বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপ্রক্রিয়া নিয়ে কিছু কথা

এইচ এম মহসীন
Published : 13 July 2014, 07:39 AM
Updated : 13 July 2014, 07:39 AM

কিছুদিনের মধ্যেই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হবে। কাঙ্ক্ষিত ফল পেয়ে অনেক ছাত্রছাত্রী উচ্ছ্বসিত হবে, অভিভাবকরা গর্বিত হবেন এবং শীর্ষস্থানীয় কিছু কলেজে সাফল্য উদযাপনে আনন্দের বন্যা বইয়ে দেওয়ার খবর গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হবে।

তবে প্রতিবারের মতো এবারও জিপিএ ৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থী তাদের কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না। কারণ দেশে মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা চাহিদার তুলনায় কম। তাই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই ভর্তিপরীক্ষা নামক 'মহাযুদ্ধে' অবতীর্ণ হওয়ার জন্য ইতোমধ্যেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছে শিক্ষার্থীরা।

মানসম্মত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে ভর্তি হতে পারা জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের কী কী গুণাবলী কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় আনা উচিত, ভর্তিপরীক্ষা ও সর্বোপরি বাছাই পদ্ধতি কেমন হওয়া উচিত এবং ভর্তিপদ্ধতি সমন্ধে আমরা উন্নত বিশ্বের কাছ থেকে কী শিক্ষা নিতে পারি সেসব নিয়েই এই লেখা।

প্রথমেই দেখা যাক, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বাছাইয়ের প্রয়োজন কেন। এর সবচেয়ে দৃশ্যমান উত্তর হচ্ছে, বিদ্যমান আসনের তুলনায় আগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি বলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি ফিল্টারিং মেকানিজম দরকার। তবে এর বাইরে আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। মূলত প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চায় তাদের প্রতিষ্ঠান দেশে-বিদেশে সেরার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হোক।

কিন্তু 'সেরা' বিচারের মাপকাঠি কী? ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বললে, একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সফলতা যেমন তাদের পণ্যের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে, তেমনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক সফলতাও নির্ভর করে তার শিক্ষার্থীদের সফলতার ওপর। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্য হচ্ছে তাদের প্রতিষ্ঠানের গ্র্যাজুয়েটগণ, যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে বিভিন্ন পেশায় যোগদান করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্যের (গ্র্যাজুয়েটদের) ক্রেতা হচ্ছে নিয়োগকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান (সরকারি কিংবা বেসরকারি) এবং সর্বোপরি দেশ ও সমাজ। কারণ এই গ্র্যাজুয়েটগণ আমাদের সমাজেই বসবাস করেন এবং বিভিন্ন অবদানের মাধ্যমে সমাজকে প্রভাবিত করেন।

তাই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সফলতা শুধু তার শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক পরীক্ষার ফলাফলের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় না। বরং যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কাজে লাগিয়ে কর্মক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে পারে, সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে, স্থানীয়, কমিউনিটি ও সর্বোপরি দেশের ও বিশ্বের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের অবদানের কারণে স্বীকৃতি পায়, সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই তত বেশি মর্যাদাপূর্ণ স্থানে ভূষিত হয় ও শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা পায়।

গ্র্যাজুয়েটদের সাফল্য দিয়ে যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের পরিমাপ করা হয়, তাই ভর্তির সময় সেরা শিক্ষার্থীদের নির্বাচন করা আবশ্যক। কারণ উচ্চ মানসম্পন্ন আউটপুটের জন্য প্রথম শর্ত হচ্ছে ভালো মানের ইনপুট।

মানসম্মত ইনটেক (ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী) নির্বাচনের মানদণ্ড কী হওয়া উচিত সেটি এবার একটি খতিয়ে দেখা যাক। আগেই বলেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের সফলতার মাপকাঠি হচ্ছে তার শিক্ষার্থীদের সাফল্য। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-পরবর্তী জীবনে সফল হতে হলে একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে যেসব গুণাবলী প্রয়োজন সেগুলোই হওয়া উচিত ভর্তির জন্য বাছাইয়ের মানদণ্ড। প্রশ্ন হচ্ছে, কী সে গুণাবলী।

সফলভাবে শিক্ষা অর্জন করার জন্য পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তু রপ্ত করার দক্ষতা (academic skills) নিঃসন্দেহে দরকার। কিন্তু শুধু পাঠ্যক্রমের ওপর দক্ষতা থাকলেই কি একজন শিক্ষার্থী জীবনে সফল হতে পারে? মোটেই নয়। বরং পড়াশোনার পাশাপাশি নেতৃত্বের গুণাবলী, প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রেখে কাজ করার ক্ষমতা, দেশের প্রতি আনুগত্য ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা একজন মানুষকে পরিপূর্ণ করে তোলে। তাই পাঠ্যক্রমের নৈপুণ্যের বাইরের উল্লিখিত বিষয়গুলোও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা বাঞ্ছনীয়।

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপদ্ধতি নিয়ে আলোচনায় যাবার আগে বহির্বিশ্বের দিকে একটু নজর বুলিয়ে নিই। উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়-ভিত্তিক ভর্তিপরীক্ষা দিতে হয় না, বরং স্ট্যান্ডার্ডাইজড টেস্টের মাধ্যমে সকল বিশ্ববিদ্যলয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করা যায়।

অনেক ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা আবেদন করারও প্রয়োজন হয় না। যেমন, অস্ট্রেলিয়ায় আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ে ভর্তির জন্য স্ট্যাট (STAT) নামক স্ট্যান্ডার্ডাইজড টেস্ট দিতে হয়। তেমনি যুক্তরাজ্যেও লেভেল ও বিষয়ভেদে (BMAT, GAMSAT, LNAT ইত্যাদি) বিভিন্ন স্ট্যান্ডার্ডাইজড টেস্ট দিতে হয়। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও শিক্ষার্থী বাছাইয়ের জন্য স্ট্যান্ডার্ডাইজড পরীক্ষার স্কোর ব্যবহার করে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে এখানকার ভর্তিপদ্ধতি সমন্ধে একটু বিস্তারিত আলোচনা করে, এর আলোকে বাংলাদেশের ভর্তিপদ্ধতির কীভাবে উন্নতি করা যায় সে আলোচনায় যাব।

যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা সমন্ধে যারা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন, এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ে পড়াশোনার জন্য উচ্চ মাধ্যমিক (যুক্তরাষ্ট্রে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির সমপর্যায়ের স্কুলকে হাই স্কুল বলা হয়) পর্যায়ের গ্রেডের পাশাপাশি স্যাট (SAT) অথবা এসিটি (ACT) টেস্টের স্কোর আবশ্যক। গ্রাজুয়েট পর্যায়ে ভর্তি হতে হলে স্নাতকের ট্র্যান্সক্রিপ্টের পাশাপাশি সাধারণত (বিজ্ঞান ও আর্টসের বিষয়ের জন্য) জিআরই (GRE), ব্যবসায় শিক্ষার জন্য জিম্যাট (GMAT), আইন শিক্ষার জন্য এলস্যাট (LSAT) এবং চিকিৎসাক্ষেত্রের জন্য এমক্যাট (MCAT) পরীক্ষার স্কোর আবশ্যক।

তবে যে কোনো পর্যায়ে ভর্তির জন্য শুধু গ্রেড এবং স্ট্যান্ডার্ডাইজড টেস্টের স্কোরই যথেষ্ট নয়, পাঠক্রমের বাইরে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা (extracurricular activities) এবং শিক্ষকদের অথবা কর্মরত আবেদনকারীদের ক্ষেত্রে তাদের সুপারভাইজারদের সুপারিশপত্র (letter of recommendation) এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত বিষয়ে পড়াশোনায় আগ্রহী হওয়ার কারণ নিয়ে আবেদনকারীর লেখা রচনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

নিয়মিত পাঠ্যক্রমের বহির্ভূত বিষয়ের উদাহরণ হিসেবে অনেক বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হতে পারে। স্পোর্টসে (ফুটবল, বাস্কেটবল ইত্যাদি) পারদর্শিতা, কমিউনিটি সার্ভিস (সামাজিক কাজে ফান্ড তোলা, নদীর তীর পরিষ্কার করা ইত্যাদি), স্কুল বা কলেজ পর্যায়ে কোনো ক্লাবের নেতৃত্ব দেওয়া, গবেষণামূলক অথবা যে কোনো ধরনের লেখা প্রকাশ করা– এসবই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও স্কলারশিপ প্রদানের জন্য বিবেচিত হয়।

আবেদন জমা দেওয়ার ডেডলাইন শেষ হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি-কর্মকর্তাগণ আবেদনগুলো প্রাক-বাছাই (Pre-Screen) করেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের প্রোগ্রামের লক্ষ্য, বৈচিত্র্যের প্রয়োজনীয়তা, পাঠ্যক্রমের কাঠিন্য (academic rigor), আবেদনকারীর সংখ্যা ইত্যাদি বিবেচনা করে কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার্থীদের একটি প্রোফাইল নির্ধারণ করে। যেমন, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ন্যূনতম একটি পর্যায়ের জিপিএ, একটি স্ট্যান্ডার্ডাইজড টেস্টের ন্যূনতম একটি স্কোর, গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের ক্ষেত্রে ন্যূনতম অভিজ্ঞতা ইত্যাদি থাকতে হবে। এই পর্যায়ে বাছাইকৃত প্রতিটি আবেদন নিয়ে অ্যাডমিশন বোর্ডে আলোচনা হয়। আবেদনকারীদের অনেক সময় একাধিক সাক্ষাৎকারেরও মুখোমুখি হতে হয়।

এবার দেখা যাক, বিশ্ববিদ্যালয়-ভিত্তিক ভর্তিপরীক্ষার তুলনায় স্ট্যান্ডার্ডাইজড টেস্টের কী কী সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, দেশের যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সমক্ষেত্রে পড়াশোনা করার জন্য প্রাসঙ্গিক স্ট্যান্ডার্ডাইজড টেস্টটি শুধু একবার দিয়েই শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করতে পারে। প্রয়োজনীয় টেস্টের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে অগ্রিম রেজিস্ট্রেশন সাপেক্ষে শিক্ষার্থীরা পছন্দমতো সময়ে, নিজেদের সুবিধামতো কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে পারে এবং একবারের চেষ্টায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেলে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে আবার ওই পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে।

এসব পরীক্ষায় পাস বা ফেল বলে কিছু নেই। তবে পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ বিশ্বব্যাপী ওই পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের প্রাপ্ত স্কোরের পরিসংখ্যান, যেমন গড়, মধ্যমা (average, median) ইত্যাদি প্রকাশ করে থাকে। ফলে একজন পরীক্ষার্থী তার স্কোরের তুলনামূলক অবস্থান বুঝতে পারে। অধিকন্তু আবেদনকারী তার কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের স্কোরের পরিসংখ্যান দেখে তার টার্গেট স্কোর নির্ধারণ করতে পারে। ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের অনুরোধে পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ আবেদনকারীদের নির্বাচিত বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দেয়। ফলে স্কোরের কপি সত্যায়িত করা বা স্কোর জালিয়াতি সংক্রান্ত ঝামেলাও নেই।

এবার আমাদের দেশের ভর্তিপদ্ধতির দিকে নজর দেওয়া যাক। আমাদের দেশের প্রচলিত ভর্তিপদ্ধতিতে শুধু অ্যাকাডেমিক দিকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। সাধারণত বোর্ড পরীক্ষার ফলাফল এবং ভর্তিপরীক্ষার ফলাফলের ওপর একটি সমন্বিত স্কোরের মাধ্যমে বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। পাঠ্যক্রমের বাইরের বিষয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বিবেচিত হয় বলে আমার জানা নেই। অর্থাৎ এই লেখার শুরুতে উল্লিখিত যেসব গুণাবলী একজন মানুষকে সফল হতে ভূমিকা রাখে, তার শুধুমাত্র একটি দিকেই বিচার করা হয়।

এবার চলমান প্রক্রিয়ার বিশদ কার্যপদ্ধতি আলোচনা করা যাক। দেশের প্রচলিত পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের (অথবা তাদের পক্ষে অন্য কাউকে) প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীরে উপস্থিত হয়ে ভর্তির আবেদন ফরম সংগ্রহ করতে হয়। প্রক্রিয়াটি আবার এত সহজ নয়। ফরম সংগ্রহ করতে হয় এক অফিস থেকে, ফি জমা দিতে হয় ব্যাংকে এবং পূরণ করা ফরম, ফি প্রদানের রশিদসহ জমা দিতে হয় অন্য এক অফিসে। শুধু আবেদনের প্রক্রিয়া শেষ হতেই চলে যায় কমপক্ষে দু'দিন (ক্ষেত্রবিশেষ কম বা বেশি হতে পারে)। আবেদন জমা দেওয়ার বিভিন্ন ধাপে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা যে কত কষ্টকর হতে পারে তা শুধু ভুক্তভোগীরাই ভালো জানেন।

আবেদন জমা দেওয়ার পরবর্তী ধাপ হচ্ছে ভর্তিপরীক্ষা দেওয়া। যার জন্য শিক্ষার্থীদের আবার সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে পরীক্ষা দিতে হয়ে। আবেদন জমা দেওয়া এবং ভর্তিপরীক্ষার মধ্যে সাধারণত বেশ কিছু দিন গ্যাপ থাকে। ফলে এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য একজন শিক্ষার্থীকে কয়েক দিনের ব্যবধানে বেশ কয়েকবার দেশের বিভিন্ন শহরে অবস্থিত একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়। এভাবে দৌড়াদৌড়ি করা একদিকে যেমন শারীরিক হয়রানি, তেমনি এতে প্রচুর অর্থও ব্যয় হয়।

এছাড়া অনেক সময় একই দিনে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষা সংঘটিত হওয়ার কারণে কিছু শিক্ষার্থী তাদের কাঙ্ক্ষিত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পরীক্ষাই দিতে পারে না। আর নির্ধারিত পরীক্ষার দিনে অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হতে না পারলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন সে বছরের জন্য সেখানেই শেষ।

উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, আমাদের দেশের ভর্তিপদ্ধতিতে মূলত দু'ধরনের ঘাটতি রয়েছে। প্রথমত, গুণগত ঘাটতি– দেশের প্রচলিত পদ্ধতি সার্বিকভাবে সেরা শিক্ষার্থী নির্বাচনের জন্য সহায়ক নয়, কারণ এখানে অ্যাকাডেমিক বিষয়ের বাইরের গুণাবলী প্রাধান্য পায় না। দ্বিতীয়ত, পদ্ধতিগত ঘাটতি– ভর্তিপরীক্ষার প্রস্তুতি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম সংগ্রহ, পূরণ, জমা প্রদান, ভর্তিপরীক্ষায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি প্রক্রিয়া শিক্ষার্থীদের জন্য মোটেই সুখপ্রদ নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষায় ভর্তিপদ্ধতির ক্ষেত্রে এই দুটি ঘাটতি কীভাবে এবং কতখানি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

প্রথমেই আসি ভর্তিপদ্ধতির গুণগত উন্নয়নের বিষয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বাছাই প্রক্রিয়ায় পাঠ্যক্রমের ওপর দক্ষতার বাইরে অন্যান্য গুণাবলী সংযোজন করাই এ ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ। নেতৃত্ব সংক্রান্ত গুণাবলী, খেলাধূলার ক্ষেত্রে নৈপুণ্য, সততা ও নিষ্ঠা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা জাতীয় গুণাবলী বিচার করা অত্যন্ত কঠিন (subjective)। যুক্তরাষ্ট্রের মতো শিক্ষক বা সুপারভাইজারের সুপারিশপত্র অথবা কমিউনিটি সার্ভিসের অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীর মানবীয় গুণাবলীর পরিমাপক হিসেবে ব্যবহার করা হবে খুবই অবাস্তব।

এমনিতেই আমাদের দেশে ভর্তি-বিষয়ক দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিয়ে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। তাই এখানকার বাছাই পদ্ধতি হওয়া উচিত প্রশ্নাতীত। তবে আমার ধারণা ভর্তিপরীক্ষার মধ্যে এমন একটি অংশ চালু করা যেতে পারে, যেটি হবে অনেকটা মনস্তাস্ত্বিক। প্রশ্ন এবং উত্তরের ধরন এমন হবে যার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী টিম-প্লেয়ার কিনা, নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম কিনা, সমাজের দায়িত্বশীল একজন নাগরিক কিনা এসব বিষয় যাচাই করা সম্ভব।

ধারণাটি নিশ্চয়ই ইনটুইটিভ নয়, তবে বর্তমানে এ ধরনের টেস্টের মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচনের উদাহরণ বাংলাদেশেও রয়েছে। এ রকম একটি ধারণা বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য নিশ্চয়ই বিশদ আলোচনার প্রয়োজন এবং বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে যথাযথ গবেষণা বা পরীক্ষামূলক প্রকল্প পরিচালনার পরে একে বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব।

এবার আসা যাক পদ্ধতিগত উন্নয়নের বিষয়ে। আমি বিশ্বাস করি অনেকেই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা আলাদা ভর্তিপরীক্ষার প্রচলিত পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের জন্য হয়রানিমূলক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জন্যও ভর্তিপরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ, উত্তরপত্রের মান নির্ধারণ এবং ফলাফল প্রকাশের এই লম্বা প্রশাসনিক প্রক্রিয়া কম ঝামেলার নয়।

শিক্ষকগণ তাদের গবেষণাকর্ম, শিক্ষাক্রমের উন্নয়ন ও শ্রেণিপাঠের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ রেখে ভর্তিপরীক্ষার প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকেন, যা মোটেই কাম্য নয়। তাই আলাদা আলাদা ভর্তিপরীক্ষার পরিবর্তে অতিসত্বর জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা প্রচলন করা জরুরি। এটি শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উভয়ের জন্যই সুবিধাজনক।

আমরা জানি এ বিষয়ে এরই মধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে এবং বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা পদ্ধতি চালু করার ব্যাপারে সরকারি পর্যায়ে ঘোষণাও এসেছে। তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সেই ঘোষণা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। ছোট (পাইলট) আকারে হলেও গত বছর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিলেন সকলের শ্রদ্ধেয় ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। যতদূর জানি এই উদ্যোগও সফলতার মুখ দেখেনি।

বাস্তবতা হচ্ছে, সমন্বিত ভর্তিপদ্ধতির প্রচলন এখন সময়ের দাবি। কারণ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান অনুষদের পাঠ্যক্রমের মধ্যে কিছু তফাত থাকলেও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পাঠ্যক্রম রপ্ত করতে শিক্ষার্থীদের কিন্তু একই ধরনের শিক্ষাগত ভিত্তি থাকা প্রয়োজন। একইভাবে ব্যবসা ক্ষেত্রে স্নাতক পর্যায়ে যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার জন্য একই ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়-ভিত্তিক আলাদা ভর্তিপরীক্ষার যৌক্তিকতা নেই বললেই চলে।

বস্তুত, সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষার উদাহরণ আমাদের দেশেই বিদ্যমান। বর্তমানে দেশের সকল পাবলিক মেডিকেল কলেজে একই পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রী বাছাই করা হয় এবং এই পদ্ধতির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও শোনা যায় না। চিকিৎসাবিদ্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা পদ্ধতিতে বছরের পর বছর সফলতার সঙ্গে শিক্ষার্থী বাছাই করা সম্ভব হলে ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যবসা শিক্ষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি কেন চালু করা যাবে না?

তাই বলব, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের হয়রানি বন্ধ করতে অবিলম্বে সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা উচিত। শুধু তাই নয়, একই বছরে একাধিকবার ভর্তিপরীক্ষা অফার করা দরকার যাতে দৈবিক বা অন্য কোনো কারণে একজন শিক্ষার্থী প্রথম ধাপে পরীক্ষা দিতে না পারলেও তার জন্য বিকল্প একটি সুযোগ থাকে। এ ক্ষেত্রে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বজায় রাখার জন্য, একই ধরনের প্রশ্নপত্রের বিভিন্ন সেট করে সেগুলো বিভিন্ন পরীক্ষার দিনে ব্যবহার করা যেতে পারে।

সে ক্ষেত্রে একই প্রার্থী যাতে একাধিকবার পরীক্ষা দিতে না পারে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার রেকর্ড যাচাইয়ের মাধ্যমে। এই পরিবর্তনগুলো করতে পারলে ভর্তিপদ্ধতি শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক বন্ধুসুলভ হবে বলেই আমার বিশ্বাস।

পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান উন্নত করে, গ্র্যাজুয়েটদের বিশ্বঅর্থনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উপযোগী করতে হলে ভর্তিপদ্ধতির গুণগত ও প্রক্রিয়াগত উন্নয়ন জরুরি। ভর্তিপদ্ধতির গুণগত পরিবর্তন হতে হবে স্ট্র্যাটিজিক, যা যথাযথ বিচার-বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যাবে। এটি সময়-সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে প্রক্রিয়াগত পরিবর্তন হচ্ছে কৌশলগত (tactical)। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলে প্রস্তাবিত সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা পদ্ধতি খুব কম সময়েই বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টরা ভর্তিপরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তনের আশু প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এর উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন, এটি সকলের প্রত্যাশা।

এইচ এম মহসীন: স্ট্র্যাটিজি প্রফেশনাল।