নারী পুরুষের সমান মজুরি: এখনও সুদূরপরাহত

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 24 Sept 2014, 07:52 PM
Updated : 24 Sept 2014, 07:52 PM

বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের অনুরূপ বাংলাদেশেও নারী পুরুষের কাজের সমান মুল্যায়ন করা হয় না। গৃহস্থালির কাজে বা সংসারের দৈনন্দিন রক্ষণাবেক্ষণে, পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পরিবারের পরিচালনা, ছোট কী বড় সকল সংসারের এ সকল কাজ প্রচুর। কিন্তু এসবের মুল্যায়ন করা হয় না সঠিক ও সমানভাবে। এভাবে মহিলাদের কাজের পরিধি ব্যাপক ও শ্রমসাধ্য। গৃহকর্মে সহায়তার জন্যে সহযোগী থাকলেও গৃহ পরিচালনাকারীকে অনেক শ্রম ও সময় দিতে হয়।

বাস্তবে দেখা যায়, এত কিছুর পরও পরিবারের লোকজন তার সঠিক মূল্যায়ন করছে না। অথচ পরিবারকে ভালোবেসে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন গৃহবধু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত বলেছেন, এ হচ্ছে 'ভালোবাসার অর্থনীতি'! এমন অর্থনীতিকে সঠিকভাবে সমান মাপকাঠিতে পরিমাপ করা হচ্ছে সময়ের দাবি।

অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য সেন্টার ফর জেন্ডার অ্যান্ড সোসাল ট্রানসফরমেশন, ইউরোপিয়ান কমিশনের সহযোগিতায় একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিল। গবেষণার বিষয় ছিল, 'উত্তরবঙ্গের গ্রামীণ প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিভিন্ন কাজের সময় ব্যয় করার ধরন'। গবেষণার ফলাফল নিয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ আলোচনাকালে উল্লেখ করা হয় যে, "নারী মোট কর্মঘণ্টার প্রায় সাত ঘণ্টা অমূল্যায়িত সেবামূলক কাজে ব্যয় করেন। পুরুষদের ক্ষেত্রে তা মাত্র এক ঘণ্টা। অথচ নারীদের এসব কাজের স্বীকৃতি পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্র দিচ্ছে না। অন্যদিকে এ ধরনের কাজে অতিরিক্ত চাপের কারণে নারীরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, যা নারীর ক্ষমতায়নের প্রতিবন্ধক।"

পরিবারকে ভালোবেসে যে সময় ও শ্রম মা-বোনেরা দিচ্ছেন, তার সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের অবসর নেই, আনন্দ উপভোগের সময় পর্যন্ত নেই। এমনকি পারিবারিক কাজগুলো সঠিকভাবে হচ্ছে না বলে কখনও কখনও বাড়ির কর্তা বা শাশুড়ি গালমন্দও করতে পারেন তাকে। কিন্তু তার কথা শোনার লোক নেই, তার কাজের মূল্যায়ন তো সুদূরপরাহত।

এরই নাম হচ্ছে বৈষম্যমূলক আচরণ যে বিষয়ে আমাদের সংবিধান সোচ্চার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ (২) নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, "রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।" অর্থ হচ্ছে, নারী তাদের কাজের সমান মজুরি পাবেন এবং সমান মাপকাঠিতে তাদের কাজের মূল্যায়ন করা হবে, কিন্তু বৈষম্য প্রায় সকল ক্ষেত্রে দৃশ্যমান।

১৯৯৪ সালে কায়রোতে অনুষ্ঠিত জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ক আর্ন্তজাতিক সম্মেলনের ঘোষনাপত্রে নারী পুরুষের সমকক্ষতা, সমদর্শিতা এবং নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে চতুর্থ অধ্যায়ে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সকল দেশের সরকারকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়ার আহবান জানানো হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে পুরুষের সহযোগিতা প্রদানের বিষয়টিও বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ এ সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে এ ক্ষেত্রে আরও অধিক অগ্রসর হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে সকলের অভিমত। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) কর্তৃক পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, কয়েকটি দেশে মহিলারা পুরুষদের তুলনায় মাত্র ৫০ শতাংশ উর্পাজন করে। এ সকল দেশের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বেনিন, বাংলাদেশ, সিয়েরা লিয়েন, ইকুউটেরিয়েল গিনি, ক্যপে ভারডে, টোগো, ইরিত্রিয়া এবং ইয়েমেন। এ দেশসমূহের নামের পাশে বাংলাদেশের মতো দেশের নাম অবস্থান করছে যা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক।

ইউএনডিপি-এর রির্পোটে আরও উল্লেখ করা হয়–

It is important to understand that when you are living in a culture where it is accepted that women make significantly less money then men for the same job, it can be more difficult to secure a well –paying job.

বিশ্বের প্রথম শ্রেণির ১০ দেশ হচ্ছে আইসল্যান্ড, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, জাপান, নেদারল্যান্ড এবং ফ্রান্স যেখানে গড় আয়ু, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি এবং জীবনযাত্রার মানের বিবেচনায় মেয়েরা পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের এখানে কীভাবে সমান মজুরি প্রদানের সংস্কৃতি বা পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়।

অনেকে মনে করেন– আইন করে দিতে হবে, বৈষম্যসৃষ্টিকারী এবং বঞ্চনাকারীকে শাস্তি পেতে হবে। যেমন বাংলাদেশে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে আইন করা হয়েছে, দু' বছর জেলে যাওয়ার নিয়ম হয়েছে এবং বিয়ের বয়স কমানো হয়েছে। কিন্তু তাতে কি গৌরীদান বন্ধ করা যাবে, বখাটেদের উৎপাত থেকে কন্যাশিশুকে রক্ষা করা যাবে এবং দারিদ্র নিরসনের লোভে অপ্রাপ্তবয়ষ্ক কন্যাকে বিয়ে দেওয়া থেকে বিরত করা সম্ভব হবে?

তাহলে কীভাবে এমন অপসংস্কৃতি এবং আর্থ-সামাজিক প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া যাবে, যেখানে মেয়েরা সমান পরিশ্রম করে এবং সমান উৎপাদন নিশ্চিত করেও সমান মজুরি পাবে অথবা তাদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন হবে। এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। ভাবনার শেষ নেই, কিন্তু প্রয়োগধর্মী উপায় ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করা জটিল। দেশ-কাল- স্থান- পাত্র সবই একসঙ্গে গাথা। সবই বিবেচনায় আনতে হবে একসঙ্গে।

এ প্রসঙ্গে মি. নিকোলাস ক্রিসটপ এবং সিরিল ইডুংগ দম্পতির বিশ্বজোড়া সুনাম অর্জন করা বই-এর কথা উল্লেখ করছি। বইটির নাম Half the Sky: Turning the Oppression into Opportunity for women Worldwide– বইটির জন্য লেখকরা অনেক পুরস্কার পয়েছেন। সেখানে তারা তিনটি বিষয় বিশেষভাবে ঊল্লেখ করেছেন–

১. মেয়েদেরকে চটপটে বা বুদ্ধিমতি হতে হবে (Make the girls smarter);

২. মেয়েদেরকে বাণিজ্যে সহযোগিতা করতে হবে (Support a woman in business);

৩. মেয়েদের পাঠশালায় পাঠাতে হবে (Keep a girl in school)।

এমন নিয়ম মানলে, তারা তাদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন দাবি করতে পারবে। সবার উপরে বলা প্রয়োজন, আমাদের মতো দেশে সরকারের সহযোগিতা এবং অর্থবহ কর্মপন্থা হচ্ছে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ও বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ।

ধীরাজ কুমার নাথ: সাবেক সচিব।