ন্যাটো সম্মেলনে নয়া বিশ্বযুদ্ধের দামামা

হাসান তারিক চৌধুরী
Published : 6 Sept 2014, 05:23 AM
Updated : 6 Sept 2014, 05:23 AM

অন্যান্য বারের তুলনায় এবার বেশ ঘটা করেই অনুষ্ঠিত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধ জোট ন্যাটোর সম্মেলন। ৪ ও ৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের ওয়েলস এ অনুষ্ঠিত হল এ সম্মেলন। মার্কিন পত্রিকা ইউএসএ টুডে ৩১ আগস্টই এ সম্মেলন সম্পর্কে বলেছে, বার্লিন দেয়ালের পতনের পর এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন।

আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ মাধ্যমগুলোর এ রকম মন্তব্যের যথেষ্ট গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। বর্তমান বিশ্বের অশান্ত পরিস্থিতিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার যুদ্ধ ও আগ্রাসনের শিখা আর কতদূর ছড়িয়ে দেবে তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ সম্মেলন এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বিশেষ করে ইরাকে মার্কিনের তৈরি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন আইএস-এর (সাবেক আইএসআইএস) জঙ্গিরা যেভাবে মার্কিন সাংবাদিকদের শিরোচ্ছেদসহ বিভিন্ন নারকীয় বীভৎস ভিডিওচিত্র বিশ্বজুড়ে প্রচার করছে তাতে মার্কিন সামরিক কমপ্লেক্স এখন নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আমেরিকা তথা নিজ দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তার যে বড়াই পেন্টাগন করত তা কার্যত বিরাট প্রশ্নের মুখোমুখি। বিশ্বজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররাষ্ট্রগুলোর নাগরিকরা এক চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে নিপতিত হয়েছে।

২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনের ধর্মনিরপেক্ষ সরকার উৎখাতের সময় মার্কিন প্রশাসন বলেছিল যে, তারা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনবে এবং ইরাকে গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা আনবে। অথচ বাস্তবে তা ঘটেনি। বরং হয়েছে তার উল্টো। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সাদ্দাম হোসেনকে অন্যায় ফাঁসি দিয়েছিল এবং তার ভিডিও প্রচার করেছিল। আজ মার্কিনেরই তৈরি সুন্নী জঙ্গিরা মার্কিন নাগরিকদের শিরোচ্ছেদ করে তার ভিডিও প্রচার করে চলেছে।

ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে জঙ্গিবাদের কবর দিয়েছে বলে দাবি করেছিল মার্কিন প্রশাসন। কিন্তু পুরো পারমা উপত্যকা অঞ্চলে নানা বর্ণের, নানা মতের সশস্ত্র জঙ্গিবাদ বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। নাইজেরিয়ার বোকো হারাম জঙ্গিরা প্রমাণ করেছে যে এই জঙ্গিবাদের জোর আফ্রিকাতেও কম নয়।

মোট কথা, মার্কিন সরকারের আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক শ্লোগান আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রহসনে পরিণত হয়েছে। নিজের হাতে সৃষ্ট এসব দানবকে সামলানোর ব্যর্থতার দায় আজ মার্কিন প্রশাসন পুরো বিশ্বের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে তথাকথিত সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের আন্তর্জাতিক কর্মসূচিতে জোর করে অংশীদার বানাতে চায়।

এবারের ন্যাটো সম্মেলনে এই জঙ্গিবাদের বিষয়টি থাকলেও সবার আগে আলোচ্য বিষয় হিসেবে ছিল রাশিয়া ও ইউক্রেন প্রসঙ্গে। মার্কিন খবরের কাগজগুলো সে রকমই সংবাদ দিচ্ছে। ন্যাটো ঘিরে মার্কিন ও ইউরোপীয় নেতাদের নানা আলোচনার ধরন দেখে মনে হচ্ছে যেন সেই 'স্নায়ুযুদ্ধের' সময়কাল ফিরে এসেছে। আবার কারও কারও মনে হতে পারে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল আবার ফিরে এসেছে। ইউক্রেন সংকটের জন্ম দিয়ে এখন এই সংকট ব্যবহার করে যেন জার্মানি রাশিয়ার কাছ থেকে তার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন হিসাব বুঝে নিচ্ছে। এ রকম নানামুখী আলোচনার মধ্যে দিয়ে এবার ন্যাটো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

তবে সম্মেলনে কোন আলোচনা আগে হয়েছে বা কোনটা পরে হয়েছে তার চেয়ে বড় কথা হল, এবার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার সামরিক অভিলাষের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। এই অভিলাষের অংশ হিসেবে এবার তারা চীনের পর রাশিয়াকেও আঘাত করতে জোটবদ্ধ হয়েছে।

যে কারণে সম্মেলনের আগের দিন এস্তোনিয়ার রাজধানী তাল্লিনে উড়ে গিয়েছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা। সেখানে তিনি তিন বাল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া ও লাটভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ওবামা বলেন, এবারের ন্যাটো সম্মেলনে তারা সংস্থার ৫ নং অনুচ্ছেদের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেবেন।

উল্লেখ্য, ন্যাটোর ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যদি সংস্থার কোনো সদস্য রাষ্ট্র আক্রান্ত হয় তাহলে অপর সদস্য রাষ্ট্রগুলো তার পক্ষে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ২০০৪ সালে বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো ন্যাটোর সদস্য হয়েছিল। একই সঙ্গে তারা সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একমাত্র সদস্য রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রগুলো সঙ্গে নিয়ে ন্যাটোর সর্দার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সে অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতি বহুগুণে জোরদার করেছে।

তাদের সামরিক অভিলাষ এখন এতটাই চরম পর্যায়ে গেছে যে, ন্যাটোর মহাসচিব এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান ফেডোরিকা মঘিরিনি দুজনেই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রাশিয়া আক্রমণের হুমকি দিচ্ছেন। রাশিয়ার হাত থেকে ইউক্রেনকে রক্ষার খোঁড়া অজুহাত সামনে রেখে সম্মেলনে ৪ হাজার সদস্যের বিশেষ বাহিনী গঠনের ঘোষণা দিয়েছে ন্যাটো। এই বিশেষ বাহিনীর নাম হবে 'স্পেশাল র‌্যাপিড রেসপন্স ফোর্স', যারা এক ঘণ্টার মধ্যেই কোনো দেশে আক্রমণ শুরু করতে পারবে।

সম্মেলনে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সামরিক খাতে ন্যূনতম ব্যয় জিডিপির ২ শতাংশ থেকে আরও বাড়াতে বলা হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার জিডিপির ৪ শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয় করে। নিজ দেশের জনগণের করের টাকা স্বাস্থ্য ও আবাসনের মতো মৌলিক চাহিদার খাতে ব্যয় না করে সাম্রাজ্যবাদী শাসক রাষ্ট্রগুলো আজ সেসব দেশের বহুজাতিক কোম্পানি ও ফিন্যান্স পুঁজির স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যয় করছে।

তাদের এই লুণ্ঠনজীবী তৎপরতা পুরো বিশ্বকে এক ভয়ানক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। যেভাবে আজ তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়েছে তা একই সঙ্গে পারমাণবিক যুদ্ধের বিপদের সম্ভাবনাও বাড়িয়ে তুলেছে। রাশিয়া একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। যদি ন্যাটোর দ্বারা রাশিয়া কোনোভাবে আক্রান্ত হয় তা নিঃসন্দেহে পারমাণবিক যুদ্ধ পর্যন্ত গড়াতে পারে। তাতে গোটা বিশ্বের নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে।

এ রকম একটি বড় ঝুঁকির প্রতি ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি নেই। উপরন্ত তারা সম্মেলনে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি পোরোশেঙ্কোকে আমন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে রাশিয়ার প্রতি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাও বলেছে। পেন্টাগন ও ন্যাটো বিভিন্ন সামরিক কমান্ডাররা ইতোমধ্যেই রুমানিয়া ও পোল্যান্ডে তাদের ব্যালাস্টিক মিসাইল স্থাপন জোরদার করেছে এবং সেখানে তাদের সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে।

এবারের সম্মেলনের বেশিরভাগ আলোচনা শুনলে মনে হবে যেন রাশিয়াক আক্রমণ করার লক্ষ্য নিয়েই এটি আয়োজিত হয়েছিল। প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, ইরাক ও লিবিয়ায় এত বড় মানবিক সংকট চলছে– সেসব নিয়ে কার্যকর আলোচনা বাদ রেখে সমস্ত আলোচনা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে রাশিয়া ঘিরে।

রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপপ্রধান মিখাইল পোপও বলেছেন, ন্যাটো তার সামগ্রিক তৎরতার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার সীমান্তে এক চরম হুমকি সৃষ্টি করেছে। ন্যাটোর এই শক্তি সমাবেশে রাশিয়া তার ঐতিহ্যগত সামরিক পরিকল্পনা বদলে ফেলবে বলে জানিয়েছে ক্রেমলিন কর্তৃপক্ষ। এমনিভাবে রাশিয়ার উপর একটি অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেছে ন্যাটোর সদস্যরা।

ফলে বিশ্ব নিরাপত্তার শ্লোগান দিয়ে প্রকৃত অর্থে এবারের ন্যাটো সম্মেলন যুদ্ধের ডঙ্কা বাজাচ্ছে। এই ডঙ্কা বাজাতে ওয়েলসের সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন মার্কিনের তাবেদার ষাট দেশের রাষ্ট্রপ্রধান।

সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধবাজ তৎপরতা শুরু থেকেই মেনে নিতে পারেনি বিশ্বের শান্তিকামী জনগণ। তাই সারা বিশ্বে একযোগে ৩০ আগস্ট ন্যাটোবিরোধী দিবস পালিত হয়েছে। এসব বিক্ষোভে হাজার হাজার নারী পুরুষ অংশ নিয়েছেন। এমনকি ওয়েলসের যে নিউপোর্ট শহরে ওই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেখানেও হাজার হাজার মানুষ ন্যাটোবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। নিউপোর্টের ন্যাটোবিরোধী বিক্ষোভকারীরা বলেছেন, আমরা এই গ্রহকে কতিপয় যুদ্ধোন্মাদ শাসকের হাতে ছেড়ে দিতে পারি না।

বাকি বিশ্বও কি তাই বলবে?

হাসান তারিক চৌধুরী: আইনজীবী, রাজনীতিবিদ।