‘মাফকিলাব’-এর সাম্প্রদায়িক সাংবাদিকতা অব্যাহত আছে অব্যাহত আছে ‘মাফ’ প্রার্থনাও

মহিউদ্দিন আহমদ
Published : 23 Sept 2014, 05:37 PM
Updated : 23 Sept 2014, 05:37 PM

গত ১৮ আগস্ট সোমবার দৈনিক 'ইনকিলাব' নামের, বাস্তবে দৈনিক 'মাফকিলাব'-এর প্রথম পৃষ্ঠায় 'প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য এক পুলিশ কর্মকর্তার, তিনি পুলিশ বাহিনীতে তৈরী করেছেন অঘোষিত হিন্দু লীগ' শিরোনামের প্রায় এক হাজার শব্দের এক ইনকিলাবী আবর্জনায় পুলিশের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট ইন্সপেক্টর জেনারেল, প্রলয় কুমার জোয়ারদারের চরিত্র হননের প্রতিবাদে প্রলয় জোয়ারদার দ্রুত ওয়ারি থানায় মামলা দায়ের করেন এবং পুলিশও দ্রুত ইনকিলাব ভবনে অভিযান চালিয়ে 'মাফকিলাব'-এর বার্তা সম্পাদক রবিউল্লাহ রবিকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় এবং এই 'মাফকিলাব'-এর আরও কয়েকজন সাংবাদিকের খোঁজখবর নেয়। ২১ আগস্টেও ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্ঠায় দ্বিতীয় শিরোনাম ছিল, 'কেন এই প্রলয়-কাণ্ড?' এই আবর্জনাটিও লিখে ইনকিলাবীদের সর্দার এ এম এম বাহাউদ্দিন। এই আবর্জনাটির প্রথম কয়েকটি প্যাারাগ্রাফ এমন ছিল–


লেখালেখি তেমন করি না। তারপরও কখনও কখনও লিখতে হয়। দু'দিন আগেই একটি লেখা লিখেছি। আবার লিখতে হবে সেটা ভাবিনি। কিন্তু লিখতে হচ্ছে। গভীর রাতে ইনকিলাব অফিসে 'প্রলয়' ঘটানো হয়েছে। ডিবি পুলিশ অভিযান চালিয়ে বার্তা সম্পাদককে গ্রেফতার করেছে। গতকাল রাতে প্রলয় নামের এক পুলিশ কর্মকর্তা ইনকিলাব অফিসে যে 'প্রলয়' ঘটালেন তাতে বিস্মিত, হতবাক এবং মর্মাহত হয়ে লিখতে বসেছি।

একজন পুলিশ কর্মকর্তার দুর্নীতি নিয়ে ইনকিলাবে রিপোর্ট প্রকাশ করায় তিনি সংক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেছেন। ওয়ারি থানায় তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলায় তিনি অভিযোগ করেছেন 'ইনকিলাব মিথ্যা ও বানোয়াট খবর প্রচার করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। এছাড়াও পুলিশ বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে'। প্রশ্ন হল, আসলেই কি তাই? এক ব্যক্তির দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করা কি গোটা প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা? আর খবর মিথ্যা না সত্য এখনও কি সেটা তদন্ত করে বা অনুসন্ধান করে দেখা হয়েছে?

কিন্তু মাত্র ৬ দিন পর, রোববার, ২৪ আগস্ট এই একই সরদার বাহাউদ্দিন তার 'মাফকিলাব'-এর প্রথম পৃষ্ঠায় 'দুঃখ প্রকাশ ও ১৮ আগস্ট ইনকিলাবে প্রকাশিত সংবাদটি প্রত্যাহার' শিরোনামের খবরে প্রলয় জোয়াদারের কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে, নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা করে। যেমন করেছিল তাদের এক মুরুব্বি, পাকিস্তানি জেনারেল এ এ একে নিয়াজী বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল অরোরার কাছে, ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর।

বাহাউদ্দিনের এই আত্মসমর্পণের পুরো 'দলিল'টি নিচে উদ্ধৃত করছি–


গত ১৮ আগস্ট, ২০১৪ দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত 'প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য এক পুলিশ কর্মকর্তার', 'তিনি পুলিশ বাহিনীতে তৈরী করেছেন অঘোষিত হিন্দু লীগ' শীর্ষক রিপোর্টটি প্রকাশের জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। এই সাথে রিপোর্টটি প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে ইনকিলাব কর্তৃপক্ষ।

ইনকিলাব কর্তৃপক্ষ বিনয়ের সাথে স্বীকার করছে, রিপোর্টটি লেখা, সম্পাদনা ও প্রকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করা হয়নি। এ ছাড়া রিপোর্টটি প্রকাশের পর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এর অনেক তথ্যই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। রিপোর্টটিতে উর্ধ্বতন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা বাবু প্রলয় কুমার জোয়ারদার, এআইজি (পিএন্ডআর) সম্পর্কে অসত্য তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি কোনভাবেই ব্যক্তিগতভাবে তাকে বা দায়িত্বশীল পুলিশবাহিনীকে জড়িয়ে এ রকম প্রতিবেদন প্রকাশ করা সমীচীন হয়নি। এ ছাড়া এই রিপোর্টে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের সম্মানিত সদস্যদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার মতো শব্দ প্রয়োগ হওয়ায় আমরা সত্যি দুঃখিত। এ ধরনের শব্দ ও বাক্য প্রয়োগে যে সকল ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও বিশেষ সম্প্রদায়ের সম্মানিত সদস্যগণ মনে কষ্ট পেয়েছেন তাদের প্রতি ইনকিলাব কর্তৃপক্ষের আবেদন, তারা যেন আমাদের অনিচ্ছাকৃত এই ভুলকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন। ইনকিলাব কর্তৃপক্ষ সুস্পষ্টভাবে জানাচ্ছে যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সুনাম হানি হয় এবং দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বা বিভেদ সৃষ্টি হতে পারে এমন সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে দৈনিক ইনকিলাব আরও সতর্কতা অবলম্বন করবে; আরও সচেতন থাকবে।

দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, সংবিধান সমুন্নত রাখতে দৈনিক ইনকিলাব সব সময়ই অঙ্গীকারাবদ্ধ। এই প্রেক্ষাপটে আমরা আবারও জানাচ্ছি যে গত ১৮ আগস্ট, ২০১৪ তারিখে প্রকাশিত রিপোর্টটি একেবারেই অনিচ্ছাকৃত ও অসতর্কতার জন্যই প্রকাশিত হয়েছে। এজন্য অভ্যন্তরীনভাবে কে বা কারা দায়ী, তাদের দায় নিরুপণ করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এ প্রেক্ষিতে আমরা গত ১৮ আগস্ট, ২০১৪ দৈনিক ইনকিলাবের সকল সংস্করণে উল্লেখিত শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদটি এবং এর সাথে সম্পর্কিত প্রকাশিত সকল রিপোর্ট ও মন্তব্য নিঃশর্তভাবে প্রত্যাহার করছি। আমাদের প্রত্যাশা, এর মাধ্যমে সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটবে। ইনকিলাব কর্তৃপক্ষ সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করে।

–সম্পাদক

দৈনিক ইনকিলাব

এখানে আমোদজনক বিষয়টি হল, আগের দিন ২৩ আগস্ট 'মরদে মোমিন' বাহাউদ্দিন 'এ কেমন আচরণ' শিরোনামের এক প্রকাণ্ড আবর্জনায় তার গর্জন অব্যাহত রাখে। কিন্তু মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাহাউদ্দিনের অবস্থা দাঁড়ায় মুক্তিবাহিনীর সামনে যেমন মাথানত করেছিল তার আব্বা হুজুর আবদুল মান্নান মাওলানা। আমরা সকলেই জানি এই আবদুল মান্নান মাওলানা বোরকা পরে পালিয়েছিল ১৯৭১ এর ডিসেম্বরে, তার 'জান' বাঁচাতে।

এখানে আরও লক্ষ্য করার বিষয়টি হচ্ছে, 'মরদে মোমিন' বাহাউদ্দিন ২১ আগস্টের 'কেন এই প্রলয়কাণ্ড' নামের আবর্জনার শুরুতেই কাল মোটা হরফে তার নাম 'এ এম এম বাহাউদ্দিন' লিখেছে; কিন্তু তার আত্মসমর্পণের দলিলে শুধু 'সম্পাদক, দৈনিক ইনকিলাব' লিখেছে। এছাড়া ২১ তারিখের আবর্জনাটি ছিল তিন কলামের শিরোনামে, আত্মসমর্পণের দলিলটি দুই কলামের।

তারপর, আত্মসমর্পণ এবং নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনার পরও এই বাহাউদ্দিন তার আবর্জনানামায় তার ইনকিলাবের বার্তা সম্পাদক রবিউল্লাহ রবি এবং অন্যান্য জুনিয়র 'মরদে মোমিন'দের সততা, দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট হিসাবে অলিগলি এবং সাইনবোর্ড সর্বস্ব কিছু এতিম সর্বহারা লোকজনের বক্তৃতা বিবৃতি ছাপাচ্ছে। মানে, সর্দার বাহাউদ্দিন, আসলেই আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। যদি আন্তরিকভাবেই ক্ষমা প্রার্থনা করবে, তাহলে আবার নির্দোষ প্রমাণের অপচেষ্টা অব্যাহত থাকে কেন?

এখানে উল্লেখ করা জরুরি যে, মাত্র আট মাস আগে গত ১৬ জানুয়ারির রাতেও ইনকিলাব ভবনে অভিযান চালিয়েছিল পুলিশ। তখনও এই রবিউল্লাহ রবি এবং আরও ক'জন সাংবাদিককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। তখন এই 'মাফকিলাব'-এর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ ছিল, বাংলাদেশের তাবৎ মৌলবাদীদের ইনকিলাব নামের এই সংগঠন, সাতক্ষীরায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আমাদের নিরাপত্তার বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সৈন্য সামন্তও অংশগ্রহণ করেছিল বলে খবর ছাপে। ইনকিলাবের প্রেসও তখন পুলিশ সিলগলা করে দিয়েছিল। তখনও 'মাফকিলাব'-এর এই বাহাউদ্দিন নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে পার পেয়েছিল।

দুই

এই 'মাফকিলাব' ১৯৮৫-তে তার অপজন্মের পর কতবার নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা করেছে তার একটি অসম্পূর্ণ তালিকা নিচে দিচ্ছি–


আমরা দুঃখিত

গতকাল (৩১ অক্টোবর, বুধবার) দৈনিক ইনকিলাবের ব্যানার হেডলাইনের 'উগ্রপন্থী হিন্দুরা অযোধ্যায় বাবরী মসজিদ ভেঙ্গেছে' শীর্ষক সংবাদ 'আমরা মর্মাহত' শীর্ষক প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত বিশেষ সম্পাদকীয়তে যে তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমরা এগুলো প্রকাশের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। এই ছাড়া ফোল্ডের নীচে আল্লাহর ঘরে হামলার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার আহ্বান শিরোনাম এবং এ সম্পর্কিত বিবৃতি প্রকাশের জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। ভবিষ্যতে সংবাদ প্রকাশনায় সতর্কতা অবলম্বনের নিশ্চয়তা দেয়া হল।

— সম্পাদক

নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা ছিল প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম দুই কলামের শীর্ষে বক্স আইটেম।

১৯৯০ এর ১ নভেম্বর সরদার বাহাউদ্দিনের এই নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা ও আত্মসমর্পণের পর তখনকার প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদ এই ইনকিলাব বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। তখন শুনেছিলাম ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা-মালিক 'সিনিয়র মরদে মোমিন' আবদুল মান্নান মাওলানা এবং এই বাহাউদ্দিন জেনারেল এরশাদের পায়েও পড়েছিলেন এবং তাতেই কোমল হৃদয়ের এরশাদের 'দিল'ও নরম হয়ে যায়।

কিন্তু নাম মাত্র দুই বছর পর শফিক রেহমান সম্পাদিত সাপ্তাহিক 'যায় যায় দিন' এর ২০ অক্টোবর, ১৯৯২ তারিখ বিশিষ্ট সংখ্যায় 'বাগদাদের গিলাফ ইনকিলাবের বিকার, বি. চৌধুরীর বিলাপ' শিরোনামে দুই পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এই রিপোর্টের দ্বিতীয় কিন্তু দীর্ঘতর অংশের শিরোনাম ছিল 'বিকারগ্রস্ত ইনকিলাব ও ক্ষমা প্রার্থনার প্রহসন'। এখন এই দ্বিতীয় অংশটি নিচে উদ্ধৃত করছি–

বিকারগ্রস্ত ইনকিলাব ও ক্ষমা প্রার্থনার প্রহসন

ইনকিলাব প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো মিথ্যা, বিকৃত ও উস্কানিমূলক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ পরিবেশন করে থাকে। তার মাত্র ক'টি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।

১. এরশাদের শাসনকালে মওলানা মান্নান তারই তৎকালীন সহকর্মী মন্ত্রী জিয়াউদ্দিন বাবুলকে জড়িয়ে কাস্টমস সংক্রান্ত একটি খবর প্রকাশ করে। পরে এ জন্য ক্ষমা চায় এবং বাবুল মানহানি মামলা করলে আদালতে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে সমঝোতায় পৌঁছে সে মামলা প্রত্যাহার করে নেয়।

২. তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী আনোয়ার জাহিদের নাম 'জানোয়ার জাহিদ' ছেপে পরদিন ক্ষমা চেয়ে সংশোধনীতে ইচ্ছাকৃত আবারো 'জানোয়ার জাহিদ' ছেপে নিজেদের চরিত্রকে চিহ্নিত করে।

৩. '৯০ এর অক্টোবরে বিরোধী দলের গণআন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভারতের বাবরী মসজিদকে কেন্দ্র করে সুপরিকল্পিতভাবে পত্রিকাটির প্রথম পাতায় চরম উস্কানিমূলক এক বিশেষ সম্পাদকীয় ছাপা হয়। যার জের হিসেবে ৩০ ও ৩১ অক্টোবর ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। তৎকালীন সরকার এজন্য পত্রিকাটির প্রকাশনা ১৫ দিনের জন্য স্থগিত করলেও রহস্যজনক কারণে একদিন পরই 'ক্ষমা চেয়ে' ইনকিলাব যথারীতি প্রকাশিত হতে থাকে।

৪. মনু নদীর বাঁধ ভেঙে মৌলভীবাজার শহর প্লাবিত শীর্ষক একটি সম্পূর্ণ বানোয়াট সংবাদ প্রকাশ করা হয়।

৫. একবার বাংলাদেশের মানচিত্রকে আংশিক বাদ দিয়ে বিকৃত করে ছেপে বিতর্ক সৃষ্টি করে নিন্দিত হয় এবং পরে ক্ষমা প্রার্থনা করে।

৬. নব্বইয়ের জুনে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যান। আর সেই সুযোগে পত্রিকাটির প্রথম পাতায় দৃষ্টি আকর্ষণ করে রিপোর্ট করা হয় 'সিঙ্গাপুর ষড়যন্ত্র'। পরদিন তারা যথারীতি তাদের কৌশল মোতাবেক সংবাদটি ভিত্তিহীন বলে দুঃখ প্রকাশ করে। টেলিফোনে তোফায়েল আহমদ, মোহম্মদ নাসিম প্রমুখের কাছে মান্নান ক্ষমাও প্রার্থনা করেন বলে জানা যায়। কিন্তু তারা তাতে শান্ত না হয়ে প্রকাশ্যে সকল পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য উকিলের নোটিশ প্রদান করেন। এ অবস্থায় সাংবাদিক ইউনিয়নের সহায়তা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে পত্রিকার মাধ্যমে শেখ হাসিনার কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

৭. শুধু জাতীয় পার্টি কিংবা আওয়ামী লীগকেই আক্রমণ করে ইনকিলাব ক্ষান্ত হয়নি। তারা বিএনপি'র নুন খেয়ে বিএনপি'রই পাতে মল ত্যাগ করছে। কখনো বিএনপির মহাসচিব আবদুস সালাম তালুকদার কিংবা কখনো জাতীয় সংসদের স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী অথবা চিফ হুইপ খন্দকার দেলওয়ার হোসেন, প্রমুখ সম্পর্কে উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করেছে।

৮. ইনকিলাবের কলমের আক্রমণ থেকে যেমন এদেশের শিল্পী বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিবিদরা রেহাই পাননি, তেমনি তাদের শ্রমিকরাও তাদের নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি। শ্রমিকরা দাবি-দাওয়া পেশ করায় তাদের একাংশ হামলার লক্ষ্য হয়। এর ফলে ৫ সেপ্টেম্বর ৯১ তে বিশজন আহত হয়। নিহত শ্রমিক তাহেরের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলনের অপরাধেই প্রাণ দিতে হয় তাহেরকে।

৯. পত্রিকাটি প্রায় নিয়মিতভাবেই এদেশের প্রগতিশীল ব্যক্তিদের, নির্বিরোধ এবং সম্মানিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে কুৎসা প্রচার করে থাকে। বিদ্বেষ উস্কে দেয়া এই পত্রিকার একটি প্রিয় কাজ।

১০. দৈনিকটি প্রায়ই ভিত্তিহীন খবর পরিবেশন করে ভারতবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকাটি কোনো না কোনোভাবে ভারতবিরোধী সংবাদ ছেপে থাকে। কিছু না পেলে নিজেরাই 'ভারতবিরোধী সংবাদ' তৈরি করে নেয়। তার একটি নমুনা উদ্ধৃত করা যাক। ৬ এপ্রিল, '৯২ সংখ্যায় খন্দকার হাসনাত করিম এক অবাক রিপোর্ট লিখলেন: 'ভারতীয় ডাকটিকিটে 'জয় বাংলা': আগ্রাসন থেকে সাবধান।' পুরো রিপোর্টটি ছাপানো নিষ্প্রয়োজন। কারণ সংবাদ শিরোনাম থেকেই ভেতরের ভাষা ও বিষয় অনুমেয় হয়ে ওঠে।

ভারত বাংলাদেশের স্মরণে ও সৌহার্দে ২০ পয়সার একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করার মধ্যেও তারা আগ্রাসনের ঘ্রাণ পান।

তাহলে প্রশ্ন, বাংলাদেশের ডাক টিকিটে বহু দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের ছবি রয়েছে। এমনকি ফিলিপাইন, কুয়েত, পাকিস্তানের পতাকা সস্বলিত বাংলাদেশের ডাক টিকিট বেরিয়েছে। তাহলে কি ধরে নিতে হবে, এখানেও আগ্রাসন কাজ করছে? আফ্রিকার একটি দেশ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপর একবার একটি সুদৃশ্য ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিল। তাতে 'জয় হিন্দ' শব্দটিও মুদ্রিত হয়েছিল। তাহলে কি প্রমাণ হয় যে, সেই দেশটিকেও ভারত গ্রাস করতে যাচ্ছে।

এভাবেই পত্রিকাটি সর্বশেষ যাকে ক্রোধান্বিত করেছে তিনি হচ্ছেন ডা. বি. চৌধুরী। গৌরীপুরের উপ-নির্বাচনের প্রাক্কালে এক সভায় প্রদত্ত ডা. চৌধুরীর বক্তব্য ইনকিলাব বিকৃত করে প্রকাশ করেছে। বি. চৌধুরী নাকি বলেছেন: 'কোনো কোনো দল ভারতকে উস্কানি দিচ্ছে' তারপর 'নৌকায় ভোট দিলে নজরুল ইসলামকে জীবিত করা যাবে না' ইত্যাদি।

সংসদের উপনেতা ইনকিলাবের এই সংবাদের তীব্য প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে ডেপুটি স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, এ ধরনের রিপোর্ট কদর্য ও কুরুচিপূর্ণ এবং মিথ্যাচার।

৭০,৫৮,১৬৫ টাকার বিজ্ঞাপন

অথচ তীব্র আওয়ামী লীগবিরোধী ভূমিকার কারণে পত্রিকাটি বিএনপির অনুকূল্য পেয়ে আসছে। বর্তমান সরকারও যথার্থ 'অনুদান' প্রদানে কার্পণ্য করছে না। সংসদে তথ্যমন্ত্রী তথ্য দিয়েছেন ইনকিলাবকেই সরকারি বিজ্ঞাপনের সর্বোচ্চ অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। গত অর্থ বছরে ৭০ লাখ ৫৮ হাজার ১৬৫ টাকার বিজ্ঞাপন পেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেছে ইনকিলাব।

একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার একটি রিপোর্টে বলা হয়: 'বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর মওলানা মান্নান ও তার ছেলেরা আশা করেছিলেন বিএনপি তাদের বেশি করে খাতির করবে। … বিএনপির সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ মওলানা মান্নান ও তার ছেলেকে প্রথমে সংসদ সদস্য ও পরে মন্ত্রী করার আশ্বাস দিয়ে চাঁদা আদায় করেছে। … কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি পড়েছে। ফলে ইনকিলাব বিএনপির প্রতি বেশ ক্ষুব্ধ কিন্তু কোনো উপায় নেই। কারণ, মাওলানা মান্নানের নামে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা রয়েছে। মাওলানা মান্নান ১৯৮৮ সালের ১৪ জুন এরশাদের মন্ত্রিসভা থেকে মন্ত্রিত্ব হারান। তার বিরুদ্ধে বহু দুর্নীতি অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মহাখালিস্থ মাদ্রাসা সমিতির নামে অবৈধভাবে ৬ হাজার টন গম এবং বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ দেখিয়ে ৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ, ত্রাণমন্ত্রী থাকালীন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তের জন্য বিদেশ থেকে প্রাপ্ত সাহায্য ও ত্রাণসামগ্রী আত্মসাৎ প্রভৃতি। এজন্য তার পাসপোর্ট আটক করা হয়।

এখানে উল্লেখ, বিএনপি সরকার স্বৈরাচার আমলের প্রায় সকল মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও একমাত্র মান্নানকেই রহস্যজনকভাবে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হয়নি। কারণ হয়তো এরা পরস্পরের কাছে কৃতজ্ঞ। যদিও মাঝে মধ্যে 'ফাউল' করে ইনকিলাব 'লাল-হলুদ' কার্ড পায়, যা তাদের কাছে পান্তা ভাত মাত্র।

এখন, বিএনপি নেতা ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী এই বিকারগ্রস্ত দৈনিকটি সম্পর্কে বিলাপ না করে প্রশ্ন করতে পারেন, উস্কানি ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালানোর অভিযোগে পত্রিকাটিকে শাস্তি না দিয়ে আর কতদিন সরকারি বিজ্ঞাপন দিয়ে পুরস্কৃত করা হবে? বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ এবং সংবাদপত্রের দায়িত্বশীলতা নিয়ে সরকারি কর্তা ব্যক্তিরা যখন উচ্চকণ্ঠ তখন কী করে একটি পত্রিকা ক্রমাগত দায়িত্বহীন আচরণ করে যেতে পারছে এবং বারবার ক্ষমা আদায় করে নিতে পারছে?

তিন

এখন ২০০৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার দৈনিক মাফকিলাব-এ তখনকার 'দিনকাল সম্পাদক কাজী সিরাজ প্রকাশক তারেক রহমানকে উকিল নোটিশ' শিরোনামে প্রকাশিত অব্যাখ্যায়িত খবরটি নিচে উদ্ধৃত করছি–


দিনকাল সম্পাদক কাজী সিরাজ প্রকাশক তারেক রহমানকে উকিল নোটিশ

— স্টাফ রিপোর্টার

দৈনিক ইনকিলাব এবং এর সম্পাদক, প্রকাশক জনাব এ এম এম বাহাউদ্দীনকে জড়িয়ে সংবাদের নামে কল্প-কাহিনী ও কুৎসা রটানোয় দৈনিক দিনকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কাজী সিরাজ উদ্দিন আহমেদ এবং প্রকাশক তারেক রহমানের নামে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। ইনকিলাব সম্পাদকের পক্ষে এডভোকেট সৈয়দ আহমেদ গাজী গতকাল (বৃহস্পতিবার) এ নোটিশ পাঠান। নোটিশে এডভোকেট সৈয়দ আহমেদ গাজী উল্লেখ করেন, দৈনিক দিনকালের প্রথম পাতায় গত ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারী ছবিসহ প্রকাশিত সংবাদে আমার মক্কেলকে জড়িয়ে মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট, কাল্পনিক ও সাজানো তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকাশিত সংবাদে সত্যের লেশমাত্র নেই। প্রকাশিত সংবাদের প্রতিটি বক্তব্য কাল্পনিক, প্রতিটি বক্তব্য আমার মক্কেল দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। প্রকাশিত সংবাদ অপসাংবাদিকতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আমার মক্কেল শিক্ষাজীবন শেষে দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক হিসাবে অত্যন্ত নিষ্ঠা, দক্ষতা ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে আসছেন। দৈনিক ইনকিলাব প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শুধু দেশ ও জনগণের পক্সে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করছে। তারই ফলশ্রুতিতে একটি গোষ্ঠীর গাত্রদাহ হয়েছে। এরই জের হিসাবে মিথ্যা, ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশ করে আমার মক্কেল তথা দৈনিক ইনকিলাবের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে এবং ইনকিলাবকে পারিবারিকভাবে, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মান-সম্মান ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। অন্যদিকে আর্থিকভাবে অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করা হয়েছে।

উকিল নোটিশে দৈনিক দিনকাল সম্পাদক প্রকাশককে নোটিশ প্রাপ্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে প্রকাশিত সংবাদের স্থানে প্রতিবাদলিপি ছাপাতে বলা হয়েছে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে মানহানি মামলাসহ ক্ষতিপূরণ মামলা দায়ের করা হবে।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আবদুল মান্নান মাওলানা, তার এক নম্বর আওলাদ এই বাহাউদ্দিন এবং তাদের ইনকিলাবী শাগরেদরা বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুুল মান্নান ভূইয়া এবং বিএনপির মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের একদম সহ্য করতে পারত না। ১৯৯৮ এর ৯ নভেম্বর ইনকিলাবে প্রকাশিত এমন একটি আবর্জনার শিরোনাম ছিল 'সন্দেহের চোরাবালিতে বিএনপি মহাসচিব'। এই আবর্জনার রচয়িতা ছিল কোনো এক আবু সালেহ খান। মান্নান ভূইয়া এবং বিএনপির বামপন্থী গ্রুপের বিরুদ্ধে সরদার বাহাউদ্দিনদের অব্যাহত জেহাদের ব্যাকগ্রাউন্ডে ২০০০ সালের ৭ এপ্রিল, শুক্রবার বিএনপির জাতীয় কমিটির সদস্য এবং অঙ্গ সংগঠনগুলোর সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকদের এক বৈঠকে ইনকিলাব নামের এই আবর্জনানামার বিরুদ্ধে একটি নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এই তথ্যটি যাওয়া যাবে ২০০০ এর ১০ এপ্রিল, সোমবার ইনকিলাবে, 'দলের অভ্যন্তরে তিনটি নজিরবিহীন ঘটনায় বিএনপির সহকর্মীদের মধ্যে তোলপাড়' শিরোনামের খবরে।

বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এই জেহাদের প্রতিক্রিয়ায় ইনকিলাবী দুূর্বৃত্তদের লক্ষ্য করে বিএনপির দলীয় পত্রিকা দৈনিক দিনকাল-এ 'এই জাতীয়তাবাদী ধ্রুবতারাগণ বিএনপির এসেট না লায়াবিলিটিজ' শিরোনামের মস্তবড় একটি সংবাদভাষ্যে জবাব দেন জনৈক 'রাজনৈতিক ভাষ্যকার'।

এই ইনকিলাব নামক জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠনটিকে শুধু যে বিএনপি নিন্দা, ঘৃণা জানিয়েছে তা নয়; মৌলবাদীদের এই প্লাটফরমটিকে নিন্দা জানিয়েছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি সিনেট এবং ১৯৯৬ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বাংলা একাডেমী বার্ষিক সাধারণ সভাও।

চার

তবে ইনকিলাব প্রশ্নে আওয়ামীদের অবস্থান কী তা একেবারে পরিস্কার নয়। বঙ্গবন্ধুকে ইনকিলাবী দুর্বৃত্তরা কোটেশনে 'বঙ্গবন্ধু' লিখে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ইনকিলাবীরা 'আগস্ট বিপ্লবের মহানায়ক' হিসাবে বর্ণনা করে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড প্রদানকারী সেশন জজ কাজী গোলাম রসুলকে দিনের পর দিন ইনকিলাবীরা আক্রমণ করেছে, তার চরিত্র হননও চালিয়েছে সপ্তাহের পর সপ্তাহ, শেখ হাসিনা এবং আই কে গুজরালকে নিয়ে নোংরা অশ্লীল কার্টুন ছেপেছে, বাহাউদ্দিনরা আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের প্যারোডিও ছাপে এবং যখন এই অপরাধে বাহাউদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা হয় তখন ২০০০ সালের ১৪ নভেম্বর মধ্যরাতে হাইকোর্টে বিশেষ অধিবেশন বসিয়ে তাকে জামিনও দেওয়া হয়। ইনকিলাবীদের অপকর্মের শত শত উদাহরণ দিন তারিখসহ উল্লেখ করার মতো হাজার হাজার ক্লিপিং আমার সংগ্রহে আছে।

'ইনকিলাবের অপসাংবাদিকতা' নামের ২৩২ পৃষ্ঠার একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৫ এর ফেব্রুয়ারিতে, সম্পাদনা করেছিলেন সাপ্তাহিক বাংলা বার্তা সম্পাদক মোহাম্মদ শাজাহান। এই প্রজেক্টের সঙ্গে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত কাস্টম কর্মকর্তা মিলন দত্ত, 'দৈনিক ঢাকা' পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ ইউনুস, 'দৈনিক প্রথম আলো'র এখন সহযোগী সম্পাদক সোহরাব হাসান, শিপিং ব্যবসায়ী তাজুল ইসলাম, ঝিনাইদহের তখনকার এক ছাত্রনেতা অশোক ধর, সাপ্তাহিক 'আজকের সূর্যোদয়' পত্রিকার প্রধান সম্পাদক খন্দকার মোজাম্মেল হক, তরুণ সাহিত্যিক এবং এখন বাংলা একাডেমীতে কর্মরত মনির হায়দার এবং কানাডা-প্রবাসী তরুণ কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এবং আরও দশ-বার জন। এই বইতে লেখা দিয়েছিলেন কবি শামসুর রাহমান, প্রফেসর কবীর চৌধুরী, সংবাদ সম্পাদক মরহুম বজলুর রহমান, প্রফেসর মুনতাসীর মামুন, আনিসুল হক, নাসির আহমেদসহ আরও প্রায় ২০ জন। ইনকিলাবকে বর্জন করার আহবান জানিয়ে ১৯৯৭ এর ১৩ এপ্রিল বিবৃতি দিয়েছিলেন কবি সুফিয়া কামাল, প্রফেসর শওকত ওসমান, প্রফেসর কবীর চৌধুরী এবং কবি শামসুর রাহমান। লক্ষ্য করুন যে, এরা সকলেই দেশের সর্বোচ্চ সিভিলিয়ান পুরস্কার 'স্বাধীনতা পুরস্কারে' ভূষিত দেশের চার বাতিঘর ছিলেন।

কিন্তু ইনকিলাবের এমন সব বাংলাদেশবিরোধী, বাংলাবিরোধী এবং বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী ভূমিকা সত্ত্বেও ইনকিলাব, বাহাউদ্দিন এবং ইনকিলাবী দুর্বৃত্তদের রক্ষা করেই চলেছে বাংলাদেশের আওয়ামীদের বড় একটি অংশ। এই সিরিজের সর্বসাম্প্রতিক দুর্বলতার উদাহরণ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান নিউইয়র্ক সফরেও দুই দুজন ইনকিলাবী সাংবাদিক সঙ্গে গিয়েছেন।

প্রলয় জোয়ারদারের সর্বসাম্প্রতিক মামলায় এর ইনকিলাব ভবনে চালানো অভিযানের নিন্দা জানাতে এবং বাহাউদ্দিনদের সঙ্গে সহমর্মিতা জানাতে ২২ আগস্ট ইনকিলাব ভবনে যায় আওয়ামীপন্থী ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দল। পরদিন, ২৩ আগস্ট ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্ঠায় ইনকিলাব ভবনে এই সফরের ওপর এই খবরটি ছিল– 'ইনকিলাব ভবন পরিদর্শনে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ, কর্মরত অবস্থায় সাংবাদিক গ্রেফতার স্বাধীন সাংবাদিকতা নগ্ন হস্তক্ষেপ, ভীতি ছড়াতে আর একদিনও যেন এই ভবনে পুলিশ না আসে।' সঙ্গে ছিল ইনকিলাবী দুর্বৃত্তদের সঙ্গে আওয়ামী সাংবাদিক নেতাদের দুই কলামের একটি ছবিও!!

এখন অতিপ্রাসঙ্গিক এবং সঙ্গত একটি প্রশ্ন এই আওয়ামী সাংবাদিক নেতাদের করতেই পারি। বাহাউদ্দিন তো ২৪ আগস্ট তার 'মাফকিলাব'এ প্রকাশিত আত্মসমর্পণ দলিলে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করল। এখন কি আপনারা, আওয়ামী সাংবাদিক নেতারা যারা ইনকিলাব ভবনে সহমর্মিতা প্রকাশ করতে গিয়েছিলেন, আপনার কি নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করবেন অপরাধীর পক্ষ নেওয়ার কারণে? অপরাধ করেছে বলেই তো নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করল বাহাউদ্দিন।

আমি একই প্রশ্ন করেছি 'সম্পাদক পরিষদ'-এর সভাপতি 'দৈনিক সমকাল'-এর সম্পাদক গোলাম সরোয়ারকেও। গোলাম সরোয়ারও সম্পাদক পরিষদের পক্ষে ইনকিলাব ভবনে পরিচালিত অভিযানের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন রোববার, ২০ আগস্ট। তো বাহাউদ্দিন যে ২৪ তারিখে নিঃশর্ত মাফ চাইল, এখন তো গোলাম সরোয়ারদেরও নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া উচিত।

এই ঘটনা থেকে আমি প্রায় নিশ্চিত হয়েছি আমাদের অনেক নেতা-মন্ত্রীরা যেমন লেখাপড়া করেন না, লেখাপড়া করেন না আমাদের অনেক সম্পাদক-সাংবাদিকও। লেখাপড়াই যদি করতেন, তাহলে ইনকিলাবের চরিত্র, অতীত রেকর্ড, এই সাংবাদিক নেতা এবং সম্পাদকদের অ-জানা থাকে কী করে। নাকি বিজিএমইএ যেমন তাজরিন গার্মেন্টসের মালিক এবং তোবা গ্রুপের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের পাশে দাঁড়িয়েছে, এখানে সম্পাদক পরিষদও কি তাই করেছে? অভিযুক্ত এবং অপরাধী হলেও কি তাকে সমর্থন করতে হবে? তাহলে সম্পাদক বলে বড়াই করেন কেন?

তবুও আলহামদুলিল্লাহ! বাহাউদ্দিনের পক্ষ নিয়ে তারা বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছেন, ইনকিলাব ভবন পরিদর্শন করে সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন, কিন্তও এখনও এমন কিছু তারা করেননি আলহাজ্জ্ব মিজানুুর রহমানের পক্ষে। এই বান্দাও 'দৈনিক বর্তমান' নামের বছর খানেকের পুরনো একটি পত্রিকার মালিক এবং সম্পাদক। তিনি মাস দুয়েক আগে অস্ত্র আইনে গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে আছেন। আমার কাছে 'দৈনিক বর্তমান'-এ ২০১৩ এর ১৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি ছবি আছে। প্রায় আড়াই লাখ টাকা মাসিক বেতনে ভাড়া-করা 'দৈনিক বর্তমান'-এর তখনকার সম্পাদক সাহিত্যিক রাহাত খান ফুলের তোড়া উপহার দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছেন এই আলহাজ্জ্ব মিজানুর রহমানকে!! উপলক্ষ, আলহাজ্ব মিজানুর রহমান বরগুনা জেলার শ্রেষ্ঠ করদাতা হিসাবে সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন কয়েকদিন আগে।

হাল জমানার কিছু সম্পাদক এবং সাংবাদিকের 'কোয়ালিটি', গুণগতমান কোথায় নেমেছে সে সম্পর্কে আর কিছু কী বলার দরকার আছে?

মহিউদ্দিন আহমেদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক।