রোড ক্রাশ, তদন্ত কমিটি ও কিছু কথা

অপূর্ব সাহা
Published : 27 May 2014, 03:32 PM
Updated : 27 May 2014, 03:32 PM

নারায়ণগঞ্জের সাত খুন নিয়ে যখন মিডিয়া উত্তাল, চ্যানেলে চ্যানেলে পরিস্থিতির লাইভ টেলিকাস্ট আর টক-শো টকারদের নানামুখী অ্যানালাইসিসের তাপে ঘরে ঘরে জমছে ক্ষোভ আর বেদনার বাষ্প, তখন একদিন ঘটে গেল গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে লঞ্চডুবির ঘটনা। যাত্রী ছিল নাকি দু'শর উপরে। ৪০-৫০ জনের সাঁতরে ডাঙায় ওঠা, আর সার্চে উঠে আসা অর্ধশত লাশ বাদ দিলে বাকি থাকে শতেকের উপর নিখোঁজ যাত্রী, যারা স্রেফ কোনো নিশানা না রেখে 'নাই' হয়ে গেল। খবরের কাগজের পাতায় দেখলাম, টিভিতে লাইভ দেখলাম, স্বজনদের আহাজারি দেখলাম; দু'দিন, তিনদিন– তারপর থেমে গেল। সাত খুনের ঘটনা তখনও চাঙ্গা।

এমনকি সাত খুন এখনও চাঙ্গা। ওদিকে 'লঞ্চডুবি' হারিয়ে গেছে! অথচ নিহতের সংখ্যা লঞ্চডুবিতে অন্তত বিশ গুণ বেশি। সমীকরণটা মিলছে না।

আর একটা অসমীকরণের কথা বলি, নারায়ণগঞ্জে সাত জন অপহরণের পর এক মাস কেটে গেছে। এক মাস, মানে তিরিশ দিন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে ১৮,০০০ মানুষ। সেই হিসাবে প্রতিদিন সড়কে প্রাণ হারাচ্ছেন ৪৯ জন। তাহলে এক মাসে এই সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ১৪৭০ জন!

এই ১৪৭০ জনের প্রাণহানির বিপরীতে কতটুকু আওয়াজ শুনেছেন আপনি? সমীকরণ মিলছে না তো? সমীকরণ না মেলার যুক্তিতে কেউ হয়তো বলবেন, এগুলো তো নিছক দুর্ঘটনায় মৃত্যু। আর ওটা তো খুন। ফৌজদারি অপরাধ। এর উপরে দেশের ভালো-মন্দ, সরকারের অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব অনেক কিছু নির্ভর করে। তাই ওটা অনেক বেশি সিগনিফিকেন্ট।

তাহলে আমার কিছু বলার আছে। সড়কে প্রাণহানির ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিলে চলবে না। উন্নত বিশ্বে এখন আর 'রোড এক্সিডেন্ট' শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয় না। ওরা বলে, 'রোড ক্রাশ'। কেন? উত্তরটা হচ্ছে, এক্সিডেন্টের সঙ্গে একটা দৈবিক বিষয়ের সম্পর্ক আছে। এক্সিডেন্ট মানে কেউ একজন অদৃশ্য থেকে ঘটনাটা ঘটিয়েছে। কিন্তু সড়কে যা ঘটছে তাকে কোনোভাবেই দৈবিক ইশারায় ঘটমান বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গা এলিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

দুর্ঘটনার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তার পেছনে কেউ না কেউ দায়ী। চালক ব্রেক ফেল করেছিল? খুঁজলে দেখবেন, ব্রেক চাপতে দেরি হয়েছে অথবা ব্রেক সিস্টেমে ত্রুটি ছিল, পরীক্ষা না করেই রাস্তায় নামানো হয়েছিল গাড়ি অথবা গাড়িটারই জীবদ্দশা শেষ হয়ে গেছে অনেক আগে।

অথবা পথচারী অকস্মাৎ গাড়ির সামনে এসে পড়েছিল, তাকে বাঁচাতেই চালক গাড়ি খাদে নামিয়ে দিয়েছে। পথচারী কেন গাড়ির সামনে এসে পড়েছিল? খোঁজ করলে দেখবেন, সে পথ চলার নিয়মকানুনই জানে না। কেন জানে না? কার দায়িত্ব ছিল তাকে নিয়মকানুন জানানোর? এই যে একজন মানুষকে বাঁচানোর জন্য চালক আরও পনেরো জনের জীবন কেড়ে নিল, তার জন্য প্রকৃত অর্থে দায়ী কে?

রাতে গাড়ি চালাতে চালাতে চালক ঘুমাচ্ছিল? কেন ঘুমাচ্ছিল? কারণ সে দুদিন একটানা গাড়ি চালাচ্ছে, কোনো বিশ্রাম ছাড়াই; মালিক তাকে ওভারট্রিপ দিতে বাধ্য করেছে। তাহলে কে দায়ী?

চালক মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিল? কীভাবে? বাংলাদেশে তো নেশা-জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে গাড়িচালনা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তা প্রয়োগের জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে। তাহলে মদ্যপ চালক দুর্ঘটনায় পতিত হলে সে দায় কার?

এভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে কিছু অবহেলা, দায়িত্বহীনতা, কিছু বিকৃত অভীপ্সা আর সামান্য কিছু ভুলের সমষ্টি। তাহলে কী করে সড়ক দুর্ঘটনাকে দৈবিক ঘটনা বলি! এটা তো সংঘটিত অপরাধ। নয় কি?

আমি এখানে অনেকগুলো 'কেন' এবং 'কে'র অবতারণা করেছি। কারণ যতদূর জানি সড়ক দুর্ঘটনাসংশ্লিষ্ট এই 'কেন' এবং 'কে'র উত্তর খুব একটা খোঁজা হয় না। নৌ-দুর্ঘটনায় যেহেতু একসঙ্গে অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটে, তাই সে ক্ষেত্রে ঘটনার কারণ এবং দায়ী ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়ার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় সেটা করা হয় না। ফলত, ঘটনার মূলে লুকিয়ে থাকা 'কেন' এবং 'কে'র উত্তরগুলো যবনিকার আড়ালে থেকে যায়।

সম্প্রতি ব্র্যাকের পক্ষ থেকে একটা সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। সভাটি হয়েছিল মানিকগঞ্জে। সেখানে স্থানীয় পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি সড়ক দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠনের জন্য জোর দাবি তুললেন। তিনি তার এ সংক্রান্ত একটা অভিজ্ঞতার কথাও বললেন।

একবার ঢাকা-মানিকগঞ্জ সড়কে ঢাকার কাছাকাছি কোনো এক জায়গায় একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায়। হতাহতের সংখ্যা ছিল অনেক। সবাই দায়ী করছিল চালককে, চালকের অবহেলার কারণে এটা ঘটেছে। চালককে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। ওই নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে ঘটনাটি খতিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন, সত্যিকার অর্থে কে দায়ী তা বোঝার জন্য।

তিনি দেখলেন, দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ির সামনের একটা চাকা চুপসে আছে। পরে দেখা গেল, ওই চাকাটি কয়েকদিন আগে পরিবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু পরিবর্তন করে যে চাকাটি লাগানো হয়েছিল তা একটা পুরনো মেরামত করা চাকা। এর অর্থ হচ্ছে, গাড়ির মালিক টাকা বাঁচানোর জন্য (একটি নতুন চাকার জন্য খরচ হয় আঠারো থেকে বিশ হাজার টাকা) পুরনো, মেরামত করা চাকা লাগিয়েছিলেন (মাত্র ১৮০০ টাকায়)। ওই চাকাটি আকস্মিকভাবে বার্স্ট হওয়ার কারণেই গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে গিয়েছিল।

এখানে কে দায়ী তা স্পষ্ট।

সড়ক দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি সত্যিই দরকার। নামের তদন্ত কমিটি নয়, আক্ষরিক অর্থে কাজের। না, আমি সকল রোড ক্রাশের জন্য তদন্ত কমিটির সুপারিশ করছি না, তাতে কমিটির পাহাড় তৈরি হবে এবং সেই পাহাড় অপসারণের জন্য পরবর্তীতে নতুন নতুন প্রকল্পের প্রয়োজন পড়বে। ঘটনার গুরুত্বানুসারে এ ধরনের কমিটি করে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পারলে, আমার ধারণা, সড়কে প্রবঞ্চনা অনেকটাই কমবে।

কিন্তু গোড়াতেই তো গলদ রয়েছে। যে প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলাম। সাত খুনের জন্য যে ভাইব্রেশন, যে মাত্রার উৎকণ্ঠা, যে ত্বরণ-সরণ এবং ক্ষরণ, তার কিয়দংশও দেখি না লঞ্চ দুর্ঘটনায় ব্যাপক সংখ্যার প্রাণহানিতে কিংবা প্রতিদিন প্রায় ৫০ জন মানুষের রোড ক্রাশে খুনের ঘটনায়। যেন এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। যেন এটা মলত্যাগ করার মতো প্রাকৃতিক, আহার করলে তো ওটা ত্যাগ করতেই হবে। অর্থাৎ আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এর জন্য দায়ী।

অবশ্য রোড ক্রাশের প্রকৃতিও অনেকাংশে দায়ী। এটা ঘটে এখানে-ওখানে বিচ্ছিন্নভাবে, খানিকটা নিঃশব্দে। তাই চোখে পড়ে না। আর চোখে পড়লেও মনে দাগ কাটে না। ঘটনা ঘটে, টেলিভিশনের স্ক্রিনে হামাগুড়ি দিয়ে যায় বার্তা– ''অমুক জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনায় এত জন মারা গেছে, আহত হয়েছে আরও এতজন।'' স্ক্রল সরে যায়, আর আমরা ভুলে যাই।

তারপর কোনো জায়গায় ভ্রমণের প্রয়োজন পড়লে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে গাড়িতে উঠি। যখন দেখি চালক বেপরোয়া গাড়ি চালাচ্ছে, ত্রাহি অবস্থা হয়, ভাবি এর শেষ কোথায়। ভ্রমণ শেষে ফের ইস্যুটা মাথা থেকে বেরিয়ে যায়।

তাই বড় কিছু করতে হলে প্রথমে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। রোড ক্রাশ মলত্যাগের মতো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। আমি আবার বলছি, এটা সংঘটিত অপরাধ। এটা মৃত্যু নয়, হত্যা। খুন। সড়কে ঠাণ্ডা মাথায় চালানো হত্যাযজ্ঞ। নেপথ্যে আছে এক বা একাধিক খুনি।

ওই মানিকগঞ্জেই অন্য একটা সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত মতবিনিময় সভায় মানিকগঞ্জের এসপি মহোদয় একটা কথা বলেছিলেন সেদিন। কথাটা এ রকম– সারাদেশে রেজিস্টার্ড গাড়ির সংখ্যা ২০ লাখের মতো। বিআরটিএর মতে, লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকের সংখ্যা ১১ লাখ। ২০ লাখ বিয়োগ ১১ লাখ, সমান ৯ লাখ। এই ৯ লাখ ঘাতক দেশব্যাপী কিলবিল করে বেড়াচ্ছে, আপনাকে হত্যা করার জন্য।

সত্যিই, এরা তো চালক নয়। এরা কেউ হেলপার, কেউ কন্ডাক্টর। লাইসেন্স ছাড়া আমরা কাউকে তো চালক বলতে পারি না। এদের হাতে যখন গাড়ির স্টিয়ারিং, পায়ের নিচে যখন ব্রেক প্যাডেল, তখন এরা দুর্নিবার, বেপরোয়া। যেহেতু এরা আইন-কানুন জানে না, তাই সেগুলো মান্য করার বাধ্যবাধকতা এদের নেই। যেহেতু এরা বেআইনি, তাই আইন পদদলিত করাতেই এদের সুখ। তীব্র গতি এদের কাছে রোমাঞ্চকর। এরা স্টিয়ারিং নিয়ে খেলায় মেতে ওঠে। মৃত্যু মৃত্যু খেলা।

বিআরটিএকে বলব, এই ৯ লাখ ছদ্মবেশি চালককে শনাক্ত করুন। তাদের সত্যিকারের চালক বানিয়ে তুলুন। প্রয়োজনে জেলায় জেলায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলুন। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে প্রশিক্ষিত ইন্সট্রাক্টর নিয়োগ করুন। প্রয়োজনে ভুয়া চালকদের প্রণোদনা দিয়ে আকর্ষণ করুন। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিয়ে অগ্রসর হোন। দরকার হলে এনজিওদের সম্পৃক্ত করুন। এই ৯ লাখ ভুয়া চালককে যদি দক্ষ এবং বৈধ চালকে রূপান্তর করতে পারা যায়, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, রোড ক্রাশ অর্ধেক কমে যাবে।

পরিশেষে, ওই এসপি মহোদয়ের একটি কথা দিয়ে নিবন্ধের সমাপ্তি টানব– "আমাদের মহাসড়কগুলোকে তো কোনোভাবেই মহাসড়কের সংজ্ঞার ভেতর ফেলা যায় না।" কথাটা কতটা সত্যি তা আমি আপনি আমরা সবাই জানি। মহাসড়ককে মহাসড়ক হতে হলে কিছু শর্ত তাকে পূরণ করতে হয়। যেমন, এদিকে দুই লেন ওদিকে দুই লেন মিলিয়ে কমপক্ষে চার লেন থাকতে হয়। স্বল্পগতির যানবাহন সেখানে চলাচল করতে পারে না। সড়কের মাঝখানে যাতে গরু-ছাগল চলে আসতে না পারে তার জন্য বেষ্টনি থাকতে হয়। স্পষ্টভাবে প্রয়োজনীয় সকল সড়ক চিহ্ন ও সংকেত থাকতে হয়। মহাসড়কে আইনের লঙ্ঘন থামাতে পর্যাপ্ত ফোর্স থাকতে হয় ইত্যাদি।

ক'টা শর্ত আমাদের তথাকথিত মহাসড়কগুলো পূরণ করছে? প্রশ্নটা রাখছি পাঠকদের কাছে। আর মিনতি রাখছি যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও সড়ক ও জনপথ বিভাগের সমীপে, মহাসড়কগুলোকে সত্যিকারের মহাসড়ক বানানোর কথা ভাবুন।

২০২০ সাল নাগাদ সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ৫০ শতাংশ হ্রাস এবং সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৩০ শতাংশ হ্রাস করার যে লক্ষ্য সরকারের রয়েছে, তা পূরণ করতে হলে ভাবনাটা কিন্তু ভাবতেই হবে।

অপূর্ব সাহা: ব্যবস্থাপক, ব্র্যাক সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচি।