জনগণের ক্ষমতায়নে তথ্য অধিকার আইন

সাদেকা হালিম
Published : 27 Sept 2014, 07:03 PM
Updated : 27 Sept 2014, 07:03 PM

সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, জনগণই হবে প্রজাতন্ত্রের মালিক। এই অনুচ্ছেদের আলোকে তথ্যের মালিক জনগণ। জনগণের তথ্য-অধিকার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, দুর্নীতি হ্রাস ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, সংবিধানে মৌলিক অধিকার রূপে স্বীকৃত চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতার অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার সুনিশ্চিত করতে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ জাতীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত হয়। যদিও বাংলাদেশের সংবিধানে এ আইনের বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই তবু সংবিধানের ৯, ৩২ এবং ৩৯ ধারা তথ্য অধিকার আইনের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এ আইনে উল্লেখ আছে যে, বাস্তবায়নের ফলস্বরূপ একটি কমিশনে থাকবে। সরকারকে বিশেষ অভিনন্দন যে, তারা তথ্য কমিশন এবং মানবাধিকার কমিশন গঠন করেছে জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষার্থে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সচেতন হতে এবং বিচারপ্রাপ্তিতে।

তথ্য অধিকার আইনের চর্চা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনের বান্তবতার নিরিখে বিশ্লেষণ করা উচিত। এ আইনে আটটি অধ্যায় এবং সাঁইত্রিশটি ধারা আছে। তথ্য কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে অভিযোগ গ্রহণ এবং কোনো আবেদনকারী তথ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং আপিল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বঞ্চিত হয়ে কমিশনে অভিযোগ করলে তার তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ।

তথ্য আইন বাস্তবায়নে দুটি দলই মূখ্য, আবেদনকারী ও সরবরাহকারী। দুটি দলই যে কোনো ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। তথ্য কমিশন একটি আধা-বিচারিক প্রতিষ্ঠান। এটি আবেদনকারীকে তথ্য আদায়ে Code of Civil Procedure 1908 অনুযায়ী সহযোগিতা করে। তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে অনেক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অপারগতা প্রকাশ করছেন। আবার ধারা ৭ অনুযায়ী যে বিশটি বিষয়ে সরকার তথ্য দিতে বাধ্য নয়, তার মধ্যে আবেদনটি না পড়লেও ধারা ৭ কৌশলে ব্যবহার করে যাচ্ছেন।

যেমন, দুটি সাংবিধানিক কমিশন যথাক্রমে নির্বাচন কমিশন এবং সরকারি কর্ম কমিশন ধারা ৭-এর মূলত (ছ, জ এবং ঝ) ব্যবহার করে তথ্য প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে। বদিউল আলম মজুমদার নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর জমাকৃত আয়-ব্যয়-সংক্রান্ত তথ্য জানতে চেয়ে তথ্য আহরণে ব্যর্থ হন। তথ্য কমিশন শুনানিতে সিদ্ধান্ত দেয় যে, যেহেতু নিবন্ধিত দলগুলো নির্বাচন কমিশনে অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছে, তাই এ রিপোর্ট 'পাবলিক ডকুমেন্ট' এবং আবেদনকারীকে নির্বাচন কমিশন তথ্য প্রদানে বাধ্য। কিন্ত এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন তথ্য কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তথ্য প্রদান করেনি।

উল্লেখ্য যে, ২০১৩ সালে ভারতের ছয়টি রাজনৈতিক দলকে 'পাবলিক অথরিটি' বলে ঘোষণা করে ভারতের কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন। তথ্য প্রদানে অপারগতার জন্য সম্প্রতি কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং বিজেপি সভাপতি অমিত শাহকে নোটিশ পাঠিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন।

অন্যতম আরেকটি অভিযোগ করেন বিপ্লব কুমার কর্মকার। সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে তিনি দৈবচয়নের ভিত্তিতে নির্বাচিত ২৯ তম বিসিএস পরীক্ষায় বিভিন্ন ক্যাডারের (শিক্ষা, পররাষ্ট্র, শুল্ক, আবগারি, কর ও পুলিশ) প্রার্থীদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বর জানতে চেয়ে আবেদন করেন। জবাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন যে, মৌখিক পরীক্ষার নম্বর প্রদানের কোনো বিধান সরকারি কর্ম কমিশনের নেই।

পরে, তথ্য কমিশনের শুনানিতে আবেদনকারীকে তথ্য প্রদানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ প্রদান করে। কিন্তু সরকারি কর্ম কমিশন ধারা ৭-এর উপধারা (ছ, জ এবং ঝ) অনুযায়ী এ আদেশ অমান্য করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করবে এই মর্মে ২৪ জুলাই, ২০১৪ একটি পত্র তথ্য কমিশনে প্রেরণ করে। এই আইনের ধারা ৭-এ উল্লেখ নেই যে, মৌখিক পরীক্ষার ফল প্রদান করা যাবে না। মৌখিক পরীক্ষার ফল জানার অধিকার পরীক্ষার্থীদের আছে এবং এটা ধারা ৭-এর মধ্যে পড়ে না। পরীক্ষার ফল যদি পাবলিক ডকুমেন্ট হয়, তাহলে মৌখিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হবে না কেন?

রাষ্ট্র তথ্য কমিশন গঠন করেছে, কিন্তু লক্ষণীয় যে, সাংবিধানিক কমিশনগুলো তার আদেশ অমান্য করছে। উপরোল্লিখিত দুটি অভিযোগেই কমিশন কর্তৃক জরিমানা করা যেত। কিন্তু তথ্য কমিশন কর্তৃক আমলাতান্ত্রিক মানসকাঠামো নিয়ে অভিযোগগুলো পর্যালোচনার কারণে জরিমানার পরিমাণ অত্যন্ত সীমিত। এ যাবত মাত্র দুজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে জরিমানা করা হয়েছে।

তথ্য কমিশনের অন্যতম কাজ হচ্ছে প্রাপ্ত অভিযোগগুলো নিষ্পত্তি করা। ২০০৯ সালে কমিশন গঠনের পর থেকে তথ্য অধিকার আইন চর্চার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ২০১০-২০১৪ পর্যন্ত মোট অভিযোগের সংখ্যা ৬৬৭। শুনানির জন্য আমলে গৃহীত অভিযোগের পরিমাণ ৩৩৭। এর মধ্যে ৩২১ টি অভিযোগ শুনানির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়েছে। তথ্য না পেয়ে সংক্ষুব্ধ অভিযোগকারীর আবেদন সঠিক পদ্ধতিতে (তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী) না হওয়ায় সঠিক প্রক্রিয়ায় আবেদন করার জন্য (ধারা ৮-এর উপধারা ১, ২, ৩ অনুসারে) তথ্য কমিশন কর্তৃক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ৩০৭ জনকে।

উল্লেখ্য, তথ্যপ্রাপ্তির প্রক্রিয়া কঠোরভাবে অনুসরণ করfতে প্রায় ৫০ শতাংশ অভিযোগকারী তথ্যপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত। লক্ষ্যণীয় যে, পত্র প্রেরণের মাধ্যমে কমিশন কর্তৃক নির্দেশ দেওয়ার পর পুনরায় আবেদনের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। এর কারণ আবেদনকারী পুনরায় ২০-৩০ কার্যদিবস তথ্য আহরণের জন্য ব্যয় করতে আগ্রহী হয় না এবং তথ্য আহরণের জন্য তাকে পুনরায় যাতায়াত বাবদও খরচ করতে হয়। উপরন্তু, আবেদনকারীকে আবারও তথ্য প্রদানের দায়িত্বে ন্যস্ত কর্মকর্তার সম্মুখীন হতে হয় যেটা সব সময় তার জন্য সুখকর অভিজ্ঞতা নয়।

তথ্যপ্রাপ্তির দীর্ঘ প্রক্রিয়া বাস্তবে অধিকসংখ্যক আবেদনকারীকে তথ্য অধিকার আইন ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করছে। কয়েক মাস আগে, তথ্য কমিশনের ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে তথ্য কমিশন ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু অভিযোগের intent বিবেচনায় নিয়ে অভিযোগ গ্রহণের মতামত দেন যেটি ভারতে অনুসৃত।

অভিযোগগুলি বিশ্লেষণে প্রতীয়মান যে, ব্যক্তিগত উদ্যোগে অভিযোগের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে সীমিত। বিশেষ করে, দরিদ্র জনগণ নিজস্ব উদ্যোগে এ আইনের সুফল ভোগ করতে পারছেন না। সাধারণত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বেসরকারি সংস্থার সহোযোগিতায় আইনটি ব্যবহার করছেন। তাদের এ আইন সম্পর্কে জানানোর যে প্রক্রিয়া তা সঠিকভাবে সম্পন্ন না হওয়ার দরুণ তারা এ সম্পর্কে অবগত নন। এজন্য যে হারে অভিযোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া প্রয়োজন তা হচ্ছে না।

এ ব্যতীত তথ্য আইনের (ধারা ৩২) অনুযায়ী আটটি গোয়েন্দা সংস্থা তথ্য প্রদানে বিরত থাকবে, কেবলমাত্র দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য প্রদান করবে।

তথ্য কমিশনের নিষ্পত্তিকৃত অভিযোগের মধ্যে সর্বোচ্চ অভিযোগ ভূমি-সংক্রান্ত, এ সংখ্যা ৫০। শুনানির পর পূর্ণাঙ্গ তথ্য পেয়েছেন ৪৬ শতাংশ; কোনো তথ্য পাননি এমন আবেদনকারীর সংখ্যা ২৬ শতাংশ; আংশিক তথ্য পেয়েছেন ১০ শতাংশ; বিভ্রান্তিকর তথ্য পেয়েছেন ২ শতাংশ এবং অন্যান্য অভিযোগকারী যারা আবেদন করেছেন কিন্তু তথ্য পেয়েছেন কিনা সে ব্যাপারে কমিশনকে অবগত করেননি, এমন ১৬ শতাংশ। তথ্য কমিশনে শুনানির মাধ্যমে ২৬ শতাংশ অভিযোগকারীর তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিন্তকরণ হওয়া সত্ত্বেও, সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তাদের তথ্য প্রদান করেননি। যদিও আংশিক বা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করা হয়েছে। শুনানি-পরবর্তী সিদ্ধান্ত মোতাবেক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রদান বাঞ্ছনীয়।

অন্যতম আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে তথ্য অধিকার আইনের সংজ্ঞা যা বিষয়ভিত্তিক না হয়ে বৈজ্ঞানিক হওয়ার দরুণ কিছু কর্মকর্তা ও আপিল কর্তৃপক্ষ প্রায়শই আবেদনকারীকে তথ্য প্রদানে বঞ্চিত করেন। উল্লেখযোগ্য, যে বিষয় সম্পর্কে আবেদনকারী তথ্য চেয়েছেন তার উল্লেখ (যেমন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভিজিডি কার্ড ইত্যাদি) না থাকায় তথ্যের সংজ্ঞা কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তথ্য প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করছেন। এসব ক্ষেত্রে কমিশনের নির্দেশে তথ্য প্রদান করা হয়।

উপরন্তু, অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট ১৯২৩-এর ৫ (১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত ধারা মোতাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের তথ্যের যৌক্তিকভাবে যত্ন নিতে হয়। তাছাড়া, তথ্য যদি বিনিময় করেন তাহলে ওই কর্মকর্তা অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন। এছাড়া ১৯৭৯/১৯৯৬ বিজনেস রুলসের কিছু ধারা তথ্য সরবরাহে তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হচ্ছে। কিন্তু তথ্য অধিকার আইনের ধারা ৩ অনুযায়ী তথ্যের আবেদন করলে তথ্য অধিকার আইনই প্রধান্য পাবে। প্রয়োজন হলে যেসব আইনের বিশেষ ধারাগুলো তথ্য আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সেগুলো অতিসত্বর বাতিল করতে হবে।

এছাড়া আইনে তথ্য না দিলে কেবলমাত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে জরিমানা করার বিধান রয়েছে, আপিল কর্তৃপক্ষকে নয়। অনেক ক্ষেত্রে আপিল কর্তৃপক্ষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তথ্য সরবরাহে নিরুৎসাহিত করেন। এ ক্ষেত্রে যেহেতু দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন (ACR) লিখেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, কাজেই তাদের মতামত উপেক্ষা করে তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা নার্ভাস হয়ে যান।

এসব প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও তথ্য অধিকার আইন জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষার্থে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে সহায়ক হতে পারে। নারীরা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তথ্যপ্রাপ্তির মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতায়ন করতে পারেন। মৌলিক অধিকার রক্ষার্থে পার্বত্য এলাকার আদিবাসীরা এ আইন ব্যবহার করছেন।

তথ্য অধিকার আইনটি যেন সকল স্তরের জনগণ সহজে ব্যবহার করতে পারে সে ব্যপারে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি, পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে গণমাধ্যম ও জনপ্রতিনিধিদের সমর্থন বিশেষভাবে কাম্য।


ড. সাদেকা হালিম:
অধ্যাপক, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক তথ্য কমিশনার।