আমাদের যেন কোনো ভুল না হয়ে যায়

হাসান মামুনহাসান মামুন
Published : 18 June 2014, 01:57 AM
Updated : 18 June 2014, 01:57 AM

পটকাবাজি করে তাদের শবে বরাত পালন ঘিরে আমাদের রাজধানী শহরের পল্লবীতে বিহারি বলে পরিচিত আটকে-পড়া পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে সম্প্রতি যে কাণ্ড হয়ে গেল– বলা যায় পুলিশের উপস্থিতিতে– তাতে গালে হাত দিয়ে ভাবতে হয়, এও তবে সম্ভব!

বিহারি বলে যারা আমাদের কাছে পরিচিত, তাদের সবাই যে বিহার থেকে এসেছিল তা নয়। উত্তর প্রদেশ থেকেও অনেকে এসে উঠেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। দেশ বিভাগের সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিণতিতেই এসেছিল তারা দলে দলে, দফায় দফায়।

পাকিস্তান সরকার অগত্যা তাদের বরণ করে নেয় এবং তারাও নিজেদের মনে করতে থাকে 'সাচ্চা পাকিস্তানি'! সে ধারায় একাত্তরে এদের একটি বড় অংশের ঘৃণ্য ভূমিকা আমরা বাংলাদেশের মানুষ অন্তত ভুলে যাব না। এর আগেও বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে পাকিস্তানি জান্তা। এরাও ব্যবহৃত হয়। তার মধ্যে রয়েছে হিন্দুবিরোধী সহিংসতায় এদের একাংশকে 'গুণ্ডা' হিসেবে ব্যবহার করা।

স্বাধীনতার পর তাদের অপশন দেওয়া হয় বাংলাদেশ বা পাকিস্তানকে বেছে নিতে। মজার বিষয় হল, এদের একাংশ তখন বাংলাদেশেই থেকে যেতে চায়। বৃহত্তর বাঙালি সমাজে মিশেও গেছে অনেকে। যারা নিজেদের পাকিস্তানি বলে দাবি করে সে দেশে যেতে চেয়েছিল, তাদের সংখ্যাও আবার কম ছিল না।

এদের মধ্যে যারা এলিট, সামরিক ও বেসামরিক চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ী– তারা চলে যায় শুরুতেই। একটা সময় পর্যন্ত অন্যরাও যায় ধীরে ধীরে। একাধিক কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি হয় বাধাগ্রস্ত। এতে বাকিরা কার্যত আটকা পড়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা ক্যাম্পে। বলা উচিত, ক্যাম্পের অভিশপ্ত জীবনে।

রাজধানীর ক্যাম্পেও তাদের জীবন মানবেতর। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও দারিদ্র পরিস্থিতির কারণেই বিহারিদের অনেকে জড়িয়ে পড়েছে নানা অবৈধ ও অপরাধমূলক কাজে। সবার বিষয়ে ঢালাওভাবে বলা অবশ্য ঠিক নয়। সেটি কিন্তু জাতি-বিদ্বেষ বা এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা। আমরা হয়তো খেয়াল করি না, চুল কাটা, মিস্ত্রিগিরিসহ নানা স্বীকৃত পেশায় ঢুকে পড়েছে এরা এবং দক্ষতা অর্জন করেছে। বিশেষত এদের উত্তর প্রজন্ম, যাদের জন্ম বাংলাদেশে।

মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ওঠাবসা করতে করতে মুখের ভাষাও বদলে গেছে অনেকের। সেটাকে তারা কিন্তু স্বাভাবিক বলেই গ্রহণ করেছে। ঐতিহাসিক কারণে এ উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর পরবর্তী প্রজন্ম সাম্প্রদায়িক মনোভাব কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হতে পারে; তবে বাস্তবতার চাপে তাদের একটা বড় অংশ নিজেদের বাংলাদেশি বলেই দাবি করছে এখন। ভারতের বিহার, উত্তর প্রদেশ আর পূর্ব পাকিস্তানে এদের বাপ-দাদারা যা-ই করুক, তারা সে উত্তরাধিকার আর বহন করতে চাইছে না।

দেখতেও পাচ্ছে, তাদের বাপ-দাদাদেরও সবাইকে নেয়নি স্বপ্নের পাকিস্তান। যেখানে এদের নিয়ে কোনোমতে পুনর্বাসন করা হচ্ছিল, সেখানেও দানা বেঁধে উঠছিল জাতি ও গোষ্ঠীগত প্রতিরোধ। জীবন সেখানেও আনন্দ ও গৌরবের নয়। কালক্রমে এটাও তারা দেখতে পাচ্ছে, নানামুখী সংঘাতে জর্জরিত পাকিস্তান রাষ্ট্রটাই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে ভেতর থেকে।

পাকিস্তানের জন্য একদা সব কিছু করতে রাজি বিহারিদের নতুন প্রজন্ম স্বভাবতই চাইছে বাংলাদেশে তার ভাগ্য গড়ে তুলতে। দুর্দশা আর লাঞ্ছনার ক্যাম্পজীবন থেকেও রেহাই চায় তারা। এদেশের সর্বোচ্চ আদালতও তাদের পক্ষে রায় দিয়ে বলেছেন, ভোটাধিকারসহ এরা নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যারা শিশু অর্থাৎ অপরাধে লিপ্ত হওয়ার মতো সক্ষম ছিল না, তাদেরও নাগরিক করে নেওয়া যায়।

এসব বলা হচ্ছে এটি স্পষ্ট করতে যে, আটকে-পড়া পাকিস্তানি বা বিহারি বলতেই যারা পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগী বা যুদ্ধাপরাধী ভাবেন এবং জাতিগত ঘৃণা থেকেও যারা এদের বিষয়ে যা খুশি মন্তব্য করেন– তারা ঠিক কাজ করছেন না। কোনো বিষয়েই ঢালাও মন্তব্য করা ঠিক নয়। তখন হয় কী, এদের ওপর জঘন্য কিছু ঘটে গেলেও আমাদের গায়ে লাগে না। কেউ কেউ এমনও বলে ফেলি, 'তো কী হয়েছে'?

আমাদের সবারই একটু চিন্তা করে দেখা দরকার, পল্লবীর বিহারি ক্যাম্পে একদল 'বহিরাগত যুবক' তেড়ে এসে ওখানকার কয়েকটি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় আর তাতে একই পরিবারের নয় সদস্য পুড়ে মারা যায়। এদের প্রায় সবাই ঘুমন্ত শিশু ও নারী। দুই নারী নাকি ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। তালাবদ্ধ করে রাখায় তারা বেরোতেও পারেনি। একই ঘটনায় এক বিহারি যুবক আবার হামলাকারী বা পুলিশের গুলিতে মারা যায়। কাপড়ে কারচুপির কাজে দক্ষ ছিল সে।

এত বড় ঘটনা নিয়ে মিডিয়ায় যে খুব হৈচৈ হয়েছে বা হচ্ছে, তা নয়। এরই মধ্যে যেসব রিপোর্ট এসেছে, তাতে কিন্তু বোঝা হয়ে গেছে, ওখানে পুলিশের ভূমিকা ছিল পক্ষপাতদুষ্ট। আক্রমণকারীদের কাউকে নয়, পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে আক্রান্তদের কয়েকজনকে। তাদের রিমান্ডে নেওয়ার খবর রয়েছে। এলোমেলো মামলার খবরও মিলছে ওই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘিরে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হেন দুষ্কর্ম নেই, বিহারিদের একাংশ যা করেনি। বুদ্ধিজীবী নিধনেও এরা ব্যবহৃত হয়েছিল বলে প্রমাণ রয়েছে। এর প্রতিশোধ হিসেবে স্বাধীনতার পর কিছু ঘটনা ঘটে যায়, সরকার যা রোধ করতে পারেনি। কিন্তু এরপর দেশের কোথাও কোনো বিহারি ক্যাম্পে এ ধরনের হামলা ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়নি।

অথচ কী অদ্ভূতভাবে আমরা কিছু লোক বলছি, দেশের আইন না মেনে তারা প্রতিবার ভয়ঙ্কর পটকাবাজি করে শবে বরাতে! এটা নিয়েই নাকি 'ত্রিমুখী সংঘর্ষ' ঘটে। খবরে বেরিয়ে আসছে আরও অনেক কিছু। বিদ্যুতের লাইন টানা নিয়ে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির সঙ্গে বিহারিদের কারও কারও কথা কাটাকাটির জেরেই নাকি এমন হামলা। ক্যাম্পের জমি দখলের কাহিনীও প্রচারিত হচ্ছে, যদিও এর কোনো মাথামুণ্ডু মিলছে না। আটকে-পড়া পাকিস্তানিরা তো আছে সরকার-প্রদত্ত জমিতে। সেটা দখল হবে কীভাবে?

যে কারণেই হোক আর যে যোগাযোগই থাকুক, পল্লবীর বিহারি ক্যাম্পে যে ঘটনা ঘটে গেছে, তাতে নিন্দা জানানোর কোনো ভাষা নেই। যে পরিবারের নয়জন এভাবে পুড়ে মারা গেল আর যে যুবক নিহত হল গুলি খেয়ে, তাদের কেউ একাত্তরে কোনো অপরাধ করেছিল কি? এ দশজনের কারও জন্মও কি হয়েছিল তখন? আর অপরাধ করে থাকলেও এমন হামলা ও নির্বিকারভাবে হত্যার অধিকার কে দিয়েছে তাদের?

দেশে তো এখন একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার চলছে। পারলে বিহারি যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার করুন। ইতোমধ্যে যারা পাকিস্তান চলে গিয়েছে, তাদেরও। আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওই সদস্যদের, যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু কোনোভাবে কেউ জাস্টিফাই করবেন না বিহারি ক্যাম্পে নারী-শিশুকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা। এতে আমরা আরও ছোট হয়ে যাব।

আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এ অপরাধের খবর প্রচারিত হয়েছে যথারীতি। এটাকে তারা একটি আটকে-পড়া ও দুর্বল সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর হীন আক্রমণ হিসেবেই তুলে ধরেছে। অতীতে বিহারিরা পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের মদদে যত 'বীরত্ব'ই দেখাক, এখন তারা কিন্তু দুর্বল। এদের মধ্যে যারা এখনও চলে যেতে প্রস্তুত, তাদেরও আর নিতে চাইছে না পাকিস্তান। তাদের নিয়ে যাওয়া ও পুনর্বাসনে বিদেশি যেসব সংস্থা যুক্ত ছিল, এমনকি পয়সাকড়ি জোগাচ্ছিল– আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে তারাও। এ অবস্থায় বিহারিদের একাংশের ওপর এমন হামলাকে বুঝদার কেউ সহজভাবে নেবেন না।

ভারতেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা গেছে সাম্প্রদায়িক হামলার সময় পুলিশকে প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা রাখতে। পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রের খাতায় নাম লেখাতে যাওয়া দেশ নয় বলেই ভারতের কথাটা এখানে তোলা হল। বাংলাদেশও ব্যর্থ রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে না। তা সত্ত্বেও এটা স্বীকার করতে হবে বা কেউ এমন অভিযোগ তুললে রাগ করা যাবে না যে, এদেশে সব ধরনের সংখ্যালঘুই কমবেশি নিরাপত্তাহীন।

বৌদ্ধরা এখানে কিছুটা নাকি নিরাপদ বোধ করতেন। কক্সবাজারের রামুতে সংঘটিত ঘটনায় সে বোধ আর নেই বলেই মনে হয়। পশ্চিমাবিরোধী জঙ্গিদের উত্থানে খ্রিস্টানরাও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। আর হিন্দুরা তো সাম্প্রদায়িক শক্তির বরাবরের টার্গেট। তা সত্ত্বেও বলব, হিন্দুদের যাওয়ার একটা জায়গা অন্তত আছে। প্রতিবেশি শক্তিশালী দেশটি থেকে বাংলাদেশে তাদের স্বস্তিতে রাখার ওপর জোরও দেওয়া হয়। কিন্তু বিহারি? তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।

নিবন্ধটি লেখা পর্যন্ত আদি বিহারিদের স্বপ্নের দেশ পাকিস্তান থেকে এ ঘটনায় কোনো প্রতিক্রিয়া জানানোর খবর পাইনি। পাব বলেও মনে হচ্ছে না। তাদের পক্ষ থেকে একবার এমনটিও বোধহয় বলা হয়েছিল, আটকে-পড়া পাকিস্তানিদের মধ্যপ্রাচ্যের কোথাও বিশেষত সৌদি আরবে নিয়ে পুনর্বাসন করা হোক। ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এসে বাংলাদেশের নাগরিক হতে না-চেয়ে পাকিস্তান যেতে না-পারা বিহারিদের সঠিকভাবেই বলা হচ্ছে 'রাষ্ট্রবিহীন'।

এদের একাংশ অবশ্য এরই মধ্যে বুদ্ধি করে ভোটার হয়েছে। তাদের অভিহিত করা হচ্ছে আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটব্যাংক বলে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কে কাকে ভোট দেবে, সেটি তার অধিকারের বিষয়। হিন্দুসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে থাকলে সেটিও তাদের অধিকার। কাউকে এজন্য দোষ দেওয়া যায় না। আদালতের সম্মতিতে বিহারিদের কেউ ভোটার হয়ে বিএনপি-জামায়াতকে ভোট দিলে সে ক্ষেত্রেও কিছু বলার থাকে না।

বিহারিদের যে অংশটি ইতিহাসের গতিধারা বা বাস্তবতাটুকুও বুঝতে না পেরে এখনও পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর, তাদের নিয়ে এ লেখকেরও কম বিরক্তি নেই। কিন্তু এদেরও কারও গায়ে যেন হাত না তুলি– কোনো কারণ বা অজুহাতে।

আর নতুন প্রজন্মের বিহারি, যারা বাংলাদেশকেই নিজেদের গন্তব্য ভাবছে, তাদের সঙ্গে আমরা যেন সংলাপে অবতীর্ণ হই। অভিশপ্ত ক্যাম্পজীবনের বাইরে এসে মূলধারায় থেকে তারা যেন স্বাভাবিক একটা জীবন কাটাতে পারে, এদেশের উন্নয়নে ভূমিকা রেখে পূর্বপুরুষের কৃতকর্ম থেকেও যেন বেরিয়ে আসতে পারে তারা। অগ্নিদগ্ধ হয়ে আর গুলি খেয়ে এমন করুণভাবে মরার তো প্রশ্নই ওঠে না।

ইতোমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে যে পুলিশের ভূমিকা, এ ক্ষেত্রে তার তদন্ত বিশ্বাসযোগ্য হবে না মোটেই। ভিন্ন ধরনের একটি তদন্তের ব্যবস্থা করে এ লজ্জাজনক ঘটনার একটা বিহিত করতেই হবে সরকারকে। নইলে নতুন একটি বড় অপরাধমূলক ঘটনা চেপে যাওয়ার চেষ্টার অভিযোগ উঠবে তার বিরুদ্ধে। এ দুর্বল ম্যান্ডেটের সরকারের আরও বিপক্ষে যাবে সেটি।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট।