সালাহ্উদ্দীন স্যারের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

মুনতাসীর মামুন
Published : 15 Feb 2019, 05:24 PM
Updated : 21 Oct 2014, 06:21 AM

অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ স্যার ছিলেন উপমহাদেশের বয়োজ্যেষ্ঠ ঐতিহাসিক। আমাদের সমাজে ক্রমেই শ্রদ্ধা করার মতো মানুষ কমে যাচ্ছে। যারা ছিলেন কোনো না কোনো সময় শ্রদ্ধেয়, তাঁরা জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে এমন কিছু করছেন যে শ্রদ্ধার ভিতটা নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। বাংলা প্রবাদ তো শত শত বছরের জীবনচর্যার অভিজ্ঞতা। এ কারণেই সেই প্রবাদের সৃষ্টি– সব ভালো তার শেষ ভালো যার । অধ্যাপক আহমদের শুরুও ভালো ছিল, শেষও। এত দীর্ঘ দিন খুব কম বাঙালি শ্রদ্ধেয় থেকেছেন।

এ দেশে এ সমাজে যে গুটিকয় মানুষকে আমরা নির্দ্বিধায় শ্রদ্ধা করতে পারতাম অধ্যাপক আহমদ ছিলেন তাদের একজন। ১৯ অক্টোবর এই মানুষটি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে আমাদের সবাইকে অভিভাবকহীন করে চলে গেলেন।

আমি তাঁর পিএইচডি-র প্রথম ছাত্র। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করি তখন তিনি রাজশাহী থেকে চলে এসেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিছুদিন পর যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। শিক্ষকতা করতে হলে পিএইচ-ডি করতে হয়। আমার বিভাগীয় শিক্ষকরা নানা টেকনিকাল কারণ দেখিয়ে এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিলেন।

সালাহ্উদ্দীন স্যারের সঙ্গে আমার কিঞ্চিৎ পরিচয় ছিল। বিভাগে যোগ দিলে আমি সিদ্ধান্ত নিই তাঁর অধীনেই পিএইচ-ডি করব। কেননা সামাজিক ইতিহাসের নির্মাতা হিসেবে তাঁর স্থান উচ্চে। তিনি যখন আমাদের বিভাগে আসেন তখন তাঁকে বহিরাগত হিসেবেই দেখা হত এবং তাঁর যোগদানের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। আমি লক্ষ্য করেছি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এক ধরনের আঞ্চলিকতা কাজ করে। যোগ্যতা থেকেও আঞ্চলিকতা প্রাধান্য পায় যে কারণে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এখন ইনসুলার হয়ে যাচ্ছে।

আমার পিএইচ-ডির রূপরেখা বিভাগে জমা দেওয়ার পর অ্যাকাডেমিক কমিটিতে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। এ ক্ষেত্রে একজন সিনিয়ন শিক্ষক উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পিএইচ-ডি আর পাঠ্যপুস্তকে চিন্তায় তফাৎ আছে। 'এই বিষয় পাঠাপুস্তকের'। আমার বিষয় ছিল উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গের সমাজ যা নিয়ে আগে কোনো কাজ হয়নি।

মিটিং শেষে দেখি স্যার খুবই বিমর্ষ। বিষয়টি তাঁকে আহত করেছিল। খানিকটা অপমানিতও বোধ করেছিলেন। আমি তাঁকে হেসে বলেছিলাম, আপনি এখানে নতুন এসেছেন। এখানকার হালচাল আপনার শিষ্ট জীবনচর্চার বিপরীত। তারা বাধ্য হবে আমার রূপরেখা অনুমোদন করতে। দুই সপ্তাহ পর, আগের রূপরেখাটিই জমা দিলাম। জানালাম, তাদের পরামর্শ গ্রহণ করেছি। বিনা বাক্যব্যয়ে তা পাশ হয়ে গেল।

তিন বছরেরও কম সময়ে পিএইচ-ডি শেষ করি। সাধারণত পিএইচ-ডি ডিগ্রি পেতে বছর খানেক সময় লেগে যায়। আমার পরীক্ষক ছিলেন অধ্যাপক এ আর মল্লিক ও ভারতের অধ্যাপক সুমিত সরকার। সালাহ্উদ্দীন স্যার ব্যক্তিগতভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাস তিনেকের মধ্যে আমার রিপোর্ট এনে দিয়েছিলেন। মাস ছয়েকের মধ্যে আমি ডিগ্রি পেয়ে যাই।

ছাত্রের কল্যাণের প্রতি এই যে পিতৃত্বমূলক দৃষ্টিভঙ্গি বা আচরণ এটি তার মধ্যে সব সময় ছিল এবং এখনও বর্তমান। আমার সৌভাগ্য যে, আমি পড়ার সময় ও কনিষ্ঠ শিক্ষক থাকার সময় যে সব শিক্ষকের সংস্পর্শে এসেছিলাম তা আমার মনন উন্নয়নে সহায়তা করেছে। আর এখনকার ছাত্রদের দুর্ভাগ্য, তারা আমাদের মতো শিক্ষক পেয়েছেন যারা মনন উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না।

আমি সেই শিক্ষকদের কথা এখনও সুখে দুঃখে স্মরণ করি; যেমন, জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক মমতাজুর রহমান তরফদার, অধ্যাপক সাদউদ্দীন, অধ্যাপক হাশেম খান প্রমুখ। আমার সৌভাগ্য তাদের অনেকে বেঁচে আছেন এবং এখনও আমার শুভকামনা করেন।

অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহমদকে আমরা পছন্দ করি কয়েকটি কারণে– তাঁর মানবিক গুণাবলী, ইতিবাচক মনোভাব, নীতির ক্ষেত্রে আপসহীনতা, ছাত্রদের প্রতি অসীম ভালবাসা। ভদ্রবোধের, শুদ্ধবোধের চূড়ান্ত প্রতীক তিনি। এ কারণে যে তাঁকে মাঝে মাঝে বিব্রত হতে হয় না তা নয়। আমাদের অনেক আচরণ যা মাঝে মাঝে ভদ্রতার সীমা অতিক্রম করে তাও তিনি স্মিত মুখে উপেক্ষা করেন।

স্যারের জীবনকাহিনি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি না তাঁর জীবনসঙ্গিনী হামিদা খানমের কথা উল্লেখ করি। আমার এই গুরুপত্নী আজ প্রয়াত। তাঁর প্রস্থান আমার স্যারের জীবন একেবারে বর্ণহীন করে তুলেছে। তাঁরা ছিলেন পরস্পরের পরিপূরক। তাঁদের দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে কখনও কোনো কলহ হয়েছে কিনা সন্দেহ। অনবদ্য ভাষায় হামিদা খানম তাঁর আত্মজীবনী লিখে গেছেন– ঝরা বকুলের পথে । আমাকেও তিনি অতীব স্নেহ করতেন।

সালাহ্উদ্দীন স্যার এত নিভৃতচারী যে, তাঁর সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। আমি এখানে তাঁর জীবনের অসম্পূর্ণ রূপরেখা তুলে ধরছি।

আবুল ফয়েজ সালাহ্উদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯২৪ সালে, ফরিদপুরের এক শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারে। কিন্তুু তাঁর ছেলেবেলা, যৌবন কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে। তাঁর বাবার ছিল বদলির চাকরি এবং অধিকাংশ সময় তাঁকে কাটাতে হয়েছিল পূর্ববঙ্গ ছেড়ে। তাই সালাহ্উদ্দীন আহমদকে পড়তে হয়েছিল বাঁকুড়া জেলা স্কুল, বিষ্ণুপুর হাইস্কুল এবং কলকাতার তালতলা হাইস্কুলে। শেষোক্ত এই স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন ১৯৩৮ সালে। আইএ পাশ করেছিলেন রিপন কলেজ থেকে, ১৯৪০ সালে। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৩ এবং ১৯৪৪ সালে, ইতিহাসে লাভ করেছিলেন স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি।

এখানে উল্লেখ্য যে, সালাহ্উদ্দীন আহমদের দাদা 'আহমদ'ও উনিশ শতকের শেষের দিকে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে লাভ করেছিলেন স্নাতক ডিগ্রি। তাঁর বাবাও ছিলেন শিক্ষিত। ফলে তৎকালীন সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও, ধর্মীয় গোঁড়ামির মধ্যে তাঁর ছেলেবেলা কাটেনি। অপেক্ষাকৃত উদার পরিবারে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। ছাত্রজীবনে উৎসাহ বোধ করেছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এবং পরে ঝুঁকেছিলেন বামপন্থী আন্দোলনের দিকে, তৎকালীন অনেক মুসলমান যুবার মতো সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে নয়।

হয়তো তিনি যোগ দিতেন কমিউনিস্ট পার্টিতেই যদি না ১৯৪০ সালে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হত মানবেন্দ্রনাথ রায়ের [এমএন রায়]। এ যোগাযোগ তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এমএন রায়ের যুক্তিবাদী ও বুদ্ধিবৃত্তিক মন ও চিন্তুা তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর ভাষায়, 'আকৃষ্ট হয়েছিলাম পলিটিকসে ইনটেলেকচুয়ালি'।

১৯৪১ সালে যোগ দিয়েছিলেন তিনি রায়ের 'র‌্যাডিকাল ডেমোক্রেটিক পার্টি'তে। সক্রিয়ভাবে এ সময় তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন রাজনীতিতে। ১৯৪২-৪৪ সাল পর্যন্তু ছিলেন তিনি 'তিলজলা ইন্ডিয়ান সাইকেল ইউনিয়নের সভাপতি এবং 'কলকাতা পোর্ট কমিশনার্স শ্রমিক ইউনিয়নের'র সহকারী সম্পাদক। ১৯৪৫ সালে, সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন 'অল বেঙ্গল পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ ইউনিয়নে'র। ট্রেড ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর কাছে এক ধরনের শিক্ষার মতো।

১৯৪৬ সালে, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময় তিনি রাজনীতি ছেড়ে, দাঙ্গারোধ ও দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রদের সাহায্যকল্পে যোগ দিয়েছিলেন ভারতীয় রেডক্রসে। রায়ের লেখা পড়ে, আগে ছিলেন তিনি গান্ধীবিরোধী কিন্তু দাঙ্গার সময় গান্ধীর কর্মকাণ্ড এবং নোয়াখালী সফর তাঁকে করে তুলেছিল গান্ধীভক্ত। তাঁর মনে, গান্ধীর যে দিকটা তাঁকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল তা হল, সর্বধর্মের সমন্বয় সাধনের চেষ্টা। কিন্তু তাই বলে, রায়ের 'র‌্যাডিকাল হিউনিনিজম' যে তিনি একেবারে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তা নয়।

পাকিস্তান হওয়ার পর চলে এসেছিলেন তিনি ঢাকায় এবং যোগ দিয়েছিলেন জগন্নাথ কলেজে শিক্ষক হিসেবে। এ সময় তিনি এবং তাঁর কলকাতার কিছু বন্ধু যাঁরা প্রায় একই সঙ্গে চলে এসেছিলেন ঢাকায়, যেমন, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা এবং হাবিবুর রহমান– সবাই মিলে গঠন করেছিলেন 'র‌্যাশনালিস্ট ক্লাব'। শুধু তাই নয়, এখান থেকে প্রকাশিত হয়েছিল 'মুক্তি' নামে একটি সাময়িকপত্রও।

১৯৪৮ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্তু তিনি শিক্ষকতা করেছেন জগন্নাথ কলেজ, রাজশাহী, পেনসেলভেনিয়া, শিকাগো, জাহাঙ্গীরনগর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতিহাস পরিষদ, এশিয়াটিক সোসাইটি প্রভৃতি বিভিন্ন বিদ্বৎসভার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন এবং আছেনও। গবেষণা পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন। বিভিন্ন সময় ভ্রমণ করেছেন এশিয়া, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা।

শিক্ষাক্ষেত্রে বিশিষ্ট অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার দেশের সর্বোচ্চ পদক একুশে পদক (১৯৯১) ও স্বাধীনতা পদক (১৯৯৯)-এ তাঁকে ভূষিত করেছেন। তিনি মৃত্যুর সময় ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক। তাঁর স্ত্রী হামিদা খানমও ছিলেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ।

অধ্যাপক আহমদ দীর্ঘসময় শিক্ষকতায় যুক্ত থেকেছেন এবং এই সময়ে বিভিন্ন সরকার তাঁকে উচ্চপদে (উপাচার্য বা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান) নিয়োগ করতে চেয়েছে। কিন্তু সবসময় তিনি এসব পদের মোহ প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সাধারণ একজন শিক্ষক হিসেবেই জীবনযাপন করতে চেয়েছেন। ব্যক্তিজীবনে সহজ, নির্লোভ এবং নিপাট ভদ্রতার তিনি প্রতীক। আমাদের সমাজে, বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির একজন সদস্যের পক্ষে জীবনের বিভিন্ন প্রলোভন ত্যাগ করে নিজ লক্ষ্যে থাকা কম কথা নয়। 'সিম্পল লিভিং' এবং 'হাই থিংকিং'-এ তিনি বিশ্বাসী।

তাঁর এই জীবনচর্যার ছাপ আমরা দেখি তাঁর বিভিন্ন রচনায়। বস্তুত তাঁর জীবনচর্যা এর ফলে সৃষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও রচনার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। তাঁর জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, বাল্য ও যৌবনের পরিবেশ তৈরি করেছে তাঁর মনোজগত যা নাগরিক, সংস্কৃত ও যুক্তিবাদী এবং উদার মানবতাবাদী।

বলা যেতে পারে, ১৯৪৮ সালে জগন্নাথ কলেজে যোগ দেওয়ার সময় থেকেই সালাহ্উদ্দীন আহমদের ইতিহাসচর্চার শুরু। বহুলপ্রজ তিনি নন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি রচনা করেছেন প্রায় ২৫টি গ্রন্থ। কয়েকটি গ্রন্থ সম্পাদনাও করেছেন। গত এক দশকে পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধও লিখেছেন যার কিছু কিছু আবার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ঐসব গ্রন্থে।

তাঁর গবেষণার আগ্রহের বিষয় উনিশ শতকের বাংলা। পত্রপত্রিকায় যেসব প্রবন্ধ লিখেছেন তাঁর অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি বিষয়ে। তবে উনিশ শতকের গবেষণাই হোক বা বর্তমান শতক নিয়ে রচনাই হোক– সব কিছুতে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে। সেটি হচ্ছে মানবিকতা ও সব সংস্কৃতির সমন্বয়। তিনি একটি কথাই বারবার বলতে চেয়েছেন বা এখনও বলছেন, তা হল উপমহাদেশের মানুষকে অবশ্যই সমন্বয়ের সংস্কৃতির ধারক-বাহক হতে হবে, না হলে তার পক্ষে সুস্থভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব নয়।

সালাহ্উদ্দীন আহমদ পিএইচ-ডি করেছেন যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাফল্যের সঙ্গে তিনি ষাটের দশকে অধ্যাপক বলহেচেটের তত্ত্বাবধানে 'সোশ্যাল আইডিয়াজ অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জ ইন বেঙ্গল (১৮১৮-১৮৩৫)' শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। আশির দশক পর্যন্তু তাঁর পুরনো গবেষণা ভিত্তি করেই আরও কিছু প্রবন্ধ লেখেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেগুলি তাঁর অভিসন্দর্ভের। কোনো না কোনো অংশ বা চিন্তার বিস্তৃতি।

একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এই বৃত্ত থেকে তাঁর পক্ষে বেরুনো সম্ভব হয়নি। তিনি সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠেন গত শতকের নব্বই দশকে। এ সময় পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখতে শুরু করেন। বেশকিছু গবেষণা প্রবন্ধও রচনা করেন। সেগুলির কিছু নিয়ে গত এক দশকে তাঁর বেশকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। (সম্পাদিত গ্রন্থসমূহ বাদে)। শ্রেণিকরণ করলে তাঁকে সামাজিক ঐতিহাসিকই বলতে হবে।

সামাজিক ঐতিহাসিক হিসেবে তাঁর খ্যাতির ভিত্তি পরবর্তী গ্রন্থসমূহ নয়, বরং প্রথম গ্রন্থটি। ১৯৬৫ সালে লাইডেন থেকে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর ঐতিহাসিক হিসেবে দেশে-বিদেশে তিনি যে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তার রেশ এখনও মুছে যায়নি।

কিন্তুু এর কারণ কী? গ্রন্থটির গুণগত মান ও উৎকর্ষতার কথা পরম নিন্দুকও অস্বীকার করবে না। তবে এর অন্য একটি দিক আছে। সালাহ্উদ্দীন আহমদ যে সময় এ অভিসন্দর্ভটি রচনা করতে লন্ডন গিয়েছিলেন, সে সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে যেসব গবেষক সেখানে গিয়েছিলেন তাঁরা গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে মুসলমান সম্প্রদায়কেই বেছে নিয়েছিলেন। এর একটি কারণ হতে পারে যে, পাকিস্তানি হিসেবে হয়তো তৎকালীন শাসকদের ধ্যান-ধারণা বা আদর্শ তাঁদের খানিকটা প্রভাবিত করেছিল অথবা লন্ডনের ইংরেজ গবেষণা পরিদর্শকদের কাছে বিষয়টি মনে হয়েছিল নতুন।

সালাহ্উদ্দীন আহমদই বোধহয় তাঁর সমসাময়িক পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে প্রথম যিনি তত্ত্বাবধায়কের দেওয়া এ ধরনের কোনো বিষয়ের ওপর কাজ করতে অস্বীকার করেছিলেন এবং বিষয় হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটির বিষয় বেছে নিয়েছিলেন। হয়তো তাঁর মনে হয়েছিল, শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর অভিসন্দর্ভ রচনা সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে পারে। ফলে গুণগত উৎকর্ষতার কথা বাদ দিলেও ঐ সময় একজন মুসলমান ঐতিহাসিকের এ ধরনের রচনা সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।

সোশ্যাল আইডিয়াস অ্যান্ড সোশ্যাল চেঞ্জ ইন বেঙ্গল (১৮১৮-১৮৩৫) প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল লাইডেন থেকে ১৯৬৫ সালে, কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল এর দ্বিতীয় সংস্করণ।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার সমাজ জীবনে যে পরিবর্তন হয়েছিল তার কয়েকটি দিক আলোচনা করা হয়েছে এ গ্রন্থে। ১৮১৮ থেকে ১৮৩৫ সালের মধ্যে প্রাধান্য বিস্তারকারী আদর্শ, তা গড়ে ওঠার কারণ এবং সরকারি নীতিতে এর প্রতিক্রিয়া– এক কথায় যেমন সংস্কার আন্দোলনসমূহের সূত্রপাত, শিক্ষার বিস্তার এবং সবশেষে ভারত বিভাগ– এসব কিছুর মূল খোঁজার চেষ্টা করেছেন সালাহ্উদ্দীন আহমদ এ গ্রন্থে।

বইটি বিভক্ত দুটি অধ্যায়ে। ভূমিকায় তিনি পুরো বইটির মূল বক্তব্য সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতীয় বিশেষ করে বাঙালি সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় পাশ্চাত্যের অভিঘাত চ্যালেঞ্জ হেনেছিল দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থায়। ঐ সময় এ চ্যালেঞ্জ যেমনভাবে অনুভূত হয়েছিল, প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করেছিল তেমনি। ঐ সময়ই সংস্কারের বার্তা নিয়ে আর্বিভাব হয়েছিল রামমোহনের মতো ব্যক্তিত্বের। আবার তখনই মুসলমান সমাজের একাংশ, মূলত কৃষিজীবী যারা, জড়িয়ে পড়েছিলেন তিতুমীরের প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় আন্দোলন। মুসলমান সম্প্রদায়ের পরবর্তী বিকাশে এ আন্দোলন সৃষ্টি করেছিল অভিঘাতের।

ভারতীয় প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী পুরনো ভারতীয় স্বৈরাচারের ঐতিহ্যই অব্যাহত রেখেছিল। তবে কিছু গভর্নর জেনারেল যেমন হেস্টিংস (১৮১৩-২২) বা বেন্টিংকের (১৮২৮-৩৫) উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী উৎসাহ যুগিয়েছিল নতুন আদর্শ বিকাশে। বিশেষ করে জনমত বিকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়তা করেছিল বেন্টিংক প্রশাসন।

ভারতে বসবাসকারী সাধারণ ইংরেজ, যেমন, মিশনারি ও অবাধ বাণিজ্যের প্রবক্তা ব্যবসায়ীরা নতুন আদর্শ বিস্তারে সাহায্য করেছিল যা আবার পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছিল সামাজিক পরিবর্তনে। নতুন অর্থনৈতিক ও সামাজিক আদর্শে যুগিয়েছিল উৎসাহ, তবে মুসলমানদের 'সেপারিটজম' এর ভিত্তিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তখন, যার মূল কারণ পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি দু'সম্প্রদায়ের ভিন্ন প্রতিক্রিয়া।

উপসংহারে সালাহ্উদ্দীন আহমদ লিখেছেন, ইংল্যান্ডের সংস্কার আন্দোলন, বিশেষ করে ফ্রি 'ট্রেডার্স'দের-বাংলার সামাজিক-অর্থনৈতিক বিকাশে প্রচণ্ড অভিঘাত এনেছিল। উপযোগবাদ ও মিশনারিদের প্রভাব বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে সমাজ সচেতনতা সৃষ্টিতে ছিল সহায়ক এবং এভাবে একই সঙ্গে সংস্কার ও প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত মতামত সৃষ্টিতে সাহায্য করেছিল। ঐ সময়ের জনমত মানে প্রধানত শহুরে উচ্চ ও মধ্যশ্র্রেণির অভিমত।

তাঁর মতে, জনমতে যে ভাবনা-চিন্তুা প্রতিফলিত হয়েছিল তাই পরবর্তীকালে উপমহাদেশের ইতিহাস রচনায় সহায়তা করেছিল। পাশ্চাত্যের সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়েই এগুলি বিকশিত হয়েছিল এবং অর্জন করেছিল অদ্ভুত কিছু বৈশিষ্ট্য। বলতে গেলে, এসব আদর্শ পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধেই শুধু নয়, পাশ্চাত্যের চিন্তুা ও সংস্কৃতির সৃষ্টি করেছিল এক ধরনের প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধের।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদ, হিন্দু পুনর্জাগরণ এবং ধর্মনিরপেক্ষ চরমপন্থী এসব কিছু মিলেই নির্মিত হয়েছে উপমহাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যেগুলি ছিল বাংলায় ভ্রুণাবস্থায়।

সালাহ্উদ্দীন আহমদের সমসাময়িক যাঁরা সামাজিক ইতিহাস রচনা করেছেন, তাঁরা প্রায় সবাই সমাজকে বিচার করেছেন খণ্ডিতভাবে; অনেক ক্ষেত্রে একটি সম্প্রদায়ের ওপরই তাঁরা বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সালাহ্উদ্দীন আহমদের গ্রন্থের শিরোনাম দেখে ধরে নেওয়া যায়, সামগ্রিকভাবে তিনি সমাজকে বিচার করতে চেয়েছেন।

বিশ শতকের শুরুতে, ভারতবর্ষে ইতিহাস রচনায় খানিকটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছিল। পূর্ববর্তী সিভিলিয়ান বা ঐতিহাসিকদের রচনার সঙ্গে ছিল এই পার্থক্য। ভট্টচার্যের ভাষায়, নতুন এই ফ্রেম ছিল 'জাতীয় জাগরণের' এবং এর বৈশিষ্ট্য ছিল–

১. পাশ্চাত্য আদর্শ গ্রহণকারী এবং ইনিসটিটিউশন্ হলো পরিবর্তনের ক্রিয়াশীল উপাদান (active agent);

২. বাংলার 'রেনেসাঁর' ওপর গুরুত্ব;

৩. উনিশ শতকের সাংস্কৃতিক সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষের যুক্তকরণ।

পঞ্চাশের দশকে, রমেশচন্দ্র মজুমদার, কে কে দত্ত, রায় চৌধুরী প্রমুখ যখন বাংলার (বা ভারতের] ইতিহাস রচনা করলেন তখন ইংরেজি শিক্ষা এবং পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক আদর্শের গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সমাজ পরিবর্তন বা সংস্কারের কারণ হিসেবে দেখালেন, ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে অগ্রগামী ভারতীয় সংস্কারকদের সহযোগিতা। এটি ছিল ভারতীয় মনে ঔপনিবেশিক প্রভাব দূর করার আদর্শগত লড়াইয়ের একটি অংশ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল অতীতের 'স্বর্ণযুগের' ওপর গুরুত্ব আরোপ। (২)

কিন্তুু এই 'জাতীয় জাগরণ বা রেনেসাঁ' ঔপনিবেশিক ইতিহাসচর্চার প্রভাব পুরোপুরি এড়াতে পারেনি। উনিশ শতকী ইতিহাস চর্চা [যেমন, ব্রিটেন ভারতকে ক্রমে নিয়ে গেছে প্রগতির পথে] এই সময় (বা পরবর্তীকালে] উপরোক্ত ফ্রেমের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে গেল এবং বিলেতে যারা গেলেন ডিগ্রি করতে তাঁদেরও ঐ ফ্রেম এগিয়ে দেওয়া হল। (৩)

সালাহ্উদ্দীন আহমদকেও ফ্রেম নিতে হয়েছিল [যেমন, বিদেশি সরকারের ভূমিকার বদলে ব্যক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ] এবং তাঁর তত্ত্বাবধায়ক কেনেথ বলহ্যাচেটের ভূমিকাও ছিল এ ক্ষেত্রে প্রধান। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে, বলহ্যাচেটের বইয়ের নাম Social Policy and Social Change in Western India, 1817-1830 (London, 1961)

অধ্যাপক আহমদের তথ্য ব্যবহারেও ঐ সময়ের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তা হল, ইংরেজ প্রশাসনিক দলিলপত্রের [যা এখনও অনেকে মনে করে ইতিহাস রচনার প্রধান উপাদান] ওপর নির্ভরশীলতা। নির্বিচার এ ধরনের তথ্য ব্যবহৃত হয়েছে।

কিন্তুু তা সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে সালাহ্উদ্দীন আহমদের Social Ideas and Social Change in Bengal একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বইটির উৎকর্ষ এখনও অনেক গ্রন্থ ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।

গত শতকের নব্বই দশকে সালাহ্উদ্দীন আহমদের বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন পেশাদারি সংস্থা, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ প্রভৃতির কারণে তাঁর মনোজগতেও খানিকটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। একজন শিক্ষক হিসেবে শুধু নিজেকে অ্যাকাডেমিক চর্চায় আর তিনি আবদ্ধ রাখেননি। বরং সমাজের একজন বিশেষ ব্যক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়েছেন। এ কারণেই খুব সম্ভব তিনি বাংলা ভাষায় লেখা শুরু করেন।

ভাষার ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গে যাঁরা জড়িত তাঁরা বাংলা ভাষায় গবেষণাটা কৌলিন্যের কাজ বলে মনে করেন না। ফলে তাঁরা যেমন দেশবাসীর কাছে অচেনা, তেমনি বিদেশি ভাষায়ও অচেনা। একজন গবেষক ও লেখক হিসেবে তাঁদের সামাজিক দায়বোধের ব্যাপারে সন্দেহ থাকার যথেষ্ট কারণ আছে।

নব্বই দশকে সালাহ্উদ্দীন আহমদের পাঁচটি গ্রন্থের মধ্যে চারটি বাংলায়। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশে জাতীয় চেতনায় উন্মেষ ও বিকাশ , পরের বছর বাঙালির সাধনা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ । ১২টি প্রবন্ধের সংকলন। ১৯৯৩ সালে ৭টি প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ: জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ইতিহাসের সন্ধানে প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। এতে সংকলিত হয়েছে ১১টি প্রবন্ধ।

এই চারটি গ্রন্থের প্রবন্ধ সমূহকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়। একটি নিছক অ্যাকাডেমিক, অন্যটি নানা বিষয়ে ভাবনা। কিন্তুু দু'ধরনের প্রবন্ধেই অন্তুর্নিহিত মিল আছে। তিনি মূলত চেয়েছেন, বাঙালির সমাজচিন্তা, মুসলমানদের আইডেনটিটি, ধর্মনিরপেক্ষতাবোধ প্রভৃতি বিষয় তুলে ধরতে।

অন্যদিকে অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধের বিষয়, যেমন, 'উনিশ শতকে বাংলার মুসলমান: শিক্ষা, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা' , 'বাঙালি মুসলিম সমাজ, রাষ্ট্র, চিন্তুা ও জনমত', 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ঐতিহাসিক পটভূমি ১৯০৬-১৯৭১' ইত্যাদি। বই চারটির মধ্যে আমার কাছে উল্লেখযোগ্য মনে হয়েছে বাঙালির সাধনা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ । এই গ্রন্থের প্রবন্ধগুলি বিশ্লেষণ করলে সালাহ্উদ্দীন আহমদের মননচর্চার দিকটি স্পষ্ট হবে।

সংকলনে প্রথম প্রবন্ধ 'বাংলার সমাজ চিন্তা: ঐতিহ্য ও বিবর্তন' । এটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য দাবি রাখে, কারণ অধ্যাপক আহমদের পরবর্তী সব রচনাসমূহে এখানে বিবৃতি দৃষ্টিভঙ্গিই প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর অভিসন্দর্ভে ব্যক্ত অনেক মতামতও দেখা যায় সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধিত হয়েছে। যেমন, এই প্রবন্ধে তিতুমীর সম্পর্কে তিনি লিখছেন–


"তিতুমীর যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেটা ছিল মূলত ধর্মীয় ও আর্থ-সামাজিক। গ্রামাঞ্চলের কৃষক, তাঁতি ও অন্যান্য দরিদ্র জনসাধারণকে জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের অত্যাচার থেকে মুক্ত করা ছিল এবং এই আন্দোলনের একটি প্রধান লক্ষ্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ধর্মীয় ও সামাজিক কারণ।''

একই মন্তব্য করেছেন তিনি ফারায়েজী আন্দোলন সম্পর্কে।

এ প্রবন্ধে তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা হল–

"বাঙালির মনাসচেতনাকে ধর্মের সে ধর্ম হিন্দু, বৌদ্ধ বা ইসলাম যে ধর্মই হোক না কেন– তার সনাতন আচার-বিচারের চেয়ে তার আধ্যাত্মিক মানবতাবাদ ও অন্তর্নিহিত মর্মবাণী বেশি আকৃষ্ট করেছে এবং সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।"

সেই দৃষ্টিভঙ্গি আরেকটু বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে পরবর্তী প্রবন্ধ 'আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে মানবতাবাদী ও সমম্বয়ধর্মী ধারা' য়। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্তু সাংস্কৃতিক ধারাগুলি তিনি চিহ্নিত করেছেন, সেগুলি হল– প্রাক-আর্য এবং হিন্দু-বৌদ্ধ ধারা, ইসলাম বা মুসলিম ধারা এবং পাশ্চাত্যের ধারা। "এই তিনটি বিভিন্ন ধারা এই উপমহাদেশের মহামানবের সাগরে এসে মিশে গিয়ে একাকার হয়ে গেছে। এই মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল বিরোধ ও সঙ্ঘাত দিয়ে, তারপর এল মিলন ও আদান-প্রদান পালা; পরিসমাপ্তি ঘটল আত্তীকরণ ও সমম্বয়ের মধ্যে দিয়ে" — আমাদের উচিত হবে, এই সমম্বয়ের ফলে যে মানবতাবাদী ধারা তৈরি হয়েছে তা অব্যাহত রাখা।

তিনি যখন রামমোহন রায় সম্পর্কে (রামমোহন রায় ও ব্রাহ্ম সমাজ) আলোচনা করনে তখন তথ্যগুলি এভাবেই বিচার করেন এবং উপসংহারে পৌঁছান যে, রামমোহন একটি 'সর্বজনীন বিশ্বধর্ম প্রতিষ্ঠা' করতে চেয়েছিলেন। হিন্দুধর্মের সংস্কারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিকল্প ধারা সৃষ্টি করেছিলেন কি না এবং তাতে হিন্দু ধর্মের উপাদানগুলি কী পরিমাণে ছিল তা বিচার করেন না।

বাংলার মুসলমান ও তাদের আত্মপরিচয় নিয়েও তিনি চিন্তাভাবনা করেছেন। এ সংকলনেও সে বিষয়ে দুটি প্রবন্ধ আছে। এ ক্ষেত্রেও তিনি বাংলার মুসলমানদের অনগ্রসরতা, রক্ষণশীলতা বিষয় যেমন উল্লেখ করেছেন তেমনি দেখাবার চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে ছিল 'প্রগতিশীল সংস্কারবাদ'। এই শেষোক্ত ধারাটিকেই তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন যে কারণে দেলোয়ার হোসেনের রচনাকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন যদিও দেলোয়ার হোসেন তাঁর সময়ে উল্লেখযোগ্য কেউ ছিলেন না এবং তাঁর রচনা সে সময় কাউকে উজ্জীবিতও করেনি।

আমাদের আত্মপরিচয়েরও ( আত্মপরিচয়ের সন্ধানে: একটি ঐতিহাসিক সমীক্ষা ) বিভিন্ন পর্বে তিনি আলো ফেলেছেন। "পাকিস্তান ছিল সাম্প্রদায়িক মুসলিম জাতীয়তাবাদের অপসৃস্টি" — তা মেনে নিলেও প্রশ্ন থেকে যায় স্বাধীন বাংলার (যা হতে পারত ধর্মনিরপেক্ষ) যে কনসেপ্ট ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলমান নেতৃত্ব একযোগে তুলে ধরেছিলেন তা কংগ্রেস হাইকমান্ড কোন যুক্তিতে মানতে অস্বীকার করলেন? বা সাম্প্রদায়িকতা কি একতরফা একটি বিষয়? এর উদ্ভব কেন হয়? এসব প্রশ্ন অনুক্ত থেকে যায়। তাঁর মতে, এই দুর্বলতার কারণেই আমাদের নয়া জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয় অন্তিমে যা সহায়ক হয় বাংলাদেশ গঠনে।

এসব প্রবন্ধগুলির মূল সুর এক। তিনি বলছেন– জাতীয়তাবাদের প্রধান ভিত্তি হল স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং শুধু ধর্মীয় একতার ভিত্তিতে বর্তমানে কোনো রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। পাকিস্তান আন্দোলন ছিল মূলত অর্থনেতিক ও রাজনৈতিক এবং পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ও ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপন বা ধর্মীয় কোনো শ্লোগান দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। পরে অবশ্য ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছিল শোষণের হাতিয়ার হিসেবে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তানের এবং নিজেকে তা একমাত্র প্রতিষ্ঠিত রাখতে পারত গণতন্ত্রের ভিত্তিতেই, কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।

উল্লিখিত প্রবন্ধগুলিতে তিনি আরও লিখেছেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জনগণ তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যে ঐতিহ্য কোনো বিশেষ ধর্মের বা বর্ণের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, যেটা সম্পূর্ণ লোকায়ত এবং ভূ-ভিত্তিক– সেই ঐতিহ্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগল এবং তাদের এই অন্বেষার পরিণতি বাংলাদেশের জন্ম।

তিনি এ প্রসঙ্গে বাঙালি মুসলমান সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তা আগের থেকে ভিন্ন। তিনি বলছেন, বাঙালি মুসলমান ধর্মভীরু হওয়া সত্ত্বেও তাদের গণজীবনে একটি উদার ও মানবতাবাদী ধারা প্রবাহিত হয়ে আসছে এবং যার প্রমাণ পাওয়া যায় আউল বাউলের মধ্যে। এ আধ্যাত্মিক মানবতাবাদ পরবর্তীকালে বাঙালি জাতির স্বাতন্ত্র্যবোধ ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদকে জাগ্রত করতে সাহায্য করছে। তাঁর মূল বক্তব্য, সমম্বয়ধর্মী, মানবতাবাদী বা ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমাজের মূল উপাদান মনে না করলে সামাজিক শান্তিপ্রতিষ্ঠা দুরুহ।

এ সমস্ত চিন্তুাভাবনার নির্যাস নিয়ে তিনি রচনা করেছেন Bengali Nationalism and the Emergence of Bangladesh: An Introductory Outline (ICBS, Dhaka 1994)– এখানেও তিনি একই মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। বিভিন্ন পর্বের সমাজ চিন্তুা এবং সবশেষে বাঙালি জাতীয়তাবাদ (স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন) নিয়ে আলোচনা করে তিনি এই উপসংহারেই পৌঁছান–

"এই উপমহাদেশের জনজীবনে আবহমানকাল থেকে যে ধারাটি প্রাধান্য পেয়ে এসেছে সেটি সমঝোতা ও সমম্বয়ের ধারা। এই সমন্বয় আমরা দেখতে পাই আমাদের সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে, যেমন– সঙ্গীতে, শিল্পে, সাহিত্যে এমনকি পোশাক-পরিচ্ছদে এবং আচার-বিচারে। তেমনি আবার এই সমম্বয় দেখা যায় আমাদের ধর্ম ও সমাজ চিন্তুায়, আমাদের সামগ্রিক জীবনবোধের মধ্যে। বস্তুত এই উপমহাদেশের মানুষ আমরা যৌথভাবে এক সুমহান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী।"

(বাঙালির সাধনাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ)

এই উত্তরাধিকার যদি আমরা সংরক্ষণ করি তাহলেই বাংলাদেশ কেন, উপমহাদেশ জুড়ে শান্তি আসতে পারে।

পরবর্তীকালে ইংরেজি ও বাংলায় তাঁর আরও কিছু প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে; যেমন, ইতিহাস ও ঐতিহ্য (২০০৭) , Bangladesh : Tradition and Transformation, India Pakistan Bangladesh : Perspectives on History Society and Politics , বাঙালির সাধনা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ , বরণীয় ব্যক্তিত্ব ও স্মরণীয় সুহৃদ প্রভৃতি।

গত শতকের নব্বয়ের দশকে সালাহ্উদ্দীন আহমদ নতুন এক প্রকল্পে আগ্রহী হয়ে ওঠেন, তা হল 'ওরাল হিস্ট্রি'। তিনি এর বাংলা নামকরণ করেছেন 'কথ্য ইতিহাস', যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় এ নামকরণ যথাযথ নয়। পশ্চিমবঙ্গে এর নামকরণ করা হয়েছে 'মুখের কথার ইতিহাস'। আচ্ছা, মৌখিক ইতিহাস বললে কী হয়?

ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অর্থানুকূল্যে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে তিনি এ প্রকল্পের কাজ শুরু করেন এবং একশ জনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। সাক্ষাৎকার বিবরণীসমূহের সার-সংক্ষেপে 'কথ্য ইতিহাসের রূপরেখা' নামে প্রকাশিত হয়েছে। এরপর 'তৃণমূল পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ 'শীর্ষক তিন বছর মেয়াদী একটি প্রকল্পও তিনি গ্রহণ করেছিলেন। এ প্রকল্পের আওতায় প্রায় এক হাজার ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল এবং এর ভিত্তিতে ঐ কেন্দ্র থেকে পরে বেশকিছু গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে। ঐ সব গ্রন্থে অবশ্য তাঁর কোনো রকম সম্মানজনক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।

ইতিহাসের এ পদ্ধতি অনুসরণে কেন তিনি এত বেশি আগ্রহী তার একটি ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন–

"১. বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস চেতনার অভাবে প্রাতিষ্ঠানিক দলিল দস্তাবেজের উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের দেশে এখনও গড়ে উঠেনি।

২. অধিকাংশ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বিশেষ করে রাজনীতিবিদগণ নিজেদের স্মৃতিকথা লিখে যান না।…

ইতিহাসের বিভিন্ন উৎসের বিশ্লেষণে এভাবে আমাদের কাছে সমকালীন ইতিহাসের উপাদানের দুষ্প্রাপ্যতা ও এর অব্যাহত সংকটের চিত্রটিই প্রকট হয়ে উঠে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাসের উপাদান সংরক্ষণের জন্য মৌখিক তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা তর্কাতীতভাবে প্রতিপন্ন হয়।"

তবে এই পদ্ধতিটি এখনও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না বা সুশৃঙ্খলভাবে এগুলি উপস্থাপিত করার ব্যাপারেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ গবেষণা ইন্সস্টিটিউট এই প্রকল্পটি গ্রহণ করেছিল এবং অধ্যাপক আহমদ এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

ঐতিহাসিকের কাজ কী? সালাহ্উদ্দীন আহমদের ভাষায়–

"নিরপেক্ষ ও মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অবলম্বন করে ইতিহাস সাধনা করা সকল ঐতিহাসিকের আদর্শ ও লক্ষ্য। ঐতিহাসিকরা ইতিহাস রচনা করেন কোন বিশেষ মুষ্টিমেয় শ্রেণির জন্য নয়; তাদের রচনা সমগ্র পাঠক সমাজের জন্য।"

[ভাষণ]

বস্তুত 'নিরপেক্ষ' ঐতিহাসিক হওয়া কি কারও পক্ষে সম্ভব?

তিনি যখন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র তখন ইতিহাসের ছাত্রদের ওপর মার্কসবাদী ঐতিহাসিক সুশোভন সরকারের বেশ প্রভাব ছিল। সালাহ্উদ্দীন আহমদ নিজেও তাঁর ছাত্র ছিলেন, বামপন্থী ঝোঁকও তাঁর ছিল কিন্তুু ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে মার্কসবাদী পদ্ধতি তিনি কখনও ব্যবহার করেননি। এর কারণ, যৌবনেই তিনি আবার মানবেন্দ্রনাথ রায় প্রচারিত 'র‌্যাডিক্যাল হিউম্যানিজম'এর দিকে ঝুঁকেছিলেন।

তাই ধরে নিতে পারি, তিনি যখন ঐতিহাসিককে 'নিরপেক্ষ ও মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি' নিয়ে কাজ করতে বলেন তখন তার উৎস উদারনীতি ও মানবতাবাদ। কিন্তুু উদারতা অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, উদারতাবাদের ফলে যত বেশি বিভ্রান্তির সৃষ্টি হওয়া উচিত সালাহ্উদ্দীন আহমদের লেখায় তা হয়নি। সালাহ্উদ্দীন আহমদের প্রথম বই-ই প্রমাণ করেছিল যে, তাঁর চিন্তা স্বচছ, রচনা সংযমী ও পরিচ্ছন্ন বা এক কথায় তিনি ক্ষমতাবান।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, তা সত্ত্বেও বলতে হয়, ১৯৬৫ সালে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর সক্রিয়ভাবে ইতিহাসচর্চা থেকে তিনি নিজেকে বিরত রেখেছিলেন অনেকদিন। ফলে এখানে তাঁর পক্ষে কোনো অনুসারী তৈরি করা সম্ভব হয়নি। সমাজ সম্পর্কে তাঁর যে চিন্তুা তা তাঁর অল্প কিছু ছাত্রকে হয়তো প্রভাবিত করেছে কিন্তুু ইতিহাস রচনাকে নয়। তিনি বলেছিলেন, ইতিহাস সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া উচিত এবং এ কারণেই, খুব সম্ভব, নব্বই দশক থেকে সেভাবে কাজ করছেন। বাংলা ভাষায় ইতিহাসচর্চা করেছেন। তাঁর এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকায় আমরা লাভবান হয়েছি।

স্যারকে আমরা কোনো অনুষ্ঠানে ডাকলেই আসতেন বা আসার চেষ্টা করতেন। আমার কাছে তিনি ছিলেন বটবৃক্ষের মতো। ছাত্র হিসেবে আমাকে নিয়ে গর্ব করার তাঁর কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু আমার গর্ব করার বিষয় যে, আমি তাঁর ছাত্র। এটিই আমার বড় পরিচয়।