মূল্যনিয়ন্ত্রণ নয়, দরকার বিকল্প ভাবনা

এইচ এম মহসীন
Published : 25 July 2014, 06:57 AM
Updated : 25 July 2014, 06:57 AM

প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আনন্দদায়ক। তাই নাড়ির টানে গ্রামে ফিরে যেতে শুরু করেছেন শহরের অসংখ্য মানুষ। তবে প্রতি ঈদের মতো এবারও সাধারণ মানুষের গ্রামের বাড়িতে ফেরার অভিজ্ঞতা যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুখকর হবে না সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। যাত্রীদের সীমাহীন ভোগান্তি, টিকেটের চড়া দামবৃদ্ধি, দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েও টিকেট না পাওয়া এবং কালোবাজারিদের মাধ্যমে টিকেট বিক্রি হওয়ার অভিযোগ আমাদের সকলেরই জানা।

স্বভাবতই আমরা এ ভোগান্তির জন্য পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং ক্ষমতাসীন সরকারকে দায়ী করে থাকি। পরিবহন ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফার লোভ, কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও কালোবাজারির প্রভাব জাতীয় বিষয়গুলো তুলে ধরে দৈনিক পত্রিকায় সম্পাদকীয়, কলাম প্রকাশের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সচিত্র প্রতিবেদনও প্রচারিত হয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বছর ঘুরে যখন আবার ঈদ ফিরে আসে, দেশের কোটি কোটি মানুষ আগের বছরের মতো সেই একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। এ যেন বিশ্বকাপ খেলা চলাকালীন টিভি রিপ্লে দেখার মতো অবস্থা।

গতানুগতিক দোষারোপ-কেন্দ্রিক কলাম এবং এতদসংক্রান্ত সুপারিশ যে ঈদে বাড়ি ফেরার ভোগান্তি কমাতে কোনো সমাধান আনবে না সেটি বলাই বাহুল্য। তাই ঈদের সময়ে টিকেটের দাম বাড়া যৌক্তিক কিনা, টিকেট কালোবাজারি বন্ধ করা কতটুকু সম্ভব এবং কীভাবে ঈদে বাড়ি ফেরা নিয়ে ভোগান্তি এড়ানো যায় এ বিষয়গুলো আজ অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করব।

প্রথমেই আসা যাক, টিকিটের মূল্য বৃদ্ধির প্রসঙ্গে। এ বিষয়ে মতামত তুলে ধরার আগেই জেনে নেওয়া ভালো যে, সাধারণত দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে পণ্য বা সেবার মূল্য নির্ধারণ করা হয়। প্রথমটি হচ্ছে, উৎপাদন খরচভিত্তিক (Cost based pricing)– অর্থাৎ উৎপাদনের খরচ বাড়লে পণ্যের দাম বাড়বে এবং উৎপাদন খরচ কমলে পণ্যের দাম কমবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বেশিরভাগ খুচরা বিক্রেতাই তাদের ক্রয়মূল্যের ওপর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভ যোগ করে পণ্যের চুড়ান্ত বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে থাকে।

মূল্য নির্ধারণের দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হচ্ছে ভ্যালু বেইজড প্রাইসিং (Value based pricing)। এ পদ্ধতিতে একজন ভোক্তা কাঙ্ক্ষিত পণ্য বা সেবার কীভাবে মূল্যায়ন করে এবং সেটির জন্য সে কত টাকা দিতে ইচ্ছুক (willingness to pay) সেটিই মূল্য নির্ধারণের আসল মাপকাঠি। ওই পণ্য উৎপাদনে বা সেবা দিতে কত খরচ সেটি এখানে বিবেচ্য নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ক্যান্সার নিরাময়কারী কোনো ওষুধ যদি তৈরি করা হয় যার মাধ্যমে ক্যান্সার থেকে মুক্তি নিশ্চিত, তাহলে এই ওষুধ তৈরিতে খরচ যা-ই হোক না কেন, অনেকে বিত্তবানই মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে হলেও সেটি কিনতে দ্বিধান্বিত হবেন না।

উপরোক্ত দুটি পদ্ধতির আলোকে ঈদে যানবাহনের টিকেটের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি খতিয়ে দেখা যাক। প্রথমেই দেখব ঈদের সময়ে যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে পরিবহন কর্তৃপক্ষের খরচ বৃদ্ধি পায় কিনা যা এ সময়ে পরিবহনের টিকেটের মূল্যবৃদ্ধি প্রভাবিত করতে পারে।

আমরা জানি ঈদের আগে যেমন ঢাকা থেকে বহির্গামী যানবাহনগুলো সম্পূর্ণ ভর্তি থাকে, বিপরীত পক্ষে, ঢাকাগামী যানগুলো কিন্তু প্রায়ই যাত্রীহীন থাকে। এর বিপরীত চিত্র থাকে ঈদের পরে ঢাকাতে ফেরতের ক্ষেত্রে। তাই পরিবহন কর্তৃপক্ষ যদি স্বাভাবিক সময়ের মতো একই টিকেট মূল্য নেয়, তাহলে তারা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। অনেক পরিবহন মালিক শুধু এই যুক্তির কারণেই টিকিটের দাম দ্বিগুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে থাকেন।

শুধু তাই নয়, ঈদের সময়ে অতিরিক্ত চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে গাড়ির চালক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের স্টাফদের রোজা রেখেও অতিরিক্ত শিফটে কাজ করতে হয়, যেটি ওভারটাইম হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। গার্মেন্টস বা অন্যান্য শিল্পের শ্রমিকরা যেমন ওভারটাইমে দেড় থেকে দুই গুণ পারিশ্রমিক পায়, একইভাবে ঈদের সময়ে অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্য পরিবহন ক্ষেত্রে কর্মরত চালক ও অন্যান্য স্টাফদেরও অতিরিক্ত পারিশ্রমিক প্রাপ্য।

ধরুন, একজন চালক প্রতি ঘণ্টায় ৭০ টাকা হিসেবে বেতন পায় এবং স্বাভাবিক সময়ে সে দিনে ৮ ঘণ্টা গাড়ি চালায়, অর্থাৎ দৈনিক তার আয় হচ্ছে ৫৬০ টাকা। ধরা যাক, ঈদের আগে যদি ওই একই ট্রিপ পরিচালনার জন্য ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ১২ ঘণ্টা সময় লাগে (যানজটের কারণে)। তাহলে চালকের পারিশ্রমিক হওয়া উচিত প্রথম ৮ ঘণ্টা ৭০ টাকা হিসেবে এবং পরবর্তী ৪ ঘণ্টা ১০৫ (দেড়গুণ) টাকা হিসেবে মোট ৯৮০ টাকা। শুধু এই হিসেবেই চালকের বেতনের পেছনে খরচ বেড়ে যায় শতকরা ৭৫ শতাংশ।

এ তো গেল শুধু ওভারটাইমের হিসাব। এবার আসা যাক ঈদ উপলক্ষে বোনাসের কথায়। অন্যান্য পেশায় বছরে দুই ঈদে বোনাস হিসেবে সাধারণত মূল বেতনের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ দেওয়া হয়ে থাকে। ঈদের সময়ে পরিবহন চালক ও স্টাফদের ক্ষেত্রেও যদি সমরূপ বোনাসের হিসাব করা হয়, তাহলে শুধু বেতন-ভাতার ক্ষেত্রেই খরচ প্রায় দ্বিগুণ পর্যন্ত হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, টিকিটের মূল্য বৃদ্ধি না করে মালিক কর্তৃপক্ষ এই অতিরিক্ত খরচ কীভাবে বহন করবে?

ঈদের আগে রাস্তায় যানজটের পরিস্থিতি যে কী ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায় সেটি নিশ্চয়ই সকলেরই কমবেশি জানা, যার ফলে বিভিন্নভাবে পরিবহন কর্তৃপক্ষের খরচ বেড়ে থাকে। প্রথমত, একই দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য বেশিক্ষণ ধরে গাড়ি, ট্রেন বা লঞ্চ চালাতে হয় যার ফলে অতিরিক্ত জ্বালানি তেলের প্রয়োজন হয়। দ্বিতীয়ত, প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের জন্য বেশিক্ষণ অফিস বা অন্যান্য কার্যক্রম চালু রাখতে হয়। তৃতীয়ত, একই সময়ে কমসংখ্যক ট্রিপ চালনা করার ফলে, ট্রিপ প্রতি ওভারহেড খরচও অনেক বেড়ে যায়। এসব কারণে মুনাফার হার ধরে রাখতে চাইলে টিকিটের মূল্য বৃদ্ধি করা ছাড়া বিকল্প থাকে না।

ওপরের আলোচনার ভিত্তিতে একথা নিঃসন্দেহেই বলা যায় যে, উৎপাদন-ভিত্তিক (cost based) মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি অনুযায়ী, ঈদের সময়ে যানবাহনের টিকেটের দাম বাড়া যৌক্তিক।

এবার দেখা যাক ভ্যালু বেইজড প্রাইসিং-এর তত্ত্ব অনুযায়ী টিকেটের মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা কতটুকু। আমরা জানি চাহিদা ও সরবরাহের মধ্য যদি বিস্তর ব্যবধান থাকে, তাহলে অর্থনীতির মৌলিক তত্ত্ব অনুযায়ী মূল্য বৃদ্ধি হয়। বলাই বাহুল্য, ঈদের সময়ে টিকিটের সরবরাহের তুলনায় চাহিদা অত্যন্ত বেশি। ফলে যাত্রীরা নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে হলেও টিকেট কিনতে আগ্রহী। অনেক সময়েই টিভি রিপোর্টে দেখা যায়, সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে, অতিরিক্ত টাকার বিনিময়ে হলেও যখন যাত্রীরা টিকেট হাতে পায়, তখন তাদের আনন্দের সীমা থাকে না– বিজয়সূচক 'ভি' চিহ্ন দেখিয়ে, রাজ্যের হাসি মুখে এঁটে দিয়ে তারা 'ঈদের চাঁদ' হাতে পাবার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে।

টিকেটের উচ্চ দাম নিয়ে অভিযোগ থাকলেও প্রতি বছরেই ঈদের কয়েকদিন আগে ট্রেন, লঞ্চ ও দূরপাল্লার বাস, এমনকি বিমানের টিকেটও ফুরিয়ে যায়। খবরে প্রকাশ ঈদের সময়ের আভ্যন্তরীন বিমানের সব টিকেট ইতোমধ্যেই বিক্রি হয়ে গিয়েছে। তাই যাত্রীরা অতিরিক্ত টাকা দিয়ে হলেও যে টিকেট কিনতে আগ্রহী (willing to pay) সেটি আলাদা করে প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই। তাই ভ্যালু বেইজড প্রাইসিং-এর তত্ত্ব অনুযায়ীও টিকেটের মূল্যবৃদ্ধি যৌক্তিক।

উপরোক্ত অর্থনৈতিক ব্যাখ্যার পরেও টিকেটের মূল্যবৃদ্ধি 'জায়েজ' (নৈতিক) মেনে নিতে যারা দ্বিধান্বিত এবং সরকার কর্তৃক টিকেটের মূল্য নির্ধারণ করা যথাযথ সমাধান মনে করেন, তাদের জন্য আমরা একটু দেখে নিতে চাই ইসলাম মূল্য নির্ধারণ সম্পর্কে কী বলে। বস্তুত, সরকার কর্তৃক মূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে পণ্যের মালিকের অধিকার সম্পর্কিত বিষয়ে ইসলামেও ভিন্ন মতবাদ রয়েছে। ইমাম শাফিঈ এবং ইমাম ইবনে হাম্বলের অনুসারীরা সরকার কর্তৃক মূল্য নির্ধারণের বিপক্ষে। তাদের মতে, মুক্তবাজারের অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যই পণ্যের মূল্য নির্ধারণে ভূমিকা রাখে; সমাজপতি বা সরকারপক্ষের মূল্য নির্ধারণের কোনো কর্তৃত্ব নেই, পণ্যের মালিকই শুধু এর মূল্য নির্ধারণ করার অধিকার রাখে।

পক্ষান্তরে, ইমাম মালিকী ও ইমাম হানাফির অনুসারীগণ দাবি করেন যে, সরকার কর্তৃক মূল্য নির্ধারণ ইসলামসিদ্ধ। তবে বলা হয়েছে যে, সরকার তখনই হস্তক্ষেপ করতে পারে যদি বাজারে কারও একচেটিয়া কর্তৃত্ব থাকে, অথবা যদি কোনো ব্যবসায়ী খাদ্যশস্যের মতো অত্যাবশ্যক পণ্য মজুদ করার মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানোয় ভূমিকা রাখে।

এই বাক্যের শেষ অংশটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও টিকেট বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে টিকেট সরিয়ে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার অভিযোগ রয়েছে, বাড়ি ফেরার টিকেট নিশ্চয়ই খাদ্যশস্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ নয় যেটি না পেলে সমাজের কারও কোনো বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।

আরও একটি ব্যাপার হচ্ছে, পরিবহন ক্ষেত্রে পণ্য মজুদ করে রাখার কোনো উপায় নেই– একে বলা হয় perishable product, অর্থাৎ একটি বাস, ট্রেন বা বিমানে একটি সিট যদি অবিক্রিত থাকে, তাহলে সেটির আর কোনো মূল্যই থাকে না, যেহেতু ওই সিট পরবর্তীতে বিক্রি করার সুযোগ থাকে না।

ইসলামে ব্যবসায়িক লেনদেন বা চুক্তির ক্ষেত্রে 'পারস্পরিক সমঝোতার' মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। যেহেতু বাস বা ট্রেনের টিকেট জীবন-মৃত্যুর মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয় এবং পরিবহন কর্তৃপক্ষ জোর করে কোনো যাত্রীকে টিকেট কিনতে বাধ্যও করে না, তাই ঈদের সময় টিকেটের মূল্যবৃদ্ধি (যার পেছনে পরিবহন চালনার খরচ বৃদ্ধিও রয়েছে) ইসলাম ধর্মে গ্রহণযোগ্য হিসেবেই ধরে নেওয়া যায়।

এ প্রসঙ্গে আরও দুএকটি কথা না বললেই নয়। আর দশটি পণ্য বা সেবার মতোই পরিবহন ক্ষেত্রেও চাহিদা বাড়লে মূল্য বাড়ার উদাহরণ সারা বিশ্বেই রয়েছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিস্টমাস অথবা থ্যাঙ্কসগিভিং-এর সময় সাধারণ সময়ের তুলনায় বিমানের টিকেটের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়। একইভাবে গ্রীষ্মকালীন উচ্চ চাহিদার কারণে যুক্তরাজ্যে বিমানের টিকেটের দাম দ্বিগুণের চেয়েও বেশি হয়।

এবার দেখা যাক ঈদে বাড়ি ফেরার ভোগান্তি কমানো কতখানি সম্ভব। আসলে এই ভোগান্তির সমাধান হিসেবে আলাদিনের চেরাগের মতো কোনো যন্ত্র কারও হাতে নেই। যথাযথ গবেষণা করলে দেখা যাবে, মানুষের অতিরিক্ত নগরকেন্দ্রিকতা এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম প্রশস্ত এবং অপরিকল্পিত রাস্তা ঈদে বাড়ি ফেরার ভোগান্তির অন্যতম কারণ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক যে অর্থনীতি আমরা গড়ে তুলছি সেটি নিতান্তই অনিয়ন্ত্রণসাধ্য। এই সমস্যাগুলো দীর্ঘমেয়াদী যার সমাধানও হতে হবে দীর্ঘমেয়াদী।

রাজধানীর উপর নির্ভরতা কমিয়ে যদি জেলা পর্যায়ে আরও বিশ-ত্রিশটি বা তার চেয়েও বেশি শহর গড়ে তোলা যেত, তাহলে ঢাকায় বসবাসের পরিবেশ ও যানজটের পরিস্থিতির যেমন উন্নতি হত, তেমনি ঈদের সময় ঢাকা থেকে বহির্গামী যাত্রীর সংখ্যাও কমে যেত যার ফলে যানবাহনের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্য ভারসাম্য স্থাপন করাও সহজ হত।

উপরে উল্লিখিত দীর্ঘমেয়াদী সমাধান বাস্তবায়নের জন্য সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঐকমত্য, পরিকল্পনা ও সমন্বয় প্রয়োজন যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অদূর ভবিষ্যতে ঘটার কোনো সম্ভাবনা দেখি না। তাই স্বল্পমেয়াদে এই ভোগান্তির সঙ্গে লড়াই করা শিখতে হবে। হয়রানি এড়ানোর জন্য রিভার্স ট্র্যাভেল করা যেতে পারে, অর্থাৎ প্রতি বছর ঢাকা থেকে গ্রামে না গিয়ে মাঝে মাঝে গ্রামের বাবা-মা বা আত্নীয়-স্বজনকেও ঢাকায় নিয়ে আসা যেতে পারে। ঢাকা থেকে সারাদেশে একসঙ্গে লাখ লাখ লোক বের হয়ে যেতে চান বলে ঈদের সময় যে চাপ পড়ে, রিভার্স ট্র্যাভেলের ফলে কিছু লোক সারাদেশ থেকে ঢাকার দিকে এলে একমুখী চাপ অনেক কমে যাবে।

প্রশ্ন জাগতে পারে, স্বল্পমেয়াদে সরকার কিংবা কর্তৃপক্ষের কি কিছুই করণীয় নেই? অনেকে মনে করেন টিকেট অনলাইনের মাধ্যমে বিক্রি করা হলে কালোবাজারির হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। অনলাইনে টিকেট বিক্রি করা হলে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো থেকে মুক্তি পাওয়া গেলেও কালোবাজারির হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে এ ধরনের চিন্তা খুবই সাদাসিধা (naive) ধরনের। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টিকেট বিতরণকারী কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারাই কালোবাজারির সঙ্গে যুক্ত। সর্ষের মধ্যেই যদি ভূত থাকে তাহলে সে ভূত তাড়ানো এত সহজ হবে না। তবে স্বচ্ছ, দুর্নীতিমূক্ত টিকেট বিক্রি প্রক্রিয়া চালু করতে পারলে সেটি যাত্রীদের ভোগান্তি কমানোর ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে অত্যন্ত সহায়ক হবে।

বরাবরই অভিযোগ শোনা যায় যে, দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও অনেকেই টিকেট পান না। তবে এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বিড়ম্বনার সমাধান অত্যন্ত সহজেই সম্ভব। যে কোনো টিকেট প্রদানকারী সংস্থা তাদের কাছে কতটি বিক্রয়যোগ্য টিকেট আছে সেটি জানে। তাই এমন ব্যবস্থা করা উচিত যাতে টিকেটের জন্য লাইনে দাঁড়ানোর সময় প্রত্যেকে কাঙ্ক্ষিত (জনপ্রতি যে ক'টি টিকেট বিক্রয় গ্রহণযোগ্য তার চেয়ে কম বা সমান) টিকেট সংখ্যা উল্লেখ করবে।

ফলে টিকেট প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ তাদের হাতে থাকা টিকেট সংখ্যা এবং আগ্রহী ক্রেতাদের চাহিদাকৃত টিকেটের পরিমাণ সমন্ধে জানবে। যখনই তারা দেখবে যে লাইনে দাঁড়ানো ক্রেতাদের চাহিদা মেটানোর পরে অতিরিক্ত টিকেট অবশিষ্ট থাকবে না, তারা তখন অন্য কাউকে লাইনে ঢুকতে দেবে না এবং মাইকের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত ঘোষণা করে দেবে। এমন একটি সহজ পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পরেও টিকেট না পাওয়ার অভিযোগ এড়ানো সম্ভব।

শেষ করার আগে বলতে চাই, পানি যেমন বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা কঠিন, তেমনি চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য না থাকলে টিকিটের মূল্য স্থির (fixed) রেখে কালোবাজারি বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। সরকার মূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও অর্থনৈতিক কারণে বরাবরের মতোই টিকেট কালোবাজারির হাতে চলে যাবে।

তাই মূল্য নিয়ন্ত্রণের মতো স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপের পরিবর্তে ঈদে বাড়ি ফেরা নিয়ে ভোগান্তির মূল কারণ নির্মূল করতে হবে। প্রথমত, জেলা শহরগুলো বড় শহরে রূপান্তর করার মাধ্যমে ঢাকার ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। দ্বিতীয়ত, আন্তঃজেলা রাস্তাগুলোর প্রশস্ততা বাড়ানো খুবই জরুরি।

এসব পদক্ষেপ শুধু ঈদে বাড়ি ফেরার ভোগান্তিই কমাবে না, ঢাকাকে করে তুলবে বসবাসযোগ্য শহর এবং দেশের প্রত্যন্ত মানুষের কাছে নগরকেন্দ্রিক সুবিধা পৌঁছে দেবে যেটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আরও ভূমিকা রাখবে। সরকারের দায়িত্বশীলগণ যত দ্রুত মানুষের ভোগান্তি উপলব্ধি করে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবেন ততই দেশের মঙ্গল।

এইচ এম মহসীন: স্ট্র্যাটিজি প্রফেশনাল।