বাংলাদেশে বন্যা ও আমাদের দায়-দায়িত্ব

দানেশ মিয়া
Published : 14 Nov 2018, 01:10 PM
Updated : 9 Sept 2014, 01:53 PM

গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার একটি বৃহত্তম ব-দ্বীপ অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান। এই ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশকে বছরের পর বছর বন্যায় আক্রান্ত হতে হচ্ছে। কখনও কখনও এই বন্যা সহনশীল মাত্রায় সীমাবদ্ধ থাকছে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা ভয়াল আকার ধারণ করছে। প্রায় ২৩০ টি নদী একটি জটিল জালের মতো বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে, যার মধ্যে ৫৭ টি নদী আন্তঃদেশীয়, যেগুলো চীন, ভুটান, নেপাল ও ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে। নদীগুলোর প্রবাহের শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি উল্লিখিত উজানের দেশগুলোতেই রয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশ এই নদীগুলোর পানি-বহির্গমন পথের শেষপ্রান্তে অবস্থিত হয়ে নদী-বাস্তুসংস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

সাম্প্রতিক কয়েক দশকের বন্যার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে গড়ে বার্ষিক এক-পঞ্চমাংশ ভূমি বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ১৯৮৮ এবং ১৯৯৮ সালের ভয়াবহতম বন্যা বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ ভূমির কৃষি ও মানুষের আবাস ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং মানুষ ও গবাদি পশুর জীবন ও স্বাস্থ্যের হানি ঘটিয়েছে।

আঞ্চলিক ও স্থানীয় অতিবৃষ্টি এবং ভৌত অনেক কারণ বাংলাদেশে বন্যা হওয়ার জন্য দায়ী। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, স্থানীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে বন উজাড়করণ এই প্রক্রিয়ায় বেশ খানিকটা প্রভাবকের ভূমিকা পালন করছে বলে গবেষকরা প্রায় নিশ্চিতভাবে সাক্ষ্য উপস্থাপন করেছেন। ভৌত কারণগুলোর মধ্যে সম্প্রতি হিমালয়ে অস্বাভাবিকভাবে বরফের আস্তরণ (গ্লেসিয়ার) গলে যাওয়া, নদী, উপনদী ও খালগুলোর পানি নির্গমন ক্ষমতা বিভিন্ন কারণে হ্রাস পাওয়া, অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ এবং নির্বিচার বন উজাড় হওয়া অন্যতম।

এতে নদী, উপনদী, খাল ও অন্যান্য চ্যানেলগুলোর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে অতিবৃষ্টিতে সহজেই পানি উপচিয়ে বন্যার আকার ধারণ করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে যে বন্যা হয়েছে, তার প্রধান কারণ উজানের দেশগুলোতে অতিবৃষ্টি। নির্বিচার বনধ্বংস হওয়ার ফলে বনভূমি থেকে প্রচুর মাটিক্ষয় হয়ে বৃষ্টির ঢলের সঙ্গে তা প্রবাহিত হয়ে ভাটির দেশ বাংলাদেশের নদীগুলোর নাব্যতা ইতোমধ্যেই কমিয়ে দিয়েছে অনেকখানি।

নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার কোনো সুস্পষ্ট প্রচেষ্টাও চোখে পড়ছে না। তাই উজান থেকে অতি অল্প সময়ে ধেয়ে আসা পানি বাংলাদেশের নদী-নালা ধারণ করতে না পেরে বন্যার আকার ধারণ করেছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে বনধ্বংস হচ্ছে, সেটিও স্থানীয়ভাবে কোথাও কোথাও বন্যার কারণ হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যের একদল বিজ্ঞানী ১৯৯০ এবং ২০০০ সালের মধ্যে ৫৬ উন্নয়নশীল দেশের বন্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে, উক্ত দশকে দেশগুলোতে প্রায় ১০০,০০০ মানুষ বন্যার কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং প্রায় ৩২০ মিলিয়ন মানুষ পরিবেশ-উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছেন।

এতে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ১১৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাকৃতিক বন শতকরা প্রায় ১০ ভাগ হারে কমতে থাকলে, বন্যার ঘটনা শতকরা ৪ থেকে ২৮ ভাগ এবং বন্যাদুর্গত সময় শতকরা ৪ থেকে ৮ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।

বাংলাদেশে বন্যা কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে যদি তা ভয়াল রূপ ধারণ না করে। স্বাভাবিক বন্যার পরবর্তী সময়গুলোতে, বিশেষ করে ধান ও রবি ফসলের বাম্পার ফলন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু বন্যা যখন সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করে তখন তা কৃষি, অবকাঠামো ও বাসস্থানের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে।

তথ্যমতে, বন্যার ফলে বাংলাদেশে ফসলের যে ক্ষয়-ক্ষতি হয়, তা বার্ষিক গড়ে প্রায় ০.৪৭ মিলিয়ন টন। কিন্তু ১৯৯৮ সালের বন্যায় সেই ক্ষতি ৩ থেকে ৫ মিলিয়ন টন ছাড়িয়ে গেছে। মোট আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা সেই বছরের জিডিপির শতকরা প্রায় ১০ শতাংশ।

পৃথিবীব্যাপী বন্যার প্রকোপ বাড়ছে সংখ্যায় এবং ক্ষতিকরণের মাত্রায়। আগেই বলেছি, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এবং বন উজাড়করণ বন্যা সংঘটিত হওয়ার প্রধান প্রভাবক। গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৫০ সেন্টিমিটার থেকে ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে।

হিসাবটি করা হয়েছে তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিভিন্ন ধরন অনুমান করে। সাম্প্রতিক উপগ্রহ ও ভূমিভিত্তিক পর্যবেক্ষণ থেকে এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়েছে যে, ১৯৯৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর প্রায় ৩ মিলিমিটার করে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিশ শতকে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা বৃদ্ধির চেয়ে অনেক বেশি।

গত চল্লিশ বছরের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার এমান্ডসন সাগরের কাছে থাকা কিছু গ্লেসিয়ার এমনভাবে গলে গেছে যে, তা আর কোনোভাবেই বরফ হয়ে ফিরে আসবে না। ওই গ্লেসিয়ার যদি সম্পূর্ণ গলে যায় তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় চার ফুট বেড়ে যাবে। আর যদি পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার সমস্ত বরফ গলে যায়, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ১১ ফুট পর্যন্ত বেড়ে যাবে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে চীন ও বাংলাদেশ ভয়াবহ বিপদে পড়বে বলে নাসা ইতোমধ্যেই সতর্ক করে দিয়েছে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের উপরিভাগের তাপমাত্রা যদি ক্রমবর্ধমান থাকে তাহলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে, ২০৫০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের গড় উচ্চতা প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার বাড়বে এবং এতে প্রায় ১৪ শতাংশ ভাগ স্থলভূমি স্থায়ী ও অস্থায়ী জলনিমজ্জনের শিকার হবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় তাপমাত্রা ও ভারী বৃষ্টিপাত, ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় সামুদ্রিক জলোচ্ছাস পর্যবেক্ষণ করা গেছে। এতে বাংলাদেশ তার আর্থ-সামাজিক অবস্থায় একটা সুষ্পষ্ট চাপ পর্যবেক্ষণ করছে। এ রকম একটি অবস্থায় বন্যার অন্যান্য কারণগুলো যদি স্থির থাকে কিংবা আরও খারাপ দিকে অগ্রসর হয়, তাহলে বাংলাদেশে বন্যা একটি স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিবে এবং তা দেশের প্রায় অর্ধেক ভূখণ্ড গ্রাস করবে।

একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় সিভিল সোসাইটি ও সরকারের একটি পরিস্কার দায়বদ্ধতা প্রত্যাশিত। এটা স্পষ্ট, বাংলাদেশের বন্যার জন্য অনেকাংশেই বাংলাদেশ দায়ী নয়। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের দায় যেমন বাংলাদেশের নয়, তেমনি উজানের দেশগুলোতে বন উজাড়করনের দায়ও আমাদের ঘাড়ে বর্তাবে না। সম্প্রতি বাংলাদেশের ২১ জেলায় বন্যা যেভাবে ক্ষয়-ক্ষতি করে গেছে, তার দায় খুব কমই বাংলাদেশের। এখানে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা খুবই জরুরি।

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার জন্য যেমন 'ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড' এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করার চেষ্টা হচ্ছে, তেমনি বন্যার জন্য আলাদা করে 'ফ্লাড ট্রাস্ট ফান্ড' করা যেতে পারে। যেখানে আঞ্চলিক সহযোগিতা থাকবে সবচেয়ে বেশি।

বাংলাদেশের বন্যায় বাংলাদেশের যে দায় তা হল, নদ, নদী, খাল, নালা এগুলো অল্প কিছু লোভী ও ভূমিদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারা। বাংলাদেশের বনভূমি ও প্রাকৃতিক বনজ সম্পদ এত নির্মমভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে যে, সুন্দরবন ছাড়া আর কোনো প্রাকৃতিক বন বাংলাদেশে আর কত বছর টিকে থাকবে তা হিসাব করে বলে দেওয়া যাবে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অনিয়ন্ত্রিত অবকাঠামো নির্মাণ, নগরের পানি ও পয়ঃনিষ্কাষণের কোনো পরিকল্পিত ব্যবস্থা না রাখা নগরের বন্যার অন্যতম কারণ। এর দায় তো বাংলাদেশেরই। এই দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারকেই নিতে হবে।

এজন্য একটি রাজনৈতিক অঙ্গীকার আশু প্রয়োজন। এই অঙ্গীকার বিনির্মাণের জন্য বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটিকে কাজ করতে এগিয়ে আসতে হবে।

ড. দানেশ মিয়া: অধ্যাপক, বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান ইন্সটিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।