ঈদ-আনন্দ এবং নিরানন্দ সড়ক

অপূর্ব সাহা
Published : 26 July 2014, 06:53 AM
Updated : 26 July 2014, 06:53 AM

চলছে পবিত্র মাহে রমজান। আসছে ঈদ, আনন্দের পসরা সাজিয়ে। মানুষ ছুটছে তার প্রিয় গন্তব্যে; তার শেকড়ে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই শেকড়মুখী যাত্রা কতটুকু কণ্টকবিহীন?

উত্তর সবার জানা। তবু বলি, পথে পথে ছড়িয়ে আছে নিরাপত্তাহীনতার কাঁটা। আমাদের দেশের জনগণ গত কয়েক দশক ধরে এই কাঁটাই চোখের জলে নাকের জলে আপন করে নিয়েছে। কারণ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রিয়জন হারানোর তীব্র বেদনা, সংশয়, শঙ্কা, পথের অনিশ্চয়তা কোনো সরকারই লাঘব করতে পারেনি। অধিকন্তু, সরকার এমন সব পদক্ষেপ নিয়েছে যা সড়ক দুর্ঘটনার রাশ টেনে ধরার বদলে তাকে জ্যামিতিক হারে বাড়িয়ে দিয়েছে। সড়কগুলো করে তুলেছে মৃত্যুফাঁদ!

আমার কখনও জেনে, কখনও না জেনে সেই ফাঁদে পা দিচ্ছি। আমরা দলবেঁধে অপঘাতের মুত্যু আলিঙ্গন করছি। আমরা ক্ষণিক শিরোনাম হচ্ছি পত্রপত্রিকায়। তারপর বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছি। এটা আমাদের প্রতিদিনের ঘটনা। নৈমিত্তিক ট্র্যাজিডি।

কিছু কিছু ঘটনা অবশ্য বিস্মৃতির অতল থেকে গলা বাড়ালে আমরা ফের কাঁদতে বসি। এই তো এ মাসের ১১ তারিখে ছিল কুখ্যাত মিরেরসরাই ট্র্যাজিডি। মোবাইলে কথা বলছিল চালক, আর মহামূল্যবান জীবন দিয়ে তার খেসারত দিতে হল স্কুলগামী ৪৪ মাসুম শিশুকে। ২০১১ সালের ঘটনা। টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম, সেই শিশুদের আপনজনেরা আজও ছবির ফ্রেম ও অন্যান্য স্মৃতিচিহ্ন বুকে চেপে ধরে আহাজারি করছে।

সেই কান্না যখন ছড়িয়ে পড়ছে বাংলার আনাচে কানাচে, সবাই বেদনায় কাতর, ঠিক তখনই ব্রেকিং নিউজে চোখে পড়ল, বরিশালের উজিরপুরের ইচলাদিতে হানিফ পরিবহনের একটি বাসের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রিক্সা-ট্যাম্পুসহ অনেকগুলো দোকান গুঁড়িয়ে দিয়ে খাদে পড়ার খবর। চোখের নিমেষে ঝরে গেল ১২ টি তাজা প্রাণ। রিক্সা-ট্যাম্পু আর দোকানের সঙ্গে গুঁড়িয়ে গেল কতগুলো স্বপ্ন। গোটা উজিরপুর বিহ্বল হয়ে পড়ল শোকে।

পরদিন দেখলাম একের পর এক মৃতদের জানাজা। কিন্তু বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারাল কেন? কোনো পত্রিকায় এই কেন'র উত্তর আমি পাইনি। তবে একটি টিভি চ্যানেলে দুর্ঘটনাকবলিত বাসের একজন যাত্রীকে বলতে শুনেছি, চালক নাকি বেপরোয়া গাড়ি চালাচ্ছিল এবং মোবাইল ফোনে কথা বলছিল।

গাড়ি চালাতে চালাতে মোবাইল ফোনে কথা বলা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ কী অদ্ভূত ব্যাপার! ২০১১ সালের এই দিনে মোবাইল ফোনে কথা বলার কারণেই মিরেরসরাই ট্র্যাজিডির জন্ম হয়েছিল। তার ঠিক চার বছর পর ওই একই কারণে জন্ম হল আর একটি সড়ক ট্র্যাজিডির, যার নাম উজিরপুর। কী হতভাগা জাতি আমরা!

আইন প্রয়োগের কথা না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু মর্মান্তিক ইতিহাস থেকেও আমরা শিক্ষা নিই না। ৪৪ জন শিশুর অপঘাতে মৃত্যুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও তো ওই একটা দিন আমরা গাড়ি চালাতে চালাতে মোবাইলে কথা বলা থেকে বিরত থাকতে পারতাম!

দীর্ঘশ্বাস মোচন করা ছাড়া আর কী করার আছে! কথা হচ্ছিল বেপরোয়া গাড়িচালনা নিয়ে। উজিরপুর ট্র্যাজিডির মাত্র দশ দিন আগে বেপরোয়া গাড়িচালনার কারণে জন্ম নিয়েছিল গদখালি ট্র্যাজিডি। সোহাগ পরিবহনের ৮৪ নম্বর গাড়িটি ঢাকা থেকে যাত্রী নিয়ে বেনাপোল যাচ্ছিল। গাড়ির বেশিরভাগ যাত্রীই ভারতে যাওয়ার উদ্দেশে বেনাপোল যাচ্ছিলেন। বৃষ্টির মধ্যে অপর একটি গাড়িকে ওভারটেক করতে গিয়ে বাসের চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। এ সময় রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে বাসটি দুমড়ে মুচড়ে যায়। মারা যান ১০ জন। আহত হন ১৬ জন।

দুর্ঘটনার সময় যাত্রীদের অধিকাংশ ঘুমিয়ে ছিলেন। সোহাগ পরিবহনের এই কোচ ঢাকা থেকে ছেড়ে আসার পর থেকেই নাকি চালক বেপরোয়াভাবে অন্যান্য পরিবহনকে ওভারটেক করছিল। যাত্রীরা তাকে কয়েকবার সতর্কও করেছেন। কিন্তু তিনি কারও কথায় কর্ণপাত করেননি।

উজিরপুরে ছিল হানিফ পরিবহন, গদখালিতে সোহাগ পরিবহন। এই দুুটি পবিরহনই কিন্তু বেশ জনপ্রিয় এবং নিরাপদ বাহন হিসেবে যাত্রীদের মাঝে কিছুটা আস্থা অর্জনকারী। কারণ এদের গাড়িগুলো আধুনিক গেজেট সম্বলিত এবং চালকরাও মোটামুটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বলে আমরা জানি। তাহলে আমাদের জানাতে কি গলদ আছে? তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে, আমাদের সর্বশেষ আস্থার জায়গাগুলোতেও ঘূণ ধরেছে? কে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর? মিরেরসরাই, গদখালি, উজিরপুর– এরপর কোন ট্র্যাজিডি আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে?

যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। ঈদ আসছে। মানুষ ফিরবে ঘরে। একটার পর একটা মৃত্যুফাঁদ পার করে। কিন্তু সবাই কি ঘরে ফিরবে? খুব অপ্রিয় সত্য হচ্ছে, কেউ কেউ ফিরতে পারবে না। আমাদের অনাধুনিক অবৈজ্ঞানিক সড়ক ব্যবস্থা এবং নাজুক পরিবহন ব্যবস্থাপনা কাউকে কাউকে সুস্থ অবস্থায় ঘরে ফিরতে দেবে না।

আর উৎসবের দিনগুলোতে নাজুক পরিবহন ব্যবস্থাপনা এক প্রকার ভেঙেই পড়ে বলা যায়। ওই সময় সড়কে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় মানুষের চাপ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। পরিবহন অপারেটরদের জন্য এটা কিন্তু সুখবর। যত মানুষ, তত ব্যবসা। তারা লাভ দ্বিগুণ করতে টিকিটের দাম বাড়িয়েই শুধু ক্ষান্ত হয় না, পুরনো ফেলে দেওয়া গাড়ি রঙচঙ করে বা অন্যদের সাবস্ট্যান্ডার্ড গাড়ি ভাড়া নিয়ে বাসের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়।

এর ফলে দুটো ঘটনা ঘটে। টিকিটের দাম বৃদ্ধির ফলে তা নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। ফলে তারা অপেক্ষাকৃত সস্তা পরিবহনের শরণাপন্ন হন, যেসব পরিবহন অধিকতর দুর্ঘটনার ঝুঁকির মধ্যে থাকে। আর দ্বিতীয়ত, গাড়ির সংখ্যা বাড়ে, কিন্তু চালকের সংখ্যা তো বাড়ে না। এমনিতেই দেশে গাড়ি এবং চালকের অনুপাত হচ্ছে ১০০: ৫৫। অর্থাৎ একশ'টি গাড়ির জন্য চালক আছে ৫৫ জন।

তাহলে অতিরিক্ত গাড়ি চালায় কারা? হেলপার বা কন্ডাক্টররা। উৎসবের দিনগুলোতে এই হেলপার কাম ড্রাইভারদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। সড়কে তৈরি হয় চরম অস্থিরতা। দ্রুতগতি, অন্যায্য ওভারটেকিং, অতিরিক্ত বোঝাইসহ আইন অমান্যমূলক কর্মকাণ্ডের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয় সড়কগুলো।

আরও আছে। একই চালককে দিয়ে চলে একটার পর একটা ট্রিপ; খাওয়া নেই, ঘুম নেই, ট্রিপ চলছে তো চলছেই। মানবশরীর তো, কত আর সয়! এ সবই সড়ক দুর্ঘটনার আশঙ্কা অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়।

আর সর্বোপরি যেটি রয়েছে তা হচ্ছে, আইনের প্রয়োগ। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, যারা আইনের প্রয়োগ করেন তারা আরও ভালোভাবে, উজ্জ্বলভাবে উৎসব পালনের স্বপ্নে মশগুল থাকেন। আইন তারা ব্যবহার করেন, তবে তা পরিবহন ব্যবস্থাপনা সাবলীল করার জন্য নয়, সড়ক নিরাপদ করার জন্যেও নয়, নিজের পকেট ভারী করার জন্য।

না হলে কেন সাবস্ট্যান্ডার্ড ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলবে? কেন অতিরিক্ত যাত্রী বহন করবে গাড়িগুলো? কেন তারা অতিরিক্ত গতিতে চলবে? কেন চালকেরা অন্যায্য ওভারটেকিং করবে? কেন চালকেরা গাড়ি চালাতে চালাতে মোবাইল ফোনে কথা বলবে? কেন অসংখ্য মানুষের ঈদের আনন্দ সীমাহীন বিষাদে পরিণত করবে গুটিকয় মানুষ?

আমি সাধুবাদ জানাই যোগাযোগমন্ত্রীকে তাঁর অত্যন্ত কঠিন কয়েকটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য। তিনি ঈদের তিনদিন আগে থেকে এবং দুইদিন পর পর্যন্ত মহাসড়কে মালামালবাহী ভারী ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এছাড়া বাতিল করেছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ছুটি। তাঁর এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে মহাসড়কে পরিবহনের চাপ বেশ খানিকটা কমবে, যা ইতিবাচক প্রভাব রাখবে সার্বিক সড়ক নিরাপত্তায়। তাঁর একটা মহাসড়কে মেরামত কাজ শেষ করার জন্য সময় বেঁধে দেওয়ার ঘটনাও বেশ প্রশংসিত। এ সবই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচায়ক।

সড়ক নিরাপত্তা বিষয়টা সামগ্রিক, খণ্ডিত দু'একটা পরিকল্পনা বড় কোনো পরিবর্তন আনতে অপারগ। তবু এ ধরনের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হতাশার সমুদ্রে আশার দু'একটা দ্বীপের মতো দৃশ্যমান হয়। কিন্তু সেসব দ্বীপ আবার মুহূর্তে তলিয়ে যায়, যখন এনফোর্সমেন্ট বা আইন প্রয়োগের নাজুক চেহারাটা চোখের সামনে চলে আসে।

এবারের ঈদ সামনে রেখে আমরা কি বরাবরের মতোই সড়ক-মহাসড়কে আইন-ভাঙার মহোৎসব দেখব? আইনের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়তে দেখব পরিবহন ব্যবস্থার শৃঙ্খলা? দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া গাড়ির ভেতরে ডুকরে কেঁদে উঠতে দেখব মানবতা?

না, আমরা এ সকল নেতিবাচকতা আর দেখতে চাই না। পরিবর্তনের হাওয়া যখন মৃদুমন্দ বইতে শুরু করেছে, তখন সেই হাওয়া ঝড় হয়ে বয়ে যেতে দেখতে চাই। কিছু মানুষ আইন ভাঙতে চাইবেই; সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু তাকে যখন আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়, তখন দীর্ঘশ্বাস ঢাকা পড়ে যায়, তৈরি হয় আস্থার বাত্যাবরণ। আমরা দেখতে চাই রাস্তায় আইনভাঙা মানুষের শাস্তি।

এখনই শুরু হোক সেটা। আসছে ঈদ সামনে রেখে। শাস্তির সংস্কৃতি চালু হয়ে গেলে, সামনে অপেক্ষা করে থাকবে শুভদিন।

মাননীয় মন্ত্রী কি বিষয়টার দিকে একটু নজর দেবেন?