মোদিতে আমোদিত বাংলাদেশ

আমানুল্লাহ কবীর
Published : 6 July 2014, 09:30 AM
Updated : 6 July 2014, 09:30 AM

শুভেচ্ছা সফরে সুষমা স্বরাজ দিল্লি থেকে ভালোবাসা এনে ঢাকায় দিয়ে গেলেন, নিয়েও গেলেন। তিস্তার পানি নিয়ে আসেননি কিংবা সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট বার্তা দিতে পারেননি, সে কারণে তাঁর জন্য ঢাকায় ভালোবাসার কমতি ছিল না। বরং সব মহল থেকে আদর-আপ্যায়ন একটু বেশিই পেয়েছেন, নতুন আত্মীয়তা স্থাপন করতে যা করা হয়, তা-ই। যে ভালোবাসা দিয়ে গেলেন এবং নিয়ে গেলেন, দেশে ফিরে তাই যাচাই-বাছাই করবেন।

প্রথম দেখাশোনায় লেনদেন ছিল না বটে, তবে আত্মীয়তার বন্ধন নির্ধারিত হবে পরিচয়পর্বের ভিত্তিতেই। দরকারটা যেমন দিল্লির নতুন মোদি সরকারের, তেমনি শেখ হাসিনা সরকারেরও। কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সম্পর্কটা জানা থাকলেও বিজেপি সরকার তা আবার ঝালাই করতে চায়। নানা কারণেই দিল্লির কাছে প্রতিবেশি বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ; নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনী প্রচারণায় বাংলাদেশি 'অনুপ্রবেশকারীদের' সম্পর্কে যা-ই বলে থাকুন না কেন, তাতে কিছু যায়-আসে না– অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ঢাকা সফর করে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তা-ই জানান দিয়ে গেলেন।

ভারতের সাম্প্রতিক নির্বাচন কেবল বাংলাদেশের জন্যই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার সবকটি দেশের জন্যই ছিল আগ্রহ-উৎকণ্ঠার বিষয়। গভীর ঔৎসুক্য নিয়ে সবাই পর্যবেক্ষণ করছিল দিল্লির মসনদে এবার কী পরিবর্তন হয়। পরিবর্তন হবে, এ ব্যাপারে সবাই মোটামুটি নিশ্চিত হলেও কারা ক্ষমতা দখল করবে, তা অনেকের কাছেই ছিল অস্পষ্ট। বিশেষত রাজ্যভিত্তিক রাজনীতি জোরদার হওয়ায় ভারতের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলেরও অনেকেই ধারণা করেছিল, কেন্দ্রে অতীতের মতো কোয়ালিশন সরকার হতে পারে।

এর আরেকটা বড় কারণ ছিল, নরেন্দ্র মোদি জাতীয় রাজনীতিতে কখনও-ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন না কিংবা জাতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর পরিচিতিও ছিল না। তিনি গুজরাটের মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং গুজরাট-কেন্দ্রিক রাজনীতির মধ্যেই তাঁর সাফল্য সীমাবদ্ধ ছিল। কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিক হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ধ্বজাধারী ভারতে তাঁকে গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর্দার অন্তরালের নায়ক বলেই মনে করা হত। ওই দাঙ্গায় এক হাজার ব্যক্তি নিহত হয়েছিল, যাদের অধিকাংশই ছিল মুসলমান।

মোদির রাজনৈতিক দীক্ষা হিন্দুত্ববাদী আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের কাছে। সেখানে তৃণমূল থেকে তিনি উঠে এসেছেন বিজেপির নেতা হিসেবে। রেল স্টেশনে চা বিক্রেতা থেকে তিনি হয়েছিলেন গুজরাটের মূখ্যমন্ত্রী। ২০০২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসে কলংকময় অধ্যায়, যা গোটা বিশ্বেই নিন্দিত হয়েছে। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। কয়েক মাস আগে দাঙ্গার দায় থেকে আদালতের রায়ে মুক্তি পেলে তিনি পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক হিসেবে আবির্ভূত হন। যুক্তরাষ্ট্রও তাঁর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।

তবে গুজরাটে তাঁর শাসনামলে তিনি ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। গুজরাটে তাঁর সুশাসন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নই ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর জন্য দুয়ার খুলে দেয়। মোদির ভাগ্য খুলে যায় মনমোহন সরকারের ব্যর্থতার কারণে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে অর্থনীতিতে যে ধস নামে তার প্রেক্ষাপটে গুজরাটে মোদির উন্নয়ন-সাফল্য ভারতের জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

ভারতের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে কর্পোরেট হাউসগুলোর প্রভাব অনস্বীকার্য। ব্যবসা বা বিনিয়োগবান্ধব বলে মোদিকে তারা প্রমোট করে। বিশ্বে সবচেয়ে ব্যয়বহুল নির্বাচন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ব্যয়ের দিক থেকে তার পরেই স্থান দখল করেছে এবারের ভারতের নির্বাচন। নির্বাচনী কৌশল ও প্রচারণায় কংগ্রেস বিজেপির সমকক্ষ হতে পারেনি, বিশেষত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে বিজেপি ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। শত বছরের গতানুগতিক রাজনীতিতে অভ্যস্ত ক্ষমতা-ক্লান্ত কংগ্রেস বিজেপির নির্বাচনী কৌশলের কাছে হয়ে পড়েছিল কোণঠাসা।

ধর্মে-বর্ণে বিচিত্র বিশাল ভারতের নির্বাচনযজ্ঞে রক্তপাত না হলেও ভোট বেচাকেনা বন্ধ ছিল না। অর্থ, উপঢৌকন, এমনকি মদের বোতলও দেওয়া হয়েছে ভোটারদের। মোদির নির্বাচনী অভিযানের জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকত দুটি হেলিকপ্টার। তিনি চষে বেড়িয়েছেন ভারতের মরু অঞ্চল থেকে হিমাচল পর্যন্ত। তাঁর আক্রমণঢঙ্গী নির্বাচনী অভিযানের মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তা কংগ্রেস চেষ্টা করেছিল ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু, বিশেষত মুসলমানদের ভোট জয়ের। কিন্তু 'মোদি হাওয়ায়' তা-ও উড়ে গেছে, মুসলমানদের অনেককেই দেখা গেছে সে হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিতে।

নির্বাচনে কংগ্রেসের আশাতীত ভরাডুবিতে চমকে ওঠে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এখন আশংকা করছেন, স্বাধীনতালগ্ন থেকেই ভারতের ভাগ্যনিয়ন্ত্রক এই দলটি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা। মোদির একচেটিয়া বিজয় কেবল ভারতবাসীদের কংগ্রেসমোহকেই বিনাশ করেনি, ঐতিহ্যবাহী নেহেরু-গান্ধী পরিবারকেও অস্তিত্ব সংকটে ফেলেছে। সম্ভবত এই নির্বাচন ভারতে পারিবারিক উত্তরাধিকারের রাজনীতিতেও ইতি টেনে দিল।

আর ওই সঙ্গে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিও আর অক্ষত থাকল না। হিন্দুত্ববাদের বিজয়ে প্রমাণিত হয়, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি গত পঁয়ষট্টি বছরে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মনে স্থায়ী আসন লাভ করতে পারেনি। মোদি দ্বিতীয় প্রজন্মের রাজনীতিক। তাঁর উত্থান ভারতের প্রথম প্রজন্মের রাজনীতিকদের বস্তুত নির্বাসনেই পাঠাল।

নরেন্দ্র মোদি একজন উচ্চাভিলাষী রাজনীতিবিদ। তাঁর এই উচ্চাভিলাষের প্রতিফলন নিশ্চয়ই তাঁর সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতেও ঘটবে। তিনি তাঁর প্রথম সফর ভূটানে গিয়ে বলেছেন, শক্তিশালী ভারত প্রতিবেশিদের জন্যও মঙ্গল। ভারত ধনে-জনে-আকারে দক্ষিণ এশিয়া বা সার্ক দেশগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ। কেবল তাই নয়, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে ভারত বিশ্বের অন্যতম উঠতি শক্তি। এদিক থেকে আরেক উঠতি শক্তি প্রতিবেশি চীন তার প্রতিদ্বন্দ্বী। ভারতের মতোই তার প্রতিবেশি পাকিস্তান ও চীন পারমাণবিক দেশ। তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে, এমন কথা বলা যাবে না।

তবে মোদি তাঁর পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে সার্কভুক্ত দেশগুলোকে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানেই। শপথ অনুষ্ঠানে প্রতিবেশি দেশগুলোর সরকার প্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রচলিত রীতি ভেঙে তিনি চমক সৃষ্টি করেছিলেন। যে পাকিস্তান ভারতের চিরশত্রু, তার প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফও হাজির হয়েছিলেন সে অনুষ্ঠানে। মোদি তাঁর সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। নওয়াজ শরীফ অনেকটা আশ্বস্ত হয়েই দেশে ফিরেছেন, যদিও তাঁর দেশের সংঘাতপ্রিয় সামরিক কর্মকর্তারা তা সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি।

ওই সময় জাপানে পূর্বনির্ধারিত সফরের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি যেতে পারেননি। এজন্য তাঁর মনে অস্বস্তিও ছিল। কংগ্রেসের মিত্র বলে পরিচিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি মোদি সরকারের মনোভাব কী হবে, তা নিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদ ও পর্যবেক্ষকরা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে মনগড়া অনেক মন্তব্যই করেছেন। বিজেপির বিজয়কে অনেকেই মনে করেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য অশনিসংকেত। বিশেষত বিএনপির একটি মহল উল্লসিত হয়ে শেখ হাসিনা সরকারের মেয়াদের দিনগণনা শুরু করেছে বলে শোনা যায়।

তাদের বলে দেওয়াই ভালো যে, দিল্লি বহুত দূর অস্ত। দিল্লির তখতে যারাই আসীন হোন না কেন, তাদের কাছে ভারতের স্বার্থই বড়। কৌশলের ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু স্বার্থ হাসিলের বেলায় তারা অভিন্ন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে দিল্লির প্রতি এক নীতি, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আরেক নীতি, এই বিচারবুদ্ধি দিয়ে ভারতের রাজনীতিবিদদের যাচাই করলে চলবে না। সুষমা স্বরাজ ঢাকায় বিভিন্নজনের সঙ্গে আলোচনায় তা স্পষ্টই বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন।

দিল্লিতে ক্ষমতার পালাবদলে দুই নিকট প্রতিবেশির সম্পর্কে নড়চড় হবে না বরং তা জোরদারই হবে, একথা বলে তিনি আশ্বস্ত করেছেন শেখ হাসিনাকে। হাসিনা এখন স্বস্তিতে আছেন। সুষমা স্বরাজ প্রথাগত কূটনৈতিক আচার ভঙ্গ করে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও বৈঠক করেন, যদিও এ বৈঠকে আপত্তি ছিল সরকারের। ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের সমর্থনের বিষয়টি খালেদা জিয়া আলোচনায় তুললে সুষমা স্বরাজ বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন বিষয় এদেশের জনগণই মেটাবে, ভারত নয়।

ক্ষমতায় যে দলই আসুক, তার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে গুরুত্ব দেবে দিল্লি। সুষমা খালেদার নালিশে নাকি বিরক্ত হয়েছেন। তবে খালেদা জিয়া পরে ভারতের একটি ইংরেজি দৈনিকে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সুষমার সঙ্গে আলোচনা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশেই হয়েছে। নিজের দেশের রাজনীতবিদদের বিরুদ্ধে নালিশ সুষমার জাত্যাভিমানে লেগেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে কংগ্রেসের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে, একথার জবাবে তিনি বলেছেন, এটা আপনাদের ধারণা। আমাদের সরকার বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করবে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে আমরা নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই।

ঢাকায় সুষমার সঙ্গে বৈঠকে শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া কেউ নির্বাচনের সময় নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দলের সুব্রামনিয়াম স্বামী 'অবৈধ অভিবাসন' সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নিয়ে কোনো কথা বলেননি। পশ্চিমবঙ্গে অবৈধ অভিবাসী অর্থাৎ বাংলাদেশিদের উদ্দেশ্য করে মোদি বলেছিলেন, প্রস্তত থাকো, নির্বাচনের পর পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে হবে। অর্থাৎ 'পুশব্যাকের' ইঙ্গিত করেছিলেন।

সুব্রামনিয়াম স্বামী আসামে তাঁর বক্তৃতায় 'অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের' জন্য বাংলাদেশের এক পঞ্চমাংশ ভুখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার দাবি করেছিলেন। তাঁর এই বক্তব্যের পর আসামে সম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ৪১ জন বাঙালি মুসলমান নিহত হন। এ নিয়ে ভারত বা বাংলাদেশে তেমন উচ্চবাচ্য হয়নি।

ঢাকার একটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে 'অবৈধ অভিবাসন' সম্পর্কে তাঁর সরকারের নীতি জানতে চাইলে সুষমা সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, সমস্যাটি স্পর্শকাতর। সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেই আমরা সতর্কতার সঙ্গে এই সমস্যা মোকাবিলা করতে চাই।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, ইতোপূর্বে 'অবৈধ অভিবাসীদের' পুশব্যাকের ঘটনা ঘটেছিল গত বিজেপি সরকারের সময়ই। সীমান্তে প্রায় প্রতিদিনই বিএসএফ-এর গুলিতে বাংলাদেশিরা আহত-নিহত হচ্ছেন। বিএসএফ-এর একজন সাবেক কর্মকর্তা তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় ওই দেশের নিরাপত্তাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বসতি স্থাপনের বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

তাঁর এই বক্তব্য কতটুকু সত্য, সে ব্যাপারে আমাদের সরকার কিছু জানায়নি। তবে বিএসএফ-এর ওই সাবেক কর্মকর্তা দিল্লি কর্তৃপক্ষকে সীমান্তে অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। দিল্লি কর্তৃপক্ষ তা করবে কিনা, তা এখন জানা না গেলেও এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, কথিত অবৈধ অভিবাসী ঠেকানোর জন্য বিএসএফ আরও কঠিন অবস্থান গ্রহণ করবে।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক একতরফা বললে অত্যুক্তি হবে না। তবে সুষমা স্বরাজ তা মানতে রাজি নন। সাক্ষাৎকারপ্রার্থী সাংবাদিকদের কাছে তাঁর জবাবে পাল্টা ভারতের বিভিন্ন পদক্ষেপের লম্বা ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন। তাঁর বক্তব্য থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের যে নীতি গ্রহণ করেছেন, তার প্রতি বিজেপি সরকারের পুরো সমর্থন রয়েছে। এটা এককভাবে কংগ্রেস বা বিজেপির নীতি নয়, ক্ষুদ্র প্রতিবেশিদের প্রতি বৃহৎ প্রতিবেশিদের এই 'মাৎস্যন্যায়' তাদের চিরাচরিত নীতি।

ভারতের জন্য সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ ভূখণ্ড হচ্ছে বিদ্রোহ-উপদ্রুত উত্তর-পূর্বাঞ্চল। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার অসুবিধা, যে কারণে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারতের অখণ্ডতার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশ নিজের সার্বভৌম বুকের উপর দিয়ে ভারতকে যোগাযোগ সুবিধা প্রদান করে দিল্লিকে উদ্বেগমুক্ত করেছে। বিতর্কিত ট্রানজিট সুবিধা প্রদান করে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে কোনো আর্থিক সুবিধা পায়নি। কেবল তাই নয়, বাংলাদেশে গোপনে আশ্রয়গ্রহণকারী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে কোনো চুক্তি বা প্রটোকল ছাড়াই। এখনও বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নবাদীদের আরও ২৪ টি ঘাঁটি রয়েছে বলে ভারতের কর্তৃপক্ষ দাবি করছে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মিয়ানমারেও আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হস্তান্তরের ব্যাপারে ভারত মিয়ানমারের কাছে থেকে বাংলাদেশের মতো সহযোগিতা পায়নি। বাংলাদেশ থেকে ভারত এসব সুবিধা আদায় করেছে নানা প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে। সেসব প্রতিশ্রুতির ছিটেফোঁটা বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ভোগ করলেও প্রতিশ্রুতিগুলো কবে নাগাদ বাস্তবায়িত হবে, তা অনিশ্চিত।

দৃশ্যমান প্রাপ্তির মধ্যে রয়েছে ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ও প্রতিশ্রুত এক বিলিয়ন ডলারের আংশিক ছাড়। অপ্রাপ্তির তালিকা অনেক দীর্ঘ। এসবের মধ্যে তিস্তার পানির হিস্যা ও দীর্ঘ সময় অপেক্ষমান সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন ছাড়াও রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্যের জন্য ভারতের ভূখণ্ড দিয়ে ভুটান ও নেপালকে ট্রানজিট প্রদান। সমুদ্র-সুবিধাবঞ্চিত ভুটান ও নেপাল ট্রানজিট পেলে আমদানি-রপ্তানির জন্য চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারবে, যা বাংলাদেশের জন্য লাভজনক।

ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে ট্রানজিট সুবিধা নিলেও প্রতিশ্রুত ট্রানজিট সুবিধা এখনও ভূটান-নেপালকে দেয়নি। যে ভুটান-নেপাল-বাংলাদেশ সড়ক যোগাযোগের কথা এখন বলা হচ্ছে, তার বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

ভারত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কাগজে-কলমে ছাড় দিলেও বাস্তবে নানা আইনগত বাধার কারণে তা আটকে যাচ্ছে, যে কারণে বাণিজ্য-ঘাটতি আকাশচুম্বীই রয়ে গেছে। বরং মোদি সরকার এখন উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার নামে বাংলাদেশের উপর নতুন সুবিধা প্রদানের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে। আর তা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল সড়ক ও রেল যোগাযোগ। ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে স্থায়ী যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের জন্যই দ্রুত এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। এর ফলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে ট্রান্সশিপমেন্টের দাবিটি আর কখনও উঠতে পারবে না।

সুতরাং যে উচ্চতাতেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে যাওয়া হোক না কেন, তা সমমর্যাদা পর্যায়ে হবে কিনা কিংবা তাতে বাংলাদেশের বঞ্চনার অবসান হবে কিনা, তা প্রশ্ন আকারেই থেকে যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশ সরকার দুর্বলতার কারণে ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তা কাজে লাগিয়ে দরকষাকষি করতে ব্যর্থ হয়েছে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

পেশায় আইনজীবী সুষমা স্বরাজ ভারতের একজন ঝানু রাজনীতিবিদ। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কেন্দ্রে ও রাজ্যে রাজনীতি করেছেন। সাতাশ বছর বয়সেই তিনি রাজ্য সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর বিজেপি সরকারে তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। এছাড়া দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও নির্বাচনের আগে লোকসভায় বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রথম একক সফরে এসেছিলেন ঢাকায়। পূর্বসূরীদের কুটনৈতিক কৌশল ও ভাষা তাঁর অজানা নয়। সরাসরি মুখ দিয়ে উচ্চারণ না করলেও দেহের ভাষায় তিনি বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন, দিল্লির পরিক্ষীত মিত্র আওয়ামী লীগই। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে কাজ করেই দুই দেশের সম্পর্ককে তাঁর সরকার নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।

রাজনীতিবিদ হিসেবে নরেন্দ্র মোদি উচ্চাভিলাষী এবং নির্বাচনী প্রচারণার সময় ভারতের জনগণকেও উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব বলয় সুসংহত করে ভারতকে যেমন অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিধর দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবেন, তেমনি নিজেকেও এ অঞ্চলের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস চালাবেন।

তাঁর এ প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ বা ভুটান-নেপালকে নিয়ে মাথাব্যথা নেই, মাথাব্যথা প্রধানত পাকিস্তান ও চীনকে নিয়ে। উভয় দেশের সঙ্গেই ভারতের সীমান্ত-বিরোধ রয়েছে। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান ও চীনের যুদ্ধও হয়েছে। মনমোহন সরকারের সময় চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের উন্নতি হলেও পাকিস্তানের সঙ্গে বৈরিতা কমেনি। চীন আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি নিজেকে পরাশক্তি হিসেবে স্বপ্ন দেখছে। ভারতের সেই সম্ভাবনা না থাকলেও ভারত বিশ্বের অন্যতম প্রধান শক্তিধর দেশ হিসেবে তাদের পাশেই থাকতে চায়।

তাই চীন ও ভারতকে পরস্পরের প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য তারা সংঘাতের পথ এড়িয়ে সম্প্রীতি স্থাপনের চেষ্টা করবে, অনেক পর্যবেক্ষকের মতে এটাই স্বাভাবিক। ইতোমধ্যে তার আলামতও লক্ষ্য করা গেছে। তছাড়া বেয়াড়া প্রতিবেশি পাকিস্তানকে সামাল দেওয়ার জন্যও চীনকে ভারতের দরকার।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় থেকে ভারত বের হয়ে এসে চীনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে কিনা, সে সন্দেহ এখনও দূর হয়নি। গত দিল্লি সরকারের আমলের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। তা মেরামত করার জন্য মোদি আগামী সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে বেঠক করতে ওয়াশিংটন যাচ্ছেন। ভারতে পশ্চিমা পুঁজি আকৃষ্ট করাই তাঁর এ সফরের প্রধান লক্ষ্য।

ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিন পরই মোদি সরকার প্রতিরক্ষার কয়েকটি খাত বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পাশ্চাত্যের বিনিয়োগকারীরা এরই মধ্যে হুড়োহুড়ি করে দিল্লি আসছে। সর্বাগ্রে রাশিয়ার মন্ত্রী তাঁর দলবল নিয়ে দিল্লি ঘুরে গেছেন। প্রতিরক্ষার কয়েকটি খাত উন্মুক্ত করে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিজের দেশের প্রয়োজন মেটানো ছাড়াও বিদেশে অস্ত্র রপ্তানি করা।

মোদির এই উদ্যোগ পাকিস্তান ও চীন কতটা সুনজরে দেখবে, তা অবশ্য দেখার বিষয়। ভারত ও পাকিস্তানের অস্ত্র প্রতিযোগিতা এর ফলে নতুন মাত্রা পেতে পারে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে আফগানিস্তানেও। দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা পার্টনার ভারত। এ বছর আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য প্রত্যাহার করে নিলে আফগানিস্তানের দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে যেতে পারে ভারতকে। ভারত ইতোমধ্যেই আফগানিস্তানে তৎপর, বিশেষত উন্নয়নকাজের মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগান জনগণের মন জয়ের চেষ্টা করছে।

অপরদিকে আফগানিস্তানে প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তান পুরাতন কৌশলে সশস্ত্র তালেবানসহ অন্যান্য উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোকেই সমর্থন ও সহযোগিতা করে যাচ্ছে। পাকিস্তান তার নিজের নিরাপত্তার কারণেই আফগানিস্তানে ভারতের কর্তৃত্ব মেনে নেবে না, তার ভৌগলিক অবস্থান থেকে তা স্পষ্ট।

অভ্যন্তরীনভাবে, বিজেপির গায়ে যে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ আছে, তা মুছে ফেলে বহু ধর্ম-বর্ণের দেশে মোদি সরকারকে ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করতে হবে। বিশেষত ভারতীর মোট জনসংখ্যার পনেরো শতাংশ মানুষ যারা মুসলমান, তারা এখনও মোদি সরকারের উপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছে।

নির্বাচনে বিজেপি বিপুল বিজয় অর্জন করলেও ভোট পেয়েছে মাত্র ৩১ শতাংশ। বাকি ভোট ভাগাভাগি হয়েছে কংগ্রেস ও রাজ্যগুলোর আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে। কংগ্রেসের ভরাডুবি হলেও ভারতের রাজনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা করবে এসব আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোই। এটাই ভারতের রাজনীতি ও গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য, যার ফলে কেন্দ্রে যত শক্তিশালী সরকারই ক্ষমতার আসীন থাক না কেন, তার পক্ষে স্বেচ্ছাচারী হওয়া বা প্রচলিত রাষ্ট্রনীতির খোলনলচে বদলানোর সুযোগ থাকে না। তাছাড়া ভারতের গণতান্ত্রিক ইনস্টিটিউশনগুলো শক্তিশালী হওয়ায় তা গণতন্ত্র সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।

ভারতের পার্লামেন্টে বিরোধী দল না থাকলেও বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের মতো মোদি সরকার 'মোদি হাওয়ায়' পাল তুলে নির্বিঘ্নে ভেসে বেড়াবে, তা আশা করা যায় না।