দায়িত্বশীলদের দায়হীনতা ও মৃত্যুর মিছিল

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 21 May 2014, 06:29 AM
Updated : 21 May 2014, 06:29 AM

''যখন নিজের চোখে দেখলাম প্রিয়জনদের হারিয়ে অজস্র মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়েছেন, ক্ষোভে-দুঃখে ফুঁসছেন, তখন মনে হল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমারই এই ঘটনার সম্পূর্ণ দায় স্বীকার করা উচিত৷আমাদের সমাজের প্রতিটি কোণায় নানা অনিয়ম নানা রকমভাবে চলছে৷ আশা করব, এই সব অন্যায় একদিন সমূলে উচ্ছেদ করা হবে এবং এই ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আর ঘটবে না।''

কথকের নাম চুং হং ওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ার পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী৷ গত এপ্রিলে দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি ফেরি-দুর্ঘটনা ঘটে৷তাতে মৃত এবং নিখোঁজের সংখ্যা ছিল ৩০০। অতঃপর চুংয়ের পদত্যাগ এবং উপরে উদ্ধৃত ওই বক্তব্য৷

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘটনাটি আমাদের দেশের খুব কম গণমাধ্যমে স্থান পেয়েছে। একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ পদ ত্যাগ করে এমন চলে যাওয়াটা 'নিউজ আইটেম' হিসেবে খুব একটা পাত্তা পায়নি। আমাদের বিবেকের দরজায় তেমনভাবে নাড়াও দিতে পারেনি এই ঘটনা।

না, আমাদের নৈতিকতাবোধ নেই। বিবেক-অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে। কোনো কিছু্তেই আমাদের ভাবান্তর হয় না। দায় কিংবা দায়িত্ববোধ আমাদের এতটুকু তাড়িত বা বিচলিত করে না।

গত সপ্তাহে মেঘনায় লঞ্চ ডুবে মারা গেলেন প্রায় অর্ধশত মানুষ। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন আরও অসংখ্য ব্যক্তি। ফিটনেসবিহীন লঞ্চটি তৃতীয়বারের মতো দুর্ঘটনার কবলে পড়লেও এই নিয়ে কারও বিচলন নেই। কোনো কর্তাব্যক্তি বললেন না যে, আমার দোষে এমনটা ঘটেছে, দায় আমার, আমি পদ ছেড়ে দিলাম। যোগ্য কেউ এসে আমার ত্রুটি-দুর্বলতাগুলো অতিক্রম করে এগিয়ে চলুক। ভবিষ্যতে এমন কোনো দুর্ঘটনা যেন না ঘটে, তা নিশ্চিত হোক।

নারায়ণগঞ্জে একসঙ্গে সাতজন মানুষ অপহরণ এবং খুন হলেন। এ নিয়েও দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তির মধ্যে ভাবান্তর লক্ষ করা গেল না। সবাই এমন আচরণ করেছেন, এমনভাবে কথা বলেছেন, যেন অপহরণ এবং খুন হওয়াটা মোটেও দোষের কিছু নয়। বরং এটাই স্বাভাবিক এবং সঙ্গত। খুন হওয়াটা যেন 'অধিকার'। যাদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ, খুনীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়-মদদ দেওয়ার অভিযোগ, তাদের আড়াল করবার, তাদের দায়মুক্তি দেবার একটা সচেতন প্রয়াস বরং দেখা যাচ্ছে। দায়িত্বশীল মহলের কথা-কাজ-আচরণ দেখে মনে হচ্ছে না যে তাদের উপর দেশের মানুষের নিরাপত্তা রক্ষার ভার রয়েছে। যারা মরেছে, অপহরণের শিকার হয়েছে– অপরাধটা যেন তাদের।

প্রধান যে অভিযুক্ত ব্যক্তি– আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথারীতি তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রধান অপরাধীদের খুঁজে পাওয়া যায় না। অপরাধীকে খুঁজে বের করা যার বা যাদের দায়িত্ব, তারা তাদের ব্যর্থতার জন্য কখনও দণ্ডিত কিংবা তিরস্কৃত হয়েছেন– এমন দৃষ্টান্তও বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যায় না। রুটিনমাফিক যে যার দায়িত্ব পালন করেন। কেউ কোনো কিছুর দায় নেন না। যে যেখানে যেভাবে বাঁচার কথা, সে সেখানে নির্মমমভাবে বেঘোরে জীবন হারাচ্ছেন। মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি– এদেশে এখন সবচেয়ে বাহুল্য প্রসঙ্গ!

পৃথিবীর উন্নত দেশে দায়িত্বশীলরা ঘটনার দায় নেন। যে ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে একজন দায়ী নন, তারপরও তিনি দুঃখপ্রকাশ করেন, অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদ থেকে সরে দাঁড়ান। আর আমাদের দেশে যিনি প্রত্যক্ষভাবে দায়ী– তিনিও ঘটনার জন্য এতটুকু দুঃখ প্রকাশ করেন না, পদত্যাগ তো অনেক দূরের কথা। যদি পদত্যাগের দাবি উঠে তাহলে বরং খেপে যান। পারলে পদত্যাগের দাবি উত্থাপনকারীকে কাঁচা চিবিয়ে খান! জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে ফেলেন!

এদিকে প্রতিকারহীন মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। গত মঙ্গলবার ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একরামুল হককে গাড়ির ভেতরে গুলি করে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। বেলা ১১টার দিকে ফেনী শহরে বিলাসী হোটেলের সামনে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় গাড়িতে তার সঙ্গে থাকা আরও তিনজন অগ্নিদগ্ধ হন।

এই পুড়িয়ে মারার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। স্থানীয় প্রশাসন, থানা-পুলিশ, কেউ মুখ খুললেন না, কেউ দায় নিলেন না। 'দলের লোক' বলেই কিনা জানি না, এ ঘটনায় শুধু মুখ খুলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনিও দায় নেননি, শুধু নির্দেশ দিয়েছেন!

না, কারও দায় নেই। কোথাও এতটুকু সহানুভূতি নেই। নেই বিবেকের দংশন। আমাদের দেশে কারও বিবেক এখন আর কথা কয় না। আমরা জীবন বাঁচাতে পারছি না। যারা মারছে, সেই খুনীদের ধরতে পারছি না। অন্যায় সয়ে, অন্যায়ে প্রশ্রয় দিয়ে আমরা প্রত্যেকে যেন একেকজন মানুষখেকো নরপিশাচ হয়ে উঠছি! মানুষের জানমালের প্রতি আমাদের দায় নেই, দায়িত্ব নেই। কী সরকারি দল, কী বিরোধী দল সবাই সমান বিবেকহীন, পাষণ্ড!

একটি ফেরি-দুর্ঘটনার দায় নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী গদি ছেড়েছেন। অথচ লঞ্চ বা ফেরি-দুর্ঘটনা কিংবা মানুষ খুনের এমন মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের দেশে প্রায়ই ঘটে থাকে। এটা আমাদের কাছে সুপরিচিত। সেই একই কান্না, সেই একই বেদনা, সেই একই ক্ষোভ, একই দায় এবং দায়িত্বহীনতা।

মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে লাশ দাফনের জন্য কয়েক হাজার টাকা দেওয়া হয়। একটি প্রহসনের তদন্ত কমিটি করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে লোকদেখানো কয়েকজনকে আটকও করা হয় (পরবর্তী সময়ে তাদের ছেড়ে দেওয়ার শর্তে)! মৃত্যু-প্রতিকারে আমাদের কর্তাব্যক্তিদের দায় এবং দায়িত্বের সীমা যেন এতটুকুই!

কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে শুনেছি কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলো। এই কথাগুলি এ দেশে কেউ বলেন না৷ প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা, ন্যূনতম দায়িত্বসহ যে ব্যক্তিটি একেবারে তৃণমূল স্তরে কাজ করছেন, তারাও বলেন কি? আমরাও কি আর আশা করি যে, তারা (উচিত) কথাটা বলবেন? ঝোড়ো হাওয়া তা-ও পোড়ো বাড়িটার ভাঙা দরজার কাছে পৌঁছুতে পারে, সে-ও সম্ভব, কিন্তু কোনো সরকারি কর্তাব্যক্তি, তা তিনি যে স্তরেই থাকুন না কেন, তিনি নিজমুখে কবুল করবেন যে, অন্যায় হয়েছে, দায় স্বীকার করছি!

আমাদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধগুলো খসে পড়ছে। আমাদের মনুষ্যত্ব, আদর্শ, বিবেকবোধ সব কিছু কবর কিংবা চিতায় শায়িত যেন। কোথাও কেউ নেই যে, দায় স্বীকার করে, খারাপ কিছু আর হতে দেব না– এই শপথে দায়িত্ব নেয়।

আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে তাই নৈতিক সাহস নামক জিনিসটি কার্যত উবে যাওয়ার দশায়৷ চুং হং ওয়ান যে কথাটি বলেছেন, অন্যায় চলছে মেনে নিয়ে তার দায় কবুল করেছেন, তা করার মতো নৈতিক সাহস এ দেশে কোথায়? কে বলবে, আমি সমস্ত দায় নিয়ে পদত্যাগ করলাম। কে বলবে, আমি দায়িত্ব নিলাম, যে কোনো মূল্যে অবক্ষয় ঠেকাব। দল বা দলীয় কর্মী নয়– মানুষকে, মনুষ্যত্বকে যে কোনো মূল্যে প্রতিষ্ঠিত করব।

আর আমাদের মধ্যেই-বা সেই সাহস কবে হবে যখন সমস্ত সংকীর্ণতা আর মোসাহেবীর ঊর্ধ্বে উঠে সমস্বরে চিৎকার করে বলব, 'রাজা, তোর কাপড় কোথায়'?

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।