নৌপথে দুর্ঘটনারোধে করণীয় প্রসঙ্গে

এইচ এম মহসীন
Published : 27 August 2014, 12:46 PM
Updated : 27 August 2014, 12:46 PM

ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়– বহুল প্রচলিত এই প্রবাদটি বাঙালি জাতির জন্য প্রযোজ্য বলে মনে হয় না। 'বেলতলার' তিক্ত, অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা যদি শিক্ষা নিতে পারতাম তাহলে প্রতি বছরই ঈদের সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে একইভাবে লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটত না।

কয়েক সপ্তাহ আগে পদ্মায় মাওয়া-কাওড়াকান্দি রুটে এমভি পিনাক-৬ নামক লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার ঘটনা আমাদের সকলেরই জানা। মোবাইলে ধারণ করা লঞ্চডুবির সেই মর্মান্তিক ভিডিওটি অনেকেই দেখেছেন। সম্প্রতি ওই লঞ্চের মালিক এবং মালিকের ছেলেকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। বিদ্যমান আইনে লঞ্চের মালিক কতখানি অপরাধী সে প্রসঙ্গ না হয় আইনজীবরাই দেখবেন। তবে আমরা সাধারণ মানুষেরা বাংলাদেশে এমন অসংখ্য মর্মান্তিক মৃত্যু দেখেছি এবং ঘটনা-পরবর্তী সময়ে গ্রেফতারও দেখেছি, কিন্তু এসব গ্রেফতারে কোনো সমস্যার সমাধান হয়নি, বরং বছরের পর বছর একইভাবে দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।

দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে গত কয়েক বছরে যতগুলো লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় প্রতিটির কারণ হিসেবেই ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি (কখনও দুই বা তিনগুণ) যাত্রী পরিবহন করা এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের ফিটনেস সার্টিফিকেট না থাকার অভিযোগ উঠে এসেছে। কখনও হয়তো এর সঙ্গে নদীতে অধিক স্রোত বা ঢেউও সহায়ক ভূমিকা রেখেছে, তবে সেগুলো মূল কারণ ছিল না। ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী বহন করলে, সংশ্লিষ্ট নৌযান চলাচলের উপযুক্ত না হলে এবং অদক্ষ চালক ও স্টাফদের দ্বারা পরিচালিত হলে এ ধরনের প্রাণহানি অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও মোটেই অভাবনীয় নয়।

তাই লঞ্চডুবির ঘটনাগুলো দুর্ঘটনা বলে দেখার কোনো সুযোগ নেই। মূলত নৌপরিবহন মালিকদের অতিরিক্ত মুনাফার লোভে নিরাপত্তা বিষয়ে গাফিলতির কারণেই 'পাঠার বলি' হন সাধারণ যাত্রী। কিন্তু এর শেষ কোথায়? নদীর পাড়ে স্বজন-হারানো মানুষের কান্না ও আহাজারির দৃশ্য আমরা আর কতদিন দেখব?

অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, 'সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ' সমীপে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সুপারিশ উপস্থাপন করা উলুবনে মুক্তা ছড়ানোরই নামান্তর। কিছু মানুষের অবহেলা ও লোভের কারণে প্রতি বছর শতশত মানুষের এমন নির্মম মৃত্যু নিঃশব্দে মেনেও তো নেওয়া যায় না। তাই কেউ শুনবে না জেনেও নৌপথে দুর্ঘটনারোধের লক্ষ্যে কিছু সুপারিশ তুলে ধরার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছি। নৌপথের চলাচল নিরাপদ করতে মূলত, তিনটি বিষয় মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক– দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানো, দুর্ঘটনা মোকাবিলার প্রস্তুতি এবং দুর্ঘটনা-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা।

নৌপথে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানোর জন্য স্বভাবতই উপযুক্ত নৌযান, দক্ষ চালক এবং অনুকূল আবহাওয়ার বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি নৌযানের (যাত্রীবাহী অথবা মালবাহী) ডিজাইন, ধারণ ক্ষমতা, কারিগরি দিক, রুট ইত্যাদি বিবেচনা করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) অনুমতিপত্র বা ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়ার বিধান কার্যকর করতে হবে। নিরাপত্তার যথাযথ মানদণ্ডে অনুত্তীর্ণ একটি লঞ্চও যাতে যাত্রী পরিবহন করতে না পারে সেটি শতভাগ নিশ্চিত করা জরুরি। অধিকন্তু প্রতিটি নৌযানকে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে পরিপূর্ণ পরিদর্শন সাপেক্ষে ফিটনেস সার্টিফিকেট নবায়ন করার বিধানও কার্যকর করতে হবে।

তবে এটাও ঠিক, লঞ্চ মালিকদের প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফিটনেস সার্টিফিকেট বা অন্যান্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। তাই এ ক্ষেত্রে 'কাঁটা দিয়ে কাঁটা' তুলতে হবে– অর্থাৎ এমন পদ্ধতি চালু করতে হবে যাতে বিত্তবান ব্যবসায়ীদের (যারা অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী রাজনীতিকও) মধ্যে দুটি শক্তিশালী পক্ষের তৈরি হয় এবং তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি হয়। নিজ নিজ আর্থিক স্বার্থ রক্ষায় নেওয়া তাদের পদক্ষেপগুলোই যাতে সাধারণ যাত্রীদের জন্য নিরাপদ নৌপরিবহন নিশ্চিত করে।

এ ক্ষেত্রে প্রচণ্ড প্রতাপশালী নৌপরিবহন মালিকপকক্ষের বিপক্ষে দ্বিতীয় পক্ষ হিসেবে বীমা ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে নৌপরিবহন চালনা করার জন্য বাধ্যতামূলক বীমার প্রচলন করতে হবে। বীমাকারী প্রতিষ্ঠানের যথাযথ কাভারেজ সংক্রান্ত সার্টিফিকেট ছাড়া কোনো লঞ্চকেই যাত্রী পরিবহনের জন্য লাইসেন্স দেওয়া যাবে না।

এ ক্ষেত্রে দুটি শর্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, বীমাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কোনোভাবেই পরিবহন মালিকদের নিজস্ব (বা আত্মীয়-স্বজনের) মালিকানাধীন হতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি নৌযানের জন্য বিশাল পরিমাণের আর্থিক বীমা থাকতে হবে যাতে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়।

বীমার উদ্দেশ্য থাকবে দুটি-– প্রত্যেক যাত্রী ও চালকের জীবনের ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং দুর্ঘটনা কবলিত সংশ্লিষ্ট নৌযানের মালিকের আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান। প্রতি আরোহীর জীবনের জন্য কমপক্ষে পঞ্চাশ লক্ষ টাকার বীমা এবং নৌযানের মূল্যভিত্তিক সেটির জন্য আর্থিক কাভারেজ থাকতে হবে। দৈব বা কারিগরি ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে বীমা কর্তৃপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে এই আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেবে।

উদাহরণ হিসেবে ধরুন, পিনাক-৬ এ যাত্রী ও চালকসহ ২০০ জন আরোহী ছিল এবং লঞ্চের আর্থিক মূল্য ছিল পঞ্চাশ লক্ষ টাকা। উপরোক্ত প্রস্তাব মোতাবেক ওই লঞ্চের জন্য প্রয়োজনীয় বীমার পরিমাণ হত একশ কোটি টাকারও বেশি। অর্থাৎ দুর্ঘটনার কারণে বীমাকারী প্রতিষ্ঠানের খরচ হত একশ কোটি টাকারও বেশি।

বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো যেহেতু এ ধরনের আর্থিক দুর্যোগের ঝুঁকি নিতে চাইবে না, তাই চলাচলের অনুপযোগী জাহাজের কাছে তারা বীমা বিক্রিই করবে না। আর অপেক্ষাকৃত পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ জাহাজের কাছে বীমা বিক্রি করলেও তার প্রিমিয়ামও নির্ধারিত হবে অনেক বেশি। তাই বীমা ছাড়া জাহাজ চলাচলের বন্ধ করতে পারলে নৌপরিবহনের মালিকরা বাধ্য হয়েই যথাযথ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের জাহাজ নিরাপদ করে তুলবেন।

যেহেতু পরিবহন মালিক এবং বীমা প্রতিষ্ঠানের মালিক উভয়েই প্রভাবশালী, তাদের মধ্যে আর্থিক স্বার্থ রক্ষার লড়াই সাধারণ যাত্রীদের জন্য মানসম্মত নৌপরিবহন নিশ্চিত করতে পারবে।

দ্বিতীয়ত, লঞ্চের চালক এবং স্টাফদের যথাযথ প্রশিক্ষিত ও লাইসেন্সপ্রাপ্ত হতে হবে এবং শারীরিকভাবেও উপযুক্ত থাকতে হবে, যাতে বিপদকালীন সময়ে তারা যাত্রীদের সাহায্য ও দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে কারিগরি ও ব্যবহারিক জ্ঞান এবং শারীরিক উপযুক্ততা যাচাইয়ের জন্য নিয়মিত বিরতিতে পরীক্ষা ও মহড়ার মাধ্যমে চালক ও স্টাফদের লাইসেন্স নবায়নের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

আবহাওয়ার পূর্ভাবাস ও চূড়ান্ত প্রস্তুতি পরিদর্শন ব্যবস্থার প্রচলন করা যেতে পারে যাতে একটি স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটারাইজড সিস্টেম প্রতিটি জাহাজের নিয়মিত রুটের আবহাওয়ার পূর্ভাবাস নির্ধারিত মানদণ্ডের নিরিখে বিশ্লেষণ করে চলাচলের অনুকূল বিবেচিত হলে ইলেকট্রনিকভাবে সংশ্লিষ্ট জাহাজকে বন্দর ত্যাগ করার ক্লিয়ারেন্স দেবে। একইভাবে লঞ্চ ছাড়ার আগে সংশ্লিষ্ট পরিবহন মালিকের পক্ষের নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন স্টাফ পুরো নৌযান ঘুরে দেখে, যাত্রীসংখ্যা এবং লঞ্চের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সরঞ্জাম পরিদর্শন করে সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাকে ইলেকট্রনিকভাবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে। এই প্রতিবেদনের কোনো অংশ বাকি থাকলে জাহাজ বন্দর ত্যাগ করতে পারবে না।

প্রস্তাবিত এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশেই কমানো যাবে এবং জাহাজের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে মালিক কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব হবে।

এর সঙ্গে দরকার যাত্রী সচেতনতা। নৌপথে যাতায়াতের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়ে যাত্রীদের সচেতনতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। জাহাজের ধারণক্ষমতা, ফিটনেস সার্টিফিকেটের মেয়াদ, চালক ও স্টাফদের লাইসেন্স, অভিজ্ঞতা এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস সংক্রান্ত তথ্য ও জরুরি অবস্থায় করণীয় সমন্ধে যাত্রীদের অবগত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাহাজ ত্যাগ করার পূর্বে লাউড স্পিকারের মাধ্যমে তিন থেকে পাঁচ মিনিটের একটি ঘোষণা দেওয়ার নিয়ম চালু করা যেতে পারে।

এবার দেখা যাক, দুর্ঘটনাকালীন সময়ে জানমালের ক্ষতির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রতিকূল আবহাওয়া বা কারিগরি ত্রুটির কারণে যদি দুর্ঘটনা আসন্ন মনে হয়, সে ক্ষেত্রে দুর্যোগ মোকাবিলায় চালক এবং স্টাফদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে, তাই তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।

যদি দুর্ঘটনা ঘটে যায় তাহলে প্রাণহানির ঝুঁকি কমাতে জাহাজের প্রত্যেক আরোহীর জন্য ভেসে থাকার সরঞ্জাম (বয়া বা লাইফ জ্যাকেট) থাকতে হবে যাতে উদ্ধারকারী দল পৌছানোর আগ পর্যন্ত যাত্রীরা ভেসে থাকতে পারেন। এই লাইফ জ্যাকেটগুলো প্রতিটি সিটের সঙ্গে থাকতে হবে যাতে প্রয়োজনীয় সময়ে মুহূর্তের মধ্যেই যাত্রীরা লাইফ জ্যাকেট পরিধান করতে পারেন।

বর্তমানে অনেক লঞ্চেই কয়েকটি বয়া থাকে যেগুলো অনেকটা 'শোপিসের' মত সাজিয়ে রাখা হয়। কয়েকশ যাত্রী বহনকারী একটি জাহাজে ২০ কী ৩০ টি বয়া একদিকে যেমন মোটেই পর্যাপ্ত নয়, অন্যদিকে নাগালের বাইরে থাকার কারণে এগুলো সহজে ব্যবহার করাও সম্ভব হয় না।

অনেক সময়ে দেখা যায়, লঞ্চডুবি ঘটলে যাত্রীদের বড় একটি অংশ লঞ্চ থেকে বের হওয়ারই সুযোগ পান না। এ জন্য প্রতিটি জাহাজে অসংখ্য জরুরি বহির্গমন পথ থাকতে হবে এবং এমন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা করা যেতে পারে যাতে বিপদ আসন্ন উপলব্ধি করলে জাহাজের প্রধান চালকের একটি সুইচের চাপে সবগুলো দরজা খুলে যাবে। তাহলে লঞ্চডুবির ক্ষেত্রে যাত্রীরা ডুবন্ত লঞ্চ থেকে বের হয়ে লাইফ জ্যাকেট বা বয়ার সাহায্যে ভেসে থাকতে পারবেন।

আমরা দেখেছি শতশত মানুষের সামনে, দিনের আলোতে পিনাক-৬ নামক লঞ্চটি ডুবল, অথচ উদ্ধারকারী কর্তৃপক্ষ লঞ্চটির অবস্থানই শনাক্ত করতে পারল না। এমন ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি দেখতে না চাইলে আমাদের দুটি বিষয়ে উন্নতি করতে হবে-– রেসপন্স টাইম এবং অত্যাধুনিক ট্র্যাকিং প্রযুক্তি। ট্র্যাকিং প্রযুক্তির জন্য প্রতিটি নৌযানে ওয়াটারপ্রুফ জিপিএস জাতীয় কোনো যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।

পিনাক–৬ এর মতো অনেক নৌ-দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই উদ্ধারকারী জাহাজ বা সরঞ্জাম দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে দেরি হওয়া বা প্রতিকূল আবহাওয়ার (রাত, তীব্র স্রোত বা ঢেউ) কারণে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করতে অনেক দেরি হয়ে যায়, যার ফলে যাত্রীদের জীবিত (অথবা মৃত) উদ্ধার করা, অথবা জাহাজ উদ্ধার করা অনেক কঠিন (কখনও কখনও অসম্ভব) হয়ে পড়ে। বিপদকালীন সময়ে জরুরি সাহায্যের জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

প্রথমত, অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ স্থান, যেমন মাওয়া-কাওড়াকান্দি বা আরিচা-দৌলতদিয়া ঘাট যেখান দিয়ে দৈনিক লক্ষ লক্ষ যাত্রী নদী পারাপার করেন সেখানে সর্বক্ষণিক একাধিক উদ্ধারকারী জাহাজ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম তৈরি রাখতে হবে যাতে সম্ভাব্য দ্রুত সময়ে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করা যায়। দ্বিতীয়ত, রাতের অন্ধকার বা তীব্র স্রোতের মতো প্রতিকূলতার মধ্যেও উদ্ধারকার্য সম্পাদনের লক্ষ্যে উন্নত দেশে নৌ-দুর্ঘটনায় উদ্ধারকাজে ব্যবহৃত সরঞ্জামের উপযুক্ততা বিবেচনা করে আমদানি করতে হবে। তৃতীয়ত, দুর্ঘটনা মোকাবিলায় বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের করণীয় সমন্ধে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর থাকতে হবে, যাতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সিদ্ধান্তহীনতা উদ্ধারকার্য শুরুতে বিলম্ব না ঘটায়।

সবশেষে দুর্ঘটনা-পরবর্তী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ডুবে যাওয়া জাহাজের আরোহী এবং জাহাজ উদ্ধার করা, আহতদের চিকিৎসা প্রদান, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে উদ্ধার তৎপরতা সম্পর্কে সর্বশেষ খবর জানানো, সান্তনা ও সহায়তার আশ্বাস দেওয়া, মৃত্যুর ক্ষেত্রে স্বজনদের হাতে সুষ্ঠুভাবে লাশ তুলে দেওয়া এবং আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও ঘটনাস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং উদ্ধার তৎপরতায় কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা নিয়ে যাতে সন্দেহের উদ্রেক না ঘটে সেটি নিশ্চিত করাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ যাতে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টির মাধ্যমে ভাঙচুর জাতীয় ঘটনা না ঘটে।

এই পর্যায়ে প্রতিটি পদক্ষেপ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য পরিস্কার নীতিমালা তৈরি করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার নির্ধারণ নিয়ে যাতে বিতর্কের সুযোগ না হয় সেজন্য লঞ্চে ওঠার আগে প্রতিটি যাত্রীর নাম, ঠিকানা সংগ্রহ করে বিআইডব্লিউটি-এর ডাটাবেসে এন্ট্রি করতে হবে।

উপরে উল্লেখিত অনেক বিষয়েই বিআইডব্লিউটি-এর আইন ও নীতিমালা রয়েছে। তবে বেশিরভাগ অর্ডিন্যান্স, অ্যাক্ট বা রুলই অনেক পুরোনো এবং সময়োপযোগী নয়। যেমন, 'দি ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স– ১৯৭৬' অধ্যাদেশের পঞ্চম অধ্যায়ের ৫৮ (এ) ধারায় যাত্রী ও ক্রুদের জন্য জীবন বীমার কথা বলা থাকলেও, প্রয়োজনীয় আর্থিক কাভারেজের পরিমাণ উল্লেখ নেই।

এছাড়াও বিদ্যমান আইনে ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়া যাত্রী পরিবহন করা, প্রশিক্ষিত চালক বা ইঞ্জিনিয়ার ব্যতীত জাহাজ চালানো অথবা ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন করার জন্য যে ধরনের শাস্তির পরিমাণ নির্ধারণ করা আছে তা অত্যন্ত অপ্রতুল। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করার শাস্তি হিসেবে ('দি ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স– ১৯৭৬' ধারা ৬৬-৬৭ অনুযায়ী) দুই থেকে তিন বছর জেল এবং পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানার বিধান শত শত স্বজনহারা পরিবারের সঙ্গে ঠাট্টা করারই নামান্তর। পরিবহন মালিকদের গাফিলতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটা বন্ধ করতে হলে কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে।

দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য যাত্রীদেরও দ্বায়িত্বশীল হতে হবে। সময় বাঁচানোর জন্য গাদাগাদি করে লঞ্চে বা স্পিডবোটে নদী পারাপার না করে, বেশি সময় নিয়ে হলেও ফেরি ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সর্বোচ্চ চাহিদার সময়ে অর্থাৎ ঈদের দুদিন বা তিনদিন আগে গ্রামে না ফিরে, ঈদের এক সম্তাহ আগে অথবা ঈদের দুই একদিন পরে গ্রামে ফেরা যেতে পারে।

এছাড়াও প্রতি বছর ঈদের জন্য গ্রামে না ফিরে, গ্রামের বাবা-মা/আত্নীয় স্বজনকে শহরে নিয়ে আসা যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন রিভার্স ট্র্যাভেলের (সবাই যখন শহর থেকে গ্রামে ফিরতে চায়, তখন গ্রাম থেকে শহরে যাওয়ায় চাহিদা কম থাকে) মাধ্যমে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও হয়রানি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে, তেমনি ঈদ উদযাপনে ভিন্নতাও আসবে।

ঈদ আনন্দ উদযাপনের পরিবর্তে নদীর পাড়ে স্বজন হারানোদের আর্তনাদ আমরা আর দেখতে চাই না। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান সরকারের দায়িত্ব, তাই নৌপথে দূর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে সময়োপযোগী নীতিমালা তৈরিতেও সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে এবং বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে গেলে নৌপরিবহন পরিচালনের খরচ নিশ্চয়ই কিছুটা বেড়ে যাবে যা যাত্রীদের ভাড়ার পরিমাণ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। তবে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমানো গেলে সাধারণ যাত্রীরা কিছুটা অতিরিক্ত ভাড়া দিতে অসম্মত হবেন বলে মনে করি না। আর মালিকপক্ষ যাতে অনৈতিকভাবে ভাড়া বাড়াতে না পারে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।

সর্বশেষ কথা হচ্ছে, শুধু আইন বা নীতিমালা তৈরিতে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে না, তার প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। না হলে আগামী ঈদ-উল-আযহায়ও হয়তো দেখতে হবে নদীর পারে স্বজন-হারানোদের আহাজারির চিরাচয়িত সেই দৃশ্য।

এইচ এম মহসীন: স্ট্র্যাটিজি প্রফেশনাল।