র‌্যাব থাকবে কি থাকবে না

Published : 22 May 2014, 08:45 PM
Updated : 22 May 2014, 08:45 PM

সত্যিই কি র‌্যাব আমাদের দরকার? র‌্যাব কি তার প্রয়োজনীয়তা হারিয়েছে? এখনই কি সরকারের র‌্যাব গুটিয়ে নেবার সময়?

বক্তৃতায় যা ইচ্ছে তাই বলায় অভ্যস্ত রাজনীতিকরা প্রশ্নগুলোর খুব সহজ উত্তর দিয়ে ফেলেন।

বিএনপির প্রধান এখন র‌্যাবের বিলুপ্তির পক্ষে। ওদিকে সরকারের মন্ত্রীরা র‌্যাবের পক্ষ নিয়ে পাল্টা তীর ছুঁড়ছেন। খালেদা জিয়া যখন এ বাহিনী গড়ে তুলছিলেন, আজকের এই মন্ত্রীরাই তখন এর মধ্যে কোনো ন্যায্যতা বা যৌক্তিকতা খুঁজে পাননি।

এসব বাদানুবাদে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয় তা হল র‌্যাবকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের সর্বজনীন অভিযোগটি। কেউ বলতেই পারেন, খালেদা জিয়া একসময় এটিকে 'ব্যবহার' করেছেন। আর এখন যে দল ক্ষমতায় আছে তাদের এই বাহিনীটিকে দরকার, তাই তারাও তাদেরকে কাজে লাগাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, রাজনৈতিক ব্যবহার শব্দটি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন আপনি?

দেশের বড় বড় শহরে যদি তীব্র সহিংস কোনো বিক্ষোভ বা আন্দোলনে পরিস্থিতি পুরোপুরি ভেঙে পড়ে, তখন শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে ত্বরিৎ পদক্ষেপ নিতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে, র‌্যাবকে যদি নৈরাজ্য দমনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, এককভাবে অথবা অন্য বাহিনীগুলোর সঙ্গে, তাকে কি রাজনৈতিক ব্যবহার বলা যায়?

উগ্রপন্থীরা গত কয়েক বছরে যেভাবে সহিংসতা চালিয়ে প্রায়ই দেশ অচল করে দিয়েছে, তা দমনের জন্য নিয়মিত বাহিনীর চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী একটি বাহিনীর দরকার রয়েছে। অপারেশন পরিচালন ক্ষমতা ও দক্ষতার ব্যাপারে র‌্যাব উন্নততর। কারণ এ বাহিনীতে রয়েছেন সশস্ত্রবাহিনীর প্রশিক্ষিত সেনা ও কর্মকর্তারা। ফলে র‌্যাব অনেকের জন্যই 'ত্রাস' হয়ে উঠেছে।

কাজেই বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট দরকার। এই ইউনিটের হাতে থাকতে হবে উন্নততর সরঞ্জাম, বেশি কার্যকর অস্ত্রশস্ত্র এবং সবচেয়ে বেশি যেটি দরকার, আরও দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি, যাতে তারা দ্রুত অপারেশন চালানোর ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না যে, পুলিশকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ফৌজদারি বিচারিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেও কাজ করতে হয়।

যে কোনো সুশৃঙ্খল সমাজে পুলিশ এসব দায়িত্ব ভালোভাবেই পালন করে থাকে। কিন্তু সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা, যাদের রয়েছে 'হত্যা' করার মতো প্রশিক্ষণও, তাদের পক্ষে কি ভালো পুলিশ কর্মী হওয়া সম্ভব, যেখানে পুলিশকে অপরাধ প্রতিরোধের জন্যই মূলত শিক্ষা দেওয়া হয়? র‌্যাবের শ্রেষ্ঠত্বের যে ধারণা রয়েছে, তা তো আসলে গড়ে উঠেছে র‌্যাবের বেশিরভাগ কমান্ডার সশস্ত্র বাহিনী থেকে এসেছেন বলে। শুধু সামরিক প্রশিক্ষণের কারণেই কি তারা ভালো পুলিশ কর্মকর্তা হতে পারবেন? কোনো একদিন হঠাৎ করে যদি তাদের বলা হয়, বেসামরিক কর্মকর্তার ভূমিকা নিয়ে নিতে, তখন কি তাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার অংশ হিসেবে কাজ করার প্রস্তুতি থাকে?

যে কোনো মূল্যে দ্রুত সাড়া দিতে গিয়ে র‌্যাবের কার্যক্রমে মাঝে মাঝে আইন রক্ষার বিষয়টি গৌণ হয়ে যায়। প্রয়োজনের বেশি শক্তি প্রয়োগের অভিযোগটি র‌্যাবের বিরুদ্ধে হরহামেশাই উঠেছে। সঙ্গত কারণেই র‌্যাব এমন একটি বাহিনী হিসেবে প্রচার পেয়েছে যেটি আদালতে প্রায়ই অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

আশির দশকের মাঝামাঝিতে, এইচ এম এরশাদ নিজের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ বাহিনীর প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। তিনি সবকিছুতেই সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। প্রেসিডেন্টস সিকিউরিটি ফোর্স বা পিএসএফ গঠনের সময়ও তার ব্যত্যয় হল না। এই সামরিক শাসকের ক্ষমতাচ্যুতির পর নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সময় এ বাহিনীতে সামান্য পরিবর্তন আনা হয়। তখন সেটা ছিল শুধুমাত্র নামে– এটি হয়ে গেল স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স বা এসএসএফ। এই বাহিনীর হাতে আছে সর্বাধুনিক অস্ত্র এবং অনেকটা সর্বময় ক্ষমতা। এর দক্ষতা ও অপ্রতিরোধ্যতা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ধারণা তার মূল ভিত্তি হল ভিভিআইপিদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করলে ওরা যে কাউকে গুলি হত্যা করতে পারে এবং সেটি নিয়ে তাদের আদালতে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না।

[র‌্যাব-সংক্রান্ত এক টেলিভিশন সংলাপে; ১৩ মে, ২০১৪ তে প্রচারিত]

তার মানে, একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা অনেক সময় নির্ভর করে জনমনে ইতিবাচক ভাবমূর্তির ওপর। এই ভাবমূর্তি অনেকটাই খুইয়েছে র‌্যাব। তাদের বিচ্যুতির বিরাট তালিকায় নারায়ণগঞ্জ সর্বশেষ সংযোজন মাত্র।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের জন্ম এবং এর বিলুপ্তির দাবির মধ্যে সময়টা বেশি দিন নয়। গত মার্চে দশ বছর পূর্তি ঘটা করেই পালন করেছে এই বাহিনী। শুরু থেকেই ভালো দিক যেটা ছিল তা হল জাতীয় পুলিশ বাহিনীর মধ্যে একটি ইউনিট হিসেবে একে গড়ে তোলা। এদের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব দেশের পুলিশ প্রধানের হাতে। পুলিশেরই একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই অভিজাত বাহিনীর প্রধান (মহাপরিচালক)। সেই সঙ্গে পুলিশের মধ্যম সারির কিছু কর্মকর্তাও বিভিন্ন পর্যায়ে অভিযানের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু এই বাহিনীর অদূরদর্শী প্রতিষ্ঠাতারা ভবিষ্যৎ দেখতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তারা বুঝতে চাননি যে, এক সময় সেনা অফিসারদের সবাইকে ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে এবং পুলিশেরই চৌকশ কর্মকর্তারাই এই বাহিনীর পুরোপুরি দায়িত্বে থাকবেন। তাদের বুঝতে না পারার কারণ হল জাতি হিসেবে সম্মিলিতভাবে অনেক সময়ই এ বিষয়গুলো বোঝার ব্যর্থতা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে এটা স্বীকার করা হয়নি যে, আইন-শৃঙ্খলা থেকে শুরু করে ভিআইপিদের সুরক্ষা — সবগুলো কাজের ধরনই আসলে অসামরিক।

সম্প্রতি পুলিশ বাহিনী সোয়াট বা এসপিবিএনের মতো ইউনিট গড়ে তুলেছে। সোয়াট হল 'স্পেশাল ওয়েপনস অ্যান্ড ট্যাকটিকস' ইউনিট; এটি ঢাকা-ভিত্তিক এলিট ট্যাকটিক্যাল ফোর্স। ২০০৯ এর শুরু থেকে কাজ করছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার অংশ হিসেবে। পুলিশ অফিসাররা বলেন, দেশে-বিদেশে সোয়াটের যে প্রশিক্ষণ রয়েছে, তা দিয়ে সন্ত্রাসী আক্রমণ প্রতিরোধ বা জিম্মি উদ্ধারের মতো কাজ দক্ষতার সঙ্গে করা সম্ভব।

স্পেশাল আর্মড ফোর্স বা সাফের ইউনিট রয়েছে দেশের চৌষট্টি জেলাতেই। বিশৃঙ্খলা ঠেকানো, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রোধ, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনা, এমনকি সংঘবদ্ধ অপরাধ দমনের মতো জরুরি পরিস্থিতির উপযোগী করে ইউনিটটি গড়ে তোলা হয়েছে।

এই তো মাত্র ২০১২-তেই, কেবল পুলিশ বাহিনীর লোকজন দিয়ে 'স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন' বা এসপিবিএন গড়ে তোলা হয়েছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য ভিভিআইপিদের সুরক্ষা দেওয়া। আশা করা যেতেই পারে, ভিভিআইপিদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য কোনো একদিন এই বাহিনী সেনা-নিয়ন্ত্রিত এসএসএফের স্থলাভিষিক্ত হবে।

তবে যতদিন না এ বাহিনীগুলোর পুরোপুরি অসামরিকীকরণ সম্ভব হচ্ছে, ততদিন র‌্যাবকে তার সেনা-নিয়ন্ত্রিত কাঠামো নিয়েই পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট হয়ে হয়তো থাকতে হবে। এই বাহিনীর অনেক দোষত্রুটি থাকলেও সেগুলো কমিয়ে আনা সম্ভব, চেষ্টা এবং আন্তরিকতা থাকলে।

এজন্য যা যা করা দরকার সে তালিকা দীর্ঘই হবে; তবে একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। তিন বছরের জন্য কোনো জুনিয়র বা মধ্যম সারির সেনা কর্মকর্তাকে যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তার অধীনে কাজ করতে হয়, তাহলে বিষয়টি আসলে কী দাঁড়ায়? ওই সেনা কর্মকর্তার কাজের মূল্যায়ন ওই পুলিশ কর্মকর্তা কার্যত কতটা করতে পারবেন? এ জন্যই কি চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার অসংখ্য ঘটনা ঘটছে? নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় পুলিশকে কেন সন্দেহভাজন কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার বা আটক করতে অন্য কারও অনুমতি নিতে হল? ওদের ধরতে পুলিশকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে অবহিত করতে হতেই পারে, এ ক্ষেত্রে যেমন সেনা ও নৌবাহিনীকে করা হয়েছে। এই একটি ঘটনাই কিন্তু এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করছে যেখানে আসলে চেইন অব কমান্ড কাজ করে না।

এটা ঠিক যে, আমাদের ব্যস্ত সড়ক বা অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানো কালো পোশাক পরিহিত অস্ত্রধারী এই বাহিনীর সদস্যরা ছোট ছোট অপরাধ ঠেকায় এবং যে কারও মনে র‌্যাব হেফাজতের ভয় ধরিয়ে দেয়।

কিন্তু বিভিন্ন কথিত এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধে র‌্যাব যতগুলো খুন করেছে সেগুলো তাদের 'গৌরবময়' দশ বছরের ইতিহাসে একেকটি কালো অধ্যায়। তাদের এসব খুনের প্লটও বেশ কাঁচা– এমন সব মস্তিষ্ক থেকে এসব বেরিয়েছে যাদের এটা বিশ্বাস করতে শেখানো হয় যে, পৃথিবীর সমস্ত প্রজাতির অবস্থান তাদের নিচে (তাদের চেয়ে অনেক কম বোঝে)। সমস্যা হল, গত কয়েক বছরে র‌্যাব এসব দায় থেকে পার পেয়ে গেছে রাজনৈতিক পালাবদলে পাল্টে যাওয়া ক্ষমতাসীনদের সমর্থনের কারণে। তাদের এভাবে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার নীতি আসলে হিতে বিপরীত হয়েছে। এখন র‌্যাব অনেক কম বিশ্বাসযোগ্য। আর সাধারণ মানুষের আস্থা হারালে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সাধনও কঠিন হয়ে যায়।

কার্যত সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন এই বাহিনীকে একদিন বিলুপ্ত করতেই হবে। যত তাড়াতাড়ি হয়, তত মঙ্গল। কারণ র‌্যাবের এই ধরনের কার্যক্রমে সশস্ত্র বাহিনীই দুর্নাম কুড়াবে। সশস্ত্র বাহিনীর সুনাম ধরে রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ– বাংলাদেশের মতো গরিব দেশকে সেনাবাহিনী গড়ে তোলা এবং ব্যবস্থাপনায় বিপুল বিনিয়োগ করতে হয়। সরকার যদি র‌্যাবকে যেমন আছে তেমন রেখে দিতে চায়, তাহলে দ্রুতই এই বাহিনীর ভাবমূর্তি ঠিকঠাক করতে হবে– কেননা এটার সঙ্গে সরকারের ভাবমূর্তি জড়িত। এলিট ফোর্সটির সুনাম ক্ষুণ্ন করছে যেসব অশুভ উপাদান, তাদের শেকড় যেখানেই হোক সেসবের সমূলে উৎপাটন জরুরি।

খালেদা জিয়ার উদ্দেশে একটি সহজ প্রশ্ন, যে সব কারণে এ রকম একটি বিশেষ বাহিনী গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা আপনি অনুভব করেছিলেন, তার কতটুকু পাল্টে গেছে? একই প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে, ২০০৪ সালের চেয়ে কি এখন দেশের অবস্থা বেশি খারাপ?