বাংলাদেশের গণমাধ্যমের জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতা

মহিউদ্দিন আহমদ
Published : 15 Sept 2014, 04:41 AM
Updated : 15 Sept 2014, 04:41 AM

বাংলাদেশ সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের প্রতি বছর সংবাদপত্র ও সাময়িকীর একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করার কথা। এই প্রতিবেদনটিতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে যেসব দৈনিক, সাপ্তাহিক অর্ধ-সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক এবং ত্রৈমাসিক পত্রপত্রিকা বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়, তার তালিকা থাকে। পত্রিকার আরও কিছু বর্ণনার মধ্যে থাকে, পত্রিকার নাম, কী ভাষায় প্রকাশিত হয়, প্রথম প্রকাশের তারিখ, সম্পাদকের নাম, প্রকাশকের নাম ঠিকানা, কোথায় মুদ্রিত হয়, সেই ছাপাখানার নাম ও ঠিকানা, পত্রিকার আকার– 'ব্রডশিট' নাকি 'ট্যাবলয়েড' এবং প্রতি কপির মূল্য।

এই বার্ষিক প্রতিবেদনটি প্রতি বছর প্রকাশ করা সম্ভব হয় না, এই প্রকাশনার কাজটি সহজও নয়। তারপরও আমি ২০০৮, ২০১০ ও ২০১১ সালের প্রতিবেদন তিনটি জোগাড় করতে সফল হয়েছি। ২০১১ সালের সর্ব সাম্প্রতিক প্রতিবেদনটির শুরুতে, ৬ নম্বর পৃষ্ঠায় দেখা যায়, ১৯৭২ এ সারা দেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ছিল ৩০, সব ধরনের পত্রিকা এবং সাময়িকীর সংখ্যা ৩০০। আর ২০১১ সালে সারা দেশে দৈনিক পত্রিকার এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫১৮এ; আর সব ধরনের সাময়িকীর সংখ্যা হচ্ছে ৯৪৩।

২০১১ সালের ১১৫ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনটিতে জেলাওয়ারি পত্রপত্রিকার বর্ণনাও আছে। আছে আগের বছরগুলোর বর্ণনাও। তবে আমার আজকের আলোচনার জন্য শুধু ঢাকা জেলার দৈনিক পত্রিকার সংখ্যাটিই বেশি প্রাসঙ্গিক। ঢাকা জেলা, মানে ঢাকা মহানগর থেকেই, দেখতে পাচ্ছি প্রায় সবগুলো দৈনিক প্রকাশিত হচ্ছে। এই সংখ্যাটি হচ্ছে ২৩০। আর একটি সূত্র থেকে জেনেছি এই সংখ্যাটি এখন ৩০০ এরও উপর। তবে আমি ২৩০ সংখ্যাটি নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।

এই তালিকার এক নম্বরে আছে কয়েক বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভার। এই পত্রিকাটির পরে নাম আছে দৈনিক 'সংবাদ', ২ নম্বরে এবং তারপর ইত্তেফাক। দৈনিক 'সংবাদ' সম্পর্কে এই তথ্যগুলো আছে প্রতিবেদনটির ১২ পৃষ্ঠায়: পত্রিকাটির ভাষা: বাংলা; প্রথম প্রকাশের তারিখ ১৯৫১ এর ১৭ মে। সম্পাদকের নাম আলতামাস কবির; প্রকাশক, আলতামাস কবির, ৮৭, বিজয়নগর, ঢাকা; মুদ্রণ: দি সংবাদ লিমিটেড, ৩৬ পুরানা পল্টন, ঢাকা; আকার ৫৬/৩৫ এবং দাম প্রতিকপি ৮ টাকা।

২৩০টি দৈনিক পত্রিকার এই তালিকার ১৭ নম্বরে আছে ইংরেজি দৈনিক 'ডেইলি স্টার', ২৭ নম্বরে দৈনিক 'ভোরের কাগজ', ৬৭এ ট্যাবলয়েড দৈনিক 'মানবজমিন', ৬৯এ দৈনিক প্রথম আলো, ৭৪এ যুগান্তর এবং সবশেষে, ২৩০ নম্বরে আছে 'পূর্ব আলো' নামের একটি পত্রিকা। এই পত্রিকাটির সম্পাদকের নামের কলামে লেখা আছে ''বেস্টওয়ে মিডিয়া এন্ড কম্যুনিকেশন লি: পক্ষে: মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, বসতি কন্ডোমিনিয়াম, লেভেল নং: ৭, বাড়ি নং: ১৫, সড়ক নং ১৭, বনানী-বা/এ, ঢাকা– ১২১৩''।

পত্রিকার কত রকমের অদ্ভূত ও উদ্ভট নাম হতে পারে, তা এই প্রতিবেদনেও দেখা যায়। এমন একটি পত্রিকার নাম 'ক খ গ'; তালিকার ১৫৭ নম্বরে। পত্রিকাটির বর্ণনায় ২০১১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনটির ২৭ পৃষ্ঠায় এই কথাগুলো আছে: ভাষা: বাংলা; প্রথম প্রকাশ ০৯-০১-২০০৮; সম্পাদক শওকত মাহমুদ, ফোন: ০১৭১৫-১৬৭০৯২; প্রকাশক শওকত মাহমুদ, ৭০ পাইওনিয়ার রোড, নয়াপল্টন ঢাকা-১০০০। মুদ্রণ: টিউলিপ প্রিন্টার্স, ৩৪, সোনারগাঁও রোড, হাতিরপুল, ঢাকা। পত্রিকার আকার ৫৬/৪০, দাম প্রতি কপি ৪.০০ টাকা।

বাংলাদেশের বিএনপি জামায়াতপন্থী, জাতীয়তাবাদী সাংবাদিকদের নেতা শওকত মাহমুদ ঠিক কোন্ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন, আমার জানার আগ্রহ অনেকদিনের। কিন্তু কোথাও পাচ্ছিলাম না। এখন এই প্রতিবেদনে দেখলাম।

২.

বাংলাদেশে জনসংখ্যার বিস্ফোরন ঘটছে, আর বিস্ফোরন ঘটছে আমাদের পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীর প্রকাশনায়ও। এই বিস্ফোরনটা প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে ঢাকা শহরে। এক ঢাকা শহরে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে নিবন্ধিত আছে ২৩০টি ইংরেজি ও বাংলা দৈনিক!! ঢাকা শহরের বিপরীতে দুনিয়ার আর কোনো দেশের আর কোনো শহরে কি এতগুলো দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়? আমার জানামতে লন্ডনের মত এত বড় বিখ্যাত ও বড় শহরে 'ব্রডশীট' ও 'ট্যাবলয়েড' মিলিয়ে আছে গোটা ১৫ দৈনিক; নিউইয়র্কে আছে মাত্র দুটো দুনিয়াজোড়া বিখ্যাত দৈনিক– 'নিউ ইয়র্ক টাইমস' এবং 'ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল'। ওয়াশিংটনে আছে মাত্র একটি, 'ওয়াশিংটন পোস্ট'। ওয়াশিংটন শহরে 'ওয়াশিংটন টাইমস' নামের আর একটি দৈনিক আছে; কিন্তু এই দৈনিক 'ওয়াশিংটন টাইমস' অন্য দৈনিক 'ওয়াশিংটন পোস্ট' এর ধারে কাছেও নেই নামে এবং প্রভাবে।

তো ঢাকা শহরে এতগুলো দৈনিক কেন আছে, কেন প্রকাশিত হয়, তার ব্যাখ্যা আমাদের পত্রিকা মালিকদের সমিতি– 'নিউজ পেপার্স্ অওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ', নোয়াব, বা সম্পাদকের সংগঠন 'সম্পাদক পরিষদ' কখনও স্পষ্টভাবে দেয় না। এমন ব্যাখ্যা দিলে যে তাদের অনেক গোমর, পত্রিকা জগতের অনেক অ-জানা কথা, কেলেংকারি এবং দুর্নীতি, অনিয়ম বেনিয়মও বেরিয়ে আসবে।

আমাদের মিডিয়া জগতের মানুষজন অন্যের কেলেংকারি সন্ত্রাস দুর্নীতি, প্রকাশ করতে যেমন ফুলটাইম, ওভারটাইম আগ্রহী, তার হাজার ভাগের এক ভাগও নয় নিজেদের অন্যায় অবৈধ কাজকর্ম তুলে ধরতে।

আমাদের দেশের সম্পাদক সাংবাদিকরা কঠোরভাবে একটি নীতি মেনে চলার চেষ্টা করেন: কাকের মাংস কাকে খায় না। বাংলাদেশে সম্পাদক সাংবাদিকরা নিজেদের কাকের সঙ্গে প্রায়ই তুলনা করতে ভালোবাসেন এবং যেহেতু কাক কাকের মাংস খায় না, তারাও একে অন্যের মাংস খাবেন না। মানে, একে অন্যের দুর্নীতি, সন্ত্রাস, ঘুষ এবং অন্যায় ও অবৈধ সুযোগ সুবিধা গ্রহণ– তার কোনো খবর তাদের পত্রিকায় প্রকাশ করবেন না, করা যাবে না।

বাংলাদেশের এই সব সম্পাদক-সাংবাদিক যারা এই নীতিতে বিশ্বাস করেন তারা লক্ষ্য করেননি যে কাক কোনো প্রিয় প্রাণি, পাখি নয়, তার আওয়াজটা কর্কশ, কাককুল কোনো বাড়ির আশে পাশে ডাকতে থাকলে, মানুষজন দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। তবে কাকের সঙ্গে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রচণ্ড মিল দেখতে পাই– কাক যেমন কর্কশ আমাদের কিছু কিছু সাংবাদিকও কর্কশ চরিত্রের, কথায় কথায় হুমকি ধামকি দিয়ে থাকেন। তারা যে পত্রিকার মালিকের বেতনভূক্ত সাংবাদিক তা তাদের কথাবার্তায় চাপা পড়ে যায় তাদের দাম্ভিক আচরণে। তারা প্রায়ই হুমকি দেন অমুকের খবর কাভার করব না, অমকুকে বর্জন করব, অমুককে সাংবাদিকদের কাছে মাফ চাইতে হবে, ইত্যাদি। কিন্তু পত্রপত্রিকার কাজ তো সংবাদ 'কভার' করা, সেজন্য সাংবাদিককে তো বেতন ভাতা দেওয়া হয়। সংবাদ জোগাড় না করতে পারলে, তা তো সংশ্লিষ্ট সংবাদিক বা সাংবাদিকদের ব্যর্থতা, অযোগ্যতা। তাহলে তাকে কেন পত্রিকার মালিক বেতন ভাতা দেবেন?

এই প্রসঙ্গে আমার খুবই মনে পড়ছে সাত আট বছর আগে চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে সাংবাদিকদের এক নেতা, ফটোসাংবাদিক হিসেবে বেশি পরিচিত মরহুম হাজী জহির পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশি সাংবাদিক এবং ফটোসাংবাদিকরা প্রতিবাদে কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক একটি সংবাদ সংস্থায় কর্মরত গোধূলী নামের আর এক ফটোসাংবাদিক এই সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তার দায়িত্ব ঠিকই নিয়মিতভাবে পালন করতে থাকলেন। বিষয়টা হল, গোধুলী যদি 'স্ট্রাইক' করতে থাকেন, তাকে হয়ত চাকুরীচ্যুত হতে হত। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা বলে তার বেতনভাতাও নিশ্চয়ই বেশি ছিল। সুতরাং গোধূলী কিছুতেই তার চাকুরী হারাতে চাইলেন না। তার উপর উন্নত দেশগুলোতে, আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলোতে প্রতিবাদে ধর্মঘটে যাওয়া বা কর্মবিরতির ঘোষণা দেয়া তারা চিন্তাও করতে পাওে না।

৩.

সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক থেকে একটি বই জোগাড় করেছি। বইটির নাম FLAT EARTH NEWS; লিখেছেন নিক ডেভিস (Nick Davies) নামের এক সাংবাদিক। চাট্টো এন্ড উইন্ডাস (Chatto & Windus) প্রকাশিত ৪০৮ পৃষ্ঠার এই বইতে এককালের লন্ডন 'গার্ডিয়ান' পত্রিকার সাংবাদিক এই নিক ডেভিস তার এই পত্রিকাটিকেও বিভিন্ন ব্যর্থতা অনিয়ম বেনিয়েম এবং ধান্দাবাজীর জন্য কঠোর সমালোচনা করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত ইংরাজি সাপ্তাহিক 'দি সানডে টাইমস'এর উপর তার এই বইটিতে প্রায় ৪৫ পৃষ্ঠায় যে 'অধ্যায়টি' আছে তার শিরোনাম 'ইনসাইট ইনটু দি সানডে টাইমস' (Insight into the Sunday Times)। (এই পত্রিকাটিতেই ১৯৭১ এর ১৩ জুন এন্থনী ম্যাসকারেনহাসের সেই সাড়াজাগানো প্রায় ১০ হাজার শব্দের রিপোর্টটি পত্রিকাটির প্রথম পৃষ্ঠাসহ ভিতরের আরও কয়েকটি পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশের গণহত্যার ওপর। তার চাক্ষুষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই দীর্ঘ বিবরণ সারা দুনিয়াতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। পরে এই বিবরণ The Rape of Bangladesh নামের বইতে আরও বিস্তারিত বর্ণনাসহ প্রকাশিত হয়েছিল।)

নিক ডেভিসের এই হার্ডকভার বইটির মলাট উল্টালেই ফ্ল্যাপে ফ্ল্যাপে ঘনকালো বড় হরফে এই কথাগুলো আছে: Finally I was forced to admit that I work in a corrupted profession.

পশ্চিমা দেশের এক সাংবাদিক, এই নিক ডেভিস বলছেন তিনি সাংবাদিকতার যে পেশায় আছেন সেটি দুর্নীতিগ্রস্ত। তো এইসব উন্নত দেশে গণমাধ্যমের দুর্নীতি নিয়ে এটি প্রথম বা শেষ বই নয়। এমন প্রকাশনা, এমন আত্মস্বীকৃতি হাজার হাজার আছে। কিন্তু বাংলাদেশে 'কাকের মাংস কাক খায় না' এমন এক উদ্ভট যুক্তিতে আমাদের সম্পাদক সাংবাদিকরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের অন্ধকার জগতকে আর কতদিন আড়াল করে রাখবেন?

৪.

২০১১ এর প্রতিবেদনের হিসাব মতে বাংলাদেশে এখন ৭১২টি পত্রপত্রিকা এবং সাময়িকী প্রকাশিত হচ্ছে। ১৬ কোটি জনসংখ্যার জন্য এই সংখ্যাটি হয়ত মোটেও বেশি মনে হবে না। কিন্তু দেশের শিক্ষার হার এবং আর্থিক সঙ্গতি, কয়জন মানুষ প্রতিদিন ১০ টাকা দিয়ে একটি পত্রিকা কিনতে পারে, এই প্রশ্নগুলো বিবেচনায় নিলে পত্রপত্রিকার এই সংখ্যাটি অবশ্যই বিশাল। আমাদের কোন কোন জেলা শহরেও এখন দৈনিক পত্রিকার বিস্ফোরণ ঘটছে। এগুলোতে কি সৎ সাংবাদিকতার চর্চা হচ্ছে? এই পত্রিকাগুলোর সাংবাদিক-সম্পাদক কর্মচারীরা কি নিয়োগপত্র, নিয়মিত বেতন-ভাতা, সাংবাদিকদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন? তাহলে কেন এতগুলো পত্রপত্রিকা?

কবি আবু হাসান শাহরিয়ার বাংলাদেশে পত্রপাত্রিকার এমন বিস্ফোরনের একটা কারণ দিয়েছেন। আবু হাসান শাহরিয়ার তার 'অর্ধসত্য' (প্রকাশক: সাহিত্য বিকাশ) বইটিতে ''কৃপণের মুঠিধরা হিসেবের গোপন চালাকি'' শিরোনামের একটি লেখায়, বইয়ের ৩২ পৃষ্ঠায় বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর কোন কোনটির চরিত্র এবং অসৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখেছেন: ''সম্পদ পাহারায় বড়লোকরা আগে কুকুর পুষত, এখন পোষে দৈনিক। একুশ শতকের দৈনিক হচ্ছে বড় লোকের বাড়ীর পোষা কুকুর।''

ভূমিদস্যুরা যেভাবে তাদের মালিকানার পত্রিকাগুলোর অপব্যবহার করে চলেছে, আবু হাসান শাহরিয়ারের একটু আগের উদ্ধৃতির কথাগুলোতে তার যথার্থ প্রমাণ এবং সত্যতা পাওয়া যায়। ভূমিদস্যুরা যেমন একপক্ষকে হামলা করে, আবার প্রতিপক্ষও তার পত্রিকাকে হামলা মোকাবেলায় ব্যবহার করে এমন অপব্যবহারে এই গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমটির প্রতি মানুষজনের আস্থা-বিশ্বাসই যে সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ এদিকে 'নোয়াব' বা 'সম্পাদক পরিষদ' বা সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোরও কোনো দায়-দায়িত্ব আছে বলে মনে হয় না।

আমাদের পত্রিকাগুলো ছাড়া গত পনের বিশ বছরে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অগ্রযাত্রাও লক্ষ্যণীয়। ইতোমধ্যে ২৭টির মতো প্রাইভেট চ্যানেল প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টার সম্প্রচারে আছে। আছে পনের বিশটির মত এফএম রেডিও চ্যানেল। আছে অনলাইন নিউজ চ্যানেলও অনেকগুলো। এগুলোর সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে।

এই যে এত বিশাল একটি গণমাধ্যম বাংলাদেশের মানুষজনকে দিন দুনিয়া সম্পর্কে অবহিত রাখার সার্বক্ষণিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের এই চেষ্টাগুলো কতটুকু সফল, কোথায় কোথায় তাদের ব্যর্থতা, কোথায় মালিক-সম্পাদকদের ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য ধরনের ধান্দাবাজি তার মনিটরিং এর জন্য নিয়মিত কোনো ব্যবস্থা আমাদের কোনো পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলে নেই। বিবিসি বাংলায় প্রতি সপ্তাহে, সাধারণত মঙ্গলবার ভোর ৬-৩০এর 'প্রভাতী'তে, 'প্রীতিভাজনেষু' নামের প্রায় পনের মিনিটের একটি অনুষ্ঠানে বিবিসি বাংলায় প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলোর উপর শ্রোতাদের মন্তব্য, পরামর্শ, উপদেশ এবং সমালোচনাও প্রচারিত হয়। এসব মন্তব্য সমালোচনার জবাবও দেওয়া হয় বিবিস বাংলার পক্ষ থেকে। কোনো কোনো সমালোচনা গ্রহণ করা হয়, শ্রোতাদের ধন্যবাদ দেওয়া হয় ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য।

'আলজাজিরা' টিভি চ্যানেলে প্রতি শনিবার দুপুর ২-৩০ এ, রোববার রাত ৮-৩০ এ এবং সোমবার ১০-৩০-এ লিসেনিং পোস্ট (Listening Post) নামের আধঘন্টার একটি অনুষ্ঠান আমার খুব প্রিয়। এই অনুষ্ঠানে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে কোনো বিশেষ ইস্যুকে কেমন 'কভারেজ' দেওয়া হয়েছে, 'কভারেজ' পক্ষপাতিমূলক না নিরপেক্ষ তার উপর আলোচনা হয়। গাজায় ইসরায়েল প্রায় দুই মাস যেমন হামলা চালিয়েছে তাতে পশ্চিমা গণমাধ্যম যে নিরপেক্ষ ছিল না তা এই অনুষ্ঠানে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে কয়েক সপ্তাহ ধরে। গত সপ্তাহে দেখলাম পাকিস্তানে ইমরান খান এবং তাহেরুল কাদরীর বিক্ষোভকে 'জিও নিউজ' আর 'এ আর ওয়াই' চ্যানেল দুটির পারস্পরিক বিরোধী অবস্থান নিয়ে আলোচনা। জিও নিউজ সমর্থন দিয়েছে নেওয়াজ শরীফের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে; আর এ আর ওয়াই সমর্থন দিয়েছে ইমরান খান এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণকে। এই বিষয়টির উপর চমৎকার বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় কথাবার্তা ছিল।

আমাদের দেশে এমন অনুষ্ঠান জরুরি হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশের গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে গুরুত্ব চাইবে, ক্ষমতা প্রয়োগ করবে; কিন্তু কারও কাছে দায়বদ্ধ থাকবে না তা তো হতে পারে না। আমাদের গণমাধ্যমে কতটুকু সাংবাদিকতা থাকছে আর কতটুকু মালিকের বিভিন্ন কিসিমের স্বার্থের পক্ষে প্রতিপক্ষকে হামলা হুমকি চলছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কি মালিকের স্বাধীনতা এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা সমালোচনা এখন ফরজ। আগামী দিনগুলোতে এই কলামে এই বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে।

আমাদের অকার্যকর জাতীয় সংসদের বিপরীতে আমাদের গণমাধ্যম জনমানুষের পক্ষে বিশেষ করে যারা অবহেলিত নির্যাতিত, যারা এই দেশের সংখ্যালঘু, প্রবল ভূমিকা রাখছে। আমার এই কলামে তাদের নন্দিত ভূমিকার কথাও উদাহরণসহ অবশ্যই থাকবে।


মহিউদ্দিন আহমেদ:
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক।