থাকব না কেউ পেছনে, গড়ব সমাজ এক সনে

মাসুমা বিল্লাহ
Published : 1 Oct 2014, 12:40 PM
Updated : 1 Oct 2014, 12:40 PM

১ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে 'আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস' হিসেবে পালিত হচ্ছে ১৯৯০ সাল থেকে। প্রবীণদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি, বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘ দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।

এ বছরের প্রবীণ দিবসের প্রতিপাদ্য 'লিভিং নো ওয়ান বাহাইন্ড: প্রমোটিং আ সোসাইটি ফর অল'– বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় 'থাকব না কেউ পেছনে, গড়ব সমাজ এক সনে'। পৃথিবীজুড়ে জনসংখ্যা আবর্তনের যে জোয়ার পরিলক্ষিত হয়েছে গত শতাব্দীতে, এমনকি এ শতাব্দীতেও– এর ফলস্বরূপ জনসংখ্যার গঠন ও বিন্যাসে এসেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। আর এর প্রভাবও পড়েছে পৃথিবীর আনাচে কানাচে। পৃথিবী তার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি বিশাল প্রবীণ জনগোষ্ঠী নিয়ে এগিয়ে চলছে। সুতরাং পৃথিবীর সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রবীণদের যথার্থ অর্থেই একটি নতুন শক্তিশালী জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা সমীচীন।

জাতিসংঘের সূত্র মতে, বর্তমান পৃথিবীর ৬০০ মিলিয়ন অধিবাসীর বয়স ৬০ বছরের উপর; ২০২৫ সালে এই সংখ্যা হবে দ্বিগুণ এবং ২০৫০-এ গিয়ে এই সংখ্যা ২ বিলিয়ন অতিক্রম করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, এই ২ বিলিয়নের ৮০ শতাংশই হবেন উন্নয়নশীল দেশের অধিবাসী।

কেন পৃথিবীতে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে? গড় বর্ধিত আয়ুষ্কাল এর অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। বর্ধিত আয়ুষ্কাল বা বর্ধিত গড় আয়ু নিঃসন্দেহে উন্নয়নের সাফল্য নির্দেশ করে। যে দেশে মানুষের গড় আয়ু যত বেশি, সে দেশ তত বেশি উন্নত বলেই ধরে নেওয়া হয়; বা অন্যভাবে বলতে গেলে, উত্তরোত্তর উন্নয়ন গড় আয়ু বৃদ্ধিতে সাফল্য জোগায়।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশ, এমনকি উন্নয়নশীল দেশগুলোও গত শতাব্দীতে গড় আয়ু বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়েছে এবং এ লক্ষ্যে নিরলস কাজও করে যাচ্ছে। কিন্তু আয়ুষ্কালের উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে এই ক্রমবর্ধমান প্রবীণ জনগোষ্ঠী নিয়ে আমাদের ভাবনা কী, আমরা কতটুকু প্রস্তুত তাদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক চাহিদা মেটাতে, এ বিষয়ে আরও অনেক বেশি কাজ করতে হবে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিমণ্ডলে।

বলে রাখা ভালো যে, বর্তমান পৃথিবীর ১৮০ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীরই বাস দারিদ্রের সঙ্গে; দারিদ্রপীড়িত উন্নয়নশীল দেশে। এদের একটি বড় অংশের বাস আমাদের দেশে। বর্তমান বাংলাদেশের ৭ শতাংশ অর্থাৎ ১০ মিলিয়নের বেশি মানুষের বয়স ৬০ বছরের উপর এবং ২০৫০ সালে এই সংখ্যা দাঁড়াবে ২০ শতাংশের বেশি; অর্থাৎ জনসংখ্যার প্রতি ৫ জনে একজন হবেন প্রবীণ।

সরকার নিঃসন্দেহে প্রবীণ-হিতৈষী। তাই সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বয়স্ক ভাতা খাতে বরাদ্দ রাখছে প্রতি বছর, যদিও এই বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। কিন্তু আমাদের উপরিকাঠামো কতটা প্রবীণ-বান্ধব? যেখানে নিরাপদ সড়কের জন্য বছরের পর বছর আমাদের আন্দোলন করে যেতে হয়, আন্দোলনের এই অবসরে রাজপথে বেড়ে চলে লাশের মিছিল– যেখানে ভিড়-ধাক্কা-ঠেলাঠেলিতে যৌবন ক্ষয় হয় প্রতিদিন– এমন বাস্তবতায় পাবলিক বাসে প্রবীণদের জন্য আলাদা বিশেষায়িত বসার জায়গা বা তাদের পারাপারের জন্য নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনার কথা বলা বাতুলতা মাত্র।

আমাদের দেশে বিপুল কৃষিজীবী জনগোষ্ঠী যারা আমাদের দু'মুঠো অন্ন যোগানোর জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বিলিয়ে দিচ্ছেন যৌবন, যাদের আহ্লাদ করে আমরা আবার অর্থনীতির ভিত্তি বলেও অভিহিত করে থাকি– জীবনের পড়ন্তবেলায় তাদের জন্য স্বাস্থ্য-বীমা, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, সম্মানজনক সামাজিক অবস্থান– এসবই যেন দুরাশা।

এ তো গেল শ্রমজীবী আর কৃষিজীবী দারিদ্রপীড়িত প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কথা, এবার আসি মধ্যবিত্ত প্রবীণের কথায়। মধ্যবিত্ত প্রবীণ সর্বদাই পরমুখাপেক্ষী। কারণ আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোতে পেনশন-বীমা এতটাই যৎসামান্য যে, তা দিয়ে দু'বেলা আহার জোটানো সম্ভব হয় না, চিকিৎসা-বিনোদনের চিন্তা তো সুদূরপরাহত।

গ্রাম-কেন্দ্রিকতা থেকে হঠাৎ শহরকেন্দ্রিক হয়ে ওঠা এই দেশে মধ্যবিত্ত প্রবীণের জায়গা খুপড়ির মতো ফ্ল্যাটবাড়ির নামমাত্র বারান্দার ইজি চেয়ারে। প্রবীণের জন্য ক'টা পার্ক, মাঠ, হাঁটার জায়গা, সামাজিক যোগাযোগের সংযোগস্থল গড়ে দিতে পেরেছি আমরা কিংবা আমাদের সরকার? চিকিৎসা-ব্যয়, বিশেষ করে প্রতিযোগিতামূলক প্রাইভেট বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা-ব্যয়– এ সরকারের কতটুকু নিয়ন্ত্রণে আছে তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়ে যায়।

প্রবীণের জন্য কর্মসংস্থান, প্রবীণকে উন্নয়নের নতুন উৎস হিসেবে দেখা– এসবই আমাদের মতো দেশে যেখানে হাজার হাজার শিক্ষিত তরুণ বেকার– আপাত হাস্যকরই শোনায় বটে। কিন্তু আমরা যদি আমাদের বিপুল ক্রমবর্ধমান প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের অংশীদার করতে না পারি, তবে একদিকে এটা যেমন দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তেমনি নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর অনুপাত বাড়তে থাকবে ব্যাপক হারে।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো যখন 'হ্যাপি এইজিং' নিয়ে গবেষণাতেই ব্যয় করছে বাজেটের একটা বড় অংশ, তখন আমাদের হাতে খুব বেশি সময় কিন্তু নেই। আমাদের ভাবতে হবে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে– অন্তত প্রয়োজনীয় আইনের সংস্কার, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনগুলো করে ফেলতে হবে অতি দ্রুত। ঐতিহ্যগতভাবেই আমরা বাঙালিরা বয়োজ্যেষ্ঠকে সম্মান করি। আমাদের পারিবারিক পরিবেশ ও সহবত রীতিমতো প্রশংসনীয়। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও পিতামাতা, মুরুব্বীকে সম্মান করায় আমরা সামাজিকভাবে উৎসাহিত করি। এগুলো আমাদের ঐতিহ্যের উজ্জলতম দিক, এগুলো লালন করতে হবে।

পাশাপাশি, আমরা যদি অন্তত আমাদের পরিবারের প্রবীণদের দায়িত্ব নেওয়ার চেষ্টা করি, তাহলে সরকারের উপর চাপ কমবে। মনে রাখতে হবে যে, আমাদের শিশুটিকে লালনপালন করা যেমন আমার দায়িত্ব, তেমনি পরিবারের প্রবীণ সদস্যটিকে দেখভাল করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য। অন্যথায় আমাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা শিশুর বিকাশও রূদ্ধ করবে অবধারিতভাবে। আজকে যে নবীন সে যদি প্রবীণের কথা না ভাবে, তবে তার প্রবীণবেলায় সে তার পাশে কাউকে পাবে না– এমনকি রাষ্ট্র, সরকার, আইনকানুন, কেউ-ই তাকে ছায়া দিবে না।

প্রবীণের অভিজ্ঞতা আর নবীনের প্রাণপ্রাচুর্য, একটি ছাড়া আরেকটি অচল। যে জাতি প্রবীণের প্রজ্ঞা আর নবীনের প্রাণশক্তির মিশেল করতে পারে সাফল্যের সঙ্গে, সে জাতি এগিয়ে যায় তরতর করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রবীণরা কাজের মধ্য দিয়ে নিঃসঙ্গতা আর বার্ধক্যের একাকীত্ব জয় করতে পারেন।

পাশাপাশি, প্রবীণদের কল্যাণে 'পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন' এবং 'জাতীয় প্রবীণ নীতি' দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদও রয়েছে আমাদের সমাজে।

বাংলাদেশের 'পপুলেশন মোমেন্টাম' মাথায় রেখে এখনই ঢেলে সাজাতে হবে রাস্তাঘাট, চিকিৎসা-সেবা, গণপরিবহণ, স্বাস্থ্য–বীমা, পেনশন-বীমার মতো প্রবীণদের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় সেবা খাতগুলো। প্রবীণদের উন্নয়নের অংশীদার করার নিমিত্তে এগিয়ে আসতে হবে নতুন নতুন চিন্তা আর অভিপ্রায় নিয়ে। সর্বোপরি, পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে তাদের বিশেষ সম্মানজনক স্থান দেওয়ার যে ঐতিহ্য আমরা লালন করি, একে এগিয়ে নিতে হবে।

প্রবীণ দিবসে আসুন প্রবীণ-বান্ধব সমাজ গড়ার অঙ্গীকার করি। আমাদের সত্যিকারের ব্রত হোক এটাই– ''থাকব না কেউ পেছনে, গড়ব সমাজ এক সনে''।

মাসুমা বিল্লাহ: জনসংখ্যাবিদ ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্টের খণ্ডকালীন শিক্ষক।