‘চ্যানেল আই’এর ষোল বছর, ‘সোলবা সাল’

মহিউদ্দিন আহমদ
Published : 2 Feb 2019, 05:58 PM
Updated : 13 Oct 2014, 02:21 AM

ব্যক্তিমালিকানায় বাংলাাদেশে যে ছাব্বিশ-সাতাশটি টিভি চ্যানেল আছে তার শীর্ষস্থানীয় চার-পাঁচটি চ্যানেলের একটি হচ্ছে 'চ্যানেল আই'। এই চ্যানেলটি ১ অক্টোবর তার ষোড়শ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী মহাধুমধামের সঙ্গেই পালন করল। বস্তত এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান শুরু হয় দশ-বার দিন আগেই। তখন প্রতিদিন 'চ্যানেল আই'এর আয়োজনে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই আলোচনাগুলোর একটি ছিল টক শোগুলোর গুরুত্ব এবং যথার্থতা নিয়ে। ঢাকার কিছু ডাকসাইটে সিভিল সোসাইটির সদস্য উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা এখানে বক্তব্য দিয়েছেন।

অনুষ্ঠানটি আমি দেখিনি; তবে পরদিন দৈনিক 'প্রথম আলো'তে এই আলোচনা সভার উপর যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তার সঙ্গে আমি একমত, যেহেতু আমাদের জাতীয় সংসদটি অকার্যকর সেইহেতু টক শোগুলো এবং 'বিবিসি বাংলা'র সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সংলাপ জাতীয় অনুষ্ঠান সংসদের অভাবটি পূরণ করে দিচ্ছে। কখনও কখনও আবার এমনও মনে হয় জাতীয় সংসদের বিতর্কের চাইতে এগুলো অনেক বেশি কার্যকর। জাতীয় সংসদে গালাগাল এবং বন্দনাই বেশি হয়। কিন্তু টক শোতে পক্ষ-প্রতিপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে উপস্থিত রাখার চেষ্টা হয়; এখানে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর বক্তব্য পাওয়া যায়, জাতীয় সংসদের বর্তমান অবস্থায় যা সম্ভব নয়।

এই পর্যায়ে একটি ডিসক্লেইমার; টক শোতে আমি যাই না, দেখিও না এসব প্রোগ্রাম। রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। রাত ৮টার পর সাধারণত টেলিফোনও ধরি না। আর যে কোনো টিভি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার সম্মানী হিসেবে আমি একটি মিনিমাম পরিমাণের টাকা নিয়ে থাকি।

আমার কোনো গাড়ি নেই, আমাকে নিতে হলে আমাকে নিয়ে যেতে হয়, দিয়েও যেতে হয়। তারপর রাত ১০টার পর হলে, 'সরি, থ্যাংক ইউ'। এতসব শর্ত মেনে আমাকে দাওয়াত করার দরকার কী? আমার চাইতে যোগ্য লোক এই ঢাকা শহরে অনেক, অনেক পাওয়া যায়। যেমন একটু আগেই বলেছি, আমি টিভি টক শো দেখি না, টক শোতে অংশগ্রহণ করি না। তারপরও আমি মনে করি, যে কোনো সরকারের আমলে সরকার পক্ষের লোকজনের কিছুটা জবাবদিহিতা, কিছুটা ভাষ্য, কিছুটা আত্মপক্ষ সমর্থন এখানে আদায় করা যায়। 'বিবিসি বাংলা'র বাংলাদেশ সংলাপ এই ক্ষেত্রে একটি প্রবল ভূমিকা রেখে চলেছে।

দুই

বাংলাদেশের এই টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কয়েকটি কোনোভাবে শুধু বেঁচেই আছ। তবে শীর্ষস্থানের চ্যানেল কোনটি– 'চ্যানেল আই', 'এটিএন নিউজ', 'এনটিভি', নাকি 'চ্যানেল ৭১'– তা সঠিকভাবে জানার উপায় এই বাংলাদেশে এখনও গড়ে ওঠেনি। টিভি চ্যানেল মালিকদের এখানে সাংঘাতিক ব্যর্থতা।

পত্রপত্রিকার প্রকৃত প্রচারসংখ্যা দিয়ে একটি পত্রিকার পাঠকপ্রিয়তা যাচাই করা যায়। কিন্তু এখানে যে গভীর ও ব্যাপক দুর্নীতি চলছে তা সম্যক জানে আমাদের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর। তারা সঠিক প্রচারসংখ্যা জানার জন্য কখনও কখনও গভীর রাতে পুলিশ, র‌্যাবের মতো পত্রিকা অফিসে আচমকা পরিদর্শনে যায়। যখন ছাপাখানায় পত্রিকা ছাপা হতে থাকে তখন আসল প্রচারসংখ্যা জানার কথা। কিন্তু এখানেও নানা রকমের অনিয়ম বেনিয়ম এবং দুর্নীতির অবিশ্বাস্য রেওয়াজ চালু আছে।

দুনিয়ার উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে পত্রিকা অফিসে টেলিফোন করলেই সেই পত্রিকার প্রচারসংখ্যা জানা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে 'নো', 'নেভার'। পত্রিকার প্রকৃত প্রচারসংখ্যা মালিক-সম্পাদকরা 'অতিগোপনীয়' হিসেবে গণ্য করেন। এই ক্ষেত্রে দৈনিক 'প্রথম আলো' একমাত্র ব্যতিক্রম।

পত্রিকার প্রচারসংখ্যার উপর নির্ভর করে বিজ্ঞাপন রেট; যে পত্রিকার যত বেশি প্রচার সংখ্যা, তার রেট তত বেশি। সুতরাং প্রচারসংখ্যা বেশি দেখাতে পারলে রেটও বেশি হবে, বিজ্ঞাপন থেকে আয়ও বেশি আসবে। আমাদের পত্রপত্রিকার মালিক-সম্পাদকদের বেশিরভাগই এই দুর্নীতি প্রকাশ্যেই করে চলেছেন।

টেলিভিশনের জনপ্রিয়তা যাচাই করা হয় টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট– 'টিআরপি' দিয়ে। তো, বাংলাদেশের বর্তমান চ্যানেলগুলোর টিআরপি নিয়ে 'এটিএন নিউজ'এর প্রভাষ আমিন কী লিখেছেন, তা নিচে উদ্ধৃত করছি। দৈনিক 'ইত্তেফাক'এর গত রোজার ঈদ সংখ্যা ২০১৪এ ''বাঘের ওপর টাগ" শিরোনামে আমাদের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ওপর প্রকাশিত খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখার এটি শেষ প্যারাগ্রাফ:

''টেলিভিশন মালিকদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর আরেকটি কায়দা হচ্ছে টিআরপি । 'সিরিয়াস' নামের একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে টেলিভিশন স্টেশনগুলোর দর্শকপ্রিয়তা যাচই করে। টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ এবং বিজ্ঞাপনদাতারা অনেক টাকা দিয়ে এই টিআরপি রিপোর্ট কেনে। কিন্তু সাধারণ দর্শকরা এই টিআরপি রিপোর্ট দেখার সুযোগ পান না। বিজ্ঞাপনদাতারা এই টিআরপি রিপোর্ট দেখার সুযোগ পান না। বিজ্ঞাপনদাতারা এই টিআরপি রিপোর্ট দেখেই বিজ্ঞাপন দেন। তাই এই টিআরপি রিপোর্ট টিভি স্টেশনগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু এই মহাগুরুত্বপূর্ণ টিআরপি রিপোর্ট কীভাবে তৈরি হয় শুনলে আপনারা হাসতে হাসতে মরে যাবেন। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে মাত্র ২৬০টি বাসার দর্শকদের পছন্দ মনিটর করেই তৈরি হয় এই টিআরপি । তাও কোন ২৬০টি বাসা তা 'সিরিয়াস' ছাড়া আর কেউ জানে না। ভুতুড়ে সেই ২৬০ জন দর্শকই নির্ধারণ করেন টিভি স্টেশনের ভাগ্য এবং এই ২৬০ জনের সবাই ঢাকার। তার মানে ঢাকার বাইরের মানুষ টিভি দেখল কী দেখল না তাতে টিভি স্টেশনের মালিকদের কিছুই যায় আসে না।

হাস্যকর বললাম এই কারণে যে, প্রতি সপ্তাহেই টিআরপি রিপোর্ট দেখার সুযোগ হয় আমার। এমন অনেক টিভি টিআরপি রেটিংয়ে এগিয়ে থাকে, যা আপনারা হয়তো কখনওই দেখেননি। অভিযোগ আছে 'সিরিয়াস' প্রায়শই এই টিআরপি রিপোর্ট ম্যানিপুলেট করেন। 'সিরিয়াস'কে সন্তষ্ট করতে পারলে দর্শক দেখুন আর না দেখুক যে কোনো টিভি টিআরপি তে এগিয়ে থাকতে পারে।''

এই পর্যায়ে 'চ্যানেল আই'এর কাছে আমার প্রথম প্রস্তাব, কোন চ্যানেলের কী সঠিক রেটিং পয়েন্ট দর্শকদের তা নিয়মিত জানানোর ব্যবস্থা করুন। 'চ্যানেল আই' দেশের প্রথম ডিজিটাল চ্যানেল, এই আত্মপ্রচারগুলো আজ বৃহস্পতিবার ২ অক্টোবরও অনেকবার শুনেছি; এই চ্যানেল অনেক কিছু আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে চালু করেছে, আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে সমৃদ্ধও করেছে। তো, দয়া করে এখন ইলেকট্রনিক মিডিয়ারই এক সাংবাদিক প্রভাষ আমিনের পর্যবেক্ষণ এবং মন্তব্যগুলো যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সঠিক বস্তুনিষ্ঠ টিআরপি সাপ্তাহিক ভিত্তিতে প্রকাশ্যে চালু করুন।

আমরা 'চ্যানেল আই'এর সঙ্গে কামাল মজুমদারের 'মোহনা' টিভিকে তুলনা করে দেখতে চাই কে কোন অবস্থানে আছে। 'মোহনা' টিভি কি কেউ দেখে? এই চ্যানেলের মালিক, আওয়ামী লীগের সাংঘাতিকভাবে বিতর্কিত এক সংসদ সদস্য কামাল মজুমদার নাকি টিভি নাটক এবং অন্যান্য প্রোগ্রামের বকেয়া কোটি কোটি টাকা কয়েক বছর ধরে পরিশোধ করছেন না।

'চ্যানেল আই'এর দায়িত্বটা এখানে অনেক বেশি। এর মালিকদের একজন, উন্নয়নকর্মী, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ হচ্ছেন 'অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল উওনার্স'– অ্যাটকো এর মহাসচিব। 'অ্যাটকো' এর সভাপতি 'এনটিভি'র মালিক জনাব মোসাদ্দেক আলী ফালু। দু'জনের চ্যানেল দুটোই জনপ্রিয়তা এবং টিআরপি রেটিংয়ে শীর্ষের কয়েকটি চ্যানেলের দুটি।

এখানে আরও উল্লেখ করি, পশ্চিমা দেশে টিভির রেটিং প্রফেশনালিই করা হয়ে থাকে। পত্রপত্রিকায় কোন টিভি চ্যানেলের প্রোগ্রামের জনপ্রিয়তা কেমন তা নিয়মিতই ছাপা হয়। বিশ্ববিখ্যাত টক শো হোস্ট ল্যারি কিং 'সিএনএন' থেকে অবসরে যাওয়ার পর তার জায়গায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ব্রিটিশ টিভি-ব্যক্তিত্বৃ পিয়ার্স মরগ্যানকে। কিন্তু তিন বছর ধরে 'সিএনএন' মালিকপক্ষ লক্ষ করল, পিয়ার্সের এই অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা কমে যাচ্ছে। সুতরং মাস কয়েক আগে 'সিএনএন' থেকে তাঁকে বিদায় দেওয়া হয়েছে।

তিন

বুধবার ১ অক্টোবর ভোর ৪-৩০ থেকে আমি 'চ্যানেল আই' দেখা শুরু করি এবং মাঝে মাঝে কয়েক মিনিটের বিরতিসহ সকাল ১১টা পর্যন্ত একটানা দেখি। বুঝলাম, রাত ১২টায় জন্মদিনের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। ড. কামাল হোসেন, বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদসহ আরও কয়েকজন কেক কাটলেন, তাদের সকলকে চিনলামও। কিন্তু বিএনপি থেকে কে একজন থাকলেন, তাকে আগে কোথায়, কোনো টিভিতে বা পত্রিকার পাতায় দেখেছি তা মনে পড়ল না।

সকাল ৭টায় যখন দিনের পত্রিকাগুলো হাতে নিলাম, দেখলাম 'চ্যানেল আই'এর জন্মদিন উপলক্ষে যে ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছে সেখানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তথ্যমন্ত্রীর বাণী আছে। কিন্তু কোনো বাণী নেই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বা জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদের।

তাহলে মানে কী দাঁড়াল? বিএনপি কি এখন 'চ্যানেল আই'কে নিরপেক্ষ মনে করে না? তাই বিএনপির এই বয়কট, এই বর্জন?

কিন্তু সেই ২০০৩ বা ২০০৪ সালে যখন বিএনপির 'যুবরাজ' তারেক রহমান বাংলাদেশের জেলাগুলো সফরে বের হলেন, তখন এই 'চ্যানেল আই'তে সালেহ বিল্পব নামের এক ছোকরা রিপোর্টার যে উচ্ছাসের আতিশয্য দেখাল তার রিপোর্টগুলোতে, তখন একটি কলাম লিখেছিলাম আমি। সালেহ বিপ্লবকে কেন আমি 'ছোকরা বিপ্লব' বলে আমার কলামে বর্ণনা করলাম, তার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন পরে শাইখ সিরাজ, এক অনুষ্ঠানে।

তো, শাইখ সিরাজ, ফরিদুর রেজা সাগররা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে আছেন বলেও তো মনে হয় না। 'চ্যানেল আই' যদি আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকত, তাহলে শাইখ সিরাজ 'হৃদয়ে মাটি ও মানুষ' নামের চ্যাানেলটি পেতেন। কয়েক বছর ধরে শুনে আসছি, তিনি অনেক বছর ধরে এমন একটি চ্যানেলের জন্য চেষ্টা করে আসছেন, কিন্তু সফল হচ্ছেন না।

বরং দ্বিতীয় চ্যানেল জোগাতে সফল হলেন 'ডক্টর' মাহফুজুর রহমান। তার 'এটিএন বাংলা' আগে থেকেই তো ছিল, অতিরিক্ত তিনি পেলেন 'এটিএন নিউজ' টিভি। অথচ এই 'ডক্টর' রহমান ২০০৪ বা ২০০৫ সালে বগুড়ার ধুনটে ২০০৬ এর নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচনে বিএনপির পরবর্তী সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে এসেছিলেন। তাকে ধাওয়া দিয়েছিল বিএনপির তৎকালীন সিটিং এমপি জিএম সিরাজের লোকজন। জিএম সিরাজ ছিলেন বাংলাদেশ বাসমালিক সমিতির তৎকালীন সভাপতি।

ধাওয়া খাওয়ার এই খবরও দেখেছিলাম 'ডক্টর' মাহ্ফুজুর রহমানের এটিএন বাংলার খবরেই। সেদিন ১ অক্টোবর 'ডক্টর' মাহফুজুর রহমানকেও দুপুরের দিকে 'চ্যানেল আই'এর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দেখলাম। তবে তার সঙ্গে দেখলাম না বাংলাদেশের দ্বিতীয় 'রুনা লায়লা', ইভা রহমানকে।

'চ্যানেল আই' এর মালিকদের অনেক কিছু গত পনের বছরে হয়েছে। ত্রিশটির মতো কোম্পানি, শত শত কোটি টাকা তাদের এখন। কিন্তু তাদের নেই দ্বিতীয় কোনো চ্যানেল। কারণ তাদের টিমে নেই কোনো তদবিরবাজ, প্রধানমন্ত্রীকে 'আপা' ডাকার মতো কোনো সাংবাদিক।

চার

'চ্যানেল আই'এর জন্মদিনের অনুষ্ঠানগুলো দেখতে দেখতে আমার বার বার একটি কথা মনে পড়ছিল। এর দুই প্রধান পুরুষ, ফরিদুর রেজা সাগর এবং শাইখ সিরাজদের জন্য বন্দনা এবং আত্মপ্রচারের যে প্রতিযোগিতা চলল, তাহলে বিটিভিকে 'সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্স' বলে অপবাদ দেওয়া কেন? সরকারের মালিকানাধীন বিটিভি সরকারের প্রেসিডেন্ট, প্রাইম মিনিস্টার, ফার্স্ট লেডি, মিনিস্টারদের প্রচারণা চালিয়েছে অতীতে, এখনও চালায়; 'চ্যানেল আই'ও তো তার মালিকবৃন্দ এবং তাদের স্ত্রী-মা-বোনদের প্রচার চালাচ্ছে!

মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে পরের কয়েক দিন বাংলাদেশের সবগুলো পত্রিকায়, সবগুলো চ্যানেলে লতিফ সিদ্দিকী এক নম্বর খবর। কিন্তু 'চ্যানেল আই'তে লতিফ সিদ্দিকীর বিপরীতে 'চ্যানেল আই'এর বন্দনা ও বিভিন্ন বিশিষ্টজনদের মধ্যে প্রচারের প্রতিযোগিতার খবর সবগুলো বুলেটিনে এক নম্বরে ছিল।

বুধবার সকালে 'তৃতীয় মাত্রা'র অনুষ্ঠানে উপস্থাপক জিল্লুর রহমান তবু কিছুটা শালীনতা দেখালেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক, সাবেক সচিব মোফাজ্জল করীম, সাবেক সিএসপি এবং লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে ১৯৬৭-৬৮ তে আমার সিনিয়র ব্যাচমেট ড. মিজানুর রহমান শেলী এবং রাশেদা কে চৌধুরীকে জিল্লুর রহমান জিজ্ঞাসা করলেন, '''চ্যানেল আই'এর কী কী ঘাটতি আছে, এই চ্যানেলে আপনারা নতুন কী দেখতে চান?''

এখানেও ব্যারিস্টার রফিকউল-হক এবং রাশেদা কে চৌধুরীর মধ্যে বন্দনার প্রতিযোগিতা দেখলাম। রফিকুল হক বললেন, ইটালির ভেনিস সফরকালে তিনি দেখেছেন এক বাংলাদেশির ইটলিয়ান স্ত্রী 'চ্যানেল আই'এর খবর দেখতে চারতলায় ছুটে গেলেন। আর রাশেদা চৌধুরী বললেন, ভারতের গুজরাটে তাঁর ছেলের শ্বশুরবাড়িতে 'চ্যানেল আই' দেখার প্রবল আগ্রহের কথা।

এমন বন্দনা সেদিন প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কথায়ও দেখলাম। গত বছর তিনি 'চ্যানেল আই'এর ক্রোড়পত্রের জন্য লেখা দিয়েছিলেন। আমার কাছে তখন তা 'চিপ' সস্তা মনে হয়েছিল। টেলিফোন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এই শিক্ষককে তখন প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। লিখতে হলে তিনি সম্পাদকীয় পাতায় লিখবেন। যেমন আজ বৃহস্পতিবার 'প্রথম আলো'তে সৈয়দ শামছুল হকের বন্দনামূলক একটি লেখা দেখছি। সৈয়দ শামসুল হকও 'চ্যানেল আই'তে কোনো ঘাটতি ত্রুটি ব্যর্থতা দেখতে পান না। 'চ্যানেল আই'তে তিনি কোনো বিজ্ঞাপন-সন্ত্রাস দেখেন না। সৈয়দ শামসুল হকের এই বন্দনা তাঁর অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে মনে করি।

এই বন্দনার প্রতিযোগিতা দেখতে দেখতে আমার আরও মনে হচ্ছিল, এই সব বিশিষ্টজন 'চ্যানেল ৭১', 'এটিএন' এবং 'এনটিভি'র জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানেও প্রায়ই এই কথাগুলোই বলবেন। 'চ্যানেল আই'এর জায়গায় শুধু জন্মদিনের অনুষ্ঠান উদযাপনকারী টিভি চ্যানেলের নাম বসিয়ে দিলেই হল। এই দিনের অনুষ্ঠানগুলোতে আরও বুঝলাম, বাঙালি মাত্রই প্রচারকাতর।

'চ্যানেল আই'এর 'কৃষি সংবাদ'টি আমি সুযোগ পেলেই দেখি। দেখি 'প্রকৃতি ও জীবন' সংবাদও। আরও দেখি সংবাদ, সকাল ৯টার বুলেটিনের শেষ দিকে প্রচারিত দিনের সংবাদপত্রগুলোর অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম। তবে এই শিরোনামগুলোর পাঠক মৃদুলা মতিনের ছবি দেখানোতে আপত্তিটা কোথায়? মাঝে মাঝে বড় অশুদ্ধ উচ্চারণ থাকে তার। তারপরও তাকে 'চ্যানেল আই'এর পর্দায় দেখার একটি আগ্রহ আমার অনেকদিনের।

'চ্যানেল আই'এর খবর সব সময় বস্তুনিষ্ঠ নয়। উদাহরণ দিচ্ছি, আগের দিন মঙ্গলবার শাইখ সিরাজ ওয়াশিংটনে কোনো এক সেমিনারে গুটি সার সম্পর্কে কী বলেছেন, তা সকাল ৭টার বুলেটিন থেকে শুরু করে রাত ৯টার বুলেটিনেও প্রচার করতে হবে কেন? কারণ কি এই যে, তিনি শাইখ সিরাজ, তিনি একজন মালিক? আত্মপ্রচার কি এমন প্রকট হতে হবে?

জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও দেখলাম, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি 'ইউনিলিভার', তার সাবান সামগ্রী এবং মোবাইল কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনের দাপট এবং প্রতাপ। পশ্চিমা দেশে, কোনো একজন 'ইনভেস্টিগেটিভ' রিপোর্টার, এই জন্মদিনে বিজ্ঞাপন খাতে 'চ্যানেল আই'এর আয় কত কোটি টাকা, খরচই-বা কত, এমন সব খরচের যৌক্তিকতা, এসবের উপর দীর্ঘ প্রতিবেদন তৈরি করে ছাপাতেন।

আমাদের পত্রপত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলগুলো দেশের মানুষদের সচেতনতা বাড়াতে, বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করতে, মানবাধিকার রক্ষায়, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে প্রবল ভূমিকা রাখছে। কিন্তু এতসব, বড় বড় নন্দিত ভূমিকার পরও যখন দেখি, বাংলাদেশের অনেক মানুষ অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে একদিকে, আবার চাঁদে দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদীকেও দেখছে এবং বিশ্বাসও করছে, তখন আর মেলাতে পারি না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অসাধারণ সময এখন বাংলাদেশে। বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব দুর্গাপুজা চলছে। কয়েক দিন পর কোরবানির ঈদ। পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের এক উত্তম সময় এখন। ক্ন্তিু লক্ষ্য করেছেন কি, হিন্দুদের উৎসব উদযাপিত হয়েছে পুলিশি প্রহরায়! এই দেশে সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে না কমছে? আমাদের গণমাধ্যমের প্রভাব এবং কার্যকারিতা নিয়ে তখন মনে প্রশ্ন জাগে।

'চ্যানেল আই'তে জাঁকজমকের এত বড় বড় সব অনুষ্ঠান, এত বড় বড় সব লোকের দোয়া শুভকামনা এবং অভিনন্দন জ্ঞাপন, কিন্তু একজন মানুষকে এই বছরের অনুষ্ঠানে দেখলাম না, আগের বছরগুলোতও নয়। ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা এবং এখন চেয়ারম্যান সনজীদা খাতুনকে 'চ্যানেল আই'এর কোনো অনুষ্ঠানে দেখা যায় না।

শিউলিতলা, উত্তরা

বৃহষ্পতিবার, ২ অক্টোবর, ২০১৪

মহিউদ্দিন আহমেদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক, শৌখিন মিডিয়া মনিটর।