অভিশংসন নয়, নিয়োগের বিধিমালা জরুরি

জায়েদুল আহসান পিন্টু
Published : 21 August 2014, 06:12 AM
Updated : 21 August 2014, 06:12 AM

মন্ত্রিসভা ১৮ আগস্ট সংবিধান সংশোধন বিলের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে। এটি হবে সংবিধানের ১৬ তম সংশোধনী। শুধুমাত্র বিচারপতিদের অভিশংসন বা অপসারণের পদ্ধতি পরিবর্তন করতেই এ সংশোধনী আনা হচ্ছে।

আমাদের দেশে একটিমাত্র ইস্যু নিয়ে সংবিধান সংশোধনের ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। ব্যক্তিবিশেষের মর্জিরক্ষায়ও আমরা সংবিধান কাটাছেঁড়া করতে দেখেছি। কিন্তু এবার কোনো রকম আলাপ-আলোচনা ছাড়া, একপ্রকার হুট করেই সংবিধান সংশোধনের ইস্যুটি সরকার সামনে নিয়ে এসেছে। সংবিধানে যা বলা আছে তা না মেনে সংবিধানে যা নেই তা সংযোজন করার জরুরি প্রয়োজনীয়তা কেন হঠাৎ দেখা দিল, তার যুক্তিসঙ্গত কারণ এখনও সরকার তুলে ধরতে পারেনি। আমার কাছে বিচারকদের অপসারণের পদ্ধতির চেয়ে তাঁদের নিয়োগের জন্য বিধিমালা প্রণয়ন বেশি জরুরি বলে মনে হয়।

আইনমন্ত্রী বুধবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, জনগণ ও বিচার বিভাগের কল্যাণেই সংবিধান সংশোধন করা হচ্ছে। তিনি মনে করেন, বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা জনগণের কাছে থাকতে হবে। তাঁর এই মন্তব্যের সঙ্গে আমিও একমত। সকল পক্ষেরই জনগণের কাছে জবাবদিহির একটা ব্যবস্থা থাকতে হবে (সেটা জনপ্রতিনিধিরা করুন আর না করুন)। গণমাধ্যমের সংবাদ ও আইনমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের আলোকে এই সংশোধনী আনা হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে ছিল।

জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা বিচার বিভাগের কাছে ন্যস্ত হয়। এতে বলা হয়, বিচারপতিদের অভিশংসনে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করতে পারবেন। এই সংশোধনীল ফলে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অভিশংসন বা অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ফিরে যাচ্ছে।

২০১২ সালে তৎকালীন স্পিকার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদের একটি রুলিং কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকে অপসারণের দাবি উঠে সংসদে। তখনই সরকারি দলের সাংসদরা এই ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার দাবি করেন। সহজেই অনুমেয় যে, ওই দাবি এখন বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি বলেছে, একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতেই বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞরা বলছেন, সংবিধান সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ এভাবে তাড়াহুড়া করে করা ঠিক হচ্ছে না; তারা অপপ্রয়োগেরও আশঙ্কা করেছেন।

আইন কমিশন বলেছে, তারাও সুপারিশ করেছে যে, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছেই থাকা উচিত। ‌আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক কেন এই সুপারিশ করলেন তা বোঝা যাচ্ছে না। তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে যখন সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে '৭২ এর মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার আদেশ দিলেন, সেই আদেশ অনুযায়ী সংবিধানের ১৫ তম সংশোধনী এনে সরকার প্রায় সব কিছু '৭২ এর সংবিধানে ফিরিয়ে নিয়েছে। তখন রায়দাতা এবিএম খায়রুল হক বিচারপতি অপসারণের বিষয়টি কেন '৭২ এর আদলে সংসদের কাছে ফিরিয়ে দিতে চাননি, ওই ক্ষমতা কেন নিজেদের হাতে রেখে দিয়েছিলেন, এই প্রশ্ন উঠতেই পারে।

সরকারের সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ, আইনমন্ত্রীর যুক্তি, বিএনপির অভিযোগ, আইন কমিশনের সুপারিশ কিংবা 'সংবিধান বিশেষজ্ঞদের' আশঙ্কা, এসবের চেয়ে বড় প্রশ্ন হল, বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে বা বিচারপতিদের হাতে থাকলে জনগণের কী লাভ? বিচারাঙ্গনকে আরও জনমুখী করতে বা দক্ষ বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে অপসারণের ক্ষমতা কার হাতে থাকল না থাকল সেটা কি খুব জরুরি কিছু? এতে কি বিচারালয়ে গুণগত কোনো পরিবর্তন আনবে?

আমার মত হল, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছেই থাকুক বা বিচারপতিদের কাছেই থাকুক, তার চেয়ে জরুরি দরকার একটি দ্ক্ষ বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলা। যে দেশে ৩১ লাখ মামলা এখনও বিচারাধীন, যার মধ্যে তিন লাখেরও বেশি উচ্চ আদালতে– যেখানে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর মানুষ বিচারের অপেক্ষায় ঘুরে অর্থ, সময় ও মেধার অপচয় ঘটাচ্ছে– সেখানে নজর না দিয়ে বিচারপতিদের চাকরি খাওয়ার ক্ষমতা নিয়ে টানাটানি করা নিশ্চয়ই যুক্তিযুক্ত নয়।

আমরা দু' দশক ধরে দেখে আসছি উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে দলীয়করণের অভিযোগ আসছে। এভাবে বিচার ব্যবস্থাকে ক্রমশই নিচের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ যেন দলীয় পছন্দে বিচারপতি নিয়োগের প্রতিযোগিতা। আওয়ামী লিগ ও বিএনপি প্রতিবারই বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনার অভিযোগ এনেছে। বিএনপির আমলে নিয়োগকৃতদের বিচারপতিদের সংবর্ধনায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা যোগ দেন না। আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগকৃতদের ক্ষেত্রেও বিএনপি একই আচরণ করে। বিচারপতি নিয়োগ ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবীদের মধ্যে মারামারি পর্যন্ত হয়েছে।

ড. কামাল হোসেন একবার বলেছিলেন, দু' লাইন ইংরেজি লিখতে পারে না এমন ব্যক্তিকেও বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি থাকাকালে ব্যারিস্টার রুকনউদ্দিন মাহমুদ একবার বিচারপতিদের 'মাই লর্ড' বলার রেওয়াজ বাতিল করে দিতে দাবি তুলেছিলেন । তাঁর যুক্তি ছিল, বিচারকের আসনে এমন অনেককে বসানো হয়েছে যাদের' মাই লর্ড' বলা যায় না।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৯৯৪ সালে বিএনপির একজন জেলা পর্যায়ের নেতাকে বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে উচ্চ আদালতে রাজনৈতিক নিয়োগের যাত্রা শুরু। সেই যাত্রা এখনও অব্যাহত আছে বলে রাজনৈতিক দলগুলো বলে আসছে। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ হলে হয়তো এত কথা উঠত না। এমনও দেখা গেছে যে, আইন বিষয়ে পড়াশোনা করে তৃতীয় শ্রেণি প্রাপ্ত অনেকই নিয়োগ পেয়েছেন। প্রথম আলোর ২০১০ সালের ১ মের প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায় যে, সদ্য নিয়োগ পাওয়া ১৭ অতিরিক্ত বিচারকের নয়জনই এলএলবিতে তৃতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ।

যে কোনো নিয়োগেই একটি নীতিমালা থাকে, নেই শুধু বিচারপতিদের নিয়োগে। এখন সংবিধানের ৯৬ ধারা সংশোধন করে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা নিচ্ছে সংসদ, অথচ সংবিধানের ৯৫ (২) (গ) ধারা অনুযায়ী বিচারক নিয়োগের যোগ্যতা নির্ধারণ করে একটি আইন প্রণয়ন করার কথা। বিয়াল্লিশ বছরেও আইনটি হয়নি। আর তাই সরকারগুলো সংবিধানের ৯৫ ধারার ক আর খ অনুযায়ী ১০ বছর সুপ্রিম কোর্টে উকালতি করলে বা ১০ বছর বিচার বিভাগীয় চাকরি করার অভিজ্ঞতা হলে যে কাউকেই নিয়োগ দিয়ে দিচ্ছেন, তার যোগ্যতা বা মেধা কতটুকু তা খতিয়ে দেখার দরকার মনে করেন না।

সরকার এ দিকটায় নজর দিলে অন্তত জনগণের কিছু লাভ হত, একটি দক্ষ বিচার ব্যবস্থা গড়ে উঠত। তা না করে অপসারণের ক্ষমতা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে সরকার! সরকারের আচরণে মনে হচ্ছে, বিচারপতিদের খুব 'বাড়' বেড়েছে, তাদের লাগাম টেনে ধরতে হবে, একটু ভয় দেখিয়ে নিই!

প্রশ্ন হল, বিচারপতিদের অপসারণ পদ্ধতি জরুরি, নাকি বিচারালয়ে যোগ্য বিচারপতি নিয়োগ, কোনটি? সরকার তার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানোর জন্য আইন কমিশনের সুপারিশের কথা বলছে। এই কমিশনই ২০১২ সালে বিচারপতি নিয়োগে আইন তৈরির সুপারিশ করেছে। গত সোমবার আইন কমিশন সরকারের কাছে যে রিপোর্ট দিয়েছে তাতেও বিচারপতি নিয়োগের যোগ্যতা প্রশ্নে কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছে। যেমন, ১০ বছর আইন পেশায় থাকলে এখন কেউ বিচারক হতে পারেন, তা পরিবর্তন করে ২০ বছর করতে বলেছে। ৫০ বছরের কমবয়সী কোনো ব্যক্তি বিচারক হতে পারবেন না। বিচারপতি অবসরে যাবেন ৬৭ এর বদলে ৭৫ বছর বয়সে।

এসব সুপারিশের প্রতিটিই যুক্তিযুক্ত। আইন কমিশনের আগে হাইকোর্ট বিভাগও একাধিকবার রুল বা আদেশ দিয়ে বিচারক নিয়োগের যোগ্যতা নির্ধারণের কথা বলেছে। সরকারগুলো সে সবে পাত্তাই দেয়নি। এ সংক্রান্ত একটি রুলের জবাব গত চার বছর ধরে সরকার দিচ্ছে না। এখানেই সরকারের সদিচ্ছার অভাব দেখা যাচ্ছে।

গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, ২০০৮ সালের ১৬ মার্চ বিচারপতি নিয়োগ ইস্যুতে 'সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন' গঠন করে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল। শুরুতে তৎকালীন সেনানিয়ন্ত্রিত সরকার বিচার বিভাগ-বহির্ভূত লোকজনের আধিক্য রেখে কমিশন গঠন করলে তা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। সমালোচনার মুখে কমিশনের গঠনে পরিবর্তন আনা হয়। সেই কমিশন গঠন করেও যদি বিচারক নিয়োগ করা হত তাহলে আজ এত প্রশ্ন উঠত না।

নির্বাচিত সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনেক অধ্যাদেশ বহাল রাখলেও বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে কমিশন গঠনের অধ্যাদেশটি সংসদে পাশ করেনি। ওই অধ্যাদেশ অনুযায়ী নয় সদস্যের কমিশন প্রধান হতেন প্রধান বিচারপতি। আর সদস্য হতেন আইনমন্ত্রী, আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ তিনজন বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ দু'জন বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতিরই বিচারপতিদের নিয়োগ করার কথা। সরকার অধ্যাদেশটি হুবহু পাস করতে না চাইলে কিছুটা রদবদল করেও যদি এটি আইন আকারে পাস করে তাতে বিচারালয়ের জন্য সুফল মিলবে।

এই জাতীয় আইনের কথা '৭২ সাল থেকেই সংবিধানে বলা আছে। কমিশন গঠন করা হলে রাষ্ট্রপতি সরকারের পছন্দমতো বিচারকদের নিয়োগ দিতে পারবেন না। রাজনৈতিক দলাদলির বিষয়টি থাকবে না। সংবিধানের দোহাই দিয়ে এত কিছু করা গেলে ওই কমিশন বা এ জাতীয় আইন কেন করা হয় না? তার মানে সরকারগুলো কি বিচার বিভাগকে নিজেদের প্রভাবের মধ্যেই রাখতে চায়?

১৩ আগস্ট প্রতিবেশি দেশ ভারতের লোকসভায় একই আদলে ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশন গঠনের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। সেখানে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে দু'জন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি, আইনমন্ত্রী এবং দু'জন বিশিষ্ট নাগরিকের সমন্বয়ে কমিশন গঠন করার কথা বলা হয়েছে। অযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ বন্ধে আমাদের বর্তমান সরকারও এ রকম একটি কমিশন গঠন করতে পারে।

তা না করে, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে 'মহৎ' কোনো উদ্দেশ্য কাজ করছে না বলেই আশঙ্কা থেকে যাবে।

জায়েদুল আহসান পিন্টু: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দেশ টিভি। দীর্ঘদিন আদালত ও বিচার বিভাগ নিয়ে কাজ করেছেন।