নদীপথে যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তা উপেক্ষিত কেন

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 21 May 2014, 07:15 PM
Updated : 21 May 2014, 07:15 PM

মুন্সিগঞ্জ জেলার গজারিয়া থানার সন্নিকটে মেঘনা নদীতে ১৫ মে, ২০১৪ ডুবে গেল এম ভি মিরাজ-৪ নামক একটি লঞ্চ, যার মধ্য থেকে ৫৫ জন যাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করেছে বাংলাদেশ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের ডুবরিরা। মেঘনা নদীর দু'ধারে স্বজনহারা অসংখ্য মানুষের মর্মস্পশী করুণ আর্তনাদ গণমানুষের হৃদয় করেছিল বিচলিত, আবেগে উদ্বেলিত। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল জনগণ। সাধারণ জনগণের ক্রোধ, তাদের আক্ষেপ ও আক্রোশ কোনোক্রমে সামাল দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। লঞ্চের মালিকও মুত্যুবরণ করেছে বলে জানা যায়।

লঞ্চডুবিতে অগণিত যাত্রীর মৃত্যুবরণ মনে হয় সাধারণ ব্যাপার এবং প্রতি বছর এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ এবং প্রতিনিয়ত। প্রতিটি দুঘর্টনার পর নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, সমুদ্র-পরিবহন দপ্তর, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহন কর্পোরেশন তদন্ত কমিটি গঠন করে দুঘর্টনার কারণ অনুসন্ধানের প্রয়োজনে এবং দোষী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে শাস্তি বিধানের লক্ষ্যে।

জানা যায়, এমন প্রায় দু'শ তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে কিন্ত মাত্র সাতটি কমিটির রির্পোট জনগণ জানতে পেরেছে। মেরিন কোর্টের ম্যাজিষ্ট্রেটগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শাস্তিস্বরূপ কিছুদিনের জন্য নৌযানের লাইসেন্স বাতিল করেন। এভাবেই চলছে নিরাপত্তা ও নৌ-প্রশাসন।

"নিরাপদ সমুদ্র পরিবহন এবং পরিচ্ছন্ন নদী বন্দর" হচ্ছে বর্তমান বিশ্বে অন্যতম শ্লোগান। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে নৌপথের যাত্রীদের নিরাপত্তা বিধান এবং নৌযানসমূহের চলাচলের নিশ্চয়তা বিধান করে নাবিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক কিছু কনভেনশান প্রণীত হয়েছে যার স্বাক্ষরকারী দেশ বাংলাদেশ।

এসবের মধ্যে অধিকভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সমুদ্রে জীবনের নিরাপত্তা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশন (International Convention on Safety of Life at Sea), জাহাজ থেকে সমুদ্র দূষিত করা প্রতিরোধ সংক্রান্ত আর্ন্তজাতিক কনভেনশন (International Convention on the Prevention of Pollution from Ships) এবং প্রশিক্ষণের মান সংরক্ষণ করে সার্টিফিকেট দান এবং সমুদ্রে ভ্রমণকারী নাবিকদের উপর প্রখর নজরদারি করা (International Convention on the Standard of Training, Certification and Watch-Keeping for sea-farers)।

বাংলাদেশে নৌ-দুর্ঘটনার কারণ অনেক এবং বিবিধ। তবে অন্যতম হচ্ছে লঞ্চ, স্টিমার ও জাহাজের অবকাঠামো বা নকশা নির্মাণ, যাতে থাকে ব্যাপক ত্রুটি। বেশিরভাগ বাণিজ্যিক নৌযানের তলার দিক সরু করে উপর প্রশস্ত করা হয়, যাতে অধিক যাত্রীর স্থান সঙ্কুলান করা যায় এবং নৌযানটি দ্রুত চলতে পারে। ফলে সামান্য ঝড়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে নৌযানটির সলিল সমাধি ঘটে।

বিশ্ব ব্যাংকের একটি সমীক্ষায় লক্ষ্য করা যায় যে, বাংলাদেশে অভ্যন্তরীন জল পরিবহনে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের কারণে দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ৩৪ শতাংশ, মাস্টারের অবহেলার কারণে হয়েছে ২৩ শতাংশ, পরস্পরে সংঘর্ষের কারণে হয়েছে ২২ শতাংশ এবং কৌশলগত কারণ, খারাপ আবহাওয়া, আগুন লাগা এবং ডুবোচরে আটকে যাওয়ার কারণে দুঘর্টনা সংঘটিত হয়েছে অবশিষ্ট ২১শতাংশ ।

বিশ্ব ব্যাংকের ১৯৯০ সালের স্টাফ অ্যাপ্রেইসাল রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে অভ্যন্তরীন নদীপথে নৌযান ডুবে যাওয়া বা দুঘর্টনা প্রতিরোধ করা ব্যাপকভাবে সম্ভব যদি নদীপথে নৌ-চলাচলে সহায়ক চিহ্ন বা যন্ত্রসমূহ স্থাপন করা যায় এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।

নাবিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ হচ্ছে অপর একটি বিশেষ প্রাধিকারপ্রাপ্ত দিক। সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, অধিকাংশ নৌযানের নিরাপত্তা বিধানে অবজ্ঞা বা উদাসীনতা হচ্ছে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। নৌযানসমূহ যে সকল তথ্য বা ডাটা প্রদান করে তা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়। বাংলাদেশে প্রতি বছরে প্রায় ২০০০ লোক নদীপথে চলাচল করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করছে। এ পরিস্থিতি ভয়াবহ এবং অমার্জনীয়। দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে নিরাপত্তার প্রতি কর্তৃপক্ষের অবজ্ঞা বা চরম উদাসীনতা।

নৌপথে চলাচলে লঞ্চসমূহকে সার্টিফিকেট প্রদানে হতাশাজনক দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ, রেজিস্ট্রেশন প্রদানে অথবা রুট নির্দিষ্ট করা এবং সময় নির্ধারণে এবং রেডিও সংযোগ দানে অসচ্ছতা বা শুদ্ধাচারের অভাব মুূলত দুঘর্টনার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আইনগত দুর্বলতা এবং তার প্রয়োগে পক্ষপাতিত্ব সমস্ত পদ্ধতিকে এমনভাবে কলুষিত করছে দিনের পর দিন, যার ফলে কোনো নৌযানের মালিক অথবা চালনাকারীকে দোষী সাব্যস্ত করা গেলেও শাস্তি প্রদান হয়ে উঠে দুরূহ।

সমুদ্র পরিবহন অধিদ্প্তর বাণিজ্যিক জাহাজ বা লঞ্চসমূহকে লাইসেন্স দেওয়ার প্রাক্কালে সর্তকতা অবলম্বন করেন না বলে অভিযোগ আছে। বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের সঙ্গে সঙ্গে নৌ-কর্তৃপক্ষের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ সংরক্ষণে আন্তরিকতা নেই, যার ফলে দুর্যোগের প্রাক্কালে কোস্ট গার্ড সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে পারে না এবং উদ্ধারকাজে অংশগ্রহণ করতে তাদের তৎপরতা দর্শনীয় হয় না।

দুঃখজনক হচ্ছে, একটি লঞ্চে কত যাত্রী উঠছে তার হিসাব বিআইডব্লিওটিসি অথবা বিআইডব্লিওটিএ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে না। অনেকে মনে করেন, এ হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং মালিকপক্ষের সঙ্গে অশুভ যোগসাধনের ফলশ্রুতি। অভিশপ্ত এম ভি মিরাজ-৪ এর মধ্যে বলা হয়েছে ২০০ যাত্রী ছিল। আবার অনেকের অভিযোগ হচ্ছে যাত্রীসংখ্যা ছিল প্রায় ৩০০ এর অধিক। এ সামান্য বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অপারগতা ও অদক্ষতা অমার্জনীয়।

বর্তমানে নৌ-চলাচল, প্রশিক্ষণ, সার্টিফিকেট দান এবং জলযানসমূহের লাইসেন্স প্রদানসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে ব্যাপকভিত্তিক অধিক্রমণ এবং দ্বৈততা বিরাজ করছে। সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর এবং মার্কেন্টাইল মেরিন বিভাগের প্রিন্সিপাল অফিসার এর মধ্যে একই কাজ দুজনেই করছে বা কে কোনটা করবে তার সীমা নির্ধারণের অভাব আছে। তেমনি অধিক্রমণ হচ্ছে বিআইডব্লিওটিসি এবং বিআইডব্লিওটিএ, এই দুটি সংগঠনের মধ্যে।

নৌপথের যাত্রীদের নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে নৌ-প্রশাসনে অনেক সংস্কার সাধন করতে হবে। কৌশলগত অনেক পরিবর্তন আনতে হবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টনের ক্ষেত্রে। সার্টিফিকেট প্রদান, জাহাজ এবং লঞ্চসমূহের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে একটি সংস্থার মাধ্যমে। জাহাজের নকশা অনুমোদন এবং ব্যাপক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিতে হবে।

বাংলাদেশে অনেক ব্যক্তি আছেন যারা সুইডেনের মালমোতে অবস্থিত ওয়ার্ল্ড মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৌ-সম্পর্কিত স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন এবং ইংল্যান্ডের কার্ডিফে অবস্থিত মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আমিও তাদের মধ্যে একজন। তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে।

সরকারকে নৌ-পরিবহনের ক্ষেত্রে অনেক বিনিয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ পদ্ধতি প্রয়োগ করে নৌপথের সর্বত্র আলোকিত বয়া, আলোক সংকেত স্থাপন, বাতিঘর দিয়ে দিনে-রাতে নৌ-চলাচলের পথ সুগম করতে হবে। একই সঙ্গে নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে প্রতিটি নৌযানের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে পর্যাপ্ত স্পিড বোট দিয়ে প্রতিনিয়ত টহলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ সকল কাজ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে নির্বাহ করা সম্ভব।

আন্তঃপরিবহণের সুযোগ ও সুবিধাসমূহের তুলনামুলক বিবেচনায় সড়ক এবং রেলপথের মধ্যে জলপথ হচ্ছে অনেক বেশি আর্কষণীয়। পরিবেশগত কারণ, স্বল্প ব্যয় এবং রক্ষণাবেক্ষণের বিবেচনায় বিভিন্ন দেশে নদীপথ অধিক ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই সরকারকে যেমন অধিক বিনিয়োগ করতে হবে, তেমনি নৌপথে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আর্কষণ করতে হবে।

নৌপথ একটি লাভজনক ও আর্কষণীয় বিনিয়োগের ক্ষেত্র। বাংলাদেশে একটি "জলপথ পরিবহন উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান" গড়তে হবে যেখানে নদী গবেষণা এবং নদী শাসনের উপর দেশীয় প্রজ্ঞা প্রয়োগ করে প্রচুর অগ্রগতি করা সম্ভব। অনেকের মতে, বিআইডব্লিওটিসি এবং বিআইডব্লিওটিএ, এই দুটি প্রতিষ্ঠান একীভূত করা জরুরি।

নিরাপত্তার বিধান লঙ্ঘনকারীদেরকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে এবং অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, নিরাপত্তার সামগ্রী ব্যতিরেকে নৌযান পরিচালনা এবং প্রশিক্ষণবিহীন মাস্টার কর্তৃক নৌযান চলাচল করলে লাইসেন্স বাতিলসহ দর্শনীয় শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি মৃত্যুর জন্য দায়-দায়িত্ব বহন করতে হবে। গরীব মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার মালিকানা কারও নেই, সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন।

সরকারকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। যাত্রীদের জীবন নিয়ে উপেক্ষা আর কতদিন এবং কেন, এ সবের জবাব চাইছে জনগণ।

ধীরাজ কুমার নাথ: সাবেক সচিব।