নিরহঙ্কার বেবী মওদুদ

আমানুল্লাহ কবীর
Published : 27 July 2014, 07:06 PM
Updated : 27 July 2014, 07:06 PM

তখনও আমার সঙ্গে তাঁর ভালো পরিচয় নেই। প্রায়ই প্রেস ক্লাবে দেখতাম তাঁকে। আমারই বয়সের একজন নারী সাংবাদিক। পরনে সাদাসিধে শাড়ি, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। টেবিলে চয়ের কাপে ঝড় তুলে কারও সঙ্গে বেশিক্ষণ আড্ডা দিতেও দেখিনি। মিতভাষিণী, মাঝে-মাঝে ঠোঁটে মৃদু হাসি।

পরে জানলাম তিনি বেবী মওদুদ। নামটা অতিপরিচিত, সংবাদ-এ চাকরি করেন। বিচারপতি মওদুদের মেয়ে, অথচ চলাফেরায় কথাবার্তায় নিরহঙ্কার। পৈতৃক পরিচয়ের সঙ্গে আচার-আচারণের মিল নেই, যা হওয়ার কথা নয় আমাদের আধা-সামন্ততান্ত্রিক সমাজে।

সে সময় আমাদের দেশে নারী সাংবাদিক হাতেগোনা কয়েকজন। নানা সামাজিক কারণেই মেয়েরা সাংবাদিকতা পেশায় আসতে উৎসাহ বোধ করত না অথবা অভিভাবকরা তাদের নিরুৎসাহিত করতেন। কিন্তু বেবী মওদুদ ওই সময় সে প্রাচীর ভেঙ্গে সাংবাদিকতাই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে সে ভাঙ্গা প্রাচীরের ফাঁক দিয়ে অনেক নারীই তাঁর সহকর্মী হন। প্রগতিশীল সংবাদপত্র বলে পরিচিত 'সংবাদ'-এ তখন বেশ কয়েকজন নারী সাংবাদিকতা করতেন।

বেবী মওদুদ রাজনৈতিকভাবে ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। ছাত্রজীবনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে, পরবর্তীকালে সিপিবিতে। তাঁর লেখাতেও তাঁর প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা প্রস্ফুটিত হত। মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থী বাম রাজনীতিকদের মধ্যে আদর্শগত কারণে ছিল দা-কুমড়ো সম্পর্ক, কেউ কাউকে সহ্য করতে পারত না। আমাদের রাজনীতিতে কালক্রমে যে পরিবর্তন ঘটে, তার ধারাবাহিকতায় বাম ধারাগুলোও মিইয়ে যায় এবং উভয় বামপন্থী রাজনীতিকদের একটা অংশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে সহায়ক মনে করে তাতে যোগ দেন।

বেবী মওদুদ ছাত্রজীবন থেকেই ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনি শেখ মুজিবর রহমানের 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' সম্পাদনা করেন। এই দুরূহ কাজটি নিঃসন্দেহে বেবী মওদুদের জন্য একটি স্মরণীয় কীর্তি। আওয়ামী লীগের গত সরকারের সময় তিনি জাতীয় সংসদের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন।

বেবী মওদুদ যাকে বিয়ে করেছিলেন তিনি ছিলেন তাঁরই সহকর্মী হাসান আলী। ১৯৭৫ সালে বাকশাল আমলে অন্যান্য সংবাদপত্রের সঙ্গে সংবাদও বন্ধ হয়ে যায়। পরে সংবাদ পুনঃপ্রকাশিত হলেও এই সাংবাদিক দম্পতির জন্য তার দ্বার উম্মুক্ত হয়নি। দীর্ঘদিনের পেশা ত্যাগ করে হাসান ভাই গায়ে কালো কোট চড়িয়ে ওকালতির সনদ নিয়ে হাজির হন আদালতে। কিন্তু বেবী মওদুদের কপালে যেন তা-ও সইল না। হঠাৎ একদিন শুনি, হাসান ভাই দুই শিশু সন্তান ও সংসারের বোঝা তাঁর উপর চাপিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকেই।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় বেবী মওদুদ তখন যোগদান করেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস), বাংলা বিভাগে বার্তা সম্পাদক হিসেবে। বাসস'র বাংলা বিভাগ তাঁর সময়ই চালু করা হয়। ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর আমি বাসস'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগদান করি। তারপর বেবী মওদুদ আর কখনও বাসস অফিসে যাননি। সম্ভবত তিনি মনে করেছিলেন, যেহেতু রাজনৈতিক কারণে বাসস-এ তাঁর চাকরি হয়েছিল, সেহেতু সরকার পরিবর্তনের পর নৈতিকভাবে ওই চাকরিতে থাকা সমীচীন হবে না।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ বেবী মওদুদকে সহকর্মী হিসেবে পাই। হাসান ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁকে সবসময় সাদা শাড়িতেই দেখেছি। পরনের সাদা শাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেন তাঁর মাথার চুলগুলোও সাদা হয়ে গিয়েছিল।

তিনি দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে। একদিন প্রেসক্লাবে তাঁর ছোট ছেলে উল্লসিতভাবে জানাল, 'মামা, ঈদের পরে আম্মাকে ইন্ডিয়াতে নিয়ে যাব'। সন্তানের সে আশা আর পূরণ হয়নি। ঈদের আগেই বেবী মওদুদ চলে গেলেন অনন্ত বিশ্রামে।

আমানুল্লাহ কবীর: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমের সিনিয়র এডিটর।