের বাঙালির জীবন এখন বড় দোটানায়। সে ইহকালেরটা যেমন ভোগ করতে চায় তেমনি পরকালেরটাও মিস করতে রাজি নয়। এই দ্বন্দ্ব তার জীবনকে ফেলছে মহাবিপদে। আগের মতো বাঙালি হবার সাধনায় সে তার পরকাল নষ্ট করতে রাজি নয়।

এই যে প্রলোভন, একে এড়িয়ে চলার মতো বিদ্যা-বুদ্ধি আছে কজনার? ফলে মানুষের মনে তো নানা ধরনের সন্দেহ দানা বাঁধবেই। সে দিক কেউ মাথায় রাখে না। আওয়ামী লীগ নিজেই বলে, তারা ধর্মীয় সনদে দেশ চালায়। অথচ জামাতের গায়ে নাকি ধর্মান্ধতার গন্ধ। এই হিপোক্রেসির মূল্য দিতে হবে না?

আগেও মানুষ ধর্ম করত। আমাদের প্রয়াত নেতাদের ভেতর হাজী দানেশ, মোহাম্মদ তোয়াহা বা মনি সিংয়ের নাম মনে করি। তিনজন তিন মেরুর তিন বিশ্বাসের মানুষ কিন্তু এ নিয়ে মারামারি বা হানহানি দেখিনি। আজকাল একদিকে লেবাস, আরেকদিকে প্রগতি। একদিকে নিজেদের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধ, আরেক প্রান্তে পরকালের মেওয়া। ফলে এর ভেতর আওয়ামী, বিএনপি বা জামাতের ককটেল ঢুকে পড়বে এটাই তো স্বাভাবিক।

তাই আমাদের আত্মসমালোচনা আর আত্মশুদ্ধির বিকল্প দেখি না। আমরা কোনটা মানব? আওয়ামী লীগের সমর্থক বা মুক্তিযুদ্ধের দিকে থাকা মানুষের বিশ্বাস না আইনমন্ত্রীর বক্তব্য? কোনটা সত্য বলে ধরে নিব আমরা? জামাত-বিএনপির কথায় যাদের বিশ্বাস নেই তাদের ভিত নাড়াচ্ছে কে? কারা উস্কে দিচ্ছে বিরোধিতা?

বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম, প্রবীণ কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদও নিজেকে গাঁধীবাদী বলে হিংসার পথ খুলে দিতে চাইছেন। কীভাবে তিনি বলেন, এটা অবমাননার উপত্যকা? তাই যদি হবে তিনি কীভাবে খ্যাতি পেলেন এই দেশে? কাজের চেয়ে কথা বড় না হলে তাকে বা আমাদেরকে কি আসলে কেউ চিনত? নিজেকে প্রশ্ন করি না কেন আমরা?

সারাদিন রোদে পুড়ে জলে ভিজে ফসল-ফলানো চাষি বা গতর-খাটা শ্রমিকের নাম কেউ জানে না। জানে না মজুর আর পরিশ্রমী মেধাবী মানুষের পরিচয়। অথচ সমাজ আলো করা মানুষগুলো মূলত পরিশ্রমবিমুখ মুখ-দেখানো আর চেহারা-সর্বস্বতা ভর করেই দাপটের সঙ্গে বেঁচে আছেন। এই দেশে গাঁধীর সমর্থক বলে সিরাজ শিকদারের গলাকাটা বিপ্লব জায়েজ করা যায় না। এখানে হত্যা মৃত্যু আর গুমকেও নিজের মতো করে দেখা ফরজ।

আজ বলছি অবমাননার জন্য সরকার দায়ী; কাল আবার যোগাযোগ মন্ত্রীর সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখে বলব: না, উন্নয়ন কিন্তু ভালোই হচ্ছে। রাজনীতির ঠ্যালায় পবিত্র অপবিত্র সব কিছু যেখানে একাকার, সেখানেই আমরা আজ শুনি ফাঁসি চাই; কাল শুনি, না, এই আইনে শাস্তি তো দূরের কথা, কারও বিচার আসলে অসম্ভব।

এই দেশ কবে যে তার আদর্শ ও বিশ্বাস থেকে সরে গেছে নিজেই জানে না। এখন যা আছে তার নাম উত্তেজনা আর অশান্তি। এ দিয়ে আর যাই হোক জাতি হিসেবে এগুনো অসম্ভব।

সিডনি; ২২ অক্টোবর, ২০১৪