সংশয় অভিশংসনে

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 8 Sept 2014, 08:38 AM
Updated : 8 Sept 2014, 08:38 AM

স্বাধীনতার চার দশকেরও বেশি সময় পর শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও সংসদের পরিধি ও ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়েন কি প্রমাণ করে না যে, মীমাংসিত স্পষ্ট ও স্বচ্ছ ধারণা ছাড়াই রাষ্ট্রের এ তিনটি বিভাগ চলছে এবং স্বভাবতই অনিয়ম আর অরাজকতা, একই সঙ্গে অস্পষ্টতা প্রায় আবহমানতা পেতে চলেছে? মাঝে মাঝেই বিভাগ তিনটির মধ্যে দ্বন্দ্বমুখর অবস্থার উদ্ভব হতে দেখা যায়। কর্তৃত্বের, নেত্বত্বের, প্রভুত্বের প্রতিযোগিতাও দেখা যায় কখনও কখনও। পরিমিতিবোধ, প্রজ্ঞা ও সততার স্বতঃস্ফূর্ত ভাবধারার অনুপস্থিতিও নজিরবিহীন নয়।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সুশাসন তখনই সুসংহত হয় যখন রাষ্ট্রীয় তিনটি অঙ্গের কর্মকাণ্ডের মধ্যে ভারসাম্য বিরাজ করে। অর্থাৎ সবক'টি অঙ্গই যখন যুগপৎভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকর উদ্যোগ বাস্তবায়নে আগ্রহী হয়। এর কারণ হল, সংবিধানে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গেরই ক্ষমতা ও কার্যপরিধির বিভাজন স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা রয়েছে। তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে এটা প্রশ্নাতীত। তবে সমস্যার সৃষ্টি তখনই হয় যখন সবক'টি অঙ্গই নিজ নিজ ক্ষমতা স্বাধীনভাবে প্রয়োগের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ প্রক্রিয়ায় কখনও কখনও ক্ষমতার দম্ভের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

দেশের গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার স্বার্থেই বিচার বিভাগ ও সংসদ এ দুই গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। কারণ বিচার বিভাগ ও সংসদের মধ্যে কোনো ধরনের বিরোধ দেখা দিলে তা হবে গণতান্ত্রিক ধারার জন্য অশনি সংকেত। বিচার বিভাগ ও সংসদ নিয়ে বর্তমানে যে বিরোধ দেখা দিয়েছে, তা পারস্পরিক সীমারেখা ও শ্রদ্ধার ওপর গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।

উচ্চ আদালতের বিচারকেরা কোনো অসদাচরণ করলে তাদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের থাকা উচিত কি না, তা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। ২০১২ সালে তৎকালীন স্পিকার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদের একটি রুলিং কেন্দ্র করে কয়েকজন সংসদ সদস্য হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকে অপসারণের দাবি তোলেন। সে সময়ই বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জোরালো হয়। যদিও সে সময় তা আর হয়নি। তবে সরকার চলমান অধিবেশনে বিচারপতিদের অপসারণে সংসদীয় অভিশংসন প্রথা চালু করে আইন পাশ করতে বদ্ধপরিকর।

আবারও বিচারপতিদের অপসারণের বিষয়টি সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা প্রায় চূড়ান্ত। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের আদি সংবিধানের ৯৬ ধারা অনুযায়ী সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণ বা অভিশংসনের ক্ষমতা ছিল। বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ ধারায় বলা হয়েছে–

''একজন বিচারপতি যদি দায়িত্ব পালনে অপারগ হন, দুর্নীতি বা নৈতিক স্খলন ঘটে সংসদ তাকে অপসারণ বা অভিশংসন করতে পারে।''

মূল সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদটি সামরিক শাসনামলে ১৯৭৮ সালের দ্বিতীয় ঘোষণা মারফত নতুন করে প্রতিস্থাপন করা হয়। পাকিস্তানও তার প্রথম সংবিধান প্রণয়ন করতে গিয়ে ১৯৫৬ সালে বিচারক অপসারণে অভিশংসন নাকি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এই দোটানায় পড়ে। শেষে সংসদীয় অভিশংসন-প্রথা গ্রহণ করে। পাকিস্তানের সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর আইয়ুব খান প্রথমবারের মতো সংসদীয় অভিশংসন-প্রথার পরিবর্তে জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রবর্তন করেন।

সব সামরিক শাসকই সম্ভবত একই ভূতে ভূতগ্রস্ত, না হলে আইয়ুবীয় পদাঙ্ক অনুসরণ করে জেনারেল জিয়া কেন সংসদীয় অভিশংসন-প্রথা বিলোপ করবেন? কারণ এই ব্যবস্থার বড় বেনিফিসিয়ারি তো সামরিক শাসকেরা। সামরিক শাসন জারি অবস্থায় সংসদ থাকে না। যেহেতু সংসদ থাকে না সে ক্ষেত্রে অভিশংসন-প্রথারও দরকার পড়ে না।

তবে এই সরকারের আমলেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী হয়েছে, সর্বশেষ সংশোধনীর খসড়ায় বিচারপতিদের অপসারণ বা অভিসংশনের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনার সুপারিশ ছিল, যদিও পরে তা কার্যকর হয়নি। বিচারপতিদের অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থাই বহাল রাখা হয়। কারণ বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদকে দিলে আদালতের রায়ের কারণে সংসদ যদি অসন্তুষ্ট হয় তাহলে সংসদের কর্তৃত্ব অপপ্রয়োগের সুযোগ থেকে যায়।

বর্তমান সংবিধানের ৯৬ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে–

"একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকিবে, যাহা এই অনুচ্ছেদে 'কাউন্সিল' বলিয়া উল্লেখিত হইবে এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকদের মধ্যে যে দুইজন কর্মে প্রবীণ তাহাদের নিয়া গঠিত হইবে।''

বিচারকদের অবসর গ্রহণ ছাড়া তাঁদের পদ থেকে কোনোভাবেই অপসারিত করা যাবে না, যদি তাঁর অসামর্থ্য বা গুরুতর কোনো অসদাচরণ তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ না হয়। আর এ বিষয়টি রাষ্ট্রপতির নির্দেশে তদন্ত করবেন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল।

৯৬ (৫) অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে–

''যে ক্ষেত্রে কাউন্সিল অথবা অন্য কোনো সূত্র হইতে প্রাপ্ত তথ্যে রাষ্ট্রপতির এরূপ বুঝিবার কারণ থাকে যে, কোনো বিচারক-

ক. শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে তাহার পদে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করিতে অযোগ্য হইয়া পড়িতে পারেন, অথবা–

খ. গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হইতে পারেন, সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলকে বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত করিতে ও উহার তদন্ত ফল জ্ঞাপন করিবার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।''

৯৬ (৬) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে– কাউন্সিল তদন্ত করার পর রাষ্ট্রপতির কাছে যদি এরূপ প্রতিবেদন দাখিল করেন যে, কাউন্সিলের মতে কোনো বিচারক তাঁর পদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে (শারীরিক ও মানসিক কারণে) অযোগ্য হয়ে পড়েছেন বা গুরুতর অসদাচরণের জন্য দোষী হয়েছেন, তাহলে রাষ্ট্রপতি আদেশ দ্বারা ওই বিচারপতিকে অপসারণ করবেন।

বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদকে দিতে হলে, সংবিধানে এ ধরনের কোনো পরিবর্তন করতে হলে আবারও সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এই সংসদ নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে। অধিকাংশ সংসদ সদস্য বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। এই সংসদের সংবিধান পরিবর্তন করা উচিত নয়। রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে সর্বতোভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। সংসদের কাছে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হলে বিচার বিভাগের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হবে। বর্তমান সরকার বিভিন্নভাবে ক্ষমতা সুসংহত করার চেষ্টা করছে। সর্বশেষ বিচারকদের অপসারণ নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, এটা তারই একটা অংশ।

উচ্চ আদালতের কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা প্রাথমিক তদন্তের ক্ষমতা বিচার বিভাগের হাতে রাখা উচিত। চলমান আইনে রাষ্ট্রপতি যে ক্ষমতাবলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্তের ভার কাউন্সিলকে দিয়ে থাকেন, তেমনটিই হওয়া উচিত। উচ্চ আদালতের বিচারকদের আচরণ ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তদন্ত সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দিলে তার ভিত্তিতে সংসদ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারে। এভাবে পরিবর্তন হলে প্রশ্নের অবকাশ কম থাকে। যদি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে পাশ কাটিয়ে শুধু সংসদের ওপর ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়, তাহলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে মারাত্মকভাবে।

উচ্চ আদালতে বিচারকদের অপসারণ নিয়ে ভিন্নমতও আছে, সামরিক বিধি দ্বারা সংবিধানের নূন্যতম পরিবর্তনও করা যায় না। জিয়ার সামরিক সরকারের ঘোষণাপত্র মারফত নতুন করে প্রতিস্থাপিত ৯৬ অনুচ্ছেদের সুপ্রিম কাউন্সিল গঠনের বিধান আদতেই অবৈধ ছিল। যদিও তা ১৯৭৮ সালের পরে পঞ্চম সংশোধনী দ্বারা বৈধতা দেওয়ার প্রয়াস চালানো হয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রায়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করা হয়। কাজেই সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ যদি '৭২ সালের সংবিধানে ফিরিয়ে নেওয়া হয় তাহলে আইনি ব্যত্যয় কিছু হবে না। ভারতসহ বহু রাষ্ট্রে এ ধরনের ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে।

সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছিলেন যে, ব্রিটিশ হাউস অব কমনস ১৬৮৯ সালে, যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস ১৭৮৭ সালে এবং ভারতের লোকসভা ১৯৫০ সালে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে দিয়েছে। এ ধরনের ব্যবস্থা আরও দেশে চালু রয়েছে। এ দেশে হলে অসুবিধার কিছু নেই।

তবে এই ক্ষমতা থাকা নির্ভর করে ক্ষমতা ব্যবহারের ওপর। ক্ষমতা ব্যবহারের ওপরই নির্ভর করবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তথা এ দেশের ভবিষ্যৎ। যদি সংসদকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং ক্ষমতা যদি প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয় বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহৃত হয়, এর দায়দায়িত্ব সংসদকেই নিতে হবে।

সংসদীয় অভিশংসন-প্রথার সমর্থনকারীদের শ্রীলঙ্কার প্রধান বিচারপতিকে অপসারণ ঘটনার দিকে একটু নজর দিতে বলব। প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাক্ষে দেশের প্রধান বিচারপতি শিরানি বন্দরানায়েককে অপসারণ করেন গত বছরের জানুয়ারিতে। পার্লামেন্টে প্রধান বিচারপতিকে অভিশংসন সংক্রান্ত বিল উত্থাপন করা হলে ওই বিলের পক্ষে ১৫৫ এবং বিপক্ষে ৪৯ ভোট পড়ে। শুরুতে প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাক্ষের আস্থাভাজন বলেই পরিচিত ছিলেন শিরানি। কিন্তু ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়ন মন্ত্রীর ক্ষমতা বাড়ানো সংক্রান্ত আইনের একটি অনুচ্ছেদ নিয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। প্রেসিডেন্টের বিরোধিতা সত্ত্বেও শিরানি মন্ত্রীর ক্ষমতা বাড়ানোর ওই অনুচ্ছেদ বাতিল করেন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন প্রেসিডেন্টের ভাই বাসিল রাজাপাক্ষে।

যদিও আদালত বন্দরানায়েককে অভিশংসন করার বিষয়টি অসাংবিধানিক হিসেবে উল্লেখ করে এবং পার্লামেন্টারি কমিটিতে তাকে 'অভিযুক্ত' করার বিষয়টি বাতিল করে দেয়। সম্পদের হিসাব না দেওয়া, সরকারি সম্পত্তির অপব্যবহারসহ ১৪ অভিযোগের মধ্যে সংসদীয় কমিটি তাকে তিনটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন বন্দরানায়েকে।

প্রধান বিচারপতিকে সরিয়ে দেওয়ায় প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের ক্ষমতা আরও সুসংহত হবে বলে দাবি করেছেন রাজাপাক্ষের সমালোচকরা। আগে এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে পারতেন না। কিন্তু রাজাপাক্ষে ২০১০ সালে সংবিধান সংশোধন করে তা তুলে দেন। এখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের মেয়াদের কোনো সীমা নেই।

প্রধান বিচারপতি শিরানিকে অভিশংসনের পুরো প্রক্রিয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে উল্লেখ করেছেন লন্ডনভিত্তিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতবিরোধী ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের শ্রীলঙ্কার পরিচালক অ্যালান কেনান। তিনি বলেন, "রাজাপাক্ষের সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তাঁকে অভিশংসিত করা হয়েছে।"

বাংলাদেশে রাজাপক্ষের মতো রাজ-মনোভাবের ব্যক্তির অভাব হবে না সংসদীয় অভিশংসন প্রথা চালু হলে।

প্রসিডিউরাল আইন, সাবস্ট্যানটিভ আইন তো অবশ্যই, সাংবিধানিক ইত্যাদি আইনেও বাংলাদেশ বেশ ভালোভাবেই ভারতীয় আইনের প্রভাবে প্রভাবিত। নতুন আইন প্রণয়ন করার ক্ষেত্রেও আমরা ভারতের উদাহরণ দিতে শ্লাঘা বোধ করি। বিচারপতিদের অভিশংসন আইন করতেও অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের আইনের কথা উচ্চারিত হচ্ছে হামেশাই।

বারের সনদপ্রাপ্ত কোনো আইনজীবী সংশ্লিষ্ট আদালতের কোনো বিচারকের পরিবারের সদস্য হলেও বিচারকের বাসভবন ব্যবহার করতে পারবেন না এমন আইনি ধারা (৫ ধারা) সম্বলিত একটি আইন হল 'রিস্টেটমেন্ট অব ভ্যাল্যুজ অব জুডিশিয়াল লাইফ'। ভারত ২০১০ সালে 'দ্য জুডিশিয়াল স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিবিলিটি বিল, ২০১০' পাশ করেছে। এতে আচরণবিধির লঙ্ঘন দ্রুত আমলে নিতে অ-বিচারক সদস্যদের দিয়ে একটি ওভারসাইট কমিটি গঠনের প্রস্তাব আছে। অথচ আমাদের সুপ্রিম কোর্টে বিচারকদের জন্য কোনো ওভারসাইট কমিটি নেই, বিচারক নিয়োগের বিধিমালা নেই। যদিও দিন কয় আগে ভারত তার বহুদিনের চর্চিত কলোজিয়াম প্রথা রদ করে বিচারক নিয়োগে নতুন প্রথার আইন পাস করেছে।

পছন্দেরটা নেব অন্যটা নেব না, এই মানসিকতা আমাদের সরকারগুলোর চিরাচরিত অভ্যাস। সরকার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বিন্যাস কিংবা সংস্কার করে বিচারকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা কেবল বিচার বিভাগের প্রতিই নয়, এরূপ যে কোনো উদ্যোগ আইনের শাসন, সুশাসন, মানবাধিকার, সর্বোপরি গণতন্ত্রের জন্যই বড় আঘাত। হলিস্টিক অবস্থানের পরিবর্তে কাস্টমাইজড অবস্থানের কারণেই সরকারের নতুন সংশোধনী আনার প্রয়াস প্রশ্নবিদ্ধ।

সংসদকে কার্যকর বা সংসদের ক্ষমতা বৃদ্ধির দায়িত্ব শুধু সরকার বা বিরোধী দলের একার নয়। দায়িত্বটা উভয়ের উপরই সমান। তবে ১৯৯১ সালে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সরকার ও বিরোধী দলের ভূমিকা সব কিছুতেই পরস্পরবিরোধী হওয়ার কারণে সংসদ কখনওই কার্যকর বা শক্তিশালী হয়নি। রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকলেও বিচারপতিদের অভিশংসনের প্রশ্নে ঐক্যমতে পৌঁছেছে সরকার ও বিরোধী দল। বিরোধী দলের মিনমিনে প্রতিবাদ তারই ইঙ্গিত দেয়।

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন কিন্তু তার মালিক নির্বিশেষে সবার জন্যই সমান হুমকি।

এম এম খালেকুজ্জামান: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।