গণতন্ত্র বনাম সম্প্রচার নীতিমালা ও বিচারপতিদের অভিশংসন-২

আমানুল্লাহ কবীর
Published : 2 Sept 2014, 06:35 AM
Updated : 2 Sept 2014, 06:35 AM

দ্বিতীয় পর্ব: বিচারপতিদের অভিশংসন

আলোচনার দ্বিতীয় বিষয়টি বিচারপতিদের অভিশংসন। সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে প্রত্যার্পণের একটি প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। দীর্ঘদিন আলোচনার পর সম্প্রচার নীতিমালা তৈরি হলেও বিচারপতিদের অভিশংসনের নতুন প্রস্তাব অনেকটা আকস্মিকভাবেই এসেছে। গত সংসদের সময় ২০১২ সালে তৎকালীন স্পিকার আবদুল হামিদের (যিনি এখন রাষ্ট্রপতি) একটি রুলিং কেন্দ্র করে হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ যে রায় দেন, তার ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট একজন বিচারপতিকে অপসারণের দাবি উঠে সংসদে। কিন্তু সংসদের প্রয়োজনীয় ক্ষমতা না থাকায় তা চাপা পড়ে যায়।

সাময়িকভাবে চাপা থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা ভুলে যাননি। কিছুদিন আগে গণভবনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদে ফিরিয়ে দেওয়ার পক্ষে মত দেন। এর আগে বিষয়টি জনসমক্ষে প্রথম আনেন নতুন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পরে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ফিরিয়ে দিতে '৭২-এর সংবিধান অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী আইনমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন। আইন কমিশনও ইতোমধ্যে অনুরূপ সুপারিশ করেছে। অর্থাৎ ভেতরে ভেতরে একটা প্রক্রিয়া চললেও তা প্রকাশ পায়নি।

সরকারের উদ্যোগের আকস্মিকতায় সংশ্লিষ্ট মহলে বিস্ময়ের কারণ হচ্ছে, তাদের ধারণা ছিল পঞ্চদশ সংশোধনীতে প্রচলিত জুডিশিয়াল কাউন্সিল অক্ষত থাকায় বিচারপতিদের অভিশংসনের পদ্ধতিটি একটি মীমাংসিত বিষয়। কেননা হাই কোর্ট পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করলেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিধানটি অক্ষত রেখেছিলেন। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে, বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, যার বেঞ্চ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিধান অপরিবর্তিত রেখেছিলেন, ল' কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনিই এখন তা বাতিল করে অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদকে ফিরিয়ে দেওয়ার পক্ষে সুপরিশ করেছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, ল' কমিশন কেন তড়িঘড়ি এমন একটি মীমাংসিত বিষয় পরিবর্তন করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছেন? ২০১২ সালে স্পিকারের রুলিং ও হাই কোর্টের রায়ের ফলে জাতীয় সংসদ ও বিচার বিভাগ স্ব-স্ব সার্বভৌম মর্যাদা একে অপরের ওপর প্রতিষ্ঠার যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে, প্রতীয়মান হয় তা ফয়সালা করার জন্য বিচারপতিদের অভিশংসনের জন্য সংসদের ক্ষমতায়ন করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই পরিবর্তনের ফলে বিচারপতিদের উপর যে মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি হবে তাতে কি তারা বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারবেন?

এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, সরকার বিচারপতিদের অভিশংসনের ব্যাপারে যত আগ্রহী, তাদের নিয়োগের জন্য নিয়োগবিধি প্রণয়ণে ততটুকুই অনাগ্রহী। স্বাধীনতার পর বিচারপতি অভিশংসনের ঘটনা একাধিক নয়। সুনির্দিষ্ট নিয়োগবিধি না থাকায় আমাদের দেশে বিচারপতি নিয়োগ হন রাজনৈতিক বিবেচনায়। সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে–

''প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।''

কিন্তু প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক স্বাধীনতা নেই। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ীই বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী একজন দলীয় নেতা বা নেত্রী, ফলে বিচারপতি হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয় দলীয় রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে। যে কারণে বিচারপতির আসনে বসেও তারা দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে উঠতে পারেন না। এভাবেই বিচার বিভাগের দলীয়করণ করা হয়েছে।

বিচার বিভাগের দুর্বলতা এবং বিচার বিভাগের উপর মানুষের আস্থা নষ্ট হওয়ার কারণ এটাই। প্রতিবেশি ভারতসহ বিভিন্ন দেশের উদাহরণ হাজির করে জাতীয় সংসদকে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা প্রদানের পক্ষে যুক্তি দেখানো হলেও, ওইসব দেশে বিচারপতি নিয়োগের জন্য প্রচলিত নিয়োগবিধি সম্পর্কে উচ্চবাচ্য নেই। এর কারণ, বিচারপতি নিয়োগে সরকার নিজের নির্বাহী ক্ষমতা হাতছাড়া করতে রাজি নয়।

'৭২-এর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের পুণর্বহালের কথা বলা হলেও ওই সঙ্গে ১১৬ অনুচ্ছেদ পুণর্বহালের বিষয়টি পরিকল্পিতভাবে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই অনুচ্ছেদে বিচারকর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্বপালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি মঞ্জুরসহ) ও শৃঙ্খলাবিধানের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। বর্তমানে যা বস্তুত নির্বাহী বিভাগের উপর ন্যস্ত।

'৭২-এর মূল সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের দফা (২) এ বলা হয়েছে–

''প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোন বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না। ……''

''কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন'' বলা হলেও তদন্ত ও প্রমাণের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়নি। আইনমন্ত্রী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাতিলের পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলেছেন, বিচারপতিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব বিচারপতিদের উপর অর্পিত হলে তদন্তের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ থাকে। তাঁর এই বক্তব্য স্পষ্ট ইঙ্গিত করে যে, ভবিষ্যতে কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্তভার কেবল বিচারপতিদের দেওয়া হবে না, সংসদ সদস্যসহ অন্যরাও থাকবেন।

আইনমন্ত্রী যুক্তি দেখাতে গিয়ে ভুলে গেছেন যে, পুলিশবাহিনীর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে পুলিশের লোকেরাই তা তদন্ত করে। নির্বাহী বিভাগের অন্যান্য অঙ্গেও একই রীতি প্রচলিত। বাঘে ছাগল খাওয়ার নিয়ত করেছে, এটাই যথেষ্ট, তার বিরুদ্ধে পানি ঘোলা করার অভিযোগ আনার দরকার নেই।

নীতিগতভাবে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদকে প্রদানের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকতে পারে, তবে আমাদের দেশ গণতন্ত্রচর্চার যে স্তরে রয়েছে তা বিবেচনায় নেওয়াই সবচেয়ে বেশি জরুরি।

প্রথমত, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জাতীয় রাজনীতি তথা সমাজে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করেছে।

দ্বিতীয়ত, বর্তমান সংসদের legitimacy নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন রয়েছে।

তৃতীয়ত, বর্তমান সংসদে গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী কোনো বিরোধী দল নেই, কেননা জাতীয় পার্টি সরকারেরও পার্টনার।

চতুর্থত, সংবিধানগতভাবেই প্রধানমন্ত্রী অসীম ক্ষমতার অধিকারী। তিনি সংসদ নেতাও। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০ বলে তিনি বলীয়ান। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর নিজের দল ও জোটের এমপিদের ভোট দানের ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ তিনি যা চাইবেন, তা-ই আইন। সুতরাং কোনো বিচারপতিকে অভিশংসনের বিষয়টি তখন সংসদের উপর নির্ভর করবে না, করবে নির্বাহী বিভাগের প্রধান প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার উপর।

পঞ্চমত, ফলে নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে বর্তমানে যতটুকু ভারসাম্য রয়েছে, তা-ও নষ্ট হবে এবং বিচার বিভাগের উপর নির্বাহী বিভাগের খবরদারির সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর এবার ষোড়শ সংশোধনী হতে যাচ্ছে। সংসদের আগামী অধিবেশনেই এই সংশোধনী পাস হবে। বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছিল। ওই রায়ের ভিত্তিতেই পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্ববধায়ক সরকারের বদলে প্রবল বিরোধিতার মুখেও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা চালু করা হয়। তার ফলে দেশে তখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তার জের জাতিকে কতদিন বহন করতে হবে, তা বলা কঠিন।

যে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের উপর প্রত্যার্পণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা-ও তেমনি ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে পড়েছে। মূল সংবিধানের প্রণেতা ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামও, নীতিগতভাবে না হলেও, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে ন্যস্ত করার বিরোধিতা করেছেন। সিনিয়র আইনজীবীসহ সংবিধান বিশেষজ্ঞদেরও একই মত যে, এর ফলে বিচার বিভাগের উপর সরকারের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পাবে এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হবে।

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামসহ বিরোধী দলগুলোর শত শত নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা ঝুলছে এবং শত শত নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে। আবার অনেকেই কারাবন্দি রয়েছে। তারা মনে করছে, ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের উপর সরকারের খবরদারি বেড়ে গেলে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে জেল-জুলুম ভয়াবহ আকার ধারণ করবে এবং সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনের জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আদালতকেও ব্যবহার করা হবে।

পঞ্চদশ সংশোধনীর পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতি মীমাংসিত বিষয় হলেও তিন বছর পর কেন সরকার তা পরিবর্তনের তাগিদ বোধ করল, এ প্রশ্ন আজ সচেতন মহলের সকলের। যারা প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না, তারা বৈঠকখানায় তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।

অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদ ফিরে পেলে তা কেবল বিচারপতিদের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে না, নির্বাচন কমিশন ও আরও কয়েকটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের অপসারণের ক্ষমতাও সংসদের হাতে চলে যাবে। বিচারপতি ছাড়া অন্যান্যরা হলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সব কমিশনার, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানসহ সব কমিশনার এবং সরকারি কর্ম কমিশন, তথ্য কমিশন ও মানবধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানসহ সব সদস্য। মহা হিসাব নিরীক্ষকের পদ সাংবিধানিক হওয়ায় তিনিও এই অপসারণ পদ্ধতির আওতায় পড়বেন। যেমন অনুচ্ছেদ ১১৮(৫)-এ বলা হয়েছে–

''সুপ্রিম কোর্টের বিচারক যেরূপ পদ্ধতিতে ও কারণে অপসারিত হইতে পারেন, সেইরূপ পদ্ধতি ও কারণ ব্যতীত কোনো নির্বাচন কমিশনার অপসারিত হইবেন না।''

কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত ও প্রমাণের জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি না থাকায় তা অবশ্যই নির্ধারিত হবে সংসদ দ্বারা। সুতরাং সংসদের অভিশংসনের ক্ষমতার এই জাল এতদূর পর্যন্ত বিস্তারিত থাকবে যে, তা ভেদ করে কোনো সাংবিধানিক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করা সম্ভব হবে না। যে কোনো কমিশনার যে কোনো সময় সরকারের ইচ্ছার শিকার হতে পারেন। যে স্পর্শকাতর নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে এত বিতর্ক, তা কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলবে।

শ্রীলংকা দক্ষিণ এশিয়ারই একটি দেশ। স্বাভাবিকভাবেই দেশটির রাজনীতি ও অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের মিল রয়েছে। প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ রাজাপক্ষের দল ও পরিবার অত্যন্ত ক্ষমতাশালী, রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের মুঠোয়। ২০১২ সালে সরকারের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয় প্রধান বিচারপতির, যিনি একজন নারী। শিরানি বন্দরনায়েক। সুপ্রিম কোর্টের অধিকাংশ বিচারপতিই তার পক্ষালম্বন করেন। বিরোধের এক পর্যায়ে পার্লামেন্টে শিরানিকে অভিশংসনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়।

এর প্রতিবাদ দেশের সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক মহলে বিস্তার লাভ করে। কমনওয়েলথ, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা, বিচারক ও আইনজীবীদের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও দেশটির বিপন্ন বিচার বিভাগের পাশে দাঁড়ায় এবং সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু এত কিছুতেও কাজ হয়নি। শিরানির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে পার্লামেন্ট তাকে অভিশংসিত করে এবং তাকে বিদায় নিতে হয়। প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষ পরে অনুগত বিচারকদের দ্বারা সুপ্রিম কোর্ট পুনর্গঠন করেন।

বাংলাদেশে অবশ্য কোনো শিরানি নেই। তবুও শতভাগ অনুগত্য নিশ্চিত করার জন্য সরকারের হাতে অস্ত্র চাই প্রয়োজনে যা ভবিষ্যতে ব্যবহার করা যাবে।

বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে কার্যকর বিরোধী দল বলে কিছু নেই। অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে, এমন আশা করারও কোনো কারণ নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়া বস্তুত আর কোনো দলের কার্যকরিতা নেই। বলতে গেলে দেশ এক ধরনের সীমিত বা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চলছে। এই অবস্থায়ও সরকার স্বস্তি বোধ করছে না।

বন্ধ্যাত্ব ব্যাধিতে আক্রান্ত সমাজের প্রতিবাদী কণ্ঠ এখন ক্ষীণ। স্বার্থচিন্তায় অন্ধ নাগরিক সমাজের পদচারণা ক্ষমতার অলিগলিতে। দুর্নীতি, খুন-খারাবি, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, অন্যায়-অবিচার, দুষ্টের পালন, শিষ্টের দমন, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা কোনো কিছুই তাদের অলিগলি থেকে রাজপথে নিয়ে আসতে পারেনি বরং পরিস্থিতি যতই প্রতিকূলে গড়াচ্ছে, তারা কচ্ছপের মতো মাথা গুটিয়ে নিচ্ছে কঠিন দেহাবরণে। ন্যায়বিচার ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন।

এই অর্থহীন গণতন্ত্রকে নির্বাচনতন্ত্রের পরিহাসে পরিণত করেছে আমাদের রাজনীতিকরা। ক্ষমতার সিঁড়িতে আরোহণ ছাড়া এখন তা আর কিছু নয়। মিথ্যাচারের বেসাতিই হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের একমাত্র অবলম্বন। যে সংবাদপত্র বা মিডিয়া সমাজের দর্পন তাতেও যদি আঁচড় পড়ে ঝাপসা হয়ে যায়, রাষ্ট্রের মালিক জনগণের সমাজচিত্র অবলোকনের আর কী বিকল্প থাকবে?

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, যারা নীতিমালা মানে না তারা স্বৈরাচারীর দালাল। না, তারা স্বৈরাচারীর দালাল নয়। তবে এই নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে তারা স্বৈরাচারীর দালাল হবে। সংবাদপত্র বা মিডিয়া কেবল সমাজের দর্পণই নয়, তাতে প্রতিবিম্বিত আলোকরশ্মিতে সমাজ আলোকিতও হয়। আলোকিত সমাজ নির্মাণের জন্যই আঁচড়বিহীন স্বাধীন মিডিয়া দরকার। নীতিমালা সেই স্বাধীনতা খর্ব করলে সমাজ অন্ধকারে ডুবে যাবে। তাতে ক্ষতি কেবল সংবাদপত্র বা মিডিয়ার হবে না, ক্ষতি হবে দেশের ও গণতন্ত্রের।

গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। সংবাদপত্র বা মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে যদি তাদের জবাবদিহিতা পাঠক ও শ্রোতাদের কাছে থাকে। তেমনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও নিশ্চিত হবে যদি বিচারকরা বিচারকাজ সম্পাদন করতে পারেন বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে। তবে তার পরিবর্তে যদি সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যম ও বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা আইন দ্বারা সরকারের কাছে নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা হয়, তা দায়বদ্ধতাহীন সরকারের পথ উম্মোচন করবে, যে পথে একসঙ্গে বহুদলীয় গণতন্ত্র হাঁটতে পারে না।

স্বচ্ছতা না থাকলে জবাবদিহিতা থাকে না, জবাবদিহিতা না থাকলে স্বেচ্ছাচারিতার জন্ম হয়। অতীতে আমাদের সে নজির রয়েছে। যে কারণে এত উদ্বেগ, এত শংকা, এত প্রশ্ন।

আমানুল্লাহ কবীর: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমের সিনিয়র এডিটর।