যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে কিছু কথা

সাব্বির খানসাব্বির খান
Published : 31 May 2014, 08:27 AM
Updated : 31 May 2014, 08:27 AM

বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে যে বিষয়টি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে চোখে পড়ে, তা হচ্ছে, 'বিরোধ'। পরিবারে বিরোধ, অফিস-আদালতে বিরোধ, সমাজের নিচু স্তর থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়েও নিজেদের সঙ্গে নিজেরা এই বিরোধ বা কোন্দলে জড়িয়ে থাকে। অর্থাৎ এমন কোনো ক্ষেত্র বা বিষয় নেই এই দেশে যা 'বিরোধ বা কোন্দল' ছাড়াই সম্পন্ন হয়। এটা যেন আমাদের সংস্কৃতির অবধারিত একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ।

অনেকে হয়তো প্রশ্ন করবেন, কোন কোন বিষয়ে বিরোধের কথা বলছেন? এ আলোচনা সংক্ষিপ্ত করার জন্য উত্তরটি এভাবেই দেওয়া যাক যে, "বাংলাদেশে কোন ক্ষেত্রে অথবা বিষয়ে বিরোধ নাই, কেউ বলতে পারবেন?" আমার প্রশ্নটা হয়তো ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনে হতে পারে, সেজন্য আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কিন্তু গভীরে দৃষ্টিপাত করলে আখেরে আমার কথাটিই সিদ্ধতা লাভ করবে বলে আমার বিশ্বাস।

যাহোক, আজ সব বিরোধ নিয়ে কথা বলার অভিপ্রায়ে লিখতে বসিনি এবং সবকিছু নিয়ে লেখা সম্ভবও নয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং এর অভ্যন্তরীন কিছু বাধ-বিরোধের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আজকের লেখাটি সীমাবদ্ধ রাখব।

২০১০ সালের ২৫ মার্চ একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গঠন করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। একই বছর ২৬ জুলাই শুরু হয়েছিল আদালতের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। সেই থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত পরিচালিত হচ্ছে, 'আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩' নামের বিশেষ আইনের দ্বারা। ইতোমধ্যে এই আদালত পার করেছে ৪ বছরের কিছু অধিক সময়। এই দীর্ঘ সময়ে জাতির যে প্রত্যাশা ছিল এই আদালতের কাছে, তা নিঃসন্দেহে পূরণ হয়নি।

দেশে আজ বিচারবান্ধব সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, যারা ১৯৭৩ সালে বিশেষ আইনটি তৈরি করেছিল। যে দলটি যুদ্ধাপরাধীদের দ্বারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত, অথচ সেই দলের সরকার ক্ষমতায় থেকেও কেন পূরণ হয়নি জনগণের প্রত্যাশা, তা প্রশ্ন করার সময় এসেছে।

একাত্তরের গণহত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াত-শিবিরচক্রের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবিতে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি জাহানারা ইমাম গঠন করেছিলেন 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি'। গঠনের সময় ঘোষণায় বলা হয়েছিল, 'সরকার যদি গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের আমীর গোলাম আযমের বিচার না করে, আমরা গণআদালতে তার বিচার করব।' জামায়াত-শিবির চক্রের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণেরও দাবি জানিয়েছিল নির্মূল কমিটি।

গণআদালতে গোলাম আযমের বিচারের কর্মসূচি সফল করার জন্য শহীদজননী জাহানারা ইমাম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-পেশাজীবী, ছাত্র-নারী-মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের সমন্বয়ে গঠন করেছিলেন 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি'।

গত বাইশ বছরে বহু সংগঠন ও ব্যক্তি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন, যা পরিণত হয়েছে জাতীয় দাবিতে এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮-এর নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত ১৪ দলীয় মহাজোট বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম আরম্ভ করেছে।

পাশাপাশি এই বিচার বাধাগ্রস্ত করার জন্য জামায়াত দেশে-বিদেশে বহুমাত্রিক চক্রান্ত আরম্ভ করেছে, ট্রাইব্যুনাল গঠনের সেই শুরু থেকে। জামায়াত চক্রান্ত করবেই। কিন্তু এই চক্রান্ত প্রতিহত করার দায়ভার কি সরকার বহন করে না?

বার বার অনুরোধ করার পরেও, ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে গত চার বছর সরকার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই চক্রান্ত প্রতিহত করতে কিছুই করেনি। এমনকি ট্রাইব্যুনালকে আরও শক্তিশালী করতে যা যা দরকার তাও আমরা বিরতিহীনভাবে বলে চলেছি। অথচ আমাদের একটি কথায়ও সরকার কর্ণপাত করেছে বলে দেখা যায়নি।

ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রথম তিন বছর বিভিন্ন মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ২০১৩ সালের আগে ট্রাইব্যুনাল কোনো রায় ঘোষণা করতে পারেনি। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট নয়টি রায় ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত।

ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দেওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে প্রথম রায়টি ছিল আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে। ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি, সোমবার তার বিরুদ্ধে প্রথম রায় ঘোষণা করা হয়। মোট আটটি অভিযোগের মধ্যে সাতটিতে তার অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২।

২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে দু'টিতে যাবজ্জীবন ও তিনটিতে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একটি অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেননি উল্লেখ করে ওই অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়।

আপিল করার পর একই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন এবং পরবর্তীতে তা কার্যকরও করা হয়।

সে বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনাল-১ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় দেন। প্রসিকিউশনের উপস্থাপিত বিশটি অভিযোগের মধ্যে আটটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়। বাকি বারোটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। মামলাটি বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানি শেষে রায়ের জন্য অপেক্ষায় আছে আজ দীর্ঘদিন ধরে।

২০১৩ সালের ৯ মে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় এ রায় দেওয়া হয়। কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগের মধ্যে দু'টিতে ফাঁসি, দু'টিতে যাবজ্জীবন আর একটিতে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। প্রমাণিত হয়নি বলে দু'টি অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছে। এই মামলাও ঝুলে আছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে।

সে বছরের ১৫ জুলাই জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল-১। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগই প্রমাণিত হলেও তার বয়সের কথা চিন্তা করে মাননীয় আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে এ শাস্তি দেন। সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করলেও শুনানি শেষ হয়ে রায় কবে হবে, কেউ তার সদুত্তর দিতে পারছেন না।

একবই বছরের ১৭ জুলাই জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে আনা বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হয়েছে। তার মধ্যে তিনটি অভিযোগের কারণে তাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া ছাড়াও, একটি অভিযোগে যাবজ্জীবন এবং অপরটিতে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এই মামলাটিও উচ্চ আদালতে রয়েছে, রায়ের অপেক্ষায়।

একই বছরের ১ অক্টোবর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, এমপির ফাঁসির রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল-১। সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনীত তেইশটি অভিযেোগের মধ্যে নয়টি প্রমাণিত হয়েছে, যার মধ্যে চারটি অভিযোগে ফাঁসির রায় দেওয়া ছাড়াও, তিনটি অভিযোগে ২০ বছর করে এবং দু'টি অভিযোগে ৫ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এই মামলাও আপিল বিভাগে রয়েছে।

দু'হাজার তেরোর ৯ অক্টোবর বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল-২। প্রায় মাসখানেক পর, ৩ নভেম্বর, এগারোটি অভিযোগের সবগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় পলাতক আশরাফুজ্জামান খান ও মঈনউদ্দিনের ফাঁসির রায় দেন ট্রাইব্যুনাল-২।

১৮ আগস্ট, ২০১৩ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ট্রাইব্যুনালের তদন্তকারী সংস্থা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে অফিসিয়ালি তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং কার্যক্রম শুরু করে। ২৭ মার্চ, ২০১৪ তদন্ত টিম জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে মামলার তদন্তের ফাইনাল রিপোর্ট ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কাছে হস্তান্তর করেন। চিফ প্রসিকিউটর তদন্ত রিপোর্ট গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই, প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজকে প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে মনোনীত করে ৭ সদস্যের একটি প্রসিকিউশন টিম গঠন করে জামায়াতের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ গঠনের দায়িত্ব প্রদান করেন।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে, প্রসিকিউশন টিম অক্লান্ত পরিশ্রম করে জামায়াতের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ গঠনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে এনেছেন এবং যে কোনো মূহূর্তে দলটি ট্রাইব্যুনালে তা উপস্থাপন করবেন।

কিন্তু গত ১৫ মে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি হৃষিকেশ সাহা প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়ে একটি নোটিশ জারি করেন। সেখানে জামায়াতের বিষয়ে তদন্তের সব নথিপত্র ভারপ্রাপ্ত প্রধান কৌঁসুলির কাছে হস্তান্তরের নোটিশ দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব নথিপত্র ভারপ্রাপ্ত প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ হায়দার আলীর কাছে হস্তান্তর করতে হবে, যাতে রাষ্ট্রপক্ষের জ্যেষ্ঠ কৌঁসুলিরা ওই নথিপত্র পরীক্ষা করতে পারেন। তারপর থেকে জামায়াতের মামলার বিষয়টি স্থগিত হয়ে আছে (বাংলা ট্রিবিউন, ২৯ মে, ২০১৪)।

তার মাত্র ক'দিন পর, ২৯ মে, ২০১৪ বাংলাদেশ সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মিডিয়াকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে, আইনানুযায়ী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার সম্ভব নয়।

এর আগেও আমরা সাঈদীর মামলার রায়ের আগে স্কাইপ কেলেঙ্কারি দেখেছি; তারপর দেখেছি সাকা চৌধুরীর রায় ঘোষণার আগেই রায়ের খসড়া অনলাইনে ছড়িয়ে যেতে। পাশাপাশি প্রতিটা ঘটনার পরেই যখন আমরা ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আমূল পরিবর্তনের কথা বলেছি, তখনই দেখা গিয়েছে এই মন্ত্রণালয়গুলোর গাইগুই।

উপরের সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করা ছাড়া, গত চার বছরের ট্রাইব্যুনাল থেকে জাতির প্রত্যাশার আর কিছুই অর্জিত হয়নি। বরং বিভিন্ন সময় পর্যায়ক্রমিকভাবে আমরা যা দেখতে পেয়েছি, তা জাতিকে হতাশ হওয়া ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি।

উদাহরণ হিসেবে আমরা জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর মামলাটি সংক্ষেপে দেখতে পারি। পর পর তিনবার রায় ঘোষণার অপেক্ষা তালিকায় (সিওভি বা কেস ওয়েটিং ফর ভ্যারডিক্ট) রাখার পরেও, আজও ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক সেই রায় ঘোষণা করা হয়নি এবং কবে যে ঘোষণা করা হবে, তাও কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না।

২০১০ এর ২৯ জুন ভিন্ন মামলায় আটককৃত নিজামীকে ২ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলেও, ২০১২ সালের ২৮ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত-১ এ তার বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। প্রায় দীর্ঘ দুই বছরে তদন্ত এবং প্রসিকিউশন টিম গণহত্যা এবং বুদ্ধিজীবী হত্যা সংশ্লিষ্টতাসহ মোট ১৬টি অভিযোগ আনেন নিজামীর বিরুদ্ধে।

এখানে উল্লেখ্য যে, নিজামী এবং কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর পৃথক দুটি ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ শুরু হয় একই দিনে, অর্থাৎ ২০১২ সালের ২৮ মে। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, একই দিনে শুরু হওয়া একই ধরনের অপরাধের কারণে কাদের মোল্লার রায় ট্রাইব্যুনাল থেকে আপিল বিভাগ ঘুরে কার্যকরও হয়ে গেল। অথচ নিজামীর রায় পর পর তিনবার ঘোষণার জন্য অপেক্ষমান রাখার পরেও, তা ঘোষণা হচ্ছে না।

এখানে কিছু যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে এই বলে যে, বিবাদী দল ইচ্ছে করে সময় ক্ষেপণ করছে এবং একজন বিচারক অবসরে যাওয়ার পরে দ্বিতীয় বিচারক নিয়োগ দেওয়ার জন্য সময় লাগছিল। এটা কি আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নয় যে, একজন বিচারকের বয়স কত এবং তিনি কবে নাগাদ অবসরে যাবেন তার হিসাব রাখা?

আর বিচারক নিয়োগের জন্য যে সময় ক্ষেপণ হয়েছে, তাতেও একটা বিষয় পরিস্কার হয়েছে যে, সরকারের ভিতরে এমন কিছু লোক আছেন, যারা এই বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছেন। একটা রায় যখন তিন তিনবার ঘোষণার অপেক্ষায় রাখার পরেও কোনো কারণে ব্যর্থ হয়, তাহলে স্বভাবতই আমরা আশা করতে পারি যে, অন্তত এই রায়টি যাতে সবকিছুর আগে অগ্রাধিকার পায়, সেভাবে কাজ করা।

কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি ঠিক তার বিপরীতটি। নতুন বিচারক নিয়োগ পাওয়ার পরে মিডিয়াতে নিজেকে আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচয়দানকারী একজন প্রসিকিউটর নিজামীর পক্ষের উকিলের স্বরে পুনরায় মামলাটির শুনানির জন্য বিচারপতিকে পরামর্শ দিলেন। একটা প্রসিকিউসনে কেন এত দ্বিধাবিভক্তি? এর সহজ সুযোগ নিচ্ছে জামায়াত। তাদের যেসব তীর ছুঁড়ছে, মূলত তার লক্ষ্যবস্তু একটাই, যে কোনো মূল্যে ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রতিহত করা।

একটা দেশের আইন মন্ত্রণালয় থাকে কেন? তাদের কাজই হচ্ছে আইন তৈরি করা। কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধেও উচ্চ আদালতে বাদীপক্ষের আপিল করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু সরকার কি তখন আইন সংশোধন করে সেই আপিলের সুযোগ সৃষ্টি করেনি?

ঠিক একই সময়ে সংগঠন হিসেবে যে জামায়াত ইসলামীর বিচার করা যাবে, তাও উল্লেখ ছিল সেই সংশোধনীতে। বিজ্ঞ আইনমন্ত্রী এত ব্যস্ত মানুষ যে, গত সরকারের আমলে নেওয়া '৭৩ এর আইনের যে সংশোধনী আনা হয়েছিল, তা-ও পড়ে দেখার সময় পাননি।

আইনমন্ত্রী আরও বলেছেন, "তিনটি কারণে এ আইনে জামায়াতের বিচার করা সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি। সেগুলো হচ্ছে– প্রথমত, এই আইনে দল হিসেবে সাজার বিধান নেই; দ্বিতীয়ত, সুপ্রিম কোর্টে জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে ইতোমধ্যেই একটা মামলা চলমান, সেখানে নতুন করে এখানে একই বিষয়ে মামলা হলে সুপ্রিম কোর্টের মামলায় কী প্রভাব পড়বে সেটা একটা বিষয়; তৃতীয়ত, এই মামলায় যদি অন্য মামলার উদাহরণ (প্রচলিত কোম্পানি আইন) ধরা হয় তাহলে সেখানে আছে, কোনো কোম্পানি কিংবা সংগঠনের বিরুদ্ধে মামলা হলে তার সাজা পাবেন হবেন সংশ্লিষ্ট কোম্পানি কিংবা সংগঠনের নিয়ন্ত্রকেরা। তা হলে এখানে জামায়াতের যদি সাজা হয় তাহলে তো তার নিয়ন্ত্রক যারা অাছেন তাদের সাজা হবার কথা। কিন্তু তারা তো এরই মধ্যে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ে সাজা ভোগ করছেন। দ্বিতীয়বার তো তারা সাজা পেতে পারেন না।"

আমি ইতোপূর্বে বলেছি যে, জামায়াত এই বিচার ঠেকানোর জন্য হেন কাজ নেই যে করছে না। সরকারের ভিতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা জামায়াতিদের কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৮ মে-তেও বলেছেন, যা জনকণ্ঠের প্রথম পাতার খবর হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর যদি উপলব্ধিতে আসে যে, দল এবং সরকারের ভিতরে জামায়াত ঢুকে গেছে এবং তারাই মূলত সরকার চালাচ্ছে, তাহলে সর্বনাশ হওয়ার আর বাকি রইল কী? এ ব্যাপারে শুদ্ধি অভিযান যত শীঘ্র চালানো যায়, সরকার তথা দলের জন্য তা হবে মঙ্গলজনক।

আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন বলেছিলেন, 'ইংল্যান্ডের সৈন্যরা, যারা আমাদের হাতে ধরা পড়েছে, তারা যুদ্ধবন্দী, যুদ্ধাপরাধী নয়। তারা ওপরওয়ালার নির্দেশে আমাদের দেশে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু এই দেশের মানুষ হয়ে যারা নিজের দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, নিজেদের মা-বাপ, ভাই-বোনকে হত্যা করেছে, তারা দেশদ্রোহী, তারা যুদ্ধাপরাধী। এদের অপরাধের ক্ষমা নেই।''

আমাদের একাত্তরের প্রসঙ্গে, আমরা কি যুদ্ধাপরাধের বিচারেরর গুরুত্বটি এভাবে উপলব্ধি করতে পারছি?

সাব্বির খান: আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ, একাত্তরের, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।