বেশি সময়ের প্রধানমন্ত্রী, দায় তো আপনারই বেশি

প্রণব সাহা
Published : 5 May 2014, 06:49 AM
Updated : 5 May 2014, 06:49 AM

বেশি দিন ক্ষমতায় থাকলে দায়িত্ব্ও একটু বেশি হবে। অবশ্যই একই সঙ্গে দেশবাসীর প্রত্যাশাও বাড়বে, একের পর এক। আর সব বেশির দায় বর্তেছে এখন শেখ হাসিনার কাঁধেই।

বাংলাদেশ স্বাধীন হ্ওয়ার পর জাতির জনকের দায়িত্ব পালন করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু বাংলাদেশ তাঁকে শত্রুর চক্রান্ত আর ঘাতকের বুলেট থেকে রক্ষা করতে পারেনি। পাকিস্তানি হানাদাররা কারাগারে কবর খুঁড়েও শেখ মুজিবের ফাঁসি কার্যকর করতে পারেনি।

কিন্তু যে দেশ স্বাধীন হয়েছে শেখ মুজিবের নামে, সেই দেশের সেনাবাহিনীর বিপথগামী সৈনিকেরা তাদের সুপ্রিম কমান্ডারকে গুলি করেছে, হত্যা করেছে। তারপর বঙ্গবন্ধুর নাম আর মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস বিকৃত করে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে।

তবু ইতিহাসের নিষ্ঠুর বাস্তবতা এড়ানোর সুযোগ নেই। তাই একুশ বছর পর রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব ফিরে এসেছিল আওয়ামী লীগের হাতে। পিতার রক্তাক্ত স্মৃতি বুকে নিয়ে ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের আদরের মেয়ে শেখ হাসিনা।

দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় তখন পর্যন্ত বজায় ছিল। কারণ ১৯৯১ সালে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে এলেও, তখন পর্যন্ত দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রপরিচালনার কৃতিত্ব ছিল একসময়ের সামরিক জান্তা গণরোষে ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের।

২০০১ সালে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিয়ে মেয়াদ পূরণের পর বেশি সময় সরকারপ্রধান থাকার কৃতিত্ব পেয়ে যান বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি প্রথম দফায় ১৯৯১ সালের ১৯ মার্চ শপথ নেওয়ার পর, ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পদত্যাগ করেছিলেন। মাঝে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচনের পর দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেও, ৩০ মার্চ আওয়ামী লীগের আন্দোলনের কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

এর ফলে খালেদা জিয়া মেয়াদ পূরণ করতে না পারলেও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকেছেন। ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হয়ে পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন ২০০৬ সালে। কয়েক দফায় দশ বছর ক্ষমতায় থেকে এইচ এম এরশাদের চেয়েও বেশি সময় রাষ্ট্রপরিচালনা থেকে এগিয়ে যান সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, যিনি স্বামীর নিহত হ্ওয়ার প্রেক্ষিতে রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন।

এর আগে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ এম এরশাদ রাষ্ট্রপতি হন ১১ ডিসেম্বর, ১৯৮৩। তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর। তবে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে তিনি ক্ষমতা দখল করেন ২৪ মার্চ, ১৯৮২। বিচারপতি এএফএম আহসান উদ্দিন চৌধুরী ১৯৮২ সালের ২৭ মার্চ থেকে ১৯৮৩ সালের ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।

খালেদা জিয়া এবং এইচ এম এরশাদকে ডিঙিয়ে এখন বেশি সময় ধরে সরকারপ্রধান থাকার কৃতিত্ব শেখ হাসিনারই। প্রথম দফায় ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন, ১৯৯৬ থেকে ১৫ জুলাই, ২০০১ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। পরে ৬ জানুয়ারি, ২০০৯ থেকে তিনি দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন।

বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের মেয়াদ হচ্ছে জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের তারিখ থেকে পাঁচ বছর। সে হিসেবে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ বছরের মেয়াদ ছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মেয়াদ পূরণের আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান সংবিধানে অর্ন্তভূক্ত করায় এবার নির্বাচন হয়েছে ৫ জানুয়ারি। আর তৃতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা শপথ নেন ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি।

২৫ জানুয়ারি তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের দশ বছর পূর্ণ হয়েছে। এখন শেখ হাসিনাই দেশের একমাত্র সরকারপ্রধান, যিনি দশ বছর তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। একনাগাড়ে পাঁচ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার কৃতিত্বও যুক্ত হয়েছে তাঁর সাফল্যের ঝুড়িতে। ফলে সবচেয়ে বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী থাকার দৌড়ে বেগম খালেদা জিয়াকে টপকে গেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

শুরুতে যেমন বলেছিলাম, বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশাও এখন অনেক বেশি। আর তার প্রধান কারণ হচ্ছে তিনি নিজেই নিজের কাজ দিয়ে এই প্রত্যাশা আকাশ-সমান করেছেন। তাই অল্প কিছুতেই সবাই 'হায় হায়' করে ওঠে।

শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা। তাই প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে তিনি যখন বঙ্গবন্ধু সেতুর উদ্বোধন করেন, তখন সেই অনুষ্ঠানে আমরা শেখ মুজিবের কন্ঠস্বরও শুনেছি যেখানে তিনি যমুনার ওপর সেতুর কথা বলেছিলেন। আর শেখ হাসিনা যেহেতু দেশের সবচেয়ে বড় এই সড়ক সেতু উদ্বোধন করার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন, তখন তাঁর কাছেই তো দেশবাসী প্রত্যাশা করে যে তাকেই পদ্মা সেতু করতে হবে।

২০০১ সালে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে মুন্সিগঞ্জে শেখ হাসিনাই পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে আমরা যারা উপস্থিত ছিলাম সাংবাদিক হিসেবে, তারা তো প্রশ্ন তুলতেই পারি যে, কেন গত পাঁচ বছরে পদ্মা সেতুর মূল নির্মাণকাজ শুরু হল না? কেন সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে আরও আগেই ব্যবস্থা নেওয়া হল না? বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপের জন্য দায়ী কে?

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শুধু নয়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী অথবা শুধু একজন রাজনীতিক হিসেবে যেসব মানবিক গুণাবলী ধারণ করেন শেখ হাসিনা, সে জন্য তাঁর শাসনামলে অপহরণ, গুমের মতো অমানবিক কাজ হলে তা মেনে নিতে কষ্ট হয় বৈকি! যিনি সবার প্রিয় 'আপা', তাঁর কাছ থেকে, এমনকি প্রধানমন্ত্রী হলেও কেউই কটুবাক্য শুনতে রাজি নয়।

প্রধানমন্ত্রী পাঁচ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্বিগুণ করেছেন, লোডশেডিংয়ের ভয়াবহতা থেকে জাতিকে মুক্তি দেওয়ার কারণেই এখন অল্প-স্বল্প লোডশেডিংও আমরা মানতে রাজি নই। কারণ দেশ এখন 'খাম্বা'র 'ধান্ধা' থেকে দূরে থাকতে চায়। কুইক রেন্টালের নামে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয়ে থাকলেও, তার প্রতিকার তো আপনাকেই করতে হবে!

বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন লাইসেন্স যেমন এসেছে শেখ হাসিনার হাত থেকে, তেমনি সবচেয়ে বেশি স্যাটেলাইট চ্যানেলের লাইসেন্স দেওয়ার কৃতিত্বও তাঁর। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার দেওয়া লাইসেন্সে সম্প্রচারে এসেও যদি বেশি বেশি টকশোতে, বেশি বেশি সরকারবিরোধী আলোচনা হয়, তাহলে তার দায়ও আপনার।

আর মুক্ত গণমাধ্যম তো গণতন্ত্রকেই শক্তিশালী করবে। এটা মেনে নিয়ে যে কেউ তো সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতেই পারে যে, কেন আপনার গণতন্ত্রে টিভি চ্যানেল বা দৈনিক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাবে! যদিও একুশে টিভি বন্ধ করে টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করার সূত্রপাত হয়েছিল বিএনপি সরকারের সময়।

যার কাছে বা যাদের কাছে কোনো প্রত্যাশা নেই, তার বা তাদের কাছে হতাশ হওয়ারও কিছু নাই। সে জন্যই সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে যখন জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুজাহিদ গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে, তখন কোনো উচ্চবাচ্য করেননি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। কিন্তু শেখ হাসিনা সাহস করে যখন স্বাধীনতার আটত্রিশ বছর পর ট্রাইব্যুনাল গঠন করে রাজাকারদের বিচার শুরু করেছেন, তখন প্রত্যাশার পারদ উঠেছে উচ্চ আকাশে। রাজাকার কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড তাই মানেনি দেশের তরুণ প্রজন্ম।

ডিজিটাল বাংলাদেশ করতে চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তথ্যপ্রযুক্তিতে তাঁর অপার আগ্রহ। শাহবাগের আন্দোলনের সূত্রপাত তাই ফেসবুকে। প্রজন্ম চত্বরে ছুটে আসার কথাও তাই শেখ হাসিনাই বলেছেন, জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে। অনেক রাজনীতিক তো শাহবাগীদের 'নাস্তিক' বলতেও ছাড়েননি।

সেই বিচারপ্রক্রিয়ায় কারও গাফিলতি মুক্তিযোদ্ধা বা নতুন প্রজন্মের কেউ মানবে না। বিচারের রায় কার্যকর করতে সরকারের ওপর নৈতিক চাপ সৃষ্টিকারীদের কোনো দোষ নেই। কারণ তারাই দেখেছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার শুধু নয়, বিদেশ থেকে খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে শেখ হাসিনার সরকারই।

তাই আবারও বলব, সাফল্য যত বাড়বে, তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই চড়বে প্রত্যাশার পারদও। আঁচ তো একটু লাগবেই সরকারের গায়ে।

প্রণব সাহা: এডিটর আউটপুট, এটিএন নিউজ।