তুরস্কের নয়া সুলতান

হাসান তারিক চৌধুরী
Published : 17 August 2014, 09:39 AM
Updated : 17 August 2014, 09:39 AM

তুরস্কে এল এক নয়া সুলতান। কৃষ্ণ সাগরের তীরে এল এক নয়া প্লাবন। যা আগামীর তুরস্ককে এক নতুন পথের সন্ধান দেবে।

১০ আগস্ট প্রথমবারের মতো জনগণের সরাসরি ভোটে দেশটির রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর সেখানকার বিভিন্ন পত্রিকায় এভাবেই মন্তব্য করা হয়েছে। তুরস্কের এই নতুন রাষ্ট্রপতি দেশটিকে কোন নতুন পথের সন্ধান দেবেন? তার এই নির্বাচন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে কি বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে? কিংবা তুরস্কের এই সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল রক্তস্নাত প্যালেস্টাইন, সিরিয়া অথবা ইরাকের সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসান ঘটাবে কি? এ রকম বহু প্রশ্নই আজ মানুষের মনে জাগছে।

বাস্তবিক অর্থে, তুরস্কের নয়া রাষ্ট্রপতি রিসেপে তায়্যিপ এরদোগান দেশটির রাজনীতিতে নবাগত কেউ নন। কিছুকাল আগেও তিনি ছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। তখনকার সংবিধান অনুযায়ী দেশটির সমস্ত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এখন বদলে যাওয়া সংবিধানে রাষ্ট্রপতিই হবেন সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু।

১০ আগস্টের নির্বাচনে উগ্র ধর্মীয় রক্ষণশীল দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে এরদোগান পান ৫১.৯ শতাংশ ভোট। তার প্রধান প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন অপেক্ষাকৃত কম রক্ষণশীল ধর্মভিত্তিক দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি এবং ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টির প্রার্থী, ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-এর সাবেক মহাসচিব সত্তর বছর বয়সী একমেলেদিন ইহসানগুল। এই প্রাথীর বাক্সে পড়ে ৩৮.৩ শতাংশ ভোট।

অপর প্রাথী ছিলেন কুর্দি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সমর্থিত পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির সালাহাত্তিন দিমিরতাস। তিনি পান ৯.৭ শতাংশ ভোট। নির্বাচনের ফলাফলের দেখা গেছে দেশটির ধর্মীয় রক্ষণশীল রাজনীতির পুরো সমর্থনই বিজয়ী প্রাথী এরদোগানের পক্ষে গেছে।

এরদোগান তুরস্কের রাজনীতিতে এক চরম কর্তৃত্ববাদী নেতা হিসেবে পরিচিত। ষাট বছর বয়সী এই নেতা ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দেশটির প্রধান নগর ইস্তাম্বুলের মেয়র ছিলেন। ছোটবেলায় ইসলামিক স্কুলে পড়াশুনার মধ্য দিয়ে যে ধর্মভিত্তিক দর্শনের ভেতরে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন, মারমারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ও বাণিজ্যের আধুনিক শিক্ষা তার রক্ষণশীল চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনতে পারেনি। অন্তত এরদোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির মতাদর্শ ও কর্মসূচি থেকে তাই বুঝা যায়।

এসব কারণে ধর্মনিরপেক্ষতার যে ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত ধারায় আধুনিক তুরস্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেটি আজ ধর্মীয় উগ্রবাদকেই প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরেছে। অথচ তুরস্কের রয়েছে এক গৌরবময় সংগ্রামী অতীত। বিদেশি দখলদাররা বার বার তুরস্ক আক্রমণ করেছে, আগ্রাসন চালিয়েছে। তুরস্ক আক্রমণ করেছে গ্রিক সেনাপতি আলেকজান্ডার, মোঙ্গল দস্যুসহ অনেকে। বাইজেনটাইন ও রোমান শাসনের সিঁড়ি বেয়ে ১১ শ শতকে সেলজুক তুর্কদের হাত ধরে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত তুরস্কের যাত্রা শুরু।

১৩ শ শতকের গোড়ার দিকে তুরস্ক আসে অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। কিন্তু সেখানকার সংগ্রামী জনগণ কখনওই এসব দখলদারিত্ব সহজভাবে মেনে নেয়নি। তারা বারা বার বিদ্রোহ করেছে। আনতে চেয়েছে শৃঙ্খলমুক্তির দিন। শাসকশ্রেণি বার বার এসব বিদ্রোহ নির্মমভাবে দমন করেছে।

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে অটোমান সাম্রাজ্যে ভাঙন ধরতে শুরু করে। সে সময় সংগ্রামী ইতিহাসের গর্ভ থেকে গড়ে উঠে তুর্কি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এর নেতৃত্ব দেন কিংবদন্তীর তুর্কি নেতা মোস্তফা কামাল আতার্তুক। ১৯২০ সালের ১ নভেম্বর তুরস্কের নবগঠিত পার্লামেন্ট ৬২৩ বছরের পুরোনো অটোমান শাসনের অবসান ঘটায়।

১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই সম্পাদিত হয় ঐতিহাসিক 'লসানে চুক্তি'। এরপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তুরস্ক প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেয়। এ চুক্তির আওতায় তখন তুরস্কে বসবাসরত ১১ লাখ গ্রিক তুরস্ক ছেড়ে গ্রিসে স্থানান্তরিত হয় এবং বিনিময়ে ৩ লাখ ৮০ হাজার তুর্কি গ্রিস থেকে তুরস্কে চলে আসে। এই স্থানান্তর সত্ত্বেও তুরস্কের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তার ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক চরিত্র হারায়নি। বরং দুই সম্প্রদায়ের শত বছরের সহাবস্থান যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল, সেটাই তখন হয়ে উঠেছিল তুরস্কের রাজনীতির প্রধান ও নেতৃত্বদানকারী ধারা।

কামাল আতাতুর্কের সুযোগ্য নেতৃত্বে এই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ধারা পরবর্তীতে আরও শক্তিশালী হয়েছিল। গড়ে উঠেছিল এক আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক তুরস্ক। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তা সহ্য হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই তুরস্ককে নিয়ে শুরু হয় বহু চক্রান্ত। ভৌগোলিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ তুরস্কে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া হয়ে ওঠে পশ্চিমারা। কারণ, তুরস্কের দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর আর উত্তরে কৃষ্ণ সাগর। দেশটির একদিকে দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপ, আরেক দিকে ইরাক ও সিরিয়া সীমান্ত।

ফলে তুরস্কে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে সাম্রাজ্যবাদ বিশেষত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ একাধারে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর থেকেছে। যে কারণে তুরস্কের রাজনীতির ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য নষ্ট করে সেখানে উগ্র ধর্মীয় ভাবধারার বিস্তারে কোটি কোটি ডলার ঢেলেছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। বিভিন্ন সময়ে উস্কে দেওয়া হয়েছে জাতি ও সম্প্রদায়গত সহিংসতা। এ রকম একটি পটভূমিতে ১৯৫২ সালে তুরস্ক যোগ দেয় সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধজোট ন্যাটোতে।

ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে তুরস্কের শাসকশ্রেণির মৌলিক ও দর্শনগত চরিত্রের দিকটি বিশ্ববাসী এবং তুরস্কের জনগণের কাছে প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়। ন্যাটোর মদদপুষ্ট তুরস্কের শাসকশ্রেণি ক্রমেই আচরণের দিক থেকে হয়ে উঠে স্বৈরাচারী এবং ভাবধারার দিক থেকে অতিরক্ষণশীল ও ধর্মাশ্রয়ী।

তুরস্কের আজকের শাসক এরদোগান সেই স্বৈরাচারী, ধর্মাশ্রয়ী ধারারই একজন। যার বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল ধরে জনগণের প্রতি রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চালানো ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বহু বার তিনি নির্মমভাবে প্রতিবাদ দমন করেছেন। সাম্প্রতিক উদাহরণ হল, ২০১৩ সালের জুন মাসে স্বতঃস্ফুর্তভাবে গড়ে ওঠা তাকসিম স্কোয়ারের আন্দোলন। কোনো বিশেষ রাজনীতিক দলের ডাকে নয়, তুরস্কের জনগণ নিজেদের প্রাণের তাগিদেই গড়ে তুলেছিলেন লাখো মানুষের অংশগ্রহণে এই ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলন। ইস্তাম্বুল, আংকারা থেকে শুরু করে তুরস্কের প্রতিটি শহরে অতি দ্রুত এই আন্দোলনের অগ্নিশিখা ছড়িয়ে পড়েছিল।

আন্দোলনকারীদের প্রধান দাবি ছিল, তুরস্কের ঐতিহ্যগত ধর্মনিরপেক্ষ ধারা ধ্বংস করা চলবে না, মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার দিতে হবে, নারীমুক্তি আনতে হবে, গণতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে ইত্যাদি। দেখা গেল, এরদোগান সরকারের পুলিশ ও মিলিটারি কামান দেগে এ আন্দোলন দমন করেছে এবং শত শত কর্মীকে জেলে পুরে দিয়েছে।

এতে তুরস্ক সরকারকে পূর্ণ মদদ দিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। আর এর প্রতিদান হিসেবে সিরিয়ায় মার্কিন মদদপুষ্ট বাহিনীকে পূর্ণ সামরিক সাহায্য দিয়েছে তুর্কি সেনাবাহিনী। এর ফলে সমৃদ্ধ্ সিরিয়া মাত্র দু' বছরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অথচ আজ দালিলিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে, সিরিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমের আনীত রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।

এ রকম একটি ভয়ানক মানবতাবিরোধী শক্তি আবার নতুন করে তুরস্কের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। এরা নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সিরিয়ার মার্কিন মদদপুষ্ট সশস্ত্র বিদ্রোহীরা তুরস্কের নতুন রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু তুরস্কের তরুণ ও নারীসমাজসহ সর্বস্তরের জনগণ এ নির্বাচন মেনে নিতে পারেননি। তারা বলছেন, নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে, জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। তুরস্কের বামপন্থীরা বলছে, 'এরদোগানের সরকার অবৈধ'। কারণ তারা নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতি করেছে।

শুধু বামপন্থীরাই নয়, বিভিন্ন বিদেশি সংবাদ সংস্থাও প্রকৃত সত্য চেপে রাখতে পারছে না।
১৩ আগস্ট ইসরাইলের জেরুজালেম পোস্ট পত্রিকা তুরস্কের নির্বাচন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছে–

''তুরস্ক ধীরে ধীরে উগ্র ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। এরদোগানের সরকার ক্রমাগত মধ্যপ্রাচ্যে সুন্নি জঙ্গি আইএসআইএস এবং প্যালেস্টাইনের হামাসের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে। যা মার্কিন প্রশাসনে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবিরোধী কর্মসূচিতে বাধার সৃষ্টি করছে।''

এ রকম একটি পরিস্থিতিতে ৭৭ মিলিয়ন আধিবাসীর তুরস্ক এক স্থায়ী সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে যাত্রা শুরু করেছে। নির্বাচনের মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক ও সৌদি আরবে বিরাট অঙ্কের মারণাস্ত্র বিক্রি করেছে। যার মধ্যে বিমান হামলার সরঞ্জামই বেশি। দেখা যাচ্ছে, তুরস্কে চরম ডানপন্থী শক্তির বিজয় শুধু তুরস্কের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষতাকেই বিপদগ্রস্ত করেনি, একই সঙ্গে তা গোটা মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাও বিপন্ন করে তুলেছে।

এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, তুরস্কের পত্রপত্রিকাগুলো তায়েপ এরদোগানের বিজয়ে তাকে নয়া সুলতান হিসেবে উল্লেখ করে যথার্থ কাজটিই করেছে। চরম কর্তৃত্ববাদী অটোমান সুলতানদের মতো তিনি এখন দেশটির নয়া সুলতান হিসেবে আবির্ভূত হয়ে পশ্চিমের সমর্থনে কতটা পশ্চদমুখী হন সেটা দেথার বিষয়। আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ কামাল আাততুর্কের তুরস্ককে তিনি মধ্যযুগের অন্ধকার কূপে পরিণত করবেন কিনা তা সময় বলে দেবে।

আপাতত দেশটির যাত্রা চলছে ভূতের মতো, উল্টোপথেই।

হাসান তারিক চৌধুরী: আইনজীবী, রাজনীতিবিদ।