বিশ্বকাপ উন্মাদনা বনাম ব্রাজিলের কান্না

আরিফ রহমান
Published : 1 July 2018, 09:21 AM
Updated : 30 June 2014, 05:46 AM

বিশ্বকাপ ফুটবল এবং ব্রাজিল, নিঃসন্দেহে বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত দুটি শব্দ। সবাই জানে ফুটবল বিশ্বকাপের আসর বসেছে এবার ব্রাজিলে। দুশো কোটি দর্শক দেখছেন টেলিভিশনে। আগে পরে মোটমাট ছয় লক্ষ পর্যটক আসা-যাওয়া করছেন ব্রাজিল। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বকাপ ফুটবল হচ্ছে Greatest Show on the Earth, আর সেই খেলাটা যখন হচ্ছে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নের ঘরে, তখন তো কথাই নেই।

যদিও কাগজে কলমে বলা হয় খরচটা পনেরো থেকে ষোল বিলিয়ন ডলার, আদতে এই মহাযজ্ঞে মোট খরচ হচ্ছে প্রায় তিরিশ থেকে চল্লিশ বিলিয়ন ডলার। মনে মনে টাকায় হিসাবটা না করাই ভালো, আমাদের এবারের উচ্চাভিলাষী বাজেটকেও ছাড়িয়ে যাবে। আপনাদের জানিয়ে রাখি, গত বিশ্বকাপে সাউথ আফ্রিকা চার বিলিয়ন ডলারেই এই 'কম্মো' করে ফেলেছিল। তাতে কী, সাউথ আফ্রিকা দরিদ্র দেশ, খরচ তারা কম করতেই পারে! ব্রাজিলের টাকা আছে, তারা খরচ করতেই পারে!

সত্যি বলতে কী, ব্রাজিলের আসলেই টাকা আছে। এই দেশের জিডিপি মোট ২.০৯০ ট্রিলিয়ন ডলার, যার মানে মাথাপিছু ১০,৮১৬ ডলার। খরচ তো তারা করবেই। কিন্তু এই দেশের একটি দশ বছর বয়সী মেয়ে যখন মাত্র পঞ্চাশ সেন্টের জন্য নিজের দেহ বিক্রি করে দেয় ভিনদেশি পর্যটকের কাছে, তখন মনে হয় সত্যি কোথাও যেন একটা সমস্যা রয়েছে। গুরুতর সমস্যা।

প্রিয় পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাই অন্য এক জগতে, বিশ্বকাপের সোনালী পর্দার নিচে চাপা-পড়া অসহায় দরিদ্র ব্রাজিলিয়ানদের জগতে। বিশ্বকাপের চাকচিক্য যাদের স্পর্শ করে না। গোল্ডেন বুট, সোনার কাপ আর অসংখ্য ফ্লাডলাইট ছাপিয়ে যাদের প্রত্যাশা দু'বেলা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার। আজ শোনাব দারিদ্রক্লিষ্ট ব্রাজিলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সংগ্রামের গল্প।

ব্রাজিলে যৌনকর্ম আইনসিদ্ধ, কিন্তু এজন্য বয়স বেঁধে দেওয়া আছে ১৮ বছর। এবারের বিশ্বকাপে ছয় লক্ষ পর্যটকের মনোরঞ্জনের জন্য প্রায় পনের লাখ নারীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এদের মাঝে পাঁচ লাখই শিশু, যাদের বয়স ৯ থেকে ১৪ । এই বাচ্চাগুলো কি স্বেচ্ছায় এ পেশা বেছে নিয়েছে? সেটা তো খুবই অসম্ভব।

আমান্দা কার্টুন দেখতে ভালোবাসে। ওর বয়স এখনও চৌদ্দ হয়নি। এই বয়সেই এই মেয়ের দুবার গর্ভপাত করাতে হয়েছে। মেয়েটা তার দাদির কাছে থাকে। এই বৃদ্ধার পক্ষে পরিবারকে একা টেনে নেওয়া সম্ভব নয়, তাই আমান্দা এই রাস্তায়। সে দাবি করছে, দশ বছরের কমবয়সী মেয়েরাও তার সঙ্গে কাজ করে। "আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই, একটা সুস্থ পরিবারের স্বপ্ন দেখি"– উচ্চাভিলাষী এই মেয়ের চোখে আজও অনেক স্বপ্ন। কিন্তু সে বেরিয়ে পড়ে রাজপথে, কোনো এক ফুটবলপ্রেমীর মনোরঞ্জনের জন্য।

আমান্দার মতো কিশোরীর স্বপ্নভঙ্গের দায় কে নেবে? তার রাষ্ট্র, ফিফা নাকি সেই ভিনদেশি পর্যটক যে এই বাচ্চাটিকে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে কোনো এক হোটেলে?

থিয়েগো, সাতাশ বছর বয়স্ক একজন দালাল। পাঁচ থেকে দশ হাজার ডলারের বিনিময়ে মা-বাবাদের কাছ থেকে ছোট ছোট বাচ্চাদের কিনে নিয়ে আসে সে। তবু তার মতে, সে একটা মহৎ কাজ করছে, এসব এলাকার দরিদ্র মানুষদের কিছুটা আয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে এভাবে, সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটারও একটা গতি হচ্ছে।

জানা যায়, এ রকম দালালরা মেয়েদের আয়ের চার ভাগের তিন ভাগই ছিনিয়ে নেয়। এক একটা মেয়ের কাছ থেকে একজন দালাল গড়ে বিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার ডলার আয় করে এক মৌসুমে। ওদিকে যৌন ব্যবসায় নিযুক্ত কিশোরীদের দেওয়া হয় মারাত্মক সব ড্রাগ, যাতে সবসময় এদের হাতে রাখা যায়।

ড্রাগ আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যেটা সবসময়ই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। ব্রাজিলে চৌদ্দ বছর বয়সী এ রকম একটি মেয়ের মৃত্যুর পর ব্যাপারটা সবার নজরে আসে। ট্রেন স্টেশনে এক খদ্দের মেয়েটাকে নিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে খুন করে লাশ ডাস্টবিনে ফেলে রাখে। সেই মেয়েটির এক বন্ধু সিএনএনকে জানায়– "ড্রাগ আমাদের ক্ষুধা ভুলে থাকতে সাহায্য করে। আমরা নিরাপদ বোধ করি এবং যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারি।"

বিশ্বকাপ আয়োজক শহর ফোর্টালেজার অ্যারেনা কাসতেলাও স্টেডিয়ামের পাশে খদ্দেরের জন্য অপেক্ষা করছিলেন এক যৌনকর্মী। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানলাম, তিনি মধ্যরাত থেকে কাজ করেন। তার কাছে জানা যায়, ফোর্টালেজার অনেক যৌনকর্মীই রাতে মাত্র সাড়ে ৪ ডলারের বিনিময়ে খদ্দেরদের আনন্দ বিলিয়ে থাকেন। অনেকে হয়তো এর চেয়ে কিছু ডলার বেশি পান। মূল্যটা খুব বেশি নয়, বিশ্বকাপের টিকিটের চেয়েও সস্তা!

অনেকদিন ধরেই আন্তর্জাতিক যৌন-পর্যটকদের প্রিয় শহর ফোর্টালেজার। ইরাসিমা সৈকত এখান থেকে দেড় ঘণ্টার পথ। এখানেই শহরের সবচেয়ে দামি প্রমোদবালাদের পাওয়া যায়। এনজিগুলোর একটি নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক লিদিয়া রদ্রিগেজের মতে, গত তিন বছরে শিশু যৌনকর্মীর সংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে গোটা শহরে প্রায় ১০০ জনের মতো শিশু যৌনকর্মী ছিল। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২০০। অ্যারেনা ক্যাস্তেলাও স্টেডিয়ামের নির্মাণ শ্রমিকদের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সম্ভবত এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

এই যৌনকর্মীদের, বিশেষ করে শিশুদের বেশিরভাগ নিজেদের ইচ্ছায় এ পথে আসেনি। রীতিমতো তাদের দিয়ে ইন্ডাস্ট্রি চালানো হচ্ছে। শিশু যৌনকর্মীদের ইংরেজি শেখানোর জন্য রাস্তায় রাস্তায় খোলা হচ্ছে স্কুল, কোচিং সেন্টার।

এ তো গেল মাত্র শুরুর গল্প, ভেতরটা এখনও বাকি। ব্রাজিলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বসবাস দারিদ্রসীমার নিচে। সরকার নূন্যতম মৌলিক চাহিদা পর্যন্ত পূরণ করতে পারে না। খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা খাত থেকে বরাদ্দ কমিয়ে বিশ্বকাপের আয়োজন করছে সরকার। স্বাভাবিকভাবেই একে স্বাগত জানাচ্ছে না সে দেশের জনগণ। তার উপর এই বিশ্বকাপের বাড়তি খরচের যোগান দিতে অতিরিক্ত করের টাকা গুনতে হচ্ছে তাদের। প্রত্যেকটা পণ্যের দাম আকাশচুম্বী, জনগণের নাভিশ্বাস, রাষ্ট্র নির্বিকার। স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তা তৈরি না করে সে টাকা দিয়ে করা হয়েছে একের পর এক বিলাসবহুল সব স্টেডিয়াম, যেখানে দরিদ্র ব্রাজিলিয়ানরা ঢুকতেও পারবে না।

ব্রাজিলের মেহনতি জনতা অবশ্য প্রথম থেকেই এর প্রতিবাদ করে আসছে। গত বছরের জুনেই প্রায় দশ লক্ষ মানুষ দেশের প্রত্যেকটা শহর থেকে বেরিয়ে আসে। ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো শহরে প্রায় তিন লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে এসে প্রতিবাদ জানায়। সাও পাওলোতে সংখ্যাটা ছিল এক লাখ দশ হাজার। এছাড়া বিভিন্ন প্রান্তে চলতে থাকে বিক্ষোভ। বিশ্বকাপের উদ্বোধনের দিনেও প্রায় লাখ খানেক মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। তারা বিশ্বকাপ চায় না, তারা চায় নিজেদের একান্ত মৌলিক চাহিদাগুলোর নিশ্চয়তা। FIFA GO HOME এই প্ল্যাকার্ড চোখে পড়বে শহরের বেশিরভাগ স্থানেই।

লুয়ানা গারথা সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র। তার মতে– "We are the ones who should decide where the public money goes. More funding for schools, hospitals, housing, transportation- not the Cup." অর্থাৎ, "আমরাই নির্ধারণ করব মানুষের টাকা কোথায় খরচ হবে। খরচ করার দরকার স্কুল, হাসপাতাল, বসতি আর যোগাযোগের জন্য– এই কাপের পেছনে নয়।"

এই আন্দোলনের অংশ Homeless Workers Movement এর একজন নেতার মতে– "আমাদের আন্দোলনটা প্রতীকী, আমরা কোনো স্টেডিয়ামে হামলা চালাব না। আমরা শুধু শ্রমিকদের অধিকার চাই এবং দেখতে চাই এই বিশ্বকাপ দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনে কী প্রভাব ফেলে।"

তবে ব্রাজিলিয়ান জনগণের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে তাদের পুলিশ হিংস্র নেকড়ের মতো আচরণ করছে। ব্রাজিল শহরের রাস্তাঘাট থেকে তোলা আন্দোলনকারীদের কয়েকটা ছবির দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। ব্রাজিলের এক শিক্ষক, রাফায়েল মার্কস লুসভার্গির ওপর পুলিশি নির্যাতনের চিত্র মিডিয়ায় আলোড়ন তুলেছে। দিন যত যাচ্ছে, মৌলিক চাহিদার দাবিতে আন্দোলনরত মানুষদের ওপর পুলিশের নির্যাতন বেড়েই চলছে।

বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচের দিনেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। রাস্তায় নেমে আসে ব্রাজিলের বিখ্যাত আর্মড পুলিশ, ঢালাওভাবে চলতে থাকে ধরপাকড়। সাংবাদিকরাও রক্ষা পায় না তাদের হাত থেকে। আন্দোলন ছেড়ে একটু রাস্তায় নেমে দেখা যাক। ব্রাজিলের রাজপথে এখন অহরহই দেখা যাচ্ছে বিশ্বকাপবিরোধী প্রচারণার হিড়িক।

ব্রাজিলের নীতিবাক্য ordem e progresso যার অর্থ 'শৃঙ্খলা ও উন্নতি' এখন শীতনিদ্রায়। রাজধানীতেই লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষ বাস করছে। লক্ষ লক্ষ যৌনকর্মী একটুকরো রুটির জন্য নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছে। যদি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কোনো উপকারেই না এল, তাহলে কী লাভ এই বিশ্বকাপ দিয়ে? কিন্তু আলো-ঝলমলে স্টেডিয়ামগুলোর পেছনের ঝোপে পড়ে থাকা মানুষগুলোর কথা বিশ্ব জানে না। টেলিভিশনে আমরা খেলোয়াড়দের নৈপুণ্য দেখি। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার নামে গলা ফাটাই, জীবন দিই, কিন্তু এসব ভুখা-নাঙ্গা মানুষদের নিয়ে জানার আগ্রহও নেই কারও।

তবে দীর্ঘ আন্দোলনেই আছে মুক্তির পথ। বিশ্ব জানুক আর না জানুক, ব্রাজিলের জনগণেরই জয় হবে। কারণ জনতাই তো সকল ক্ষমতার উৎস।

তথ্যসূত্র: