জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না পরিকল্পিত জনসংখ্যা

মাসুমা বিল্লাহ
Published : 17 July 2014, 01:34 PM
Updated : 17 July 2014, 01:34 PM

বরাবরের মতো এবারও ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস হিসেবে পালিত হল। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল 'বিনিয়োগ হোক তরুণ প্রজন্মের জন্য'। চমৎকার এই প্রতিপাদ্যের আলোকে আমাদের তরুণদের জন্য করণীয় ঠিক করা জরুরি।

বর্তমান পৃথিবীর ১.৮ বিলিয়ন জনগোষ্ঠী দশ থেকে চব্বিশ বছর বয়সী। এই ১.৮ বিলিয়নই কিশোর (adolescent) এবং যুবা (youth) এবং এরা মোট বেঁচে থাকা মানবপ্রজাতির আটাশ শতাংশ। বাকি প্রায় পনের শতাংশ দশ বছরের নিচে। সুতরাং আমাদের এই প্রিয় বসুধার প্রায় তেতাল্লিশ শতাংশ মানব-মানবী পঁচিশ বছরের নিচে, যাদের প্রয়োজন বাকি সাতষট্টি শতাংশ জনগোষ্ঠীর সহায়তা, সমর্থন, অবলম্বন আর পৃষ্ঠপোষকতা।

তরুণ প্রজন্ম মানবজাতির ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি। কাণ্ডারিকে মজবুত করে গড়ে তোলা হবে– সে বেড়ে উঠবে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাচুর্য নিয়ে নাকি হিংসা-জেদ-রেষারেষির অনুপ্রাস নিয়ে– তা নির্ধারণ করার দায় এবং দায়িত্ব পৃথিবীর সাতষট্টি শতাংশ পূর্ণবয়স্ক জনগোষ্ঠীর। এই দায় মানবজাতির কেউ এড়াতে পারে না, আর এড়িয়ে গেলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। নগর যখন পুড়ে, দেবালয়ও এড়ায় না। দায়হীনতার সংস্কৃতি থেকে উত্থিত অস্থির তরুণ প্রজন্ম ধ্বংস বৈ শান্তি বয়ে আনবে না। আর সেই ধংসের কবল থেকে রেহাই পাবে না উন্নত, উন্নয়নশীল, উন্নয়নকামী, দরিদ্র কেউই।

এই বৈশ্বিক পৃথিবীতে একা একা একটি দেশ, একটি অঞ্চল উন্নতি করতে পারে না। এক অর্থে এ এক রকম অসম্ভব। বিপুল যে তরুণ জনগোষ্ঠী পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার সিংহভাগ দখল করে আছে, তাদের বেশিরভাগের জন্ম আর বসবাস দারিদ্রপীড়িত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। আর অন্যদিকে উন্নতি আর প্রাচুর্যের স্বর্ণশিখরে উপনীত দেশগুলো বয়সী জনগোষ্ঠীর ভারে ন্যুজ। এ কথাও আজ গবেষণালব্ধ ফলাফল দ্বারা জোরালোভাবে প্রমাণিত যে, অগ্রজ এই জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব নিবে এই তরুণ প্রজন্ম। আর এই দায়িত্বপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে দেশ, সমাজ, অঞ্চলের সীমানা একাকার হয়ে যাবে।

গত এক দশকে 'জনসংখ্যা বিতর্ক'আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থেকে বেমালুম হারিয়ে গেছে এবং এ প্রসঙ্গে এক ধরনের নিরবতা সর্বত্র বিরাজমান। গবেষণাহীন সাধারণ অনুধাবন দিয়েই এটা বলা যায় যে, আমাদের এই অতিপ্রিয় বসুধার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মানের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও ব্যাপকতার রয়েছে সরাসরি এবং সুদূরপ্রসারী সম্পৃক্ততা। ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠী এবং এই জনগোষ্ঠীর অনিবার্য চাপ পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশকে দিন দিন হুমকির মুখে ফেলছে। পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে এক ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে।

এই পরিণতি হয়তো আমাদের চিন্তার গতির চেয়েও দ্রুত, কল্পনার চেয়েও তাণ্ডবপূর্ণ, ধারণার চেয়েও বিভৎস। জনসংখ্যার এই উর্দ্ধগতি সর্বোচ্চ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছানোর পূর্বেই এ সংক্রান্ত কার্যকরী প্রয়াস গ্রহণের বিকল্প নেই।

কোনো কোনো সংস্কারবাদী প্রগতিশীল গোষ্ঠী মনে করেন যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি বা হ্রাস, কোনোটিকে প্রভাবিত করা মানবাধিকার পরিপন্থী। এ ক্ষেত্রে তারা জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বিকাশকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে আগ্রহী। কিন্তু সমস্যার ব্যাপকতা উপলব্ধি করে এই দ্বিধা অবশ্যই কাটাতে হবে যে, মানবাধিকার প্রশ্নবিদ্ধ করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ যেমন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, তেমনি জনসংখ্যার অসহনীয় বৃদ্ধি রোধকল্পে এ সমস্যা পাশ কাটিয়ে যাওয়াও সুবিবেচনাপ্রসূত নয়।

হ্যাঁ, একথা স্বীকার্য যে, অতীতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নামে মানবাধিকার বার বার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, স্বাস্ব্যসেবা ও শিক্ষা খাতে সুবিচার পায়নি পৃথিবীর ব্যাপক জনগোষ্ঠী। কিন্তু এ সকল অপারগতা আর বিফলতার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সম্ভাবনাময় সকল উদ্যোগ দূরে সরিয়ে দেওয়া বা একেবারে উদ্যোগহীন হয়ে পড়া অদূরদর্শিতারই নামান্তর, যা কিনা অতিদ্রুত আমাদের এই প্রিয় বসুধার জন্য ডেকে আনবে সীমাহীন তাণ্ডব। অতীতের সকল প্রকার মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে এবং এটাই কাম্য।

জনসংখ্যা নিয়ে যারা কাজ করেন তারা এ পথেই মূলত এগিয়ে যাচ্ছেন। কী করে মানবাধিকার প্রশ্নবিদ্ধ না করেও জনসংখ্যার আয়তন সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়, তা-ই আধুনিক জনসংখ্যা কর্মসূচির মূল উপপাদ্য। মূলত জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধে সকল প্রচলিত পরিবার পরিকল্পনা মেথডের চেয়ে কার্যকরী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে মানুষকে সম্মানের সঙ্গে তার মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতন করা এবং পরিবার গঠনের ক্ষেত্রে তার নিজের মতামতে প্রাধান্য দিয়ে এবং মর্যাদাবোধ বজায় রেখে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করা।

মানুষের সচেতনতার পরিমণ্ডল সমৃদ্ধ করতে শিক্ষার বিকল্প নেই। উন্নয়নশীল দেশগুলো নারীশিক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়নকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কার্যকরী পন্থা হিসেবে অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে এবং এ লক্ষ্যে কাজও করে যাচ্ছে। তাছাড়া গণমাধ্যমকেও এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে যাতে পরিবার গঠন এবং পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে মানুষ সচেতন হয়ে নিজেই কার্যকরী ভূমিকায় অগ্রবর্তী হয়।

সর্বাধিক মনোনিবেশ করে প্রথমেই আমাদের যে প্রশ্নটি তুলতে হবে তা হচ্ছে, পৃথিবীর বাসিন্দাদের টিকে থাকার জন্য সর্বোচ্চ ঝুঁকি কোনটি? পৃথিবী তার সর্বোচ্চ ক্ষমতায় জনসংখ্যা ধারণ করে আছে এবং এই জনসংখ্যা নিয়ত ক্রমবর্ধমান– এটাই কি সর্বোচ্চ ঝুঁকি নয়? নিকট অতীতে গৃহীত মানবাধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক পরিকল্পনাগুলো আধুনিক মানবাধিকারসম্মত করে মানুষকে জন্ম পরিকল্পনা সেবার আওতায় আনতে না পারলে পৃথিবীতে প্রতিদিন জন্ম নেওয়া শত সহস্র অপরিকল্পিত মানব-মানবী যখন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে মৃত্যুমুখে পড়বে, তখন কি তা আরও বেশি হৃদয়বিদারক হবে না? তা কি মানবাধিকারের আরও নির্মম পরাজয় হিসেবে পরিগণিত হবে না?

জনসংখ্যাবিদ এবং প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা যথারীতি বলতে শুরু করেছেন যে, পৃথিবী তার ধারণক্ষমতার চেয়ে অধিক জনসংখ্যা বহন করছে যা ঝুঁকিপূর্ণ। এই মতামত প্রমাণের পক্ষে সুস্পষ্ট উদাহরণ প্রতিনিয়ত আমরা আমাদের চারপাশে দেখতে পাই। ক্ষমতার চেয়ে অধিক জনসংখ্যা ধারণ করার ফলাফল হিসেবে অনিবার্যভাবেই জনসংখ্যার প্রাকৃতিক হ্রাস (natural decline) ঘটবে, যা বিজ্ঞান আমাদের বলে এবং ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি। প্রাকৃতিক হ্রাস যে কত ভয়াবহ হতে পারে তা অনুমান করা পীড়াদায়ক হতে পারে কিন্তু কষ্টসাধ্য নয়।

অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলেও জনসংখ্যা পরিকল্পিত করার বিকল্প নেই। ভোক্তার ভোগের পরিমাণকে মোট জনসংখ্যা দিয়ে গুণ করলেই মোট সম্পদের পরিমাণ নির্ধরণ করা যায়। সুতরাং জনসংখ্যা যত বাড়বে per capita consumption তত কমবে। আর জনসংখ্যা যখন ধারণ ক্ষমতার সর্বোচ্চ সীমায় চলে যাবে তখন সম্পদের উপর যে অস্বাভাবিক চাপ তৈরি হবে তা বহন করা আমাদের এই প্রিয় বসুধার জন্য অসম্ভব হয়ে পারবে।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীর জনসংখ্যা ২০৫০ এ ৯.২ বিলিয়নে গিয়ে পৌঁছুবে। The Global Footprint Network, যারা পরিবেশের উপর জনসংখ্যার চাপ হিসাব করে দেখায়, তাদের মন্তব্য অনুযায়ী ২০৫০ সালে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার খাদ্য, পানি, জমি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় রসদের যোগান দিতে বর্তমান আয়তনের দুটি পৃথিবীর প্রয়োজন হবে।

আর তাই ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে জনসংখ্যা বিষয়ক আলোচনায় উৎসাহিত করতে হবে এবং এই আলোচনা জন-বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে হবে। শুধুমাত্র জনসংখ্যাবিদগণ এ বিষয়ে কথা বলবেন, এমন ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে সকলকে, বিশেষ করে প্রকৃতি, পরিবেশ, সমাজ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন এমন সকল বিজ্ঞানী ও গবেষককে জোরালো বিতর্কে অংশ নিতে হবে।

জনসংখ্যা বিষয়ে নিরব থাকার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এই বিতর্ক সামনে ঠেলে দিতে না পারলে আমাদের নিরবতা আবারও একদিন আমাদের দিকেই বুমেরাং হয়ে আসবে এবং মানবাধিকার করবে প্রশ্নবিদ্ধ। বিতর্ক চাঙ্গা করতে পারলেই নতুন নতুন সময়োপযোগী এবং সুদূরপ্রসারী সমাধান বের হয়ে আসার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পিত করতে বিনিয়োগ করেছে অর্থ, মেধা, প্রজ্ঞা। অনুকরণীয় সাফল্যও পেয়েছে। এখন সময় এসেছে জনসংখ্যা পরিকল্পিত করার। জনসংখ্যাকে পরিকল্পিত করতে চাই সুদুরপ্রসারী সুচিন্তিত বিনিয়োগ। মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার এই মৌলিক বিনিয়োগ দেশ এগিয়ে নিবে, প্রজন্মকে করবে অর্থনীতির শক্তিশালী হাতিয়ার। জনসংখ্যাকে পরিকল্পিত করতে জন-বিতর্কের বিকল্পের নেই এবং বিতর্কে সম্পৃক্ত করতে হবে জনমতনির্বিশেষে সবাইকে।

অন্যদিকে উন্নত দেশগুলোর প্রাচুর্য, বিজ্ঞানের অফুরান বিকাশ তথা মানবজাতির উন্নতি আর প্রগতি এগিয়ে নিতে হলে তেতাল্লিশ শতাংশ শিশু ও তরুণের বিকাশে যথোপযুক্ত বিনিয়োগ অপরিহার্য। বিনিয়োগ আসতে হবে উন্নত দেশ থেকেই। এই বিনিয়োগ এগিয়ে নিবে উন্নত-অনুন্নত সকলকে, অন্যথায় পিছিয়ে যাবে মানবপ্রজাতি।

মানুষকে ঘিরে ধরবে এইচআইভির মতো প্রাণঘাতী জীবাণু, মাতৃমৃত্যুর মতো অযাচিত অভিশাপ।


মাসুমা বিল্লাহ্:
এনএফপি ফেলো ও জনসংখ্যাবিদ, পার্টনারস ইন পপুলেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (পিপিডি)।