গণতন্ত্র: পথ থেকে বিপথে

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 24 August 2014, 10:13 AM
Updated : 24 August 2014, 10:13 AM

এমনিতে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে বলেই মনে হয়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা অস্বস্তি, শ্বাসরোধ করে ধরার মতো একটা অবস্থা অনুভূত হচ্ছে। সবাইকে থামিয়ে দেওয়া, চুপ করিয়ে বসিয়ে রাখার মতো একটা আয়োজন যেন সম্পন্ন হচ্ছে। অথচ এ ব্যাপারে কেউ স্পষ্ট করে কিছু বলছেও না।

বলপ্রয়োগ করে মিছিল-সমাবেশ এমনকি অবস্থান পর্যন্ত ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। গণমাধ্যমের উপর ঝুলছে নিয়ন্ত্রণের খাড়া। কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপি 'অসুরের' ভূমিকায় আবির্ভূত হচ্ছেন। অনেক কিছুই গায়ের জোরে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও কোনো সমালোচনা কিংবা প্রতিবাদের আভাস মিললেই ক্ষমতাধররা তেড়ে-ফুঁড়ে উঠেছেন। কানমলা দিয়ে সবাইকে শান্ত রাখতে চাইছেন। এদিকে নানাভাবে বঞ্চিত সাধারণ মানুষের রাগ ও ক্ষোভ দিন দিন বেড়েই চলেছে।

শাসকরা ভাবছেন, সব ঠিকঠাক, কোথাও সমস্যা নেই। সমস্যার কথা বললেই তারা মন খারাপ করছেন, রেগে যাচ্ছেন। তাদের অবস্থান হল– যারা সঙ্গে নেই, তারা তাদের বিরুদ্ধে। সমালোচকরা দেশদ্রোহী। বিরোধী দল হচ্ছে ষড়যন্ত্রকারী। এই পরিস্থিতিতে অনেকে হতাশ হয়ে পড়ছেন। অনেকে অবশ্য হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার ফরমাশমতো নাচছেনও (যদিও পা নড়ছে না)! সব মিলিয়ে এক অনাকাঙ্ক্ষিত দমবন্ধ পরিস্থিতি!

হারিকিরিতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন বিশ্বনন্দিত জাপানি ঔপন্যাসিক ইউকিও মিশিমার। মর্মাম্তিক আত্মনিধন। ছুরিতে নিজের পেট, বুক চিরে, রক্ত সরোবরে শ্বেতপদ্মের শয়ান। মুদিত নেত্রে টাকরায় জিভ ঠেকিয়ে অম্তিম উচ্চারণ, আর নয়– বাণীতে আত্মসমর্পণের গ্লানি। অর্থ অস্পষ্ট, অপ্রকট। যুঝতে, বাঁচতে অস্বীকার। কিন্তু কেন? সাহিত্যিক তো অন্যকে বাঁচায়, দিশা দেখায়। শরণার্থীরা অক্ষরে অক্ষরে আশ্রয় পায়। তার পলায়ন অন্যায় নয়।

ভুরিভোজের পর 'আর নয়' বলা, আর জীবন যন্ত্রণা থেকে পার পেতে 'আর নয়' বলা কি এক? এ প্রাণ নদীর মতো। বাঁকে বাঁকে বিস্ময়। কোথাও সরু, কিছুটা এগিয়ে চওড়া। একই নদীর জায়গা বিশেষে চরিত্রবৈচিত্র্য। বিচিত্র গতিতে সর্বদা অস্থিরমতি। পথ হারিয়ে মরেও শহীদের সম্মান।

জীবনে সব সিদ্ধান্ত সব সময় ঠিক হয় না। চললে ভুল হবেই৷ হাজার সচেতন হলেও নিখুঁত নৈপুণ্য অসম্ভব। সাহিত্যিকদের সঙ্গে রাজনীতিকদের পার্থক্য অনেক। লেখক একা। যা করে সবই একার দায়িত্বে। লিখুক, মরুক, বাঁচুক সব দায় নিজের। কাউকে কৈফিয়ত দিতে হয় না। রাজনীতিকদের বেলায় তা নয়। লক্ষ কোটি লোকের ভবিষ্যৎ তাদের হাতে। নেতা মরলে অনুগতরা মরবে। প্রাণে নয়, মনে।

রাজনীতিকদের প্রধান দায়িত্ব মানুষের জীবিকা সুনিশ্চিত করা, যাতে সবাই খেয়ে পরে বাঁচে, বেঘোরে
মরে না থাকে। জীবন আর জীবিকা কিন্তু এক নয়। জীবিকা মলাটের মতো, জীবনটাকে ধরে রাখে মাত্র। মলাট যতই শোভন হোক, বইটা না পড়া পর্যম্ত তার ঐশ্বর্য বোঝা যায় না। সম্পদের দাপটে, ঠাঁটবাটে মনে হতে পারে জীবনটাও খুব সুন্দর। না, তা কখনওই নয়। পেছনে অনেক কদর্য কিছু থাকতে পারে। যেটা অনেক সময় আচার আচরণে প্রকাশ পায়।

যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদের নেতৃত্বে সাধারণ মানুষ 'মলাট পাল্টানোর' সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু শাসক দলের নেতাকর্মীরাই যদি কেবল আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে এলাকা দাপিয়ে বেড়ায়, তাহলে মানুষ আস্থা রাখবে কার উপর? প্রবাদ আছে যে, পেটে খেলে পিঠে সয়। যদি মানুষকে ন্যূনতম অধিকার দেওয়া যায়, শান্তি-স্বস্তি দেওয়া য়ায় তাহলে সাধারণ মানুষ কিছু কিল কিংবা কানমলাও হজম করতে পারে।

কিন্তু তেমন কিছু কি দেশে সত্যি হচ্ছে? তোবা গার্মেন্টসের পাওনা টাকা নিয়ে আন্দোলনের ঘটনাই তো প্র্রমাণ করে যে, এদেশে শ্রমজীবীরা কী করুণ দুর্দশার মধ্যে বেঁচে আছেন! কর্মসংস্থানের সুযোগ দিন দিন সংকুচিতই হচ্ছে। বাড়ছে বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলতন্ত্র সব কিছুকে গ্রাস করছে। গণতন্ত্রচর্চা, গণতান্ত্রিক ভাষা, গণতান্ত্রিক আচরণ সবই যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। এক ধরনের হুমকি, জবরদস্তি আর শিক্ষা দেওয়ার ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতাবানদের ভাষা।

আমাদের দেশে অবশ্য গণতন্ত্র বোঝার ক্ষেত্রেই গোড়ায় গলদ রয়েছে। গণতন্ত্র বলতে আমরা বুঝি 'নির্বাচনী গণতন্ত্র'। গণতন্ত্রের প্রধান রূপ যেখানে প্রতিনিধি বাছাই করা অথবা নির্বাচিত করা, সেখানে ভোট হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রশাসন-কাঠামোর প্রতিটি স্তরে জনসম্পদ এবং জনবিত্তকে নিয়ন্ত্রণ করার চাবিকাঠি। অর্থ ছাড়া প্রশাসন সম্প্রসারণ হয় না। আর প্রশাসন সম্প্রসারণের জন্য প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের সম্প্রসারণ চাই। গ্রামে, মফস্বলে, শহরাঞ্চলে, সর্বত্র এই জনপ্রতিনিধিরা প্রশাসনিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণকারী এবং অন্যতম দখলদার। আমলাদের সঙ্গে যুগলবন্দিতে এভাবে প্রশাসন চলে। এই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোও ক্রমশ প্রশাসনিক যন্ত্রে পরিণত হয়। হিংসা ছাড়া অন্য আর কী উপায় আছে, এই ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কুক্ষিগত করার?

এর অর্থ এই নয় যে, এই পথে জনকল্যাণ হয় না। কিন্তু জনকল্যাণ, প্রশাসনিক যন্ত্রে আত্মস্থ প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা এবং এই ধরনের সরকারি পোশাকে আর নিয়মে বাঁধা গ্রামীণ আত্মশাসন ব্যবস্থা, এই তিনটের কোনোটার কোনোটাকে ছাড়া চলে না। আমাদের দেশে গত প্রায় তিন যুগ ধরে এই প্রক্রিয়া চলছে। আজও এর ইতি টানার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

এখনও ভোটের জন্য সবার আগে স্থির করতে হবে কত পুলিশ চাই, কত সৈন্য চাই, কত ইস্কুল চাই রক্ষী-শিবির স্থাপন করার জন্য, কত ভোটকর্মী চাই, কত অর্থ চাই, কত দিন ধরে ভোট করা চাই, কত গাড়ি চাই, আরও কত কিছু স্থির করা চাই। আনুষ্ঠানিক পরিভাষায় বলা চলে, এ হল নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের পরিকাঠামোগত দিক বা লজিসটিক্স। নির্বাচনের আগে প্রচারমাধ্যম, নির্বাচন কমিশন, বিরোধী দল, সরকার পক্ষ, বিচার প্রতিষ্ঠান সবাই এই চর্চায় এতটাই ব্যস্ত থাকে যে পুজোর চেয়ে আচারের প্রাধান্য পুজোর উদ্দেশ্যকে ছাপিয়ে যায়।

আমরা এমন এক কালের মধ্যে দিয়ে চলেছি, যে সময়ে দেশজাতিভাবনা দুর্বল হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। অভিবাসন, বহির্গমন, দেশত্যাগী বাস্তুহারা লক্ষকোটি মানুষের ভিড়, স্থানান্তরী এবং দেশান্তরী শ্রমিক, নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতির বাঁধনহারা বিশ্বায়ন, আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির দৌলতে বাধাহীন, সীমানাহীন মেলামেশা এবং চিন্তাবিনিময়ের কল্পজগত্ এই সবের প্রাবল্যে এবং আঘাতে দেশজাতির মৃন্ময় রূপ ভেঙে যাওয়ার কথা।

ভেঙেছেও কিছু ক্ষেত্রে। কিন্তু তার চিন্ময় রূপ শুধু অক্ষত থাকেনি, আঘাত সেই কালাতীত রূপকে পুনঃশক্তি দিয়েছে। তাই তো এখনও এক শ্রেণির শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন উদ্যোগ বা নীতি-কর্মসূচি নিয়ে মাথা ঘামায়। ভুল নীতির কারণে মনোবেদনা অনুভব করে। ভালো কিছু, কল্যাণকর কিছুর জন্য সারাক্ষণই ছটফট করে। তারাও কিন্তু দেশনির্মাণে ভূমিকা পালন করে। শাসকরা অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে তাদের এই অবদান বুঝতে পারেন না।

এর অর্থ এই যে, নাগরিকত্ব এবং সাংবিধানিক স্বীকৃতির সঙ্গে দেশ এবং জাতি নির্মাণে অংশগ্রহণের অধিকার ঘোষণাকে মেলানো যাবে না। কল্পনাশক্তি দিয়ে যে অংশগ্রহণ, তার কতটুকু সাংবিধানিক অংশগ্রহণ দিয়ে বোঝা বা মাপা যায়?

দলিত জনসাধারণ, গরিব সমাজ, জনজাতি এবং শ্রমজীবী শ্রেণিসমূহের অন্যতম বড় অবদান এই যে, তাঁরা দেশজাতির ভাবনাকে বিত্তবান, বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক এবং নেতৃবর্গের আওতা থেকে বার করে আনতে পেরেছেন। দেশজাতিকাল ভাবনা দর্শনের বিষয় নয়, এই ভাবনা আজ জনচৈতন্য বা সাধারণ চৈতন্যের অংশ হয়ে গেছে।

একদিকে রাষ্ট্রক্ষমতা যত কেন্দ্রীভূত হয়েছে, যত হিংসা এবং বলপ্রয়োগ বেড়েছে, তত দেশবাসী ভেবেছে, স্বাধীনতা যে গণতন্ত্র এনেছে তা প্রকৃত গণতন্ত্র নয়। প্রকৃত গণতন্ত্র হল অনাগত গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্র আসবে, যে গণতন্ত্র সম্পূর্ণ হয়নি, হয়তো কখনও সম্পূর্ণ হয় না, যে গণতন্ত্র আমাদের চেষ্টায় আসবে। সুশাসন চাই। সব অঞ্চলের সমান বিকাশ চাই। নারীর মর্যাদা চাই। শিশুকল্যাণ, শিক্ষা স্বাস্থ্যের উন্নতি চাই। মজুরিবৃদ্ধি চাই। শ্রমিকের জীবিকার নিরাপত্তা চাই। কৃষকের জীবনমানের উন্নতি চাই। আমরা গণতন্ত্রের দাবি করি, কারণ ওটা আমাদের স্বাধিকার। আমাদের অধিকার আছে সমান হওয়ার। সম্মান এবং স্বীকৃতি পাওয়ার। এই আকাঙ্ক্ষাই তো গণতন্ত্র!

গণতন্ত্র মানেই কেবল একটি নির্দিষ্ট সময়ান্তরে ব্যাপক আয়োজন করে ক্ষমতার পালাবদল নয়, এক দল আরেক দলকে দেখে নেওয়ার হুমকি কিংবা ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর আলটিমেটাম নয়। গণতন্ত্র মানে ক্ষমতায় গিয়ে যা খুশি তাই করা, কিংবা ক্ষমতা না পেয়ে পাগলের প্রলাপ উচ্চারণ নয়। গণতন্ত্র সমাজের প্রতিটি স্তরে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের কাঠামো এবং আন্তঃসম্পর্কের চরিত্রের মধ্যে বিদ্যমান থাকে। সমাজে বসবাসরত একজন মানুষ অন্য মানুষকে কীভাবে ধারণ করে, কোন মর্যাদায় বিবেচনা করে, অন্য মানুষের চিন্তা, মতামত ও ব্যবহারকে কোন মাত্রায় সম্মান, অসম্মান করে কিংবা মূল্য দেয় বা দেয় না, তার মধ্যেই দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিহিত আছে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং তার দীর্ঘ সমাজসম্মত অনুশীলনের মধ্যেই গণতন্ত্রিক প্রক্রিয়া সমাজে অব্যাহত থাকে।

সমাজে বিদ্যমান ক্ষমতা-কাঠামোর কতটুকু গণতন্ত্রায়ন হয়েছে, তার মধ্যেই পাওয়া যাবে একটি গণতান্ত্রিক সমাজের আসল সম্ভাবনা। সে মানদণ্ডে বাংলাদেশের সমাজ এক মিশ্র অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে নিয়ন্ত্রণ এবং ভয় দেখানোর প্রবণতা বাড়ছে। স্বাধীনভাবে সত্য কথা বলা একটি ভীষণ ঝুঁকির কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতি বা অপরাধ উন্মোচন অথবা ভিন্ন মতাবলম্বী কথা বলার কারণে মিডিয়া বা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদেরকে হুমকি বা হয়রানির বিভিন্ন ঘটনাও আমরা লক্ষ্য করছি।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাব দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের গুণগত উন্নতি সাধনে একটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। যদিও সকল দলের গঠনতন্ত্রে নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে নেতানেত্রী নির্বাচনের কথা আছে এবং তৃণমূল পর্যায়ে পরামর্শ সংক্রান্ত বিভিন্ন পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে নির্বাচন হয় অনিয়মিত এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের হাতেই রয়ে গেছে।

সমাধানের উপায় কি আমাদের রাজনীতিবিদরা বাতলাতে পারবেন? মনে হয় না। জনগণকেই সতর্ক হতে হবে। এর বিকল্প নেই।