আর্থ-রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে আক্রান্ত গণমাধ্যম, বিপর্যস্ত গণতন্ত্র!

সেলিম খান
Published : 8 May 2014, 09:35 AM
Updated : 8 May 2014, 09:35 AM

প্রিয় পাঠক, প্রথমেই বলে রাখছি আমার লেখাটা বিষয়নির্ভরতার কারণে কিছুটা দীর্ঘ তো হবেই, আবার কারও কারও জন্য বিরক্তি, এমনকি উষ্মার কারণও হতে পারে। উষ্মার কারণ হতে পারে স্বাধীনতা-পরবর্তী পশ্চিমা শাসকদের রেখে যাওয়া (পরিত্যক্ত) পুঁজির দখলদার ধনিকশ্রেণি– যারা আজ গণমাধ্যম তো বটেই দেশের প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার বাজেটের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সুবিধাভোগী– তাদের জন্যও।

আর সে জন্য শুরুতেই তাদের কাছে চাইছি ক্ষমা এই ভেবে যে, নিজের স্বাধীন দেশটিতে কোনোভাবে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকবার নিশ্চয়তাটা যেন তারা আমাদের মতো আমজনতাকে দিন।

প্রথমেই কিছুটা হলেও ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি আমার লেখার শিরোনামটিতে সন্নিবেশিত সাতটি শব্দ আর একটি আশ্চর্যবোধক যতিচিহ্ন সম্পর্কে। প্রথম শব্দবন্ধটি হচ্ছে 'আর্থ-রাজনৈতিক'। যা আসলে 'অর্থনৈতিক' ও 'রাজনৈতিক' রাজযোটক ধরনের এই দুটি শব্দসমষ্টির সংক্ষিপ্ত শব্দবন্ধ। যা কি না আবার মেলবন্ধের দিক থেকে একটিকে ছাড়া আরেকটি চলতেও পারে না। এগুতেও পারে না।

কোনো একটি সমাজের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতিই যেমন নির্ধারণ করে সেই সমাজের অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য, ঠিক তেমনি অর্থনীতিও হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের অন্যতম নিয়ামক। আমাদের এই দেশটিতে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের মালিকানাবিহীন, পশ্চিমা শাসকদের ফেলে যাওয়া কিম্বা সরকারিভাবে পরিত্যক্ত ঘোষিত– যে অভিধাতেই অভিহিত করি না কেন– সেইসব পুঁজিই নির্ধারণ করেছে রাষ্ট্রটির চরিত্র কেমন হবে, কেমন হবে রাষ্ট্রপরিচালনার প্রতিষ্ঠানগুলো, কেমন থাকবেন রাষ্ট্রের মানুষ। অন্য অর্থে বলা যায়, লুম্পেন অর্থে পরিচালিত হবে রাষ্ট্রটি, তাই বোঝা গেছে।

পাকিস্তানি স্বৈরাশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চালিকাশক্তি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামের একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে বিশ্বমানচিত্রে জায়গা পেয়েছে আমাদের লাল-সবুজের এই বাংলাদেশ। কিন্তু সেই '৪৭ সালের পর থেকে '৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের অন্যতম জননায়ক তো এদেশের সাধারণ মানুষই।

ন'মাসের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর দু'লাখ মা-বোনের জঠর-ছেঁড়া বাংলাদেশ তাদেরই হবে, এটাই স্বাভাবিক ছিল না কি? কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে দেশটির সব সম্পদ (তারও আবার ৮৯ শতাংশই পশ্চিমা পুুঁজির মালিকদের ফেলে যাওয়া), দেশটির অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি সবকিছুরই নির্ধারক হয়ে উঠল একটি দল যারা কিনা সত্যিকার অর্থেই স্বাধীনতা সংগ্রামের উপরিকাঠামোর নেতৃত্বের দাবিদার। তারাই নির্ধারণ করল কেমন হবে দেশের গণমাধ্যমের চরিত্র, কেমন হবে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো, কেমন হবে দেশের রাজনীতি, কেমনই-বা হবে দেশের সংস্কৃতি, কেমন থাকবে দেশের মানুষ, কেমন হবে দেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সম্পর্ক।

কিন্তু এসব ঠিক করতে গিয়ে প্রাধান্য পেল না কোটি বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাজাত নিয়ামকগুলো। বরং ধীরে ধীরেই জেঁকে বসল পাকিস্তানি, এমনকি ব্রিটিশ শাসকদের রেখে যাওয়া যতসব নিয়ম-নীতি আর নীতিমালা। সবকিছু পাল্টাল শুধু নামেই, বৈশিষ্ট্যে বা চরিত্রে তো নয়ই, কাঠামোতেও নয়। আর সেসবের ভিত্তিতেই পরিচালিত হতে থাকল দেশের রাষ্ট্র ও শাসন-কাঠামো।

বেনিয়া বাঙালি শাসকশ্রেণির একচেটিয়া সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা আর একই সঙ্গে মুুক্তিকামী বাঙালির আকাঙ্ক্ষা কিছুটা আমলে (বাধ্য হয়েই) নিতে গিয়ে শাসন-কাঠামোতে তৈরি হল নৈরাজ্যের প্রকটতা। রাজনীতিতে থাকল না শৃঙ্খলা। অর্থনীতি হয়ে পড়ল বেনিয়াদের হস্তগত। যে বেনিয়ারা শুরু থেকেই লুটপাটের স্বর্গ মনে করতে থাকল বিপুল সম্ভাবনার এই দেশকে।

এদেশের ব্যাংকগুলোতে পশ্চিমা মালিকদের রেখে যাওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা আর পরে সাধারণ বাঙালিদের গচ্ছিত টাকা লুটপাটের মাধ্যমে স্বাধীনতার কয়েক বছরেই তারা হয়ে ওঠে দেশপরিচালনার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। রাষ্ট্রপরিচালনায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের অদক্ষতা আর অনভিজ্ঞতার সুযোগে লুটেরা ধনীকশ্রেণির অঙুলিহেলনে পরিচালিত হতে থাকে রাজনীতি, অর্থনীতি– সর্বোপরি, শাসন-ব্যবস্থা।

দেশীয় এমনিতর বিশৃঙ্খলা আর আন্তর্জাতিক বিরুদ্ধচারিতা, দুয়ে মিলে বাংলাদেশ হয়ে পড়ে নাজুক এক পরিস্থিতির শিকার। আর এসবের কার্যকারণ হিসেবে কাজ করে ইসলামী ফাউন্ডেশন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, লাহোর ইসলামি শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশ নেওয়া, মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানে থেকে যাওয়া বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের (এরশাদসহ, যিনি কি না ছিলেন সে সময়ে যেসব বাঙালি সেনাকর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বাংলাদেশে আসবার প্রয়াস নিয়েছিলেন, তাদের বিচারের দায়িত্বে) দেশে ফিরিয়ে এনে সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ করা, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের বড় একটি অংশকে সাধারণ ক্ষমা করে দেওয়া, একাত্তরে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রীয় সম্পর্ককে অনেকটাই 'ইগনোর' করে মুসলিম দেশগুলো, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্ক জোরালো করার চেষ্টা– এমনি সব রাষ্ট্রিক সিদ্ধান্ত।

বঙ্গবন্ধু এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নিজের রাজনৈতিক শ্রেণিস্বার্থের হিসেব বিবেচনায় নিয়েই। বলা বাহুল্য, অসাম্প্রদায়িক একটি জাতি-রাষ্ট্রের উন্মেষপর্বে বঙ্গবন্ধুর এমনি সব সিদ্ধান্তে দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রে সংহত জায়গা করে নেয় স্বাধীনতাবিরোধীরা। আশ্রয়-প্রশ্রয় পায় মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি, যারা কি না ধর্মের নামে মুছে ফেলতে চেয়েছিল বাঙালির ঐতিহ্য, বাঙালির সংস্কৃতি, হাজার বছরের পাললিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি।

ফলশ্রুতিতে আসে চুয়াত্তর, আসে ম্যানমেইড দুর্ভিক্ষ, আসে ষড়যন্ত্র (দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই)। আর এসব মোকাবেলা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফিরতে হয় একদলীয় শাসন-কাঠামোতে। যা ছিল তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের একেবারেই বিপরীত একটি সিদ্ধান্ত। সর্বোপরি, যা তাঁর একাত্তর-পূর্ব রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে একেবারেই মেলে না।

হয়তো তাঁর ও তাঁর সময়ের বিবেচনায় এর কোনো বিকল্পও ছিল না তাঁর কাছে। কিন্তু তারপরও বলতে হয়, বঙ্গবন্ধুর উপরোল্লিখিত 'মহানুভব' সিদ্ধান্ত শত্রুর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামরত একজন নেতার জন্য কৌশল হিসেবে সমীচিন হলেও হতে পারে, তাই বলে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে এই সমীচিনতা কতটা যৌক্তিক তা বিবেচনার অবকাশ রাখে। এই সমীচিনতা আর যৌক্তিকতার ক্রসফায়ারে পড়ে আসে পঁচাত্তর, আসে আগস্ট।

বাংলা ও বাঙালি হারায় তার এক আশ্রয়, তার এক মহানুভবতা– শুধু তার এক রাষ্ট্রনায়ককেই নয়, বরং রাষ্ট্র জন্ম দেবার অনন্য এক কারিগরকে।

এরপর এল 'মানি ইজ নো প্রবলেম, আই উইল মেইক দ্য পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দ্য পলিটিশিয়ান' এর সমরজাত এক অধ্যায়। স্বাধীনতা-পরবর্তী আর্থ-রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের অসংহত, কিছুটা বিশৃঙ্খল, কিছুটা খাপছাড়া রূপ যেন পৌঁছে যায় সুসংহত পর্যায়ে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন গণমাধ্যমকে স্বেচ্ছাচারমুক্ত রাখতে বঙ্গবন্ধুর কিছুটা 'নিয়ন্ত্রিত' উদ্যোগকে একেবারেই নাকচ, আর ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অর্গল খুলে দিয়ে ইতোমধ্যেই সমাজ-রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানপন্থীদের কাছে দ্রুতই প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন সে সময়ের সমরশাসকেরা।

খুলে দেওয়া হয় ৫৫ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট একটি ভূখণ্ডের আট কোটি মানুষের জন্য স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারে মিশ্রিত গণমাধ্যমের অর্গল। খুলে দেওয়া সেই অর্গলের সুবিধা নিয়ে নিজেদের মত ও পথ প্রকাশে মরিয়া হয়ে ওঠে বাংলাদেশবিরোধীরা। প্রকাশ হতে থাকে বিভিন্ন মত-পথের হাজারও দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক সংবাদপত্র। যার বেশিরভাগেই প্রাধান্য পায় সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার সংঘবদ্ধ প্রচারণা।

যে সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে দীর্ঘ কয়েক দশকের সংগ্রামে জন্ম নিয়েছিল লাল-সবুজের বাংলা, পরিকল্পিতভাবে সেই চেতনা মুছে ফেলার চেষ্টা শুরু হয় ইতিহাস থেকে। সে ক্ষেত্রে বেছে নেওয়া হয় গণমাধ্যম ও পাঠ্যপুস্তক। দ্রুতই লাভজনক হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধবিরুদ্ধ প্রচারণামূলক এই প্রকাশনা ও গণমাধ্যম শিল্প। যাতে বিনিয়োগ হয় হাজার হাজার কোটি টাকা।

এভাবেই গোটা প্রকাশনা ও গণমাধ্যম শিল্প চলে যায় দুর্বৃত্ত পুঁজির করায়ত্তে। সংবাদকর্মীরা হয়ে পড়েন দুর্বৃত্ত অর্থমোড়লদের সেবাদাস। রাষ্ট্রিক ও প্রশাসনিক দিক থেকে গণমাধ্যমকে সম্পূর্ণ স্বাধীন বলা হলেও, সেই স্বাধীনতার গোটাটাই উপভোগ্য হয়ে ওঠে গণমাধ্যম মালিকদের জন্য। যার ধারাবাহিকতা এরশাদের স্বৈরশাসন, এমনকি নব্বইয়ের নাগরিক (সাংবিধানিক) আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গঠিত কথিত সংসদীয় সরকার ব্যবস্থাতেও বহাল রয়েছে।

লেখার এ পর্যায়ে বিশ্লেষণ টানতে চাইছি 'দুর্বৃত্তায়নে আক্রান্ত গণমাধ্যম' এই তিনটি শব্দের। আশির দশকে এসে গোটা গণমাধ্যম শিল্পই যখন বেনিয়া লুম্পেন পুঁজির মালিকদের দখলে, ঠিক তখনই আর্থ-রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের শিকার হয়ে একই সঙ্গে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে সাংবাদিকদের স্বার্থরক্ষাকারী সংগঠনগুলোও। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মতের অনুসারী হয়ে রাতারাতি গজিয়ে ওঠে নানা নামে সাংবাদিকদের নানান ব্যানারের সংগঠন।

একসময় প্রতিটি সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের অধীনে একটি করে ইউনিট থাকলেও বেশ দ্রুতই তা হারিয়ে ফেলে কার্যকারিতা। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি হারানোর ভয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় সে সব ইউনিট। একসময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সাংবাদিকদের স্বার্থরক্ষাকারী ট্রেড ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের শিকার হয়ে আজ পরিণত হয়েছে নিছকই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-জামায়াতের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে।

জাতীয় প্রেস ক্লাব নামে সাংবাদিকদের একটি সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান থাকলেও, তা আজ শুধুই শনিবারের হাউজি খেলা, অর্থের বিনিময়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের সেমিনার ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠানের সুযোগ করে দেওয়া, সদস্য সাংবাদিকদের ভর্তুকিতে সকাল, দুপুর আর রাতের খাবারের যোগান দেওয়া আর একটি বিশেষ কক্ষে কিছু সংখ্যক 'অভিজাত' সংবাদকর্তাদের কার্ড খেলার আসর নির্বিঘ্ন করাতেই নিবেদিত।

যদিও এই ক্লাবটিতে রয়েছে বেশ বড় পরিসরের একটি পাঠাগার ও এনডিএন নামের একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় একটি মিডিয়া সেন্টার, যা আবার সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। নির্বাচিত পরিচালনা পরিষদে বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীদের প্রাধান্য থাকায় প্রেস ক্লাব হারিয়ে ফেলেছে তার স্বকীয়তা। নেই তার প্রকৃত ও সর্বজনীন নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।

বিশ্বের অন্য প্রেস ক্লাবগুলোর কার্যক্রম যেখানে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ, পেশাগত মানোন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া, বিদেশি ফেলোশিপ, স্কলারশিপ প্রভৃতির ব্যবস্থা করা, বহির্বিশ্বের সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার ধরন-ধারনের সঙ্গে পরিচিতি ঘটানোর ব্যবস্থা-কেন্দ্রিক– সেখানে আমাদের জাতীয় প্রেস ক্লাবের নেতারা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়ে, বছরে কিম্বা দুই বছরে একবার নির্বাচনের নামে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতাকে স্বাগত জানিয়ে বৈধ করে নেন নিজেদের নেতৃত্ব। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে আসছে।

এসবের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে, নব্বইয়ের দশকে গড়ে ওঠে একদল প্রতিবাদী সংবাদকর্মীর নেতৃত্বে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, ডিআরইউ। সেটিও আজ প্রেস ক্লাব, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের পথেই হাঁটতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

সঠিক কোনো হিসাব না থাকলেও দেশে আজ পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন মিলিয়ে যে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তা হয়তো হাজারেরও ওপরে। আর এসব প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীর সংখ্যা সব মিলিয়ে লাখের বেশি, যাদের আবার সত্তর থেকে আশি শতাংশই তরুণ। অথচ তারুণ্যনির্ভর বিশাল এই সংখ্যক সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের 'ওনড্' করার মতো নেই কোনো সংগঠন। নেই তাদের নিজস্ব অধিকার ও স্বার্থরক্ষায় যুথবদ্ধ দাঁড়াবার জায়গা। রাষ্ট্রিক ও সরকারি পর্যায়েও নেই কার্যকর অভিভাবকত্ব।

যদিও গণমাধ্যম মালিকরা তাদের স্বার্থরক্ষায় ইতোমধ্যেই গড়ে তুলেছেন নিজ নিজ সংগঠন। নানান সুবিধা আদায়ে দরকষাকষি করছেন সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। সফলও হচ্ছেন।

বিপরীতে সাংবাদিক ও সংবাকর্মীদের নেই কোনো পেশাগত অধিকার, সুযোগ-সুবিধা। রাষ্ট্র, সরকার আর মালিকপক্ষের অনিয়ম, অন্যায় আর স্বেচ্ছাচারের প্রতিবাদ করলেই হারাতে হচ্ছে চাকরি। বেধড়ক মার খাচ্ছেন রাষ্ট্রিক সহায়তাপুষ্টদের স্যালাইনের স্ট্যান্ডে। ভাঙছে ক্যামেরা। দিনের পর দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে অন্যের দয়ার অর্থে। জীবন হয়ে পড়ছে অনিরাপদ।

মোটের ওপর পেশাগত অনিশ্চয়তা আর নিরাপত্তাহীনতা গ্রাস করেছে গোটা সাংবাদিক সমাজকে। ফলশ্রুতিতে অনেক সহকর্মীই আশ্রয় নিচ্ছেন দুর্বৃত্তায়নের। তাঁবেদারি করছেন মালিকপক্ষের। অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন ফরমায়েশি সাংবাদিকতায়।

এবার আসছি লেখার শিরোনামের সর্বশেষ শব্দবন্ধ 'বিপর্যস্ত গণতন্ত্র'-তে। সংবাদপত্র শিল্পের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে তার কর্মীবাহিনী, যাদের আমরা বলছি সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী। যারা না লিখলে পরদিন প্রকাশ হয় না ছাপার কাগজে সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষার কথকতা। যারা বুম আর ক্যামেরা হাতে ঘটনা-দুর্ঘটনা কভার করতে না পারলে কালো কাপড়ে ঢেকে থাকবে টেলিভিশনের পর্দা।

সমাজের অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার আর অনিয়মের কথা কাগজ-কলম আর ক্যামেরায় প্রকাশ না করতে পারলে প্রশ্রয় পাবে সাম্প্রদায়িকতা, যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বাঙালি লড়াই করেছে দীর্ঘ কয়েক দশক। মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে সমাজের সব অপশক্তি। স্বেচ্ছাচার হয়ে উঠবে শাসকগোষ্ঠী। প্রতি পদে লঙ্ঘিত হবে মানবাধিকার। বিপর্যস্ত হবে গণতন্ত্র।

এর প্রমাণ মিলছে নানাভাবে। আমরা দেখছি অবাধে চলছে মানুষ 'গুম' করা। একদিনে অপহৃত হচ্ছেন সাত সাতজন মানুষ। শীতলক্ষ্যায় জলযান না ভেসে ভাসছে মৃত মানুষের দেহ!

লেখার শিরোনামের সবশেষ ক্যারেক্টারটি তাই হচ্ছে একটি আশ্চর্যবোধক চিহ্ন (!)।

কৈফিয়ত:

এরপরের প্রয়াসে সাম্প্রতিক সময়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিশেষ করে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের হাতে সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত হবার কার্যকারণ নিয়ে লেখার আশা রাখছি।

সেলিম খান: সংবাদকর্মী।