কায়রো সম্মেলন অতঃপর

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 20 August 2014, 11:18 AM
Updated : 20 August 2014, 11:18 AM

জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ক একটি আর্ন্তজাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল মিশরের কায়রো শহরে, ১৯৯৪ সালের ৫ থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর। তিনটি বিষয়ে প্রাধান্য দিয়ে রচিত হয়েছিল ১৭৯ দেশের প্রায় ২০ হাজার প্রতিনিধির উপস্থিতিতিতে মিলিত ঘোষণা যা বিশ্ব পরিমণ্ডলে উন্নয়নের নতুন ভাবধারার উন্মোচন করেছিল। জনসংখ্যা, উন্নয়ন ও ব্যক্তির কল্যাণ, এ তিন মূলধারার সমন্বয়ে পরিচালিত হবে আধুনিক বিশ্ব, এই ছিল কায়রো ঘোষণার মূখ্য বা প্রতিপাদ্য দর্শন।

কায়রো ঘোষণায় বিশ বছরের একটি কর্মপরিকল্পনা রচিত হয়েছিল যা শেষ হতে চলেছে এ বছরই, ২০১৪ সালে। আমরা যারা কায়রো সম্মেলনে যোগদান করেছি বা সাচিবিক দায়িত্বসহ বাংলাদেশের অভিমত প্রণয়ন করেছি, আজও মনে হয় সবই স্বপ্ন। পিরামিডের ইতিহাসের মাঝে মানব সভ্যতা নিয়ে ভাবনার অন্তরালে মানুষের অধিকার, নীলনদ ঘিরে নারীর ক্ষমতায়নের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর এবং ব্যক্তির ভাবনার স্বাধীনতার দাবি নিয়ে বির্তকের ফুলঝুরি বিমোহিত করেছিল বিশ্ববাসীকে। এমন বিশাল সম্মেলন বিশ্বে আর কোথাও হয়েছে বলে মনে হয় না।

অনুরূপ বিশ্ব জনসংখ্যা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে, রুমানিয়ার রাজধানী বুখারেষ্টে। তখন বলা হয়েছিল 'শিক্ষা' হবে পরিবার পরিকল্পনার একমাত্র পদ্ধতি। ১৯৮৪ সালে পরবর্তী জনসংখ্যা সম্মেলন হয় মেক্সিকো শহরে এবং ঘোষণা করা হয় যে, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি হতে হবে 'মা ও শিশুস্বাস্থ্য' কেন্দ্র করে। অবশ্য ১৯৫৪ সালে রোম শহরে এবং ১৯৬৫ সালে বেলগ্রেডে বিশ্ব জনসংখ্যা সম্মেলন হয়েছিল, তাতে এমন কোনো উল্লেখযোগ্য সুপারিশ প্রণীত হয়নি যা বিশ্ববাসীর সমীপে প্রণিধানযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে।

কায়রো সম্মেলনের সুপারিশের আলোকে সহস্রাব্দের উন্নয়নের ৮ লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছিল যা ২০১৫ সালের মধ্যে অর্জন করতে হবে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ৪টি লক্ষ্য অর্জন করেছে এবং অবশিষ্ট ৪টি ২০১৫ সালের মধ্যেই অর্জিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে মাতৃমৃত্যু হার হ্রাসে পেয়ে প্রতি এক লক্ষে নেমে এসেছে ১৯৪ জনে, যা ১৯৭৫ সালে ছিল প্রায় ৬ শ'। এমনিভাবে শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, দারিদ্র্য বিমোচন, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার, নারীর ক্ষমতায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, নিরাপদ পানি ও ময়লা-আবর্জনা সর্ম্পকিত স্বাস্থ্য সচেতনতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।

কায়রো সম্মেলনের বিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের লক্ষ্যে, বিশ্বব্যাপী এখনই আলোচনা শুরু হয়েছে। ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশন হবে এবং সেখানে ২০১৫ পরবর্তী টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য নির্ধারণ সম্পর্কিত বিষয়সূচি নিয়ে ব্যাপক এজেন্ডাভিত্তিক আলোচনা শুরু হবে। বাংলাদেশের সাফল্যের আলোকে এ অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের কল্যাণে প্রজনন স্বাস্থ্য খাতে অধিক বিনিয়োগ এবং তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার অনেক বেশি সুযোগ সৃষ্টি। বাংলাদেশে বর্তমানে মাত্র ৩০ শতাংশ মা সন্তান প্রসবকালে প্রাতিষ্ঠানিক সেবা নিয়ে থাকেন বা হাসপাতাল, ক্লিনিকের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ সেবাদানকারীর সাহায্য গ্রহণ করে। নিরাপদ মাতৃত্ব সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বা প্রসব-পরবর্তী রুগ্নতা বা জটিলতা (Morbidity) থেকে পরিত্রাণের প্রয়োজনে প্রাতিষ্ঠানিক সেবা গ্রহণ অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন উন্নত দেশের সহযোগিতা।

বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে কিন্তু প্রসব-পরবর্তী রুগ্নতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে যা অনভিপ্রেত। এ ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাসমূহকে অধিক আর্থিক ও কৌশলগত সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে হবে। সরকারকে দক্ষ ধাত্রী এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে এবং জরুরি ধাত্রী শুশ্রূষা কেন্দ্রের (Emergency Obstetric Care) সংখ্যা বাড়াতে হবে।

জাতীয় স্বাস্থ্য খাতে সেবাদানের ক্ষেত্রে প্রজনন স্বাস্থ্য খাতে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয় তার স্বল্পতা মাতৃমঙ্গল কাজের জন্য নিতান্তই অপর্যাপ্ত। লক্ষ্যণীয় যে, এখনও বাংলাদেশের জনগণ নিজের পকেট থেকে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির জন্য ব্যয় করে প্রায় ৬৫ শতাংশ অর্থ যা গরিব জনগণকে আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত করছে। ফলে বৃহৎ এক জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যসেবার জন্যে ছুটে কবিরাজ, হেকিম ও গ্রাম্য আনাড়ি ডাক্তারদের দুয়ারে।

এমন পরিস্থিতি হচ্ছে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবাদানের নিতান্তই পরিপন্থী। ইউনিভারসাল হেলথ কভারেজ হচ্ছে বাংলাদেশ স্বাস্থ্যনীতির ঘোষিত লক্ষ্য, যার অর্থ হচ্ছে সকল লোক প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পাবেন কোনো মূল্য পরিশোধ ছাড়া এবং এ জন্যে কোনো ব্যক্তি আর্থিক অনটনে পড়বেন না।

[All people have access to essential health services without the financial hardship associated with payment .

— Lancer 2010]

১৯৯৪ সালের পর বিশ্বে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দ্রুত নগরায়ন, বয়স্ক লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি, পরিবারের কাঠামোতে পরিবর্তন, পরিবেশের ঝুঁকি এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। একই সঙ্গে অভিবাসন, খাদ্যে ভেজাল, নকল ওষুধ তৈরি, মাদকের অপব্যবহার এবং এতদসংক্রান্ত অপরাধের মাত্রা বেড়েছে।

এ সকল পরিবর্তন ব্যক্তিজীবনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। মানুষের মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে, অঞ্চলভিত্তিক জীবনধারার তারতম্য সুষ্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। অনেক ধনী ব্যক্তি গরিবের প্রাপ্য সাহায্য উপভোগ করছে, যা হচ্ছে অপরাধ। এছাড়া লিঙ্গভিত্তিক বঞ্চনা এবং মেয়েদের উপর আক্রমণ ও প্রশাসনে তাদেরকে সম্পৃক্ত না করার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

তাই জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এর প্রতিবাদ করেছেন। মহাসচিবের ভাষায়–

Too many people are being left behind–by growing income and wealth inequities, by gender inequality and gender- based violence, by discrimination and stigma, by exclusion from participation in governance and even by data and knowledge systems that fail to count and account for many of the most vulnerable people.

বাংলাদেশ বিশ্বসভায় এসব বিষয় তুলে ধরতে পারে অনায়াসে।

আতঙ্কিত হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে, নগর ও গ্রামীণ জীবনের বৈষম্য এবং স্বাস্থ্যসেবাদানের ক্ষেত্রে ভিন্নতা, যার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা অনেক বেশি জরুরি। নগরভিত্তিক সেবাপ্রাপ্যতার সুযোগ এবং গ্রামের জনগণের জন্য অনুরূপ সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারলে সমগ্র সেবাদানের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে পড়বে।

লক্ষ্যণীয় যে, শহর ও গ্রামের রোগের ধরনের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে। শহরে এইচআইভি, এইডস, এসটিআই, আরটিআই ও সংক্রামক এবং দুরারোগ্য ব্যাধির প্রভাব অনেক বেশি। এছাড়া প্রতিটি শহরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব হচ্ছে মহানগর ও পৌরসভাসমূহের। এখানে এসে যায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ব্যাপক সহযোগিতার প্রযোজনীয়তা। এ লক্ষ্যে প্রয়োজন একটি নগর স্বাস্থ্যসেবার কৌশলপত্র নির্ধারণ। আর্ন্তজাতিক অঙ্গন থেকে এ লক্ষ্যে অভিজ্ঞতা অর্জনের প্রয়োজন আছে।

স্বাস্থ্যখাতকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হলে প্রয়োজন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার উত্তম পরিবেশ এবং কৌশল নির্ধারণের দৃঢ়তা। দুর্নীতি স্বাস্থ্যখাতকে কলঙ্কিত করেছে। দুর্নীতি হচ্ছে ক্রয় কার্যক্রমে, হাসপাতাল ও ক্লিনিক নির্মাণে, ওষুধ সরবরাহে, জনবলের নিয়োগদানে এবং চিকিৎসক ও সেবাদানকারীদের কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক অনুপস্থিতির সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে। স্বাস্থ্য খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে সকল বিনিয়োগ ও সেবাদান কার্যক্রম অর্থহীন প্রলাপে পরিণত হতে বাধ্য।

জাতিসংঘে এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সঙ্গে আলোচনার প্রাক্কালে এমন সব কৌশলগত বিষয় উপস্থাপন করা বাংলাদেশের পক্ষেই সম্ভব। কারণ বিশ্বপরিমণ্ডলে বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য খাতে একটি সফল দেশ হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে এবং ১৯৮৭ সালে জনসংখ্যা পুরস্কারসহ সাম্প্রতিককালে অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছে।

১৯৯৪ সালের কায়রো সম্মেলনে গৃহীত সুপারিশসমূহের ২০ বছর অতিক্রান্ত হলেও নারীদের সন্তান ধারণের অধিকারসহ, সমাজে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা এবং ব্যক্তির কল্যাণের সঙ্গে রাষ্ট্রের সার্বিক অগ্রগতিতে অবদান রাখার মতো প্রচুর ক্ষেত্র বিরাজ করছে যেখানে একটি জনকল্যাণমুখী সরকার এবং বেসরকারি সংগঠনসমূহ এবং সুশীল সমাজ অনেক অবদান রাখতে সক্ষম। দেশবাসীর প্রত্যাশা, সরকার অনুরূপ সুযোগ সৃষ্টি করে কার্য সম্পাদনে নেতৃত্ব দান করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বিশ্ববাসী দেখতে পাবে গর্বিত এক বাংলাদেশ, এ হোক আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়।

ধীরাজ কুমার নাথ: সাবেক সচিব।