জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলিবুদ্ধদেব বসু: সামগ্র্যের সন্ধানে

আহমাদ মাযহারআহমাদ মাযহার
Published : 28 Nov 2008, 11:10 AM
Updated : 28 Nov 2008, 11:10 AM


১৯৩৭-এর বুদ্ধদেব বসু

পরিণত বয়সের রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক, সেই সময়েও যে-কজন লেখক নিজেদের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে তাঁর পেছন পেছন হেঁটে চলছিলেন বুদ্ধদেব বসু তাঁদের একজন। রবীন্দ্রনাথেরই মতো বুদ্ধদেব বসুর প্রতিভা ছিল বিপুল ও বিচিত্রগামী। রবীন্দ্রোত্তর কালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি তো তিনি ছিলেনই, ছিলেন আধুনিকতাবাদী কবিদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ও অভিভাবকপ্রতিম। কয়েক শতাব্দী ব্যবধানে রচিত প্রাচীন সংস্কৃত কাব্য মেঘদূত ও উনিশ শতকের ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার-এর ক্লেদজ কুসুম-এর সৃষ্টিশীল অনুবাদের মাধ্যমে দুই যুগের প্রাণকে এক আধারে করেছিলেন আধারিত। বাংলার কবিতাশরীরে করেছিলেন নতুন রক্ত সঞ্চালন। শিল্পমাধ্যম হিসাবে ছোটগল্পের সার্থকতা সূচিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের হাতে; পরবর্তী কালে সার্থকতার দিকে যে কয়জন কথাসাহিত্যিক এগিয়ে গেছেন দৃপ্ত পায়ে বুদ্ধদেব বসু তাঁদের অন্যতম। বাংলাভাষায় আধুনিক সাহিত্য সমালোচনার সত্যিকারের শুরু বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে; কিন্তু একে যে স্বল্প কয়জন লেখক যথেষ্ট উচ্চতায় তুলে নিয়ে গেছেন তাঁদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু যে বিশিষ্ট তা কাউকে বলে দিতে হয় না। নাটক রচনায়, বিশেষ করে কাব্য নাটকের সৃষ্টিতে পাওয়া গিয়েছিল প্রতিভার উচ্চতর পরিচয়; আরও বিশেষ করে বলা যায় পুরাণ আশ্রয়ী কাব্যনাটকের স্রষ্টা হিসাবে জীবনের শেষ পর্বে যেন জ্বলে উঠেছিলেন তিনি।মহাকাব্য

…….
কবিতা পত্রিকার প্রথম সংখ্যা
…….
মহাভারত-এর নিমগ্ন পাঠক হিসাবে রচনারত ছিলেন মহাভারতের কথা নামীয় অসাধারণ এক গ্রন্থের, যার প্রথম খণ্ড শেষ করতে পেরেছিলেন, দ্বিতীয় খণ্ড রয়ে গিয়েছিল অনিষ্পন্ন। স্মৃতিকথামূলক রচনায় তাঁর উল্লিখিত ঘটনাবলি কেবল ঘটনামাত্রই থাকে নি হয়ে উঠেছে সুন্দরের স্বাদু সন্দেশ। তিনি ছিলেন মনোলোভা শিশুসাহিত্যেরও অবিরল প্রয়াসী। বাংলা শিশুসাহিত্যে ঘনাদা-টেনিদা জাতীয় সরস চরিত্রের আদিপুরুষ কান্তিকুমার-এর স্রষ্টা হিসাবেও তাঁকে আমরা একবার স্মরণ করে নিতে পারি। বাংলাভাষায় হান্স আন্ডেরসেন ও অস্কার ওয়াইল্ডের রূপকথার মোহময় অনুবাদক। বাংলাভাষা যে পাশ্চাত্য সাহিত্যের এই ঐশ্বর্যকে তার নিজের মধ্যে যোগ্যতার সঙ্গে ধারণ করতে পারে উত্তরাধিকারীদের মনে এই আত্মবিশ্বাসও এনে দিয়েছেন তিনিই। উপর্যুক্ত কথার মধ্য দিয়ে অভিমুখ্যগুলোকে খানিকটা চিনিয়ে দেয়া গেলেও তাঁর প্রতিভার দ্যুতিকে শনাক্ত করা যায় না।

নতুন রীতির সাহিত্যযাত্রার নেতৃত্ব শুরু করেছিলেন তিনি প্রায় কিশোর বয়সে ঢাকায় বসবাস কালে প্রগতি পত্রিকা সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। পরে কলকাতায় হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে কিছুকাল (১৯৩৮-৪০) যৌথভাবে চতুরঙ্গ এবং আরও পরে একক ভাবে কবিতা পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে (১৯৩৫-১৯৬৭) সে নেতৃত্বের দায়িত্ব বহন করে নিয়ে চলেছিলেন। কবিতা পত্রিকা আর তাঁর বাড়ি 'কবিতাভবন' হয়ে উঠেছিল বাংলাসাহিত্যের আধুনিকতাবাদীদের অন্যতম পীঠস্থান। নতুন চেতনার কবিদের কবিতা প্রকাশেই কেবল নয়, তাঁদের প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও তিনি ছিলেন শস্ত্রপাণি। জীবনানন্দ-ব্যাখ্যায় আদিতে তিনিই ছিলেন একাকী পথিক। জীবনান্দ দাশের চেয়ে বয়সে তিনি তরুণতর ছিলেন কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রাঙ্গণে জীবনানন্দকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার আকাক্সক্ষা তাঁর মধ্যে ছিল প্রবীণ ও অভিভাবকসুলভ। তরুণতর সমর সেন ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়েরও তিনি ছিলেন প্রতিভাসন্ধানী। পঞ্চাশের দশকে বিভক্ত বঙ্গের কবিযশোপ্রার্থী উভয় অংশের তরুণতর বাঙালি কবিরাই তাঁর তূণ থেকে গ্রহণ করেছেন তীর। ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবীতম ছাত্র হিসাবে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরে অধ্যাপক হিসাবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ চালু করাসহ মার্কিন মুলুকের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্রামণিক অধ্যাপক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

উনিশ শতকে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠীর প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থায় যে শিক্ষিত সমাজ গড়ে উঠছিল সে সমাজের মানুষেরা এ-দেশের সাধারণ মানুষের জীবন চর্যাকে যথার্থ অনুভব করেন নি। লোকায়ত জীবনধারা সৃষ্ট সাহিত্যের প্রবহমান ধারাবাহিকতা থেকে সরে গিয়ে পাশ্চাত্য-প্রভাবিত যে আধুনিক সাহিত্যের ধারা সৃষ্টি হয়েছিল বুদ্ধদেব বসু ছিলেন সেই ধারার লেখক। যদি এই পশ্চিমী আধুনিকতার প্রভাব না ঘটত তা হলে আমাদের সাহিত্য কোন পথের দিকে ধাবিত হতো এমন প্রশ্ন সা¤প্রতিক কালে উঠলেও ধারাটি এগিয়ে চলেছে বলদর্পিতার সঙ্গে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই তাঁকে সত্যিকার রূপে খুঁজে পাওয়া যাবে।

বুদ্ধদেব বসুর প্রধান পরিচয় তিনি কবি। রবীন্দ্রোত্তর কালে রবীন্দ্রবলয় থেকে মুক্তি আকাক্সক্ষী একঝাঁক কবির মধ্যে বুদ্ধদেব বসু বিশিষ্ট ছিলেন। দীর্ঘকাল ধরে রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কবিপঞ্চকের অন্যতম হিসাবে তিনি ছিলেন প্রজ্জ্বলন্ত অগ্নি। যে সময়ে তিনি বিকাশমান ছিলেন তা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কাল। ভারতবর্ষে আধাসামন্ত যুগের অবসান আসন্নপ্রায়, দ্রুততর গতিতে গড়ে উঠছিল নগর; সেই সঙ্গে নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজ। বুদ্ধদেব বসু এই নাগরিকতা অভিমুখি সমাজেরই কবি। গল্পকার বা ঔপন্যাসিক হিসাবেও একই পথের যাত্রিক। লোকজ জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির দিকে তাঁর দৃষ্টি ছিল না। বরং নগরসমাজের গঠনের লগ্নে নতুনতর মূল্যবোধকে আবিষ্কারের উদ্দীপনা তাঁকে উজ্জীবিত করেছে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসাবে স্বাভাবিক কারণেই পাশ্চাত্যীয় সাহিত্যের মাধ্যমে ঘটেছিল আধুনিকতার দিকে তাঁর যাত্রা। বলা চলে বুদ্ধদেব বসু সেই আধুনিকতার যাত্রিক ছিলেন যে-আধুনিকতা গ্রামসমাজের বহমানতার দিক থেকে এক রকম চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। এই আধুনিকতার দৃষ্টি ছিল গ্রামসমাজের মূল্যবোধের ভাঙনোত্তর নতুন জীবনদৃষ্টির অভিমুখে। সঙ্গত কারণেই অবক্ষয়ী শার্ল বোদলেয়ার তাঁর অনুসৃষ্টিতে বাংলাভাষায় পেয়েছিলেন স্বতন্ত্র মাত্রা। অধুনা কোনও কোনও ফরাসিভাষাভিজ্ঞদের মূল্যায়নে বুদ্ধদেবের অনুবাদের ভ্রান্তি অপরিসীম হলেও, অনেক ক্ষেত্রে তাঁর অনুবাদিত বোদলেয়ারকে রীতিমতো অবোদলেয়রীয় বলেও চিহ্নিত করা গেলেও বুদ্ধদেবীয় বোদলেয়ার ষাট ও সত্তরের দশকের অনুজ কবিদের ওপর যে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল সে কথা কেউ অস্বীকার করবে না। বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে আমরা বোদলেয়ারের যে রূপ পাই তাতে স্বমূর্তিতে বোদলেয়ার না থাকতে পারেন কিন্তু যা আছে তা যে সে-সময়ের চেতনার কবিতাভাষিত রূপ তাতে সন্দেহ নেই। সংস্কৃত কাব্য মেঘদূত-এর আনেকগুলো অনুবাদ থাকলেও বুদ্ধদেব বসু যে রূপ দিয়েছেন তাতেও ছিল সেই কালচেতনারই প্রকাশ। বইয়ের অসামান্য ভূমিকাটি তাঁর সমকালের মানুষকে নতুন চোখে কালিদাসের দিকে তাকাতে সহযোগিতা করেছিল। আধুনিকতা তার শক্তি সংগ্রহ করেছিল বুদ্ধদেবের মেঘদূত থেকেই।

বুদ্ধদেব বসু ছিলেন সাহিত্যজ্বরে কম্পমান এক মানুষ। সাহিত্যই যেন ছিল তাঁর জীবনদীপের আলো। পঁয়ষট্টি বছরের জীবনপরিসরে তাঁর কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, সাহিত্য সমালোচনা, স্মৃতিকথা, ছোটদের সাহিত্য, চিরায়ত সাহিত্যের অনুবাদ ইত্যাদি সব মিলিয়ে রচনার বিপুলতা দেখলে এ-কথা অনেকটাই অনুভব করা যাবে। পেশাগত জীবনেও তিনি ছিলেন সাহিত্যেরই অধ্যাপক। অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ খোলার মধ্য দিয়ে তিনি ভিন্নতর উপায়ে সেই সাহিত্যপ্রেমেরই নিদর্শন রেখেছিলেন। পত্রিকা সম্পাদনায় তাঁর গভীর লিপ্ততা ছিল সেই সাহিত্যমগ্নতারই ভিন্ন এক উৎসার। এমনকী প্রকাশক হিসাবেও আত্মপ্রকাশ করেছিলেন যার উদ্দেশ্য ব্যবসায় সিদ্ধিলাভ নয়, আধুনিকতাপন্থী কবিতার যোগ্য প্রচার। এখানেও সাহিত্যই তাঁর আরব্ধ। নিজে সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছিলেন কবিতা সংকলন আধুনিক কবিতা। তাঁর সমসময়ে এই ধরনের একাধিক সংকলন প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত আধুনিক কবিতা অনতিক্রম্য। এর কারণ তিনি যতটা তন্নিষ্ঠ প্রেমে আধুনিক সাহিত্যকে অনুভব করতে পারতেন ততটা অন্যেরা পারেন নি। তাঁর বোধ কেবল আধুনিকতার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, সামগ্রিকভাবে সাহিত্যের সার্বিকতায় বিস্তৃত ছিল; হয়তোবা এও তাঁর এই সংকলনের সাফল্যের অন্যতম কারণ। তাঁর প্রাণভোমরা যদি সাহিত্যেই নিহিত না থাকবে তাহলে কেন তিনি চাইবেন জীবনটাকে এমন ভাবে চালিয়ে নিতে যাতে সাহিত্যেই নিমজ্জিত থাকতে পারেন চিরকাল, সাহিত্যের থেকে কোনও ভাবে যেন সরে যেতে না হয় তাঁর। এ তাঁর জীবন থেকে পলায়ন নয়, বরং জীবনমুখিতারই এক ধরনের প্রকাশ। তিনি নিশ্চয়ই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন সাহিত্যের জন্য জীবনটাকে উৎসর্গ করতে হলে কতটা সংগ্রাম করতে হয় তার জন্য। কোনও জীবন পলাতকের পক্ষে সম্ভব নয় সে-কথা অনুভব করা। যদি বুদ্ধদেবের সাত্যিকৃতি উত্তরকালের কাছে একদা অগ্রহণীয়ও হয়ে পড়ে তাহলেও তাঁর এই সাহিত্যপ্রেম ও তার প্রতি অঙ্গীকারকে সালাম জানাতেই হবে তাদের।

তিনি সামগ্রিক অর্থেই কবি ছিলেন, ছিলেন রোম্যান্টিক। ফলে তাঁর কথাসাহিত্য নাটক সমালোচনামূলক গদ্যরচনা সবই কবিতাপ্রভ ও রোম্যান্টিকতাস্পর্শিত। রোম্যান্টিকতার জন্য বন্দীর বন্দনা, কঙ্কাবতী কাব্য পাঠের স্মৃতি এখনও স্পৃষ্ট করে, একই কারণে হয়তো আরও দীর্ঘকাল পাঠকের মনে পড়বে তিথিডোর উপন্যাসের কথা কিংবা মৌলিনাথ-এর কথা, অথবা মনে পড়বে গোলাপ কেন কালোর কথা। অনবদ্য স্মৃতিকথা ছেলেবেলার কথা বারবার মনে না পড়েই যায় না। তপস্বী ও তরঙ্গিনীর কাব্য ও নাট্যরসের ঘোর না লেগেই পারে না সংবেদনশীল বাঙালি মনে। বুদ্ধদেব বসু ‌'বাংলা শিশুসাহিত্য' প্রবন্ধটি না লিখলে হয়তো বাংলা শিশুসাহিত্যের সম্পদের ঐশ্বর্য সম্পর্কে বাঙালির অজ্ঞতা কাটিয়ে উঠতে লেগে যেত আরও কত দীর্ঘ দীর্ঘ কাল তা কে জানে। রবীন্দ্রনাথেরও সৃষ্টিশীলতার কেন্দ্রে ছিল সাহিত্যই কিন্তু সাহিত্যেই শুধুমাত্র ছিল না তাঁর অক্সগীকার এমন তীব্রভাবে। সাহিত্যের প্রতি অঙ্গীকার বুদ্ধদেব বসুর এতটাই গভীর ছিল যে কেবল একাকীই পথ পাড়ি দিতে চান নি, সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন সকল সাহিত্যযাত্রীকেই। নিজের লেখার চেয়ে পত্রিকা সম্পাদনার কাজ অনেক ঝামেলাপূর্ণ। অথচ পত্রিকা সম্পাদনা থেকে তিনি সহজে বিরত হন নি। এর প্রেরণা-উৎস তো এই অঙ্গীকারই!

বইয়ের প্রকাশক হিসাবে বুদ্ধদেব বসুর নাম হয়তো প্রকাশনার ইতিহাসকারেরা কখনও লিখবেন না ব্যবসায় সাফল্য না থাকার কারণে। কিন্তু না মেনে উপায় নেই যে, তাঁর 'এক পয়সার একটি' সিরিজের বইগুলোর অবদান ব্যবসায় সাফল্যের চেয়ে অনেক বড়। প্রকাশনার ক্ষেত্রে তাঁর এই অবদান মূল্যায়নের অবকাশ আছে ভিন্ন দিক থেকে। কোনও লেখককে তাঁর আত্মপ্রকাশে সহযোগিতা করবার জন্য কোনও ধনাঢ্য ব্যক্তি অর্থলগ্নি করে মহত্তের পরিচয় দিয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত অনেক পাওয়া যাবে, কিংবা কোনও লেখক কেবল নিজের প্রচারের জন্য নিজেই প্রকাশক হিসাবে দুই একটি বই প্রকাশ করেছেন এমন দৃষ্টান্তও পাওয়া যাবে প্রচুর। কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর 'এক পয়সার একটি সিরিজ' ছিল ব্যতিক্রম। এই সিরিজের বইগুলো প্রকাশিত হয়েছিল কেবল আধুনিক সাহিত্যের প্রতি তাঁর অপরিসীম ভালোবাসাবশত। কেবল মাত্র প্রিয় সমসাময়িক বা অধমর্ণ কবিদেরকে অন্যদের কাছে তুলে ধরার সাহিত্যিক প্রচেষ্টা হিসাবে তিনি এগুলো প্রকাশ করেছিলেন; যেমন প্রকাশ করেছিলেন প্রগতি বা কবিতা পত্রিকা। শুধু তাই নয়, নিজে যে-ধরনের সাহিত্যের নকীব ছিলেন সে-সাহিত্যকে যোগ্যতম মর্যাদায় ''সত্যিকারের আগ্রহী'' পাঠকদের পাতে তুলে দেয়ার জন্য তিনি চালু করেছিলেন এই প্রকাশনা। এই রকম উপলক্ষে বই প্রকাশ করবার দৃষ্টন্ত এর আগে আছে কি? আমরা যে অর্থে নবচেতনার সাহিত্যের পত্রিকাকে লিটল ম্যাগাজিন বলে চিহ্নিত করে থাকি সে অর্থেই বুদ্ধদেব বসুকে বলতে পারি 'লিটল পাবলিশার'। প্রকাশনার ক্ষেত্রে নব আকাক্সক্ষা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস লিখতে হলে বুদ্ধদেব বসুর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করে নিতেই হবে।

জীবন যেমন সংগ্রামশীল এবং দুঃখময় তেমনি অসম্ভব আনন্দেরও আধার — বুদ্ধদেব বসুর সাহিত্য পড়তে পড়তে আমরা আন্তরিক ভাবে অনুভব করি এ-কথা। সামগ্রিকভাবে তাঁর রোম্যান্টিকতার মধ্যে এই ভাষ্যই আমরা পাই। তাঁর রচিত শিশুসাহিত্যও এর বাইরে নয়। প্রধান পরিচয়ে তিনি শিশুদের লেখক নন, কিন্তু ছোটদের জন্য লেখা তাঁর সাহিত্যের মধ্যেও আমরা এই সুরই শুনতে পাই। তাঁর সাহিত্যপ্রেম ছোটদের জন্য লেখার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে আলোককাননের ফুল হয়ে। তা না-হলে স্বপ্নকল্পনার এই ডানা তিনি পাবেন কোথায়, কিংবা কোথায় পাবেন স্নেহমমতার মোহন বাঁশি!

সাহিত্যের প্রতি অঙ্গীকার ও ভালোবাসার যে রূপ পাওয়া যায় তাঁর মধ্যে তাতে হয়তো অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, হয়তো সামগ্রিক ভাবে তাঁর বিরুদ্ধে অনেক নালিশ থাকাও স্বাভাবিক; কিন্তু কোনও মানুষের সৃষ্টিশীলতা ও প্রেমের মূল্য তার চেয়েও বেশি। জন্মশতবার্ষিকীর লগ্নে তাঁর এই মূল্যটুকুকেই বড় করে দেখা হবে।

ঢাকা, ২৮/১১/২০০৮