উন্নয়ন ও সংস্কৃতি

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
Published : 27 Nov 2010, 12:12 PM
Updated : 27 Nov 2010, 12:12 PM

উন্নয়নের যেসব ধ্যানধারণা এবং কর্মকাণ্ডে বাইরে থেকে আমরা উদ্বেলিত হচ্ছি তা আমাদের ভেতরে আত্মস্থ ও সংহত করতে হবে আমাদের সংস্কৃতির সহযোগে। আমি আমার উন্নয়নের জন্য শিক্ষা বক্তৃতায় বলি, "উন্নয়ন হচ্ছে এক গুঞ্জন-শব্দ, গতি, অগ্রগতি ও প্রগতির দ্যোতক। উন্নয়নের সনাতনী তত্ত্ব অবকাঠামোগত ও বস্তুগত উন্নয়ন নিয়ে। উৎপাদন বৃদ্ধি, ভোগ ও পুঁজি ছিল মূল কথা। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত উন্নয়নের ধারণা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আলোচনায় সীমাবদ্ধ ছিল। জাতিসংঘ উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নকে সহায়তাদানের উদ্দেশ্যে ষাটের দশককে উন্নয়ন দশক হিসেবে ঘোষণা দেয়। ক্রমে ক্রমে উন্নয়নের ধারণার ব্যাপ্তি ঘটে। সত্তরের দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে যোগ হয় সামাজিক ন্যায়বিচার এবং আশির দশকে মানবপুঁজির প্রশ্ন। নব্বইয়ের দশকে যোগ হলো মানুষের দ্বারা, মানুষের জন্য, মানুষের উন্নয়নের একটা সামগ্রিক ধারণা।"

যে টেকসই উন্নতির কথা আমরা আজ অহরহ শুনি তার পঞ্চাশ রকম অর্থ করা হয়েছিল কয়েক বছর আগে। ইতোমধ্যে শব্দদ্বয়ের ব্যঞ্জনা আরো বেড়ে থাকতে পারে। টেকসই উন্নতির উদ্দেশ্য কেবল উৎপাদন, ভোগ এবং কাঁচামালের সরবরাহের নিশ্চয়তা বিধান নয়, এর সঙ্গে সামাজিক ন্যায়বিচার বা ন্যায়ের সম্পর্ক রয়েছে। এ সম্পর্কে আমাদের উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ আমাদের জীবৎকালের দিকে লক্ষ রেখেই সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের বংশধরদের প্রতি এক দায়িত্বে আমরা যেভাবে পৃথিবী ও পরিবেশকে পেয়েছিলাম তার উন্নতি যদি করতে না-ও পারি তাহলে ঠিক সে অবস্থায় আমাদের উত্তরাধিকারীর জন্য রেখে যাওয়া আমাদের কর্তব্য মনে করি।

নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক জোসেফ স্টিগলিৎসের ভাষায়: "বিশ্বে যখন হতাশা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য প্রকট, যখন বৈশ্বিক শঠতা ও অসাম্য চলছে, যখন আন্তর্জাতিক বিধি-বিধানগুলো তৈরি হয়েছে শিল্পোন্নত দেশগুলোর, আরো সঠিকভাবে বললে, ওই সব দেশের মধ্যকার বিশেষ কিছু স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে এবং ইতোমধ্যে যারা সুবিধাবঞ্চিত, তাদের সুযোগ-সুবিধা আরো কেড়ে নিতে, তখন যুবসমাজ নিজেদের ও তার সন্তান-সন্ততিদের জন্য আরো সুন্দর একটি পৃথিবী গড়ে তোলার গঠনমূলক কাজে লিপ্ত না হয়ে বরং ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবে-এটাই স্বাভাবিক। আর তার ফলে আমাদের সবাইকে ভুগতে হচ্ছে।"

২০০৩ সালে অধ্যাপক স্টিগলিৎস বলেন, "বাজার অর্থনীতিগুলো স্বনিয়ন্ত্রিত নয়, তাদের ওপর এমন সব আঘাত ও বিড়ম্বনা আসে, যেগুলোর ওপর তাদের কোনো হাত থাকে না; প্রচণ্ড বাতিক আতঙ্ক, অযৌক্তিক প্রাচুর্য ও হতাশার শিকার হয়, ঝোঁক থাকে জোচ্চুরি আর এমন সব ঝুঁকি নেয়ার যা জুয়াখেলার পর্যায়ে পড়ে; আর মুক্তবাজারের এসব ভুলভ্রান্তি ও মন্দ কাজের দায় টানতে হয় পুরো সমাজকে…।"

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমরা বিশ্বায়নের কাঠ কাটি, জল টানি এবং বিশ্বায়নের আবর্জনা বহন করি। অত্যন্ত বিপজ্জনক নানা ধরনের বিষাক্ত বর্জ্য আমাদের গ্রহণ করতে হয়। আমরা অনেক যৌথ উদ্যোগের অংশীদার হই, যেখানে অসম চুক্তিতে সই করতে বাধ্য হই। অনেক সময় নিজেদেরই প্রাকৃতিক সম্পদ আমাদের কিনতে হয় অতি উচ্চমূল্যে এবং দুর্মূল্য বিদেশী মুদ্রায়।

আজ মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্যই নয়, বরং নিজেদের প্রয়োজন উপলব্ধি এবং সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আজ মানুষ উন্নয়ন চায়। এ শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, সার্বিক উন্নয়ন, যে উন্নয়ন মানুষের সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণ বিকাশের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এ উন্নয়ন এমন এক অংশীদারিত্বের উদ্যোগ যা নিচ থেকে ওপরে সমগ্র সমাজকে সেবা করবে এবং যার ফলে সাধারণ মানুষের আত্মনির্ভরতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

বাজারকে শাসন, মুক্ত বাণিজ্যের অনাচার বন্ধ, কৃষক-শ্রমিক-নাগরিকের মানবিক অধিকার    বাস্তবায়ন এবং পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য আমাদের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে ও বিধান দিতে হবে। অর্থনীতির উদারীকরণ যথেষ্ট নয়। আমাদের সার্বিকভাবে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে; সমাজে শুধু আইন নয় যথাযথ প্রতিষ্ঠানের সুষম বিকাশের পথে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের মধ্যে সুস্থ ও কার্যকর সামাজিক পুঁজি গড়ে উঠলে তা উন্নয়নের জন্য বড় সহায়ক হবে।

প্রায় নয় দশক আগে 'সংস্কৃতি' শব্দটা আমাদের ভাষায় সংযোজিত হয়েছে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় যে 'স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ' করার কথা বলা হয়েছে তা শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা উন্নয়ন নয়। সেই সমৃদ্ধি এমন সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিধা নিশ্চিত হবে।

আমাদের দেশের বহু ধ্যান-ধারণা ইংরেজি ভাষা থেকে আগত। খোঁজ করলে তার দেশজ ভিত্তিও পাওয়া যাবে। 'মাদার-টাঙ'-এর যুগল শব্দ থেকে সন্ধি করে আমরা যুগ্ম শব্দ 'মাতৃভাষা' পেয়েছি। ইংরেজি শব্দ 'কালচার'-এর কী বাংলা হবে তা নিয়ে একসময় আমাদের দেশে তুলকালাম হয়েছে। এর অন্যতম বাহাসকারী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 'কৃষ্টি' শব্দটির প্রতি তাঁর বিমুখতা ছিল স্পষ্ট। তাঁর আপত্তি ছিল বেদে জাতি, জন বা জনগণ অর্থে কৃষ্টি শব্দটির ব্যবহার। সংস্কৃতের অধ্যাপক দুর্গাচরণ চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন অর্বাচীন সংস্কৃতি বা বৌদ্ধ সংস্কৃতে 'সভ্যতা ও সংস্কৃতি' অর্থে কৃষ্টি শব্দের ব্যবহার ছিল। 'কালচার'-এর রবীন্দ্রনাথকৃত পরিভাষা-প্রতিশব্দ 'উৎকৃষ্টি চিত্তোৎকর্ষ, 'সমুৎকর্ষ, 'মনঃপ্রকর্ষ' বা 'চিত্তপ্রকর্ষ' তাঁর আর একটি সহজ প্রতিশব্দ কব্জিঘড়ির মতোই চলেনি।

ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে সংস্কৃতি শব্দের আবিষ্কারের খবর পেয়ে রবীন্দ্রনাথ বড় স্বস্তি লাভ করেন। তিনি আশ্বস্ত হলেন এই ভেবে যে 'কৃষ্টির মতো অশ্রাব্য শব্দটি আর ব্যবহার না করলেও চলবে। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন ১৯২২ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে তাঁর এক মহারাষ্ট্রীয় বন্ধুর কাছ থেকে তিনি সংস্কৃতি শব্দের হদিস পান। তার নবশব্দ আবিষ্কারের আনন্দ দেখে তাঁর বন্ধু বিস্মিত হয়ে বলেন, আমরা তো এ শব্দ বহুকাল ধরে মারাঠিভাষায় ব্যবহার করে আসছি। ড. চট্টোপাধ্যায় আরও বলেন, সংস্কৃতি শব্দটি ঋগ্বেদ-এ নেই, কিন্তু ব্রাহ্মণ্যগ্রন্থে আছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণের যে উক্তি ক্ষিতিমোহন সেন অনুবাদ করেছিলেন তার মধ্যে 'আমার সংস্কৃতি' শব্দদ্বয়ের উল্লেখ আছে।

এখন 'কালচার'-এর প্রতিশব্দ হিসাবে একটি মানবগোষ্ঠীর মন ও অবচেতন, অনুভব, প্রবৃত্তি ও তাড়না, আদর্শ ও উপলব্ধি, তার সাধনার প্রকাশ, তার দর্শন, সাহিত্য, শিল্প, সংগীত আর তার অন্যান্য সহজাত ক্রিয়াকলাপ, তার সৃষ্টি ও সংস্কারের অভিব্যক্তির এক সর্বন্বয় সংজ্ঞার প্রয়োজনে আমরা সংস্কৃতি কথাটি ব্যবহার করছি।

প্রতিটি সংস্কৃতির একটা স্বাভাবিক লক্ষ্য, আপন গৃহে বিনা বাধায় স্বীয় সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে। মতাদর্শপ্রণিত সরকার আজকাল সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যেমন সহায়তা দান করে, তেমনি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সংস্কৃতি চর্চা সরকারের কাছ থেকে আড়াই হাত দূরে থাকলে ভালো হয়।

যেমন মাছ জলে বাস করলেও আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না মাছ জল খায় কি না, তেমনি এক সংস্কৃতির মধ্যে বাস করে এবং নিঃশ্বাস নিয়ে ও প্রশ্বাস ফেলেও স্বীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা নাও থাকতে পারে। সংস্কৃতি ধর্মের চেয়ে ব্যাপক; ধর্মের মতো তা আমাদের ধারণ করে, দীক্ষা দেয়, সাহস দেয়, অনুপ্রাণিত করে এবং সর্ব কর্মকাণ্ডে আমাদের অগোচরে সহায়তা করে চলে। এই ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে কিছু আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা আফ্রিকার দু-একটি দেশে ও অন্যত্র উন্নয়নের সহায়তায় নাট্যশিল্পকে কাজে লাগায়।

ঐতিহাসিক কারণে আমরা ইউরোপমুখী, বিশেষভাবে ইংল্যান্ডমুখী। এই পাশ্চাত্যমুখিতার বিরুদ্ধে আমাদের দেশে সাম্প্রতিককালে উচ্চকণ্ঠে সমালোচনা হয়েছে। ২০০২ সালের মার্চে 'শিল্প-সাহিত্যে আধুনিকতা ও বাঙালির অন্বেষণ' শীর্ষক এক সেমিনারে নাট্যকার সেলিম আল দীন বাংলা নাটকে কাব্য-উপন্যাস-নৃত্যসংগীতের দ্বৈতাদ্বৈত রূপকে প্রতিফলিত করতে চেয়ে বলেন, 'উপনিবেশ কাল বিদূরিত হবার পরেও ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতা প্রসেনিয়াম মঞ্চের আলোর ঘুলঘুলিতে-অন্ধকারের অপচ্ছায়ারূপে লেগে থাকবে-এ কোনো অবন্ধ ও মুক্ত শিল্পসৃষ্টির পন্থা হতে পারে না। রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা, তার অবলেশগুলো আমাদের অগ্রগতির পথে এক কঠিন প্রতিবন্ধকতারূপে আজও ক্রিয়াশীল। শিল্পের ক্ষেত্রেও সেই একই অপঘাত আজও আমরা প্রশ্নহীন বহন করে চলেছি বলে আমাদের মাটিতে বিশ্বজয়ী সোনার ধান আর ফলে না। কতভাবেই না আমাদের নাট্য পাশ্চাত্যের পরিত্যক্ত চিহ্নগুলো বহন করে চলেছে। সেই উইংস, যবনিকা উত্তোলন, নাট্যকাহিনির সেই প্রাচীন শব অভিনেতারা নিজ নিজ কাঁধে বহন করে আনে, তারপর পুনর্বার নাট্যশেষে বহন করে চলে যায়। হাসি-কান্না যা-ই হোক, শব বহনের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ তবু শোনা যায়।

আত্ম-অন্বেষণের পথে আধুনিক বাংলা নাটকের আদল খুঁজতে হবে আমাদের দেশকালের বাস্তবতায়, সে পথেই শিল্পসিদ্ধি-অন্য কোনো পথে নয়।' (সাহিত্যসংগ্রহ ২০০২, পৃ. ১১৫)

সেলিম আল দীন এক মহীরুহের মতো। তাঁর মতো মহীরুহ দিয়ে পথপার্শ্বে এক বৃক্ষবিতান সৃষ্টি করা সহজ নয়। তিনি যেভাবে লোকসংস্কৃতি আত্মস্থ করে নাটক লিখেছেন সকলেই যে সে পথে চলবে বা চলতে পারবে তা নয়। আজ সারা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের নানা ধরনের দেওয়া-নেওয়া চলছে।

অভিনয়ের পক্ষে কী স্বাভাবিক, যা অভিনয়ের উদ্দেশ্য সাধন করে? অভিনয় আমাদের হ্দয় বিচলিত করতে চায়। আমাদের চিন্তাকে আঘাত করতে চায়। নাটকের সাঙ্গপাঙ্গ, সংগীত, আলোক, দৃশ্যপট, আলোকসজ্জা সকলে মিলে আমাদের আকর্ষণ করে এবং চঞ্চল করে তোলে।

ছিন্নপত্রাবলীতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: 'নাটকে আবার খুব বেশি হাত ছেড়ে দেওয়া যায় না–কাজটা অনেকটা চৌঘুড়ি হাঁকানোর মতো–অনেকগুলো ঘোড়াকে এক গাড়িতে জুতে, এক রাস্তা দিয়ে, এক উদ্দেশ্যের দিকে নিয়ে যাওয়া। সুতরাং ওর মধ্যে কোনো একটা ঘোড়াকে বেশি লাগাম ছেড়ে দেওয়া যায় না, সবকটাকে সমান গতিতে ছোটানো চাই।'

আমরা যদি পূর্বের দিকে মুখ ফেরাই তবে দেখি সেসব দেশেও সমালোচনায় উপনিবেশিকতা বিরোধের অনুষঙ্গ হিসেবে পাশ্চাত্যবিরোধিতা এসেছে। আবার উপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে আবেগময় উচ্চারণ করেও নাট্যকারগণ সাফল্যের সঙ্গে প্রসেনিয়াম পদ্ধতি কাজে লাগিয়েছে। চীনের অপেরা নাটকে যে নাচ-গান, লম্ফঝম্ফ, সামরিক কসরৎ, ম্যাজিক-ভোজবাজি দেখানো হতো তার প্রভাব কমিয়ে সংলাপ ও স্বগোতক্তির ব্যবহারকে স্বাগত জানিয়ে চীনা নাট্যকারেরা স্বাস্থ্যকর রূপান্তর করিয়েছে।

ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র অস্বীকার করার প্রয়োজন নেই। আবার সেই শাস্ত্রের ওপর দাগা বুলিয়ে বর্তমানকালে চলব সেও ভালো কথা নয়। বর্তমান কালের একটা অহঙ্কার থাকা উচিত। রক্তকরবী বাংলা নাটকের অন্তিম নাটক নয়। ভবিষ্যতের নাট্যকার কোন আনন্দে, কোন বেদনায়, কোন প্রেরণায় বা নিপীড়নে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের জন্য নতুন দিনের নাটক রচনা করবেন তা আমরা বলতে পারি না। অতীত ও বর্তমানের শাস্ত্রাদির কীভাবে সমন্বয় সাধন করা যায়, এ সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা নির্দিষ্ট করা যায় না। তবে আমাদেরকে নতুন চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হতে হবে; মনের দিক থেকে স্বাগত না জানানোর জন্য প্রস্তুতি না থাকলেও।

নাট্যাভিনয়ের কুশীলবদের একসময় তেমন ইজ্জত ছিল না। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্র-এ পরামর্শ দেন, লোকবসতির মধ্যে অভিনেতা ও বাজিকরদের যেন বসবাস করতে না দেওয়া হয়। চীনেও অভিনেতা-নর্তকীদের তেমন একটা মর্যাদা ছিল না। বাংলা থিয়েটারে প্রথম চারজন অভিনেত্রী শ্যামা, গোলাপ, এলোকেশি ও জগন্তারিনীর অংশগ্রহণ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পছন্দ হয়নি, তাদের নিষিদ্ধ পেশার সঙ্গে সম্পর্কের কারণে। বর্তমানে নাটক ও নাট্যাভিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ও অনুশীলনের বিষয়। কিছুদিন হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নাট্যোৎসব সুসম্পন্ন হলো তার নির্দেশকদের সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিলেন নারী।

অভিনয় দেখতে পুরুষমানুষরা নাকি ভুলে যেতে, আর মেয়েরা নাকি মনে করতে যায়। লন্ডনে লোকে নাকি থিয়েটারে যায় হাসতে, প্যারিসে যায় নাটকের যাথার্থ বিচার করতে আর নিউইয়র্কে যায় বাজারমাত নাটক দেখে হালফ্যাশনের সঙ্গে তাল ঠুকতে। আমরা স্বৈরশাসনের আমলে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সমালোচনা শুনতে অভিনয় দেখতে ভালোবাসতাম।

আমি চট্টগ্রামে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় বিটা'র নারী পাচার বিরোধী মীনকন্যার  নাট্যাভিনয় দেখে মুগ্ধ হই। আমরা নিত্যকার জীবনে এমন অনেক দুর্দশা-দুর্গতি মুখ বুঝে সহ্য করি, যার বিরুদ্ধে নাট্যকলার মাধ্যমে একটা স্থায়ী প্রতিরোধী অবস্থার সূচনা হতে পারে।

আমি গত এক মাসে দুটো নাটক দেখেছি, আতাউর রহমানের নির্দেশনায় বাংলার মাটি বাংলার জল এবং ড. ইসরাফিল শাহীনের নির্দেশনায় সিদ্ধান্ত। প্রথমটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিন্নপত্রাবলীর নাট্যরূপ দিয়েছেন সৈয়দ শামসুল হক এবং দ্বিতীয়টি বার্টল্ট ব্রেখ্ট্-এর দ্য মেজরস টেকন-এর অনুবাদ। উভয় নাটকে মঞ্চের নতুনত্ব দেখে আমি মুগ্ধ। একটিতে নানা প্রযুক্তির ব্যবহার, আরেকটি আটপৌঢ়ে নিরালঙ্কার। কিন্তু দুটো নাটকের ক্ষেত্রেই নাটকের যবনিকা পতনের পরও প্রায় ত্রিশ মিনিটের মতো আমার পরমানন্দে নিজেকে উদ্বেলিত মনে হয়।

উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে যেমন পুঁজি, জমি, শ্রম, প্রযুক্তি এবং উদ্যোগকর্ম সংশ্লিষ্ট, তেমন সম্পর্ক নেই সংস্কৃতির সঙ্গে। উন্নয়নের প্রভাবে সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসতে পারে। উন্নয়নের অভাবে সংস্কৃতি বিবর্ণ হলুদবর্ণ হয়ে তার ঔজ্জ্বল্য হারাতে পারে। আমাদের জীবনে যেসব অমঙ্গলকর্ম দেখা যায় নারী পাচার, আদম ব্যাপারীর কাজ, অস্বাস্থ্য, অশিক্ষা, বিদ্যমান অসহিষ্ণুতা যা সমাজে অস্থিরতার সৃষ্টি করে এবং পরোক্ষভাবে উন্নয়ন ব্যাহত করে সেসব ক্ষেত্রে সংস্কৃতি শুধু সহায়ক নয়, সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

আমাদের উন্নয়ন-ভাবনায় কৃষি, দারিদ্র্য ও পল্লী উন্নয়ন যতখানি, আমাদের মন আকর্ষণ করেছে, সেই অনপাতে রাষ্ট্রক্ষমতা, রাষ্ট্র-অর্থায়ন, রাজনৈতিক অর্থনীতি, সম্পদের বণ্টন, বৈষম্য এবং বিশেষ করে সংস্কৃতির কথা তেমন করে আকর্ষণ করেনি।

উন্নয়নের কর্তা মানুষ, দূষণের কর্তাও মানুষ। কোন উন্নয়ন আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে, সে-সম্পর্কে আমাদের সম্যক ধারণা নেই। উন্নয়নের ক্লেশ, বিষ ও বর্জ্য থেকে সংস্কৃতিচর্চা আমাদের রক্ষা করে না–আমাদের সজীব ও সিক্ত করে রাখে। উন্নয়নের পাগলা ঘোড়ার রাশ টেনে সীমাহীন বৈষম্যের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করার জন্য আমাদের সবিশেষ যত্নবান হতে হবে।

সমাজে যারা ভরসাহীন এবং যারা বঞ্চনা ও শোষণের পাত্র, তাদের ভরসা যোগাতে পারে কেবল সুস্থ সংস্কৃতিকর্ম। আমরা দু'বার স্বাধীন হয়েছি। আমাদের দ্বিজত্বে যে-গৌরব ছিল তাকে ধরে রাখতে এবং ঝুঁকিপূর্ণ এই ক্রান্তিলগ্নে মনসই রাখতে আসুন আমরা সুস্থ ও সুন্দর সংস্কৃতিকর্মের অনুশীলনের জন্য অঙ্গীকার করি।

ফেসবুক লিংক । মতামত-বিশ্লেষণ

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: ১৯৯৬ সালে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।