দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের অপার সম্ভাবনা

মুহম্মদ মাহবুব আলী
Published : 10 Sept 2014, 01:47 PM
Updated : 10 Sept 2014, 01:47 PM

বাংলাদেশ বৈদেশিক বিনিয়োগের একটি অপার সম্ভাবনাময় দেশ। সাড়ে পাঁচ বছরে যেভাবে দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ শক্তিশালী হয়েছে তাতে এদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছে ১.৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৩ সালে যদিও দেশে সহিংসতা ও আত্মবিধ্বংসী ও নেতিবাচক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছিল, তারপরও ২৪ শতাংশ বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে।

এটি আসলে প্রমাণ করে যে, নেতিবাচক রাজনীতির পরও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এদেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরেই বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। ২০১৩ সালে ভারতে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে একই সময়ে পাকিস্তানে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আসলে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে, বিশেষত গত বিশ বছরে ক্রমশ দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত হয়েছে। বর্তমানে দেশের অর্থনীতির সামষ্টিক চলকগুলো যে কোনো সময়ের তুলনায় ইতিবাচক দিক পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বিশ্বের বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগ ২০১৩ সালে ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে যার পরিমাণ হচ্ছে ১.৪৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। আশা করা যাচ্ছে এটি ২০১৪ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ১.৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার হবে। ২০১৩ সালে মোট বৈদেশিক বিনিয়োগের ৫৪ শতাংশ এসেছে উন্নয়নশীল দেশে যার পরিমাণ হচ্ছে ৭৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বাংলাদেশে গত বছর যে বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছে তার মধ্যে ৫৪১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ইক্যুইটি খাতে, ৩৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ইন্ট্রা-কোম্পানি ঋণ ও ৬৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পুনঃবিনিয়োগজনিত আয় হিসেবে এসেছে। টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরে এসেছে ৩২৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ব্যাংকিং সেক্টরে ৩২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, টেক্সটাইল ও ওয়েভিং সেক্টরে ৪২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং জ্বালানি-বিদ্যুৎ ও পেট্রোলিয়াম বাবদ ৯৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া খাদ্যপণ্যাদি বাবদ এসেছে ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, কৃষি ও মৎস্য খাতে ৩১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং অন্যান্য খাতে ৩৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

যদিও আপাত দৃষ্টিতে প্রতিভাত হয় যে, বৈদেশিক বিনিয়োগ বহুবিধ খাতে সাধারণত এসে থাকে, তবে মূলত দুটো খাতেই সবচেয়ে বেশি আসে; তা হল জ্বালানি ও যোগাযোগ। জ্বালানি খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগের যেমন দরকার তেমনি এটি যেন দেশের উন্নয়নে ব্যয়িত হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরে এলেও তা কিন্তু ডিজিটাল ডিভাইড দূরীকরণে তেমন ভূমিকা রাখে না। বরং এতে দেশি উদ্যোক্তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

সড়কপথের অবকাঠামো নির্মাণে যে ধরনের সহায়তা পাওয়া যায় তা কিন্তু রেলপথ কিংবা নৌপথের অবকাঠামো নির্মাণ ও সম্প্রসারণে পাওয়া যায় না। তারপরও ভারতের দেওয়া ক্রেডিটের আওতায় বর্তমান সরকার রেলপথ সম্প্রসারণে বেশ মুখ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে।

নৌপথের উন্নয়ন, ড্রেজিং এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া নৌপথগুলো পুনঃখনন করে চালু করা, দেশে জলাবদ্ধতা দূর করে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা এবং নদী-ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। এ জন্যে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের যে ধারাগুলো অসঙ্গতিপূর্ণ সেগুলো সংশোধন যেমন দরকার তেমনি পাবলিক-ফরেন পার্টনারশিপের ধারাসমূহ পর্যালোচনাপূর্বক বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দেশে বিনিয়োগের জন্যে উৎসাহিত করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিদেশস্থ দূতাবাসসমূহকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। দূতাবাসে কর্মরতদের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্যে বিদেশি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং দেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্যে ইনসেনটিভ ও রিওয়ার্ডের ব্যবস্থা করা উচিত।

আবার প্রবাসী বাংলাদেশিরা যাতে 'গুডউইল অ্যাম্বাসেডর' হিসেবে কাজ করতে পারেন সে জন্যে দেশের নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে যেমন উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে, বিদেশস্থ দূতাবাসসমূহ তেমনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। তাতে তারা ডায়াসপোরা তত্ত্বের সুফল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করবেন। অধিক মাত্রার বিদেশি বিনিয়োগ সরাসরি দেশে আনয়নের ক্ষেত্রে যোগসূত্র স্থাপনের জন্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভূমিকা রাখতে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি জরুরি।

একটি দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ সচরাচর স্বাগত জানানো হয় শুধুমাত্র পুঁজি প্রাপ্তির জন্যে নয়, বরং আধুনিক ও লাগসই প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করতেও। এ জন্যে Strategic Alliance-এর মাধ্যমে দেশি ও বিদেশি সংশ্রবের মাধ্যমে একটি নবতর অধ্যায়ের সূচনা হয়। তাই উদ্ভাবনী শক্তির পাশাপাশি প্রয়োজন প্রায়োগিক কৌশলের।

চলতি অর্থ বছরে দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হবে বলে সরকার প্রত্যাশা করছে। অনর্থক কিংবা স্বীয় হীন স্বার্থে রাজনৈতিক সংঘাত সৃষ্টি করা না হলে দেশে এই বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বিদেশিরা সরাসরি সিকিউরিটিজের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারেন। সরকার চলতি অর্থ বছরে কর্পোরেট ট্যাক্সের ক্ষেত্রে হার ৩৭.৫ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ৩৫ শতাংশ করেছেন। আবার অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়াসের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্যে নানামুখী ব্যবস্থা নিয়েছেন।

এই সমস্ত উদ্যোগ তখনই সাফল্য লাভ করবে যখন কেবল নীতিনির্ধারক পর্যায় নয়, মধ্যবর্তী ও তৃণমূল পর্যায়ে যথাযথভাবে সম্প্রসারণ করা হয়। দায়িত্বশীলরা যদি নৈতিকতাসম্পন্ন হন, মিথ্যে অপবাদ, কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি ও দুর্নীতির দুর্বৃত্তায়ন থেকে বিরত থাকেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতামুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন, তবেই দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রের উন্নয়ন সম্ভব। এ জন্যে চাই আন্তরিকতা, নিষ্ঠা।

বৈদেশিক বিনিয়োগ বহুমুখী খাতে আনা প্রয়োজন। দেশি উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তারা জয়েন্ট ভেঞ্চারে কাজ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তাদের উচিত হবে সততা ও নিষ্ঠার পরিচয় দেওয়া। বিদেশি বিনিয়োগ তখনই একটি রাষ্ট্রে আসবে যখন বিনিয়োগকারী স্বীয় স্বার্থ সংরক্ষিত করতে সক্ষম হবেন, রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট পজিটিভ হবে এবং কোনো ধরনের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে তার ব্যবসা-বাণিজ্যের কোনো ধরনের ক্ষতি সাধিত হবে না।

সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দিক খুলে গেছে। আবার খনিজ সম্পদ সংগ্রহ, মৎস্য আহরণে আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে যৌথ বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন রয়েছে। সমুদ্রে পর্যটন শিল্পের সম্প্রসারণের জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হতে পারেন। আবার যে সমস্ত জলজ আগাছা এবং বিভিন্ন ধরনের অপ্রাণিজ রয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

'ব্লু ওশান'-এর যে সম্ভাবনাময় সামুদ্রিক অর্থনীতি রয়েছে তা পাঠ্যক্রমের আওতায় আনা জরুরি। সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগও এ জন্যে গ্রহণ করা করা বাঞ্ছনীয়। তবে বিদেশি বিনিয়োগ গ্রহণ করার পূর্বে অবশ্যই ওই বিনিয়োগকারী অতি-মুনাফামুখী কিনা এবং মুনাফা বিদেশে কীভাবে প্রেরণ করবেন সেটা খেয়াল রাখা দরকার। একটি পর্যায় পর্যন্ত মুনাফা স্থানান্তরিত করা যায়।

২০১১-১২ অর্থ বছরে ২০৯ টি বৈদেশিক প্রকল্প তালিকাভুক্তির প্রস্তাবনা ছিল এবং এ ক্ষেত্রে অর্থের পরিমাণ ছিল ৩,৩৮,৯১০ টাকা। ওই একই সময়ে মোট তালিকাভুক্ত প্রকল্পের সংখ্যা প্রস্তাব করা হয়েছিল ১,৮১৩ এবং টাকার পরিমাণ ছিল ৮,৩৫,৮৮৯। এটি পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ২১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। আসলে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলেই যে রাষ্ট্রের উন্নয়ন হবে তা নয় বরং এর সুফল সুষম বণ্টনের ক্ষেত্রে কতটুকু রাখে তা বিচার্য বিষয়।

দেশে অন্যান্য যে সমস্ত ক্ষেত্রে বৈদেশিক বিনিয়োগ আসতে পারে সে ক্ষেত্রে এসএমই এবং পর্যটন শিল্প উল্লেখযোগ্য। ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি গ্রুপ এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগে উৎসাহ দেখিয়েছে। এসএমই সেক্টরে বিদেশি বিনিয়োগ এলে দেশে মধ্যম শ্রেণির শিল্পায়নে আরও দক্ষতা ও কার্যকারিতার সৃষ্টি হবে।

এদিকে পর্যটক শিল্পের উন্নয়নে বহুমাত্রিকতা ও দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ প্রয়োজন। কেবল ভ্রমণ বা প্রাকৃতিক ঐতিহাসিক ঐতিহ্য পরিদর্শন নয়, পাশাপাশি স্বাস্থ্য-পর্যটন, ক্রীড়া-পর্যটন, ধর্মীয়-পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে হবে। বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে পর্যটন গড়ে তোলা গেলে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পাবে।

স্বাস্থ্য-পর্যটন গড়ে তুলতে হলে এই খাতে অধিকতর বিনিয়োগ প্রয়োজন। দক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হাসপাতাল নির্মাণ, চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্টসহ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মানবসম্পদ গঠনের ক্ষেত্রে বিদেশি সহায়তা, কারিগরি কৌশল দরকার। ডায়াগনস্টিক সেন্টারসমূহ যাতে আরও আধুনিক হয় সে জন্যে পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।

বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের জিডিপি ভবিষ্যতে ৯ শতাংশ কমে যেতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রয়োজন। দেশের বনায়ন বৃদ্ধি ও পরিবেশের মান উন্নয়ন এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্যে বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। অনেক সময় এ ক্ষেত্রে Geo-political reason বিবেচনায় আনতে হয়। এর ফলে একটি রাষ্ট্রের ব্যবসায়িক ব্যবস্থাপনা গ্রাহ্য করা হয় না।

দেশে অ্যাগ্রো-প্রসেসিং জোন সৃষ্টি এবং কাঁচামাল সংগ্রহ ও উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আবার দেশকে আরও অগ্রগতির দিকে নিতে হলে অবশ্যই ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে হবে। আইসটি, ওষুধ, চামড়া-শিল্প, চা-শিল্প, বস্ত্রখাত, ইলেকট্রনিকস খাতসহ নানামুখী শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বৈদেশিক বিনিয়োগ চাই।

এই বিনিয়োগ আমদানি বিকল্পায়ন শিল্পে এলে দেশের সাধারণ মানুষ বেশি উপকৃত হবে। আবার রপ্তানিমুখী শিল্পায়নকে যাতে কেউ জিম্মি করতে না পারেন সে দিকে খেয়াল রাখা দরকার। সম্ভাবনাময় ও বহুধা-বিভক্ত রপ্তানিমুখী শিল্পের ক্ষেত্রে বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রয়োজন যাতে নতুন নতুন পণ্যাদি প্রস্তুত করা যায়।

দেশের নীতিনির্ধারকরা এসব বিষয় মাথায় রেখে কাজ করবেন আশা রাখি।

ড. মুহম্মদ মাহাবুব আলী: ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনোমিস্ট।