প্রাচ্য-প্রতীচীর পথে-প্রান্তরে: মাছি মারা সমাচার

শোয়েব সাঈদ
Published : 28 May 2014, 03:06 PM
Updated : 28 May 2014, 03:06 PM

কর্মহীনতার শ্লেষ প্রকাশ করতে গিয়ে আমরা মাছি মারা বা তাড়ানোর উপমা ব্যবহার করে থাকি। হয়তো পারিপার্শ্বিক অন্যান্য কাজের তুলনায় মাছি মারা বা তাড়ানোকে খুবই সহজ আর গুরুত্বহীন মনে হয়। বহুল প্রচলিত এই ধারণার পেছনের বাস্তবতাটুকু ভিন্নমাত্রার। কোনো কোনো দেশে পাকা আমের পাশে ভন ভন করা এ মাছি মারার কাজটি মোটেই সহজসাধ্য নয়, বরং রীতিমতো উচ্চপ্রযুক্তির বিলিয়ন ডলার রিটার্নের মিলিয়ন ডলার প্রজেক্ট!

মানবিকতার এ যুগে মানুষের প্রতি আমরা যতটা মানবিক, পশু-পাখি, পরিবেশ, এমনকি কীটপতঙ্গের প্রতি ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়েও বেশি। অতএব মাছিকে বিষপ্রয়োগে মারা চলবে না– মারতে হবে ক্রমশ বিলুপ্ত করার প্রাকৃতিক এবং মানবিক পদ্ধতিতে, যাতে পরিবেশের গায়ে আঁচড় না লাগে।

রুটিরুজির টানে প্রাচ্য-প্রতীচীর কসমোপলিটান সিটি থেকে নৈসর্গিক নান্দনিকতার ছোট ছোট জনপদেও ছুটতে হচ্ছে। মেক্সিকো এবং সেন্ট্রাল আমেরিকার কতিপয় দেশ তার অন্যতম। ফল উৎপাদক এবং রপ্তানিকারক হিসেবে এই অঞ্চলের বিশেষ সুখ্যাতি রয়েছে। মেক্সিকোর আম তো ফল হিসেবে রীতিমতো 'সেলেব্রেটি'।

কিন্তু কিছু সংখ্যক পোকামাকড়, বিশেষ করে ভূমধ্যসাগরীয়, মেক্সিকান এবং ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফলমাছির (ফ্রুট ফ্লাইস) উৎপাতে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ-এর মতো বিশাল বাজারে ফল রপ্তানি বিপর্যস্ত। স্ত্রী মাছি নিষিক্ত ডিমগুলোকে ফুটানোর জন্যে ফলের খোসা ভেদ করে ডিম পাড়ে এবং ফলটি নষ্ট হয়ে বিপণন-অযোগ্য হয়ে পড়ে।

এই অঞ্চলের মাছি নিয়ন্ত্রণে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ, মেক্সিকো এবং সেন্ট্রাল আমেরিকার সরকারসমূহ, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতায় কয়েক দশক যাবত চলছে পরিবেশবান্ধব মাছি বন্ধ্যাকরণ প্রজেক্টের এক মহাকর্মযজ্ঞ।

এসআইটি (স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক) বা পোকা বন্ধ্যাকরণ কৌশল নামক জৈবিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে একটি এলাকা থেকে মাছি বা পোকা উচ্ছেদ করা হয়। রাসায়নিক কীটনাশকবিহীন পরিবেশবান্ধব এই প্রযুক্তি মানুষ, জীবজন্তু, এমনকি উপকারী পোকামাকড়ের কোনো ক্ষতি না করে, শুধু নির্দিষ্ট পোকার উপরই কাজ করে।

এই প্রযুক্তিতে কারখানায় সাধারণত পুরুষ পোকা চাষ করে রেডিয়েশন বা বিকিরণের মাধ্যমে বন্ধ্যা করে বিমানের মাধ্যমে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হয়। বন্ধ্যাকৃত পোকা প্রজননে বন্য পোকার সঙ্গে প্রতিযোগিতার ফলে ক্রমশ পোকার সংখ্যা কমতে থাকে এবং এক পর্যায়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে এলাকাটিকে মাছিমুক্ত ঘোষণা করে ফল রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।

মাছি উৎপাদন কারখানাতে অসংখ্য পোকাকে নেটবেষ্টিত খাঁচার মধ্যে রাখা হয়। নেটের বাইরের আবরণটি ফলের খোসার গঠন বৈশিষ্ট্যের কৃত্রিম শিট দিয়ে তৈরি। স্ত্রী মাছি এই শিটকে ফলের খোসা ভেবে তা ভেদ করে ডিম পাড়ে। ডিমগুলো পাতলা শিটের অপর প্রান্তে জমা হয় এবং হালকাভাবে পানি ছিটিয়ে ডিম সংগ্রহ করা হয়।

সংগৃহীত ডিমগুলোকে নির্দিষ্ট আর্দ্রতা এবং তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করে, প্রাকৃতিক পরিবেশের অনুরূপ কৃত্রিম পরিবেশে বিশেষ ফর্মুলায় তৈরি সুষম খাবারের সাহায্যে লার্ভা, পিউপা থেকে পূর্ণাঙ্গ মাছিতে পরিণত করা হয়। প্রাপ্তবয়স্ক পিউপাকে নির্দিষ্ট মাত্রার গামা বিকিরণের মাধ্যমে বন্ধ্যা করা হয়। লক্ষ লক্ষ পিওপাকে একসঙ্গে বিকরিত করা হয়।

জীবনচক্রের বিভিন্ন স্তরে পুরুষ মাছির তাপমাত্রা সহ্যক্ষমতা বেশি থাকে। বন্ধ্যাকরণের জন্যে যেহেতু পুরুষ মাছির প্রয়োজন, তাই এই বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে পুরুষ মাছিকে স্ত্রী মাছি থেকে আলাদা করা হয়। কখনও কখনও পিওপা থাকা অবস্থায় রঙ মিশানো হয়।

রেডিয়েশনের পর রঙটি মাছির মাথায় থেকে যায়, যা পরবর্তীতে প্রকৃতিতে চাষকৃত বন্ধ্যা মাছি চিনতে সাহায্য করে। কোটি কোটি চাষকৃত বন্ধ্যা মাছি বিমান থেকে আক্রান্ত এলাকায় ছেড়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) এবং জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস)-এর মাধ্যমে চাষকৃত মাছির সংখ্যা, গতিবিধি, সাফল্যের মাত্রা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করা হয়।

গত কয়েক দশকের এসআইটি কার্যক্রমের প্রত্যক্ষ সুফল হচ্ছে পুরো ল্যাটিন আমেরিকা জুড়ে প্রায় ২০ টির বেশি ফল ও সবজিকে পোকামুক্ত করে উন্নত দেশগুলোতে রপ্তানি-উপযোগী করে তোলা এবং কয়েকশ মিলিয়ন ডলারের হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি। উত্তর এবং সেন্ট্রাল আমেরিকায় ফল ও সবজি উৎপাদনে প্রায় বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের এই প্রজেক্টের প্রত্যক্ষ সুফল হচ্ছে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার আর পরোক্ষ সুফল হচ্ছে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। পরোক্ষ সুফলের মধ্যে কীটনাশক ব্যবহারজনিত কারণে মানবস্বাস্থ্য, গবাদিপশু ও পোল্ট্রিস্বাস্থ্য এবং উপকারী পোকামাকড়ের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবার সুবিধেও রয়েছে।

এসআইটি প্রযুক্তি গবাদি পশুর জন্যে ভয়ানক ক্ষতিকর পোকা স্ক্রুওয়ার্ম নিয়ন্ত্রণেও ব্যবহৃত হচ্ছে। স্ক্রুওয়ার্ম হচ্ছে ব্লোফ্লাই নামে পরিচিত একপ্রকার পরজীবী মাছি যা উষ্ণরক্তের প্রাণির টিস্যু খেয়ে বেঁচে থাকে। নিউ ওয়ার্ল্ড, ওল্ড ওয়ার্ল্ড ইত্যাদি বাহারি নাম আছে এই মাছিগুলোর। গরু বা অন্যন্য গবাদিপশুর শরীরে ঘা হলে সেই ঘায়ের ভেতর স্ত্রী পোকা ডিম পাড়ে এবং জীবনচক্র সম্পাদন করে। স্ক্রুওয়ার্মের প্রাদুর্ভাবে মরু অঞ্চলে ব্যাপক হারে উটের প্রাণহানি ঘটে।

পানামা সিটি থেকে দু'ঘণ্টার ড্রাইভে কোপেগ (কমিশন ফর দি ইরাডিকেশন অ্যান্ড প্রিভেনশন অব স্ক্রুওয়ার্ম)-এর স্ক্রুওয়ার্ম উৎপাদন কেন্দ্র অবস্থিত। কোপেগ পরিচালিত হয় ইউএসডিএ-এর ৯০ শতাংশ এবং পানামা সরকারের ১০ শতাংশ অনুদানের উপর। ফলের মাছির মতোই একই প্রযুক্তিতে বন্ধ্যাকৃত পোকা উৎপাদন করে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হয়, যাতে ক্রমশ পোকার সংখ্যা কমে আসে।

স্ক্রুওয়ার্ম উৎপাদন কেন্দ্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অতি কঠোর। কারণ স্ক্রুওয়ার্ম মানুষের জন্যেও বিপজ্জনক এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রাণহানিও ঘটতে পারে। কোপেগ পরিদর্শনে সম্মুখীন হতে হয়েছে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার। নির্বাহীদের সঙ্গে বৈঠকের পর কারখানা পরিদর্শনের শুরুতেই বিব্রত হতে হল। পরিধেয় সবটুকুই খুলে কড়া হলুদ বর্ণের বিশেষ ড্রেস পরে কারখানায় প্রবেশ করতে হবে।

তাতেও সমস্যা ছিল না, সমস্যাটি ছিল দিগম্বর হওয়ার কাজটুকু সারতে হবে পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে ওপেন ফ্লোরে, কোনো কুঠুরির ভেতরে একাকী নয়। সহকর্মীরা দ্বিধাহীনভাবে পটাপট কাপড় বদলিয়ে ফেলল। আমার সংস্কৃতি আমাকে থমকে দিল, প্রচণ্ড দ্বিধায় পড়তে হল। দীর্ঘদিন জাপানে 'ওনসেন' বা উষ্ণ-প্রস্রবণ সংস্কৃতির স্পর্শে ছিলাম যা ওই মুহূর্তে দ্বিধা ভাঙতে সাহায্য করল। তাছাড়া কারখানার ভেতর প্রবেশ করতে হলে পদ-পদবি নির্বিশেষে এটাই কমপ্লায়েন্স এবং কোনো বিকল্প নেই।

কারখানা পরিদর্শনের পর গোসল করা বাধ্যতামূলক। গোসলে কোনো ফাঁকি চলবে না এবং এই পুরো বিষয়টি মনিটর করার জন্যে একাধিক স্টাফ থাকে। স্টাফ যদি মনে করে গোসল পর্যাপ্ত নয়, তবে আবার তা করতে হবে। এই কড়াকড়ির মূল কারণ হচ্ছে যাতে কোনোভাবেই জীবন-চক্রের কোনো স্তরেই স্ক্রুওয়ার্ম মানববাহিত হয়ে কারখানার বাইরে এসে জনস্বাস্থ্য ও পশুস্বাস্থ্য বিপদাপন্ন করতে না পারে।

কারখানার ভেতরেও রয়েছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মেক্সিকোতে ২০১৩ সাল থেকে দেখছি মাছিচাষের স্থাপনাগুলোতে সাধারণ নিরাপত্তারক্ষীদের বদলে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মেক্সিকোতে এই সেনা-উপস্থিতি ভিন্নমাত্রার মনে হল। পরে জানলাম, নতুন প্রশাসন কৃষি আর খাদ্য নিরাপত্তাকে জাতীয় নিরাপত্তার অংশ ঘোষণা করায় কৃষির সঙ্গে জড়িত জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তার দেখভাল সেনাবাহিনী করছে।

বাজার বিশ্বায়নের এই যুগে রপ্তানিমুখী কৃষি-অর্থনীতির একটি শক্ত ভিত্তির উপর জাতীয় অর্থনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করবার প্রয়াসে এবং একই সঙ্গে বিশ্বনাগরিকের দায়িত্বশীলতায় এবং হাইটেক প্রযুক্তির প্রায়োগিকতায় বৈশ্বিক এই পৃথিবীকে আরও পরিবেশবান্ধব করার তাগিদে মাছি মারা এখন আর বিদ্রূপাত্মক বচন নয়, জাতীয় নিরাপত্তায় অঙ্গীভূত বিশাল কর্মযজ্ঞের দায়িত্বশীল বাস্তবতাও বটে।

ড. শোয়েব সাঈদ: বায়োটেক নির্বাহী, কানাডা।