জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার এখনই সময়

দানেশ মিয়া
Published : 3 June 2014, 07:41 AM
Updated : 3 June 2014, 07:41 AM

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন যে মনুষ্যসৃষ্ট, এমন ধারণায় অনৈক্য এখন খুব কম মানুষেরই আছে। এই পরিবর্তনের প্রভাব এখন ধনী, গরীব সব দেশই আঁচ করতে পারছে। তবে এই পরিবর্তনের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে কত ভয়াবহ, তা আমরা চিন্তাও করতে পারছি না।

১৮৫০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৭৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত ৫০ বছরের প্রতি দশকে তাপমাত্রা বেড়েছে ০.১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা গত ১০০ বছরের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রায় দ্বিগুণ। গত ২০১২ সনে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বিংশ শতাব্দীর চেয়ে ০.৫৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল।

এটা স্পষ্ট যে, যত দিন গড়াচ্ছে, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে। তাপমাত্রার এই বৃদ্ধি দশমিক মাত্রার হলেও, এর ফলে বৈশ্বিক মোট তাপের যে পরিবর্তন হয়, তা কিন্তু অনেক। পৃথিবীর স্থায়ী এবং অস্থায়ী বড় বড় বরফের আস্তরণগুলো (গ্লেসিয়ার) সাম্প্রতিক সময়ে গলে যাওয়া এবং এর অনেকাংশই আর আগের অবস্থায় ফিরে না যাওয়া, বৈশ্বিক স্বল্পমাত্রার তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং সময়ের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান হারে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতার ভয়াবহতাই প্রকাশ করছে।

জলবায়ু বিজ্ঞানীরা সতর্কবাণী দিয়েছেন, বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে বেড়ে গেলে, আমাদের জৈব, অজৈব, সমাজ, সভ্যতা সবকিছুর ভারসাম্য স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বর্তমানে যেভাবে তাপমাত্রা বাড়ছে, তাতে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মান-মাত্রা পার হতে এই শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না, তার আগেই বিপদ ঘটে যাবে।

প্রাকৃতিকভাবে জলবায়ুর যে স্বাভাবিক পরিবর্তন হওয়ার কথা এবং যে পরিবর্তন ও বিবর্তনে আমাদের সমাজ ও অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, জলবায়ুর সে পরিবর্তন ছাপিয়ে মনুষ্যসৃষ্ট কারণে জলবায়ুতন্ত্র ইতোমধ্যেই অনেকখানি পরিবর্তিত হয়েছে। পৃথিবীপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি এই পরিবর্তনের পেছনে কাজ করেছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সমুদ্র ও মহাসমুদ্রের অম্লতা বৃদ্ধি ও তাদের গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন, মেরু অঞ্চলের বড় বড় বরফের আস্তরনের অবস্থান ও আকারের পরিবর্তন এবং অতিমাত্রার জলবায়ুগত বিভিন্ন ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি।

জলবায়ুতন্ত্রের এই পরিবর্তনের ঝুঁকি বিজ্ঞানীদের গবেষণায় সুষ্পষ্টভাবে জানা গেছে, যা 'আর-ফিরে-আসবে-না' এ রকম একটি স্থানান্তরের দিকে জলবায়ুকে ঠেলে দিবে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা ১০ সেন্টিমিটার থেকে ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। ২১০০ সালের মধ্যে ৫০ সেন্টিমিটার থেকে ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে।

এই হিসাবটি করা হয়েছে তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিভিন্ন ধরন অনুমান করে সমুদ্রপৃষ্ঠের বৈশ্বিক গড় হিসেবে। এই ধারণার অনিশ্চয়তা অনেক বেশি। বিভিন্ন আঞ্চলিক জলবায়ু মডেল অনুসারে কোথাও কোথাও অনেক বেশি উচ্চতা বৃদ্ধির ধারণা করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক উপগ্রহ ও ভূমি-ভিত্তিক পর্যবেক্ষণ থেকে এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়েছে যে, ১৯৯৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর প্রায় ৩ মিলিমিটার করে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিংশ শতাব্দীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা বৃদ্ধির চেয়ে অনেক বেশি।

এই উচ্চতা বৃদ্ধির নিম্নমাত্রার হিসাবটিও যদি সত্যি হয়, তাহলে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ ভাগ (৭০০ মিলিয়ন), যারা উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলে বাস করছে, তারা জল-নিমজ্জনের মধ্যে পড়বে এবং তৎসংক্রান্ত যাবতীয় প্রভাবে অসংখ্য পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বিস্তর জীবনহানি ঘটবে।

জলবায়ু পরিবর্তন ইতোমধ্যেই সমুদ্রের রাসায়নিক অবস্থা প্রভাবিত করেছে লবণ ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের বিস্তার পরিবর্তন করার মাধ্যমে। এতে সমুদ্রের পানির কার্বনের মজুদ ও পানির অম্লতা পরিবর্তিত হচ্ছে। নদী বা বাতাসে যেসব বর্জ্য নিক্ষিপ্ত কিংবা নির্গত হয়, তাদের অনেকাংশেরই সর্বশেষ অবস্থান হয় সমুদ্রে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড যা প্রাথমিকভাবে বায়ুমণ্ডলে অবস্থান করে, তার এক তৃতীয়াংশ সমুদ্রের পানিতে দ্রবীভূত হয়।

শিল্প বিপ্লবের পর দ্রবীভূত কার্বন ডাই অক্সাইড ইতোমধ্যেই সমুদ্রের পানির পিএইচ কমিয়ে (পিএইচ-এর মান ৮.২ থেকে কমে ৮.১ হয়েছে) দিয়েছে অর্থাৎ পানির অম্লতা বাড়িয়ে দিয়েছে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা আরও বাড়তে থাকলে, তা সমুদ্রের পিএইচ-এর মান ২১০০ সালের মধ্যে ০.৫ ইউনিট পর্যন্ত কমিয়ে দিবে।

আর এতে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়ে যাবে। বিশেষ করে যেসব প্রজাতি জীবনচক্রের কমপক্ষে কোনো এক সময় ক্যালসিয়াম কার্বনেটের খোলস তৈরি করে, বিশেষ করে প্রবাল ও শামুক-ঝিনুক, তারা সমুদ্রের এই অম্লতার কারণে বিলীন হয়ে যাবে।

সম্প্রতি 'নাসা' একটি ভয়াবহ তথ্য প্রকাশ করেছে। গত চল্লিশ বছরের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার এমান্ডসন সাগরের কাছে থাকা কিছু গ্লেসিয়ার (বরফের সিট) এমনভাবে গলে গেছে যে, তা আর কোনোভাবেই বরফ হয়ে ফিরে আসবে না। ওই গ্লেসিয়ার যদি সম্পূর্ণ গলে যায়, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ১.২ মিটার বেড়ে যাবে। আর যদি পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার সমস্ত বরফ গলে যায়, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ৩.৫ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যাবে। পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার পাশাপাশি পূর্ব অ্যান্টার্কটিকাতেও বরফক্ষয়ের একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

গ্রীনল্যান্ডের বরফের চূড়ার ক্ষয় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির আরও ভয়াবহ অশনি সংকেত দিচ্ছে। যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির আগাম ধারণা আগামী দুই-তিন দশকেই আমুল পরিবর্তন করে দিতে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে চীন ও বাংলাদেশ ভয়াবহ বিপদে পড়বে বলে নাসা সতর্ক করে দিয়েছে। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় বাস করে।

এর মধ্যে বেশ কিছু অঞ্চল উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল হিসেবে পরিচিত, যেখানে জমির উর্বরতা বেশ ভালো এবং প্রচুর মানুষ ঘনবসতিতে বাস করে। সেসব দেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আধা মিটার বাড়লেও মানুষ ও অন্যান্য জীবের অনেক সংকট তৈরি হবে। তার পাশাপাশি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা এই সংকট আরও ঘনীভূত করবে। এতে বড় বড় নদীর বদ্বীপ অঞ্চলগুলো ভয়ানক বিপদের আশংকায় আছে।

এ রকম আশংকায় প্রায় চল্লিশ দেশে তিনশ মিলিয়ন মানুষ বাস করে। এসব অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আধা মিটার বাড়লেও একশ মিলিয়ন মানুষ অতিমাত্রায় এবং ঘন ঘন বন্যায় আক্রান্ত হবে, এমনকি স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকারও হবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিমাত্রায় তাপমাত্রা ও ভারী বৃষ্টিপাত, কখনও প্রচণ্ড খরা, ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সাইক্লোন ও অন্যান্য ঝড় পর্যবেক্ষণ করা গেছে। এতে বাংলাদেশ তার আর্থ-সামাজিক অবস্থায় একটা সুষ্পষ্ট চাপ পর্যবেক্ষণ করছে।

বাংলাদেশের ভূখণ্ডের উপরিভাগের তাপমাত্রা যদি ক্রমবর্ধমান থাকে, তাহলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের গড় উচ্চতা প্রায় ১ মিটার বেড়ে যেতে পারে (সমুদ্রপৃষ্ঠের দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক মডেল থেকে সম্প্রতি পাওয়া সূত্রানুসারে)। এতে প্রায় ২০ শতাংশ বাসযোগ্য স্থলভূমি স্থায়ী ও অস্থায়ী জল-নিমজ্জনের শিকার হবে এবং ১৫ মিলিয়ন লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

মানুষের কর্মকাণ্ডে প্রভাবিত জলবায়ু পরিবর্তন মানুষকেই ঠেকাতে হবে। ইউএনএফসিসিসি-এর কিউটো প্রটোকলের সমাধান দিয়েছে– পৃথিবীর শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলোই যেহেতু জলবায়ুর এই পরিবর্তনের জন্য মূলত দায়ী, তাদেরকেই এই পরিবর্তন ঠেকানোর দায়িত্ব নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশেষ করে ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো যেভাবে ইতোমধ্যেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, তাতে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর চেয়ে এই পরিবর্তনে মানিয়ে চলাটাই অগ্রগণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

কিন্তু পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর কাজটি করেই যেতে হবে। কারণ এই পরিবর্তন যদি অব্যাহতভাবে চলতেই থাকে, তাহলে এই পরিবর্তনে বিপর্যস্ত সম্প্রদায়, জৈবিক, অজৈবিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহ্যসীমা অতিক্রম করবে, যখন সবকিছু ভেঙে পড়তে বাধ্য।

এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল শ্লোগান, Raise your voice, not the sea level, যথার্থ হয়েছে এজন্য যে, এখনই সর্বোচ্চ সময় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সোচ্চার হওয়ার, যাতে পৃথিবীর দায়ী দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে সচেষ্ট হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণে দিতে এগিয়ে আসে।

ড. দানেশ মিয়া: অধ্যাপক, বনবিদ্যা ও পরিবেশবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।