জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ, ব্যথা-বেদনার কিছু কথা

মহিউদ্দিন আহমদ
Published : 16 Sept 2014, 06:41 PM
Updated : 16 Sept 2014, 06:41 PM

শুধুমাত্র তিনটি বাক্যের চিঠিটি। কিন্তু ঐতিহাসিক চিঠি। তিরিশ লাখ শহীদের রক্ত, সাড়ে সাত কোাটি বাঙালির হাসি, কান্না, ব্যথা, বেদনা, আনন্দ, ত্যাগ-তিতীক্ষার স্মৃতি, অভিজ্ঞতা জড়িত আছে এ চিঠিতে। স্বাধীনতা উত্তর বিশ বছরের কূটনৈতিক জীবনে চিঠিটি আগে কোনোদিন দেখিনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনেক খুঁজেছি। নিউইয়র্কের বাংলাদেশ মিশনেও দেখেছি। কোথাও নেই। তবে চিঠিটার বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত ছিলাম।

নিউইয়র্কের বাংলাদেশ মিশনে কাজ করার সময় একদিন জাতিসংঘের হ্যামার-শোল্ড লাইব্রেরিতে ১৯৭১এর ডিসেম্বরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মুহূর্তে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের ওপর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এবং নিরাপত্তা পরিষদে যে বিতর্ক হয় এবং তার আট মাস পর বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তিতে যে অপ্রত্যাশিত বাধার সম্মুখীন হতে হয় তার বিবরণ পড়তে গিয়ে চিঠিটি বিরাট এক রক্তাক্ত ইতিহাসের কথা আবার স্মরণ করিয়ে দিল। চিঠিটি এই রকম ছিল:

I have the honour, on behalf of the Government of the People's Republic of Bangladesh, to submit this application of the People's Republic of Bangladesh for membership of the United Nations.

I declare that the People's Republic of Bangladesh accepts the obligations contained in the Charter of the United Nations and that it solemnly undertakes to fulfil those obligations.

I should be grateful if this application could be placed before the Security Council immediately, and other appropriate actions taken in this regard.

M. Abdus Samad Azad

Minister for Foreign Affairs of the People's Republic of Bangladesh

স্বাধীন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুস সামাদ আজাদ এই চিঠিটি ১৯৭২ সালে ড. কুর্ট ওয়াল্ড হেইমকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন। জাতিসংঘের চার্টারে আছে, যে কোনো শান্তিপ্রিয় দেশ জাতিসংঘের আদর্শ, উদ্দেশ্য এবং দায়-দায়িত্ব মেনে নিয়ে জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য দরখাস্ত করতে পারে। চার্টারের সংশ্লিষ্ট ধারাটি এই রকম–

Article- 4

1. Membership in the United Nations is open to all other peace loving states which accept the obligations contained in the present charter, and in the judgement of the Organisation, are able and willing to carry out those obligations.

2. The admission of any such state to membership in the United nations will be effected by a decision of the General Assembly upon the recommendation of the Security Council.

জাতিসংঘ মহাসচিবকে উদ্দেশ্য করে এ চিঠি জনাব আবদুস সামাদ আজাদ এই ধারা অনুসারেই পাঠিয়েছিলেন।

নিয়ম হল, সদস্যপদ চেয়ে এ ধরনের কোনো চিঠি পাওয়ার পর মহাসচিব তা নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির দৃষ্টিতে আনেন। নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি প্রয়োজনবোধ করলে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে কিছু অনানুষ্ঠানিক এবং ঘরোয়া আলোচনা করে আনুষ্ঠনিক সভা ডাকেন। তারপর নিরাপত্তা পরিষদ এ ধরনের সদস্যপদের দরখাস্ত নিরাপত্তা পরিষদেরই একটি কমিটি 'Committee on the Admission of the new Members'এর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠায়। নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যই এ এডমিশন কমিটিরও সদস্য। এই এডমিশন কমিটি আনুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হয়ে সদস্যপদের জন্য পাঠানো দরখাস্ত বিবেচনা করে এবং নিরাপত্তা পরিষদকে সাধারণত কমিটির সুপারিশ জানিয়ে একটি রিপোর্ট পেশ করে। নিরাপত্তা পরিষদ কমিটির এ রিপোর্ট বিবেচনা করে দরখাস্তকারী দেশের পক্ষে বা বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়। পরিষদের সিদ্ধান্ত যদি ইতিবাচক হয়, তা আবার সুপারিশ আকারে সাধারণ পরিষদে পাঠানো হয় এবং সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সদস্যপদের দরখাস্তের নিষ্পত্তি হয়, সাধারণ সদস্যপদ প্রাপ্তি দিয়ে।

এই দরখাস্তটি পাওয়ার পর জাতিসংঘ মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়াল্ড হাইম বাংলাদেশের সদস্যপদের ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশের জন্য তা নিরাপত্তা পরিষদে পেশ করেন।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই চিঠি পাওয়ার পর নিরাপত্তা পরিষদ কোনো রকমের দেরি না করে দুদিনের মধ্যে ১০ তারিখেই এক সভায় মিলিত হয়। বাংলাদেশের সদস্যপদের দরখাস্ত এই দিনের সভার একমাত্র আলোচ্যসূচি ছিল।

নিরাপত্তা পরিষদের ১০ আগস্টের অধিবেশনে বাংলাদেশের সদস্যপদ সংক্রান্ত দরখাস্ত বিবেচনা করার জন্য জাতিসংঘ সচিবালয় কর্তৃক যে খসড়া আলোচ্যসূচি প্রণীত হয়েছিল, গণচীনের প্রতিনিধি মি. হুয়াং হয়া সেদিন এই আলোচ্যসূচি গ্রহণের বিরুদ্ধে একমাত্র ভোটটি দিয়ে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির বিরুদ্ধে দীর্ঘ বিরোধিতার সূচনা করেন। আলোচ্যসূচিই গ্রহণ করতে দিতে চায়নি সেদিন গণচীন। একেবারেই মামুলি পদ্ধতিগত বিষয়, যে কোনো আনুষ্ঠানিক সভার শুরুতেই থাকে খসড়া আলোচ্যসূচি গ্রহণ নিয়মমাফিক এডমিশন কমিটিতে আমাদের দরখাস্তটি পাঠানো হবে কি হবে না, তাই ঠিক করতে হল এদিন নিরাপত্তা পরিষদের ভোটাভুটিতে। শুধু গণচীন বিষয়টি এডমিশন কমিটিতে পাঠানোর বিরুদ্ধে ভোট দেয়। তবে আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ভারত, ইতালি, জাপান, পানামা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুগোস্লাভিয়া আলোচ্যসূচিটি গ্রহণের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। ৩টি দেশ– গিনি, সোমালিয়া এবং সুদান ভোটাভুটিতে অংশগ্রহণ করেনি।

নিরাপত্তা পরিষদের ১০ আগস্টের এই সভায় বাংলাদেশের সদস্যপদের দরখাস্তটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিরাপত্তা পরিষদের কাছে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য 'এডমিশন কমিটি'কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এটি একটি পদ্ধতিগত বিষয় ছিল বলে গণচীন নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়া সত্ত্বেও এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে একে রুখতে পারেনি। মানে, পদ্ধতিগত বিষয়সমূহে ভেটো প্রয়োগ চলে না।

নিরাপত্তা পরিষদের সভার মাত্র একদিন পর 'এডমিশন কমিটি' ১১ আগস্টে এক সভায় বসে। এই দিনের এডমিশন কমিটির মিটিংয়ে গণচীনের প্রতিনিধি বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখে বলেন যে, ৭১-এর ডিসেম্বরে সাধারণ পরিষদ এবং নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়ন না করা পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান এবং পাকিস্তান-বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান ইস্যুগুলো সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ

Not qualified at all to be admitted to the United Nations and therefore, the Chinese delegation was firmly opposed to consideration of the application by the Security Council under existing circumstances.

এ দিনের সভায় কমিটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে অসমর্থ হওয়ার কারণে এডমিশন কমিটি ২১ আগস্টে আবার বৈঠকে মিলিত হয়।

গণচীনের প্রতিনিধি এডমিশন কমিটির এ দু'দিনের সভায় বাংলাদেশের সদস্যপদের বিরুদ্ধে তার প্রবল বিরোধিতা অব্যাহত রাখেন। সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত যখন পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন বেলজিয়ামের প্রতিনিধির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ২১ তারিখের সভায় বাংলাদেশের সদস্যপদের প্রশ্নে কমিটির সদস্যদের কার কী অভিমত এ বিষয়ের ওপর ভোটাভুটি হয়। আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ভারত, ইতালি, জাপান, পানামা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুগোস্লাভিয়া এ ১১ টি দেশ কমিটির এ ভোটাভুটিতে বাংলাদেশের সদস্যপদের অনুকূলে ভোট দেয়। বাংলাদেশের সদস্যপদের বিপক্ষে ভোট দেয় গিনি। গণচীন, সোমালিয়া এবং সুদান ভোটাভুটিতে অংশগ্রহণ করেনি।

বাংলাদেশের সদস্য পদের প্রশ্নে 'এডমিশন কমিটি' যে রিপোর্ট দেয় তা বিবেচনা করার জন্য বৃহস্পতিবার ২৪ আগস্ট জাতিসংঘের সদর দপ্তরে বেলজিয়ামের প্রতিনিধির সভাপতিত্বে নিরাপত্তা পরিষদের সভা আবার শুরু হয়। পরিষদের ৫ টি স্থায়ী দেশ– মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং গণচীন এবং অন্য ১৯ টি অস্থায়ী সদস্য দেশ– আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, গণচীন, ফ্রান্স, গিনি, ভারত, ইতালি, জাপান, পানামা, সোমালিয়া, সুদান এবং যুগোস্লাভিয়ার প্রতিনিধিরা এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। এ সভার বিবেচ্য বিষয় ছিল যুক্তরাজ্য, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুগোস্লাভিয়া– নিরাপত্তা পরিষদের এই ৪টি সদস্য দেশের উত্থাপিত নিম্নোক্ত খসড়া প্রস্তাবটি–

The Security Council,

Having examined the application of the People's Republic of Bangladesh for admission to the United Nations,

Recommends to the General Assembly that the People's Republic of Bangladesh be admitted to Membership in the United Nations.

২৩ আগস্ট ১৯৭২ তারিখ বিশিষ্ট 'এডমিশন কমিটি'র রিপোর্টটিও নিরাপত্তা পরিষদের এ দিনকার সভায় কার্যপত্র হিসেবে বিবেচ্য ছিল।

নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি, বেলজিয়াম প্রতিনিধি কয়েকটি বাক্যে তার উদ্বোধনী বক্তব্য রাখার পরপরই গণচীনের প্রতিনিধি প্রথম বক্তা হিসেবে বাংলাদেশের সদস্যপদের বিরুদ্ধে আবারও এবার তৃতীয়বারের মতো– প্রবল বিরোধিতা শুরু করেন। এইদিন বিতর্ক অসমাপ্ত থাকে এবং পরদিন আবার বিতর্ক শুরু করার পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়।

শুক্রবার ২৫ তারিখ অপরাহ্নে নিরাপত্তা পরিষদের ৩ টার নির্ধারিত সভা ৩-৩৫ মিনিটে আবার শুরু হয়। দুই দিনের দীর্ঘ বিতর্ক শেষে ২৫ তারিখে বাংলাদেশের সদস্যপদের ওপর তিনটি প্রস্তাব ভোটাভুটিতে দেওয়া হয়। ১৯৭১-এর পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের ওপর গৃহীত জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়ন সাপেক্ষে বাংলাদেশের সদস্যপদ বিবেচনা স্থগিত রাখার জন্য গণচীনের একটি খসড়া প্রস্তাব ভোটাভুটিতে প্রথম দেওয়া হয়। গণচীনের প্রতিনিধির দাবি অনুসারেই বাংলাদেশের সদস্যপদ বিবেচনা স্থগিত রাখার জন্য এ প্রস্তাবটি প্রথম ভোটাভুটিতে দেওয়া হয়। এই প্রস্তাবের পক্ষে চীন, গিনি এবং সুদান এ ৩টি দেশ ভোট দেয়। ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুগোস্লাভিয়া প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, পানামা, সোমালিয়া, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভোটাভুটিতে বিরত থাকে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভোট পেতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে গণচীনের প্রস্তাবটি নাকচ হয়ে যায়।

গিনি, সোমালিয়া ও সুদানের আনীত একটি সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর এ দিন দ্বিতীয় ভোটাভুটি হয়। এই সংশোধনীটিতে বলা হয়েছিল যে, চার শক্তি আনীত খসড়া প্রস্তাবের শেষে এ অংশটুকু জুড়তে হবে–

"Subject to the immediate implementation of those provisions of the Geneva Conventions of 1949 relating to the release and repatriation off prisoners of war and civilian internees as mentioned in Security Council resolution 307 (1971)"

এই সংশোধনী প্রস্তাবও নাকচ হয়ে যায়। গিনি, সোমালিয়া, সুদান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সংশোধনী প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। সংশোধনী প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য এবং যুগোস্লাভিয়া। ভোটদানে বিরত থাকে আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, গণচীন, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান এবং পানামা।

এরপর, সবশেষে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি ওই চার শক্তি আনীত বাংলাদেশের সদস্যপদের পক্ষের প্রস্তাবটি এই দিনের তৃতীয় ভোটাভুটিতে দেন। বাংলাদেশের সদষ্য পদের পক্ষে এ প্রস্তাবে ভোট দেয়। ১১ টি দেশ– আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ভারত, ইতালি, জাপান, পানামা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুগোস্লাভিয়া। প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় মাত্র একটি সদ্যস্য দেশ, নিরাপত্তা পরিষদের ৫ টি স্থায়ী সদস্যের একটি স্থায়ী সদস্য, গণচীন। ভোটাভুটিতে বিরত থাকে গিনি, সোমালিয়া এবং সুদান।

গণচীনের এই ভেটো প্রয়োগের ফলে বাংলাদেশের সদস্যপদের পক্ষের প্রস্তাবটি সেদিন গৃহীত হতে পারেনি। যে গণচীনকে পশ্চিমা শক্তিবর্গ পঁচিশটি বছর জাতিসংঘের সদস্যপদের বাইরে রেখেছিল, সেই গণচীন ১৯৭১ সালে সদস্য হয়েই '৭২-এর ২৫ আগস্টে তার প্রথম ভেটোটি প্রয়োগ করেছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে।

আরও কিছু বক্তৃতার পর এ দিন সন্ধা ৭.০০ টায় নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন শেষ হয়েছিল।

গণচীনের প্রতিনিধি এডমিশন কমিটি এবং নিরাপত্তা পরিষদের আমাদের এই সদস্যপদ সংক্রান্ত বক্তৃতায় যতবারই বাংলাদেশ নামটি উচ্চারণ করেছিলেন তা কোটেশনের মধ্যে 'বাংলাদেশ' হিসেবেই করেছিলেন

One People's Republic against another People's Republic, the most powerful People's Republic against the newest People's Republic,

সেদিন ১৯৭২এ গণচীনের এই ভূমিকা লন্ডনে আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছিল। ছাত্রাবস্থা থেকেই গণচীনকে মহান গণচীন হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম। মনে করেছি চেয়ারম্যান মাও সে তুং সারা বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের পক্ষে এক 'কলোসাস'। ১৯৬২ তে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ঢাকার তেজগাঁও বিমান বন্দরে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌএন লাইয়ের ঘন্টাখানেকের যাত্রাবিরতিকালে রেলিংএর বাইরে এবং প্রখর সূর্যের নিচে দাঁড়িয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়েছিলাম। সেদিন চৌএন লাইকে দেখতে পাইনি কিন্তু তাঁর প্লেনটি দেখার যে সৌভাগ্য হয়েছিল, তাতেই খুব খুশি হয়েছিলাম। ঐ আনন্দ নিয়েই হল্লা করতে করতে সেদিন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ফিরে এসেছিলাম অন্যান্য বন্ধুসহ।

তারপর অর্থনীতিবিদ পল সুইজি চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পক্ষে যতসব যুক্তি দিয়েছেন বামপন্থী বন্ধুদের আলোচনায় হা করে শুনেছি সেই আমলে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ে তখন আমাদের বামপন্থী বন্ধুরা উদ্ভট এবং আজগুবি যতসব গল্প বলেছে, প্রায় সবগুলো গিলে খেয়েছি বলা যায়। এতটুকু অবিশ্বাস করলে 'গাইয়া' বলে গাল খাওয়ার ভয় ছিল। তার আগে নাদেঝদা ক্রুপস্কায়ার নাম শুনিনি আবিস্কার করে ফেলেছিল এক বামপন্থী বন্ধু একদিন। তারপর থেকে তো আমার গায়ে কাদামাটির গন্ধ পেতে থাকল বন্ধুটি। দুএকবার এমন অভিজ্ঞতার পর আজগুবি গল্প সব মুখস্থ ছিল। বর্তমানে এক বিরাট আমলা, বিভিন্ন সময়ে অনেক তরক্কী হয়েছে আমার সেই এককালের বামপন্থী বন্ধুর।

পরে ১৯৭১এ স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে লন্ডনে গণচীন সম্পর্কে আমাদের কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা পরে না হয় আর একদিন বলা যাবে। কিন্তু ১৯৭১ এবং ১৯৭২এ গণচীন জাতিসংঘে যে কী দুঃখজনক ভূমিকা নেয় তা জাতিসংঘের সেই সময়কার নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারণ পরিষদের দলিলে ইতিহাস হয়ে আছে। এসব কারও মন্তব্য নয়।

পরে, ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ১৩৬তম সদস্য দেশ হিসেবে আমরা জাতিসংঘের সদস্যপদ পাই। গণচীন এবার আর বাধা দেয়নি।

তারপর থেকে জাতিসংঘ পরিবারে আমাদের কার্যপরিধি এবং কর্মতৎপরতা বেড়েছে। ১৯৭৪এর সেপ্টেম্বরে আমাদের সদস্যপদ প্রাপ্তির পরপরই জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রথম ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তাঁর ভাষণটি দিয়েছিলেন বাংলায়। এই প্রথম জাতিসংঘ পরিবারের কোনো সভায় বাংলা ভাষা উচ্চারিত হয়েছিল।

তারপর আমরা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হয়েছিলাম দুবছরের মেয়াদের জন্য– পরিবারের ১০টি অস্থায়ী সদস্যের একটি হিসেবে। আর একবার এরশাদ সাহেবের আমলে ব্যর্থ হয়েছিলাম মালয়েশিয়ার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। তবে এরশাদ সাহেবের আমলে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এই জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদেই সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৮৬ তে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এই পদে নির্বাচিত হতে হলে আমাদের আরও একশ পঞ্চাশ বছরের মতো অপেক্ষা করতে হবে। তার আগে আমাদের টার্ন আসবে না।

বাংলাদেশের প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব জনাব এস এ এম এস কিবরিয়া জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল পদমর্যাদায় এসকাপের নির্বাহী সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন দু'টার্ম। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ মহাসচিবের পদের পরই আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলের পদ। জাতিসংঘ সিস্টেমে যে কোনো বাঙালির জন্য এই ছিল শীর্ষতম পদ। জাতিসংঘ সিস্টেমে আমাদের অনেক নাগরিক কর্মরত আছেন, কিন্তু আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলের পদে আর কেউ ছিল না, এখনও নেই।

এসবই আমাদের সকলের জন্য গৌরবের। বলার প্রয়োজন রাখে না যে, এসব সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য বলেই।

জাতিসংঘ পরিবার থেকে আমরা অনেকভাবে উপকৃত হয়েছি। আমরাও এই পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে আমাদের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট রয়েছি। কিন্তু জাতিসংঘে বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটলে, আমাদের বিশেষ কোনো কর্মতৎপরতা দেখলে, আমার মনে পড়ে যায় জনাব আবদুস সামাদ আজাদের সেই তিন বাক্যের চিঠিটির কথা।

মূল চিঠিটির অফিস কপি খোঁজ করে পাওয়া গেলে এটির ফটোকপি জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ অনুবিভাগের বিভিন্ন কর্মকর্তার দপ্তরে বাঁধিয়ে রাখা যেত। তবে ওটা যাখন পাওয়া যাচ্ছে না অন্তত চিঠিটিকে আর্টিস্ট দিয়ে লিখিয়ে বা কমপিউটারে কম্পোজ করে তার প্রিন্ট আউট বাঁধিয়ে রাখা যেতে পারে।

ইতোমধ্যে গণচীনের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বেরও নতুন এক অধ্যায় রচিত হয়েছে। ১৯৮৬ সালে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের 'দক্ষিণ পূর্ব এশীয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে'র মহাপরিচালক থাকাকালে আমারও এ বিষয়ে যৎসামান্য ভূমিকা রাখার সুযোগ হয়েছিল।

চীন এখন আমাদের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের মধ্যে একটি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের অতীতে সাহায্য করেছে, ভবিষ্যতেও করবে, আমরা তা আশা করি। আর ১৯৭১-এ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে এবং ১৯৭২-এ জাতিসংঘে আমাদের সদস্যপদ প্রাপ্তির বিরুদ্ধে যে সব চীনা নেতৃবৃন্দ ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁরা পরবর্তীকালে তাদের নিজ দেশেই অন্যান্য অনেক বড় বড় কারণে নিন্দিত এবং পরিত্যক্ত হয়েছিলেন। ১৯৭১ এবং ১৯৭২-এর গণচীন এখন ১৯৯৩তে সেই গণচীন নয়। সে দেশেই এত পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে। এই দেশের বার্ষিক তের চৌদ্দ পারসেন্ট প্রবৃদ্ধি আমাকে চমৎকৃত করে। পৃথিবীর কত দেশ এত চেষ্টা করেও প্রবৃদ্ধির হার এক পারসেন্ট বাড়াতে পারছে না, আর এর বিপরীতে, গণচীনকে 'ওভারহিটেড' অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই প্রবৃদ্ধির হার কমানোর জন্য এত চেষ্টা করতে হচ্ছে। গণচীনের অর্থনৈতিক সাফল্য আমাদেরও উৎসাহিত করে, আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও আশাবাদী করে। প্রায় প্রতিদিন বিবিসি, সিএনএন-এ চীনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের খবর 'হিউম্যান স্পিরিট' সম্পর্কে আমাদের উদ্দীপিত করে।

পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের ট্রেনিং-এর জন্য ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে যখন লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে প্রবেশ করেছিলাম একাডেমির তখনকার অন্যতম ডেপুটি ডাইরেক্টর জনাব আকরাম জাকি (বর্তমানে পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি জেনারেল) তাঁর প্রথম বা দ্বিতীয় বক্তৃতাতেই একটি বিখ্যাত উক্তি আমাদের শুনিয়েছিলেন–

There is no permanent friend or permanent enemy of a country. All that it has are its permanent interests.

কুটনৈতিক কাজে নিয়োজিত যে কোনো ব্যক্তি এই বাক্যটিকে কূটনীতির প্রথম সবক হিসেবে গ্রহণ করেন। আমরাও তাই করেছি।

তবে ইতিহাস যা তা ইতিহাসই। তবুও এই ইতিহাস বিকৃত করার কাজে তৎপর দেখা যায় কিছু মানুষকে। যেমনটি দেখা গেছে ১৯৮৮-এর ২১ অক্টোবর তারিখে ইংরাজি সাপ্তাহিক হলিডে'তে "Dimensions of Bangla-China relationship" শিরোনামে প্রকাশিত প্রতাপশালী সরকারি কর্মকর্তা (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর সচিব) ড. কামাল সিদ্দিকীর লেখাটির নিচে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদ দুটোতে–

OPPONENTS

The blind opponents of Bangladesh-China friendship may, of course, raise the 1971 episode to paint a different picture. But as facts have clearly shown, it was simply a case of temporary misunderstanding caused by information gap and problems of decision making in China at that time owing to prevailing extra-ordinary circumstances.

Also, the misunderstanding was blown out of proportion by the malicious propaganda of interested quarters.

Most important, the misunderstanding thawed into warmest possible relationship in the quickest possible time so much so that a few years ago, Bangladesh was publicly acclaimed by the Chinese leaders as one of the four most trusted friends of China.

আমাদের জাতিসংঘ সদস্যপদ প্রাপ্তিতে গণচীনের প্রবল বিরোধিতার সঙ্গে হলিডে'তে প্রকাশিত প্রবন্ধের উপরে উল্লেখিত অংশটির প্রথম দু'টি অনুচ্ছেদ কি সঙ্গতিপূর্ণ? আজ গণচীন আমাদের যথার্থই বন্ধু বটে, কিন্তু তার তৎকালীন ভূমিকাকে নিছক সাময়িক 'ভুল বোঝাবুঝি' বা ইনফরমেশন গ্যাপ-এর ফল বলে কি লঘু করা যায়, না উচিত? বিশেষত একজন সরকারি কর্মকর্তার পক্ষে এ ধরনের বিতর্কমূলক ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য রাখাই-বা কতখানি সঙ্গত?

[বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করেছিল ১৯৭৪-এর ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৩৬ নম্বর সদস্য হিসেবে। ১৯৭৪-এ কী ব্যাকগ্রাউন্ডে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হতে পারল, ১৯৭২-এ প্রথম চেষ্টায় কার কী ভূমিকা ছিল এসব ঐতিহাসিক তথ্য গবেষণা করে উদ্ধার করেছিলেন জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের সাবেক উপ-স্থায়ী প্রতিনিধি এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ অনুবিভাগের সাবেক মহাপরিচালক মহিউদ্দিন আহমদ। ১৯৯১-৯২তে নিউইয়র্কের বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে দায়িত্ব পালনকালে তিনি তখনকার সিকিউরিটি কাউন্সিলে অনুষ্ঠিত বিতর্কের রেকর্ড সংগ্রহ করেন। তার ভিত্তিতে লেখা তাঁর একটি প্রবন্ধ ('জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ, ব্যথা-বেদনার কিছু কথা' শিরোনামে) দৈনিক সংবাদ-এ ছাপা হয়েছিল দুই কিস্তিতে, ১৯৯৩ সালের ৯ ও ১০ অক্টোবর।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করে লেখাটি প্রকাশ করা হল।]