সমবায় হোক টেকসই উন্নয়নের রূপকার

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 5 July 2014, 05:18 AM
Updated : 5 July 2014, 05:18 AM

আন্তর্জাতিক কো-অপারেটিভ অ্যালায়েন্সের ২০১৪ সালের ঘোষণা হচ্ছে, সমবায় প্রতিষ্ঠানসমূহ টেকসই উন্নয়ন অর্জনে সক্ষম। টেকসই উন্নয়ন বলতে কী বুঝায়? ১৯৮৭ সালে টেকসই উন্নয়নের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয় তাতে উল্লেখ করা হয়, "ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিজস্ব চাহিদা পূরণের দক্ষতায় আপোষ না করে যে উন্নয়ন বর্তমানের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম তা-ই হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন।"

ইংরেজিতে বলা হয়েছে,

Development that meets the needs of the present without compromising the ability of future generations to meet their own needs.

ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে ২০১২ সালের জুন মাসে ১৯২ দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে রিও+২০ ঘোষণা গৃহীত হয়। ১৯৯২ সালে এখানেই ধরিত্রী সম্মেলন (Earth Summit) হয়েছিল এবং তার বিশ বছর পর পুনরায় এমন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে এর নাম রিও+২০ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। যে দলিলে এ ঘোষণা আসে তাতে বলা হয়, "আমরা কেমন ভবিষ্যৎ চাই" (The Future We Want)। বাস্তবে একটি তালিকা প্রণয়ন করা হয় যাতে বলা হয় টেকসই অর্থনীতি এবং দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে প্রত্যেক দেশ সবুজ অর্থনীতি অর্জন করবে এবং এ লক্ষ্যে তাদের জাতীয় নীতিমালা ও প্রাধিকার বিবেচনা করবে।

তবে তিনটি মৌলিক বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে, তা হচ্ছে অর্থনেতিক, সামাজিক এবং পরিবেশ সংরক্ষণ। জাতিসংঘের অধিবেশনে রিও+২০ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ৩০ সদস্যের ওপেন ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয় যারা (Sustainable Development Goals –Post 2015) এর বিভিন্ন বিষয় ও প্রাধিকারসমূহ চিহ্নিত করেছে।

একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য হিসেবে প্রাথমিকভাবে প্রায় ১২ টি এজেন্ডা চিহ্নিত করেছে। লক্ষ্যগুলো হল–

(১) দারিদ্র বিমোচন, (২) মহিলাদের ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গ-সমতা, (৩) গুণগত শিক্ষা এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা, (৪) স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ( ৫) খাদ্য-নিরাপত্তা ও উত্তম পুষ্টি, ( ৬) সর্বজনীন পানি প্রাপ্তি ও পরিচ্ছন্নতার সুযোগ, (৭) স্থিতিশীল বিদ্যুৎপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা, (৮) কর্মের সুযোগ, জীবিকার নিশ্চয়তা এবং সমদর্শী উন্নয়ন, (৯) প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনা, (১০) সুশাসন এবং দক্ষ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, (১১) স্থিতিশীল এবং শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা, (১২) বিশ্বজনীন ভালো পরিবেশ ও দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক উন্নয়ন ।

গণমুখী অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, দারিদ্র্য বিমোচন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশের বিপর্যয় প্রতিরোধ এবং খাদ্য-নিরাপত্তার বলয় সৃষ্টিতে অন্যতম ও উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হচ্ছে সমবায়ী উদ্যোগ। তাই সমবায়ী চেতনায় দিতে হবে নতুন উদ্দীপনা, সকল সহযোগিতা, আইন ও বিধিমালা সহজ করে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ। যেমনটি লক্ষ্য করা যায় জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড অথবা অষ্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত বিশ্বে। এ সকল দেশে সমবায় অঙ্গনে বৃহৎ পুঁজির অনুপ্রবেশের ফলে সমবায় সমিতিসমূহ অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে এবং বিশ্ববাজারে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ সমবায়ের মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করে। বিশ্বের ৩০০ টি সমবায় প্রতিষ্ঠানের সম্পদের পরিমাণ ৩০-৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। আন্তর্জাতিক সমবায় মৈত্রীর হিসাব অনুসারে, কানাডা, জাপান ও নরওয়েতে প্রতি ৩ জনে ১ সমবায়ী। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে প্রতি ৪ জনে একজন সরাসরি সমবায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। গণচীনে ১৮০ মিলিয়ন, ভারতে ২৩৬ মিলিয়ন, মালয়েশিয়ায় ৫.৪ মিলিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৯.৮ মিলিয়ান জনগণ সমবায়ের সদস্য। জাপানে কৃষিকাজে নিয়োজিতদের ৯০ শতাংশ সমবায়ী।

বেলজিয়ামে সমবায়ের মালিকানায় পরিচালিত ঔষধ শিল্প বাজারে ১৯.৫% শেয়ার অধিকার করে আছে। ব্রাজিলে সমবায় সমিতিসমূহ কৃষিতে ৪০% এবং কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতে ৬% অবদান রাখছে। কানাডার সমবায় সমিতিসমূহ বিশ্বের ৩৫% ম্যাপেল সুপার উৎপাদন করে। কেনিয়ায় ৪৫% দেশজ উৎপাদন এবং ৩১% জাতীয় সঞ্চয় সমবায় সমিতিসমূহ থেকে আসে। তেমনিভাবে কোরিয়ার প্রায় ৯০% খামার-চাষি কৃষি সমবায়ের সদস্য এবং প্রায় ৭১% মাছের বাজার মৎস্য খাতে সমবায়ীরা নিয়ন্ত্রণ করে। ডেনমার্ক ও নরওয়ের ৯৫% দুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করে সমবায়ীরা।

বাংলাদেশে প্রধানত ২৯ ধরনের সমবায় সমিতি আছে যার মধ্যে কৃষি, মৎস্য ও পশুপালন, গৃহায়ণ, পরিবহন, দুগ্ধ উৎপাদন, ঋণ ও সঞ্চয় এবং ক্ষুদ্রঋণদান কর্মসূচি পরিচালনা হচ্ছে উল্লেখযোগ্য। সমবায় সমিতির সংখ্যা প্রায় ১,৮৬,১৯৯ যার সদস্য সংখ্যা প্রায় ৯৩ লক্ষ ৫০ হাজার।

এর মধ্যে জাতীয় সমবায় সমিতি ২১ টি, কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি ৪৫৯ টি এবং অবশিষ্ট হচ্ছে প্রাথমিক সমবায় সমিতি। এ সকল সমিতির মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন ও বিতরণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।

সমবায় সমিতিসমূহের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ মহিলা সমবায় সমিতি। সমবায়ে মহিলাদের অবদান উল্লেখযোগ্য, তাদের বিচরণ অবারিত ও দৃশ্যমান, যেমন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড সমর্থিত সমিতিতে, তেমনিভাবে সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধিত সমিতির তালিকায়।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি হচ্ছে "দেশের মাটি থেকে উত্থিত উন্নয়ন দর্শন" (Home grown development philosophy)। এ আদর্শ অনুসরণ করে অগ্রগতির পথে ধাবিত হচ্ছে দেশ। দেশের সামনে লক্ষ্য হচ্ছে সবার জন্য সমান অর্থনৈতিক সুযোগ, সামাজিক নিরাপত্তা বিধান, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, কর্মসম্পাদনে স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা ও সকল স্তরে সুরক্ষা বিধান।

মানবসম্পদ উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে এবং সকল স্তরের ও ধর্মের অনুসারী জনগণের মানবাধিকার সুরক্ষার প্রয়োজনে উৎপাদনশীল বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয় বাড়াতে হবে এবং সকল জনগোষ্ঠীর মাঝে তার সুফল পৌঁছাতে হবে।

এবারের বাজেটে (২০১৪-২০১৫) প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭.৩ শতাংশ এবং ইতোমধ্যে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১১৯০ ডলার। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে হয়েছে ইউএস ডলার ২১ বিলিয়ন ( ১৬.৬.২০১৪ ) যা সর্বোচ্চ রেকর্ড। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে অনেক। বাংলাদেশ বিশ্বায়নের রথযাত্রার সহযাত্রী। অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, "সমৃদ্ধির নতুন অধ্যায়ে বাংলাদেশ: উন্নয়নের ধারাবাহিকতা।"

এ কথা সত্যি যে, সমবায় আন্দোলন আশানুরূপ অগ্রগতি লাভ করেনি এবং সমবায়ে সুশাসন দৃশ্যমানভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সমবায় সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন, নিরীক্ষা, বিরোধ নিষ্পত্তি, অবসায়ন, উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ, অভ্যন্তরীন অনিয়ম ও দলীয়করণ এবং অসমবায়ীদের অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ করে আদর্শভিত্তিক সমবায় প্রতিষ্ঠান গঠনে সমবায়ের কর্মকর্তারা দক্ষতা প্রর্দশন করতে পারেননি। জনগণ সমবায়কে একটি অর্থবহ খাত হিসেবে মনে করে না এবং এ খাতে বিনিয়োগের আর্কষণ বোধ করে না।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয় যে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ১৫ এপ্রিল, ২০১৪ 'সমবায় সমিতির ব্যবস্থাপনা' শীর্ষক একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। এ প্রতিবেদনে সমবায় সমিতির ব্যবস্থাপনায় তদারকি প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি, অর্থের বিনিময়ে নিবন্ধন প্রদান, সমবায় কর্মকর্তার নিয়মবর্হিভূত অর্থ আদায়, সমিতির বিরোধ কেন্দ্র করে সুবিধা গ্রহণ, রাজনৈতিক ও ক্ষমতাশীলদের হস্তক্ষেপ, উচ্চহারে সুদ আদায়, আয়কর ফাঁকি এবং কালো টাকার বিনিয়োগ ইত্যাদি অসংখ্য অভিযোগ উথাপিত হয়েছে। তবে অনেকগুলি সুপারিশ তারা রেখেছে যা পরীক্ষার দাবি রাখে।

টেকসই অর্থনীতির ভিত্তি ছাড়া উন্নয়ন স্থায়ী হয় না। টেকসই উন্নয়ন সুনিশ্চিত করতে হলে 'দেশজ সম্পদের কার্যকর ব্যবস্থাপনা'-য় সর্ব্বোচ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এসব সম্পদ হচ্ছে মানবসম্পদ, ভৌত সম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ। জনসংখ্যাকে রূপান্তরিত করতে হবে জনসম্পদে যেখানে বিনিয়োগ করতে হবে শিক্ষায়, জনস্বাস্থ্যে, জনগণের দক্ষতা বৃদ্ধিতে।

"বাংলাদেশের সম্ভাবনা অপরিমেয়" এ সত্য বাস্তবায়ন করতে হলে দুটি বিষয়ে জোর দিতে হবে। প্রথমত, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসতেই হবে। দ্বিতীয়ত, সকল কর্মকাণ্ডে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই।

অর্থমন্ত্রী এবারের বাজেট বক্তৃতায় "এদেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে একটি প্রযুক্তিনির্ভর সুখী, সমৃদ্ধ ও কল্যাণকামী দেশ গঠন"-এর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এ জাতীয় আশাবাদ ফলপ্রসূ করতে হলে সমবায়ের মূলনীতি, যেমন সাম্য, একতা, সহযোগিতা, সততা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রয়োগ হতে হবে সকল উন্নয়নের পদক্ষেপে।

এই প্রেক্ষাপটে, টেকসই উন্নয়নের রূপকার হিসেবে সমবায়কে প্রতিষ্ঠিত ও উজ্জীবিত করতে হলে নিম্নোক্ত কয়েকটি পদক্ষেপ অত্যন্তই জরুরি বলে প্রতীয়মান হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে–

ক. সমবায়ী চেতনা বিকাশের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় বাজেটে সমবায় খাতের জন্য অর্থের সংস্থান থাকতে হবে। বাজেটে সমবায়ের চেতনা বিকাশে বক্তব্য থাকতে হবে এবং অর্থায়ন করতে হবে। সরকারের আর্থিক সংশ্লেষ থাকলে তদারকির সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।

খ. সমবায় খাতে 'সুশাসন' প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে সমবায়ের ভাবমূর্তি বিকশিত হবে না এবং জনগণের আস্থা অর্জন ও সহযোগিতা লাভ অসম্ভব হবে। সমবায়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের জন্য প্রযোজ্য আচরণবিধি এবং শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

গ. তালিকাভুক্ত প্রায় ৪৭% সমিতি অকার্যকর আছে যা দীর্ঘদিন চলতে দেওয়া যায় না। একটি ক্রাস প্রোগ্রামের মাধ্যমে এর সুরাহা করতে হবে এবং প্রতি ৫ বছর অন্তর সচল সমবায়ীদের তালিকা পুনর্বিন্যাস করতে হবে।

ঘ. সমবায়ের সকল কর্মকাণ্ড ডিজিটাইজড করতে হবে এবং হিসাব-নিকাশ নিরীক্ষার সুবিধার্থে একক সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হবে।

ঙ. "গবেষণা ও প্রচারণা" নামে একজন অতিরিক্ত নিবন্ধকের অধীনে পৃথক বিভাগ খুলতে হবে। তিনিই নিয়মিত ত্রৈমাসিক মনিটরিং-এর আয়োজন করবেন।

চ. ২০১৩ সালের সমবায় আইনে কিছু অস্পষ্টতা বিরাজ করছে যা পরিষ্কার করতে হবে।

ছ. টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে সমবায়ের ব্যাপক ভূমিকা সর্ম্পকে জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার করতে হবে।

সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে সমবায়ের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন অর্জন সম্ভব, এ বার্তা সুপ্রতিষ্ঠিত করাই হচ্ছে সমবায় অধিদপ্তরের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ এবং আর্ন্তজাতিক সমবায় দিবসের অন্যতম আবেদন।

ধীরাজ কুমার নাথ: সাবেক সচিব।