আসন্ন বাজেট: কতিপয় তীর্যক পর্যবেক্ষণ

এম এম আকাশ
Published : 11 April 2018, 03:09 AM
Updated : 23 May 2014, 07:25 PM

ভূমিকা

বাজেট নিয়ে আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে কতগুলি গতানুগতিক আলোচনা হতে দেখা যায়। এটা এতটাই গতানুগতিক যে বাজেট প্রকাশিত হওয়ার আগেই আমরা বলে দিতে পারি যে কোন রাজনৈতিক দল বাজেট প্রসঙ্গ কী বলবে! সে জন্য তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে সাধারণ নাগরিক মধ্যবিত্তের মনে কোনো কৌতূহলও নেই।

বাংলাদেশে রাজনীতিবিদ (সরকারি দল, বিরোধী দল, তাদের সহযোগী দল এবং বামপন্থী নানা রঙয়ের নানা দল), অর্থনীতিবিদ, চিন্তাবিশারদ প্রতিষ্ঠানসমূহ (Think Tanks like CPD), ব্যবসায়ী সংগঠনসমূহ, তথাকথিত 'দাতা' সংগঠনসমূহ, বিভিন্ন পেশাজীবী গণসংগঠনসমূহ এবং আমজনতাও বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া/মন্তব্য প্রকাশ করেন।

সাধারণভাবে দেখা যায় বামপন্থীরা একে 'গরীব মারার বাজেট' হিসেবে আখ্যায়িত করেন (যেটা নতুন বা অস্বাভাবিক নয়, কারণ ধনীরাই তো ক্ষমতাসীন), বিরোধী দল বাজেটকে 'গণবিরোধী', 'ব্যর্থ', 'অবাস্তব' ইত্যাদি বিভিন্ন নেতিবাচক বিশেষণে অভিষিক্ত করেন, যদিও তারা কখনওই বলেন না যে, ক্ষমতায় থাকলে তারা কী করতেন।

সরকার অবশ্য এসবের বিপরীতে দাবি করেন 'বাজেট ভালো হয়েছে', অথবা বড়জোড় বলেন, 'বাজেট উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিন্তু বাস্তবায়নযোগ্য'। চিন্তাবিশারদরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখান বাজেটে কোথায় কোথায় কী কী অসঙ্গতি রয়েছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা সাধারণত তাদের সামষ্টিক ও খাতওয়ারি স্বার্থ থেকে কর, ঋণ ও ভর্তুকি বিষয়ে বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরেন।

বিভিন্ন পেশাজীবী গণসংগঠনসমূহ তাদের নানা সুনির্দিষ্ট প্রত্যাশা ও হতাশা ব্যক্ত করে থাকেন। তথাকথিত 'দাতারা' সাধারণত প্রবৃদ্ধির হার, মুদ্রাস্ফীতি, ভর্তুকি প্রত্যাহার, আমদানি শুল্ক হ্রাস, ঋণ সংকোচন, প্রাইভেটাইজেশন এবং সুশাসন নিয়ে কথা বলে থাকেন।

সর্বশেষে, আমজনতার প্রতিক্রিয়াগুলি আমি নিচে সহজ ভাষায় তুলে ধরছি–

১. আমার নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম বাড়বে কি?

২. বাড়িভাড়া, গ্যাস-পানি-বিদ্যুত ইত্যাদি চার্জের পরিমাণ বাড়বে কি?

৩. শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় কোনো উন্নতি হবে কি?

৪. সকলের জন্য খাদ্য-নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকবে কি?

৫. বাজেট কি গালভরা বুলিই হবে, নাকি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় আমাদেরও কণ্ঠস্বরের অধিকার (Voice Right) এবং অংশগ্রহণের অধিকার (Participation Right) থাকবে?

প্রতি বছর এসব তর্ক-বিতর্ক নিয়ে কিছুদিনের জন্য খবরের কাগজ ও টক শোগুলি সরগরম থাকলেও, পরবর্তীতে আমরা ধীরে ধীরে সব ভুলে যাই এবং একসময় নতুন বাজেটের সময় চলে আসে।

চলতি বছরের বাজেট সম্পর্কে যা বলা হয়েছিল

২০১৩-১৪ সালের বাজেট প্রস্তাব সে বছরের জুন মাসে যখন জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়, তখন নিম্নোক্ত প্রধান প্রতিক্রিয়াগুলি ব্যক্ত হয়েছিল–

১. বিভিন্ন সংবাদপত্রে তখন যে শিরোনামগুলি প্রকাশিত হয়েছিল তা হচ্ছে–

''প্রস্তাবিত বাজেট কি ফুলানো-ফাঁপানো বাজেট" (Financial Express), "ব্যয়বহুল বাজেট কিন্তু কৃপণ পরিকল্পনা" (Daily star)। 'প্রথম আলো' অর্থমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে শিরোনাম করেছিল Budget of Indecent Hope (উচ্ছ্বাসের বাজেট) ইত্যাদি।

১. বিএনপি নেতা মওদুদ আহমেদ বলেছিলেন, ''বাজেট হচ্ছে একটি বৃহৎ সুন্দর বেলুন"।

২. বামপন্থীরা কালো টাকা সাদা করার সুযোগের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।

৩. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাক্তন উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান বলেছিলেন, ''এই বাজেটের প্রস্তাবিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না।"

৪. সিপিডির সম্মানিত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ''অব্যাহত ব্যাংক ঋণ সরকারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে।" সিপিডি বাজেটকে 'পরাবাস্তব বাজেট' (Surreal Budget) হিসেবে অভিহিত করেছিল।

৫. ব্যবসায়ীরা বিদ্যুত ও জ্বালানি খাত ও বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশের অভাব নিয়ে সোচ্চার ছিলেন।

৬. জনগণ ও পেশাজীবীরা সাধারণভাবে মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্যনিরাপত্তা, মহার্ঘ ভাতা ইত্যাদি বিষয়ে শঙ্কিত ছিলেন।

এখন প্রশ্ন হল, গত এক বছরে এই আশঙ্কাগুলি কতটুকু সত্য হয়েছে?

প্রস্তাব ও বাস্তবতা

নতুন বাজেট বক্তৃতা হবে আগামী ৭ জুন। তার আগে আমরা চলতি বছরের সরকারি আয়-ব্যয়ের অফিশিয়াল সংশোধিত পরিমাপগুলি হাতে পাব না। ফলে এই মুহূর্তে এ বিষয়ে কংক্রিট কোনো পর্যালোচনা সম্ভব নয়। সাধারণভাবে এটুকু বলা যায় যে, সরকার এবারও হয়তো যে আয়-ব্যয়ের প্রস্তাব করেছিলেন তা পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে পারেননি।

অবশ্য সরকার সমর্থকরা দাবি করছেন যে, ''স্বয়ং ফেরেশতা এলেও বাজেটের ১০০ শতাংশ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।'' কিন্তু সংশোধিত বাজেটে যদি দেখা যায় যে, গড়ে বা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকার তার প্রস্তাবিত আয়-ব্যয়ের তুলনায় ১০ থেকে ২০ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছেন, তাহলে বলতেই হবে যে, ব্যক্ত আশংকাসমূহ সত্যে পরিণত হয়েছে।

এখন পর্যন্ত দুটি Scoop News বা বেসরকারি খবরে জানা গেছে যে, প্রস্তাবিত এডিপি ছিল ৬৫.৮৭ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু সংশোধিত ব্যয় হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। স্থানীয় রাজস্ব সংগ্রহের প্রস্তাব ছিল ৪১.৩০ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু সংশোধিত পরিমাপটি হচ্ছে ৩৩.৮০ কোটি টাকা।

সরকার ভেবেছিলেন, বিদেশি সাহায্য আসবে ২৪.৫৩ কোটি টাকা, কিন্তু আসলে এসেছে মাত্র ২১.২০ কোটি টাকা। এই অংকগুলি সত্য হলে ঘাটতিগুলির মাত্রা দাঁড়াবে যথাক্রমে ৯ শতাংশ (এডিপি), ১৮ শতাংশ (স্থানীয় রাজস্ব) এবং ১৪ শতাংশ (বৈদেশিক সাহায্য)।

বিদ্যুত নিয়ে সরকারের অবস্থা শাঁখের করাতের মতো হয়েছে। সরকার জরুরিভাবে বিদ্যুত দিতে গিয়ে বিদ্যুতের দামই শুধু বাড়ায়নি, ওই বর্ধিত দাম বা ইমার্জেন্সি ব্যবস্থা থেকে সরে আসতে পারছেন না। 'কুইক রেন্টাল' বন্ধ করে রাষ্ট্রীয় খাতে বিদ্যুত উৎপাদনে অগ্রাধিকার দিলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।

বাপেক্সকে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে স্থলভাগের গ্যাস ব্লকগুলিতে তাদেরই অনুসন্ধান ও কূপ খননের দায়িত্ব দিলেও এ সমস্যার সমাধানে ইতিবাচক অগ্রগতি সম্ভব। কিন্তু কায়েমী দেশি-বিদেশি স্বার্থের সঙ্গে সংগ্রাম করেই এ ক্ষেত্রে এগুতে হবে। তাই এখানে বামপন্থী ও সাধারণভাবে সৎ ও দেশপ্রেমিক শক্তিকেই এগিয়ে আসতে হবে।

কতিপয় জরুরি করণীয়

একথা ঠিক যে, অর্থনীতিবিদরা 'প্রচুর ঘাটতি', বল্গাহীন বাজেট ব্যয়ের ফলে 'ডাবল ডিজিটের মুদ্রাস্ফীতি" ইত্যাদি যেসব আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন, তা সত্য হয়নি। সরকার মহার্ঘ ভাতা কিছু পরিমাণে ও ন্যূনতম মজুরি ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি করলেও, বাজারে মৌলিক খাদ্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু উৎপাদক কৃষকের এতে অসুবিধা হয়েছে।

বিশেষত, অপরিকল্পিত আলু উৎপাদন, উপযুক্ত হিমাগার ও গুদামের সুবিধার অভাব, রপ্তানি বাজারের সঙ্গে কৃষিপণ্যের স্থানীয় বাজারের উল্লম্বিক সমন্বয়হীনতা (Lack of Vertical Integration) ইত্যাদি কাঠামোগত অসুবিধার দরুণ মধ্যসত্বভোগীদের হটিয়ে যুগপৎ ভোক্তা ও কৃষকের সমস্যার সমাধান সহজসাধ্য নয়। কিন্তু আগামী বাজেটে এ ক্ষেত্রে সুচিন্তিত সুপারিশের প্রয়োজন রয়েছে।

গ্যাস, পানি, বিদ্যুত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বন্দর, আইন-শৃঙ্খলা ইত্যাদি পাবলিক সার্ভিসসমূহের গুণ ও পরিমাণ বৃদ্ধির পরিকল্পনা ও Smart Target প্রণয়ন করতে হবে। লক্ষ্যমাত্রাগুলি হতে হবে 'সুনির্দিষ্ট', 'পরিমাপযোগ্য', 'জনসম্পৃক্ত', 'বাস্তবায়নযোগ্য' এবং 'সময়সীমা বিশিষ্ট'। চলতি বছরের ব্যর্থতাগুলি খোলামেলা স্বীকার করে আত্মসমালোচনা করতে হবে।

এছাড়া গণতন্ত্র, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা ও পাশাপাশি মৌলবাদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃৃতিক শক্তিকে পরাজিত করতে না পারলে, ভবিষ্যতে আমাদের বাজেট-সংক্রান্ত সকল আলোচনাই অসার কচকচানিতে পরিণত হবে।

ড. এম এম আকাশ: অর্থনীতিবিদ; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।