ভবিষ্যতের ডিজিটাল যন্ত্র

মোস্তাফা জব্বার
Published : 23 Nov 2010, 03:53 PM
Updated : 23 Nov 2010, 03:53 PM

সেই যে কবে প্রায় ৬০ বছর আগে মার্ক-১ যুগের ডিজিটাল যন্ত্র দুনিয়াতে কম্পিউটারের একটা ধারণা তৈরি করে দিলো, এরপর সেই যন্ত্রের খুব বেশি কি অদল বদল হয়েছে? তখনই আমরা জেনেছিলাম, এইসব যন্ত্রের একটি মগজ থাকে যেটি দিয়ে প্রসেসিং হয়। এতে তথ্য দেবার জন্য ইনপুট ডিভাইস ব্যবহার করতে হয় এবং ফলাফল দেখার জন্য দরকার হয় আউটপুট যন্ত্রের। কীবোর্ড-প্রিন্টার, স্ক্যানার-মনিটর এসব ব্যাপকভাবে প্রচলিত হতে থাকে।

পার্সোনাল কম্পিউটার বা পিসির যুগটা আইবিএম ও এ্যাপল কম্পিউটারের এবং আরও কিছু উদ্ভাবনী প্রতিষ্ঠানের অসাধারণ উদ্ভাবনসমূহের পরেও কার্যত মার্ক-এর জমানার মতোই ইনপুট-আউটপুট বা সিপিইউতেই সীমাবদ্ধ থেকে গেলো। অবশ্যই বেশ ব্যাপক পরিবর্তন হলো অপারেটিং সিস্টেম ও এ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামে। তবে তারপরেও টেবিলের ওপর বসিয়ে আমরা পিসির ডেস্কটপ সংস্করণ নিয়ে প্রায় চার যুগ পার করে দিলাম। এখনও কার্যত ডেস্কটপ পিসির শতকরা ৯০টির চেহারা প্রায় আদি ও অকৃত্রিমই রয়ে গেছে। সেই একই ধরনের কেসিং, কীবোর্ড আর মনিটরের চেহারা।

অবশ্য সিআরটি মনিটর এখন এলসিডি বা এলইডিতে বদলেছে। টাচস্ক্রিনও যুক্ত হয়েছে মনিটরে। ততোদিনে মাইক্রোপ্রসেসর জন্ম নেওয়ায় যন্ত্রটি আকারে ছোট হলো বটে। তবে এখনও ডেস্কটপ পিসি মানেই কাধে করে নেবার মতো একটি ডিভাইস। এতোদিনে পিসি নিয়ে গবেষণা কম হয়নি-উদ্ভাবনাও কম হয়নি। কখনও একসাথে মেকিন্টোস-এর মতো কম্পিউটার এবং আবার কখনও ল্যাপটপ পিসি-এইসব বিবর্তণ আমাদের অহরহই ঘটছে। ল্যাপটপের ট্র্যাকবল ওপরে না কীবোর্ড ওপরে সেইসব গবেষণাও হয়েছে। এরই মাঝে আরেকটি ডিজিটাল যন্ত্র ভিন্ন ট্র্যাক থেকে এসে ডিজিটাল দুনিয়ায় একটি বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে, যার নাম মোবাইল ফোন। কম্পিউটারের সবকিছু নিয়ে কথা বলার জন্য তৈরি হওয়া এই যন্ত্র কার্যত কম্পিউটারের দুয়ারে দাড়িয়ে আছে। কম্পিউটারের মতোই প্রসেসিং ক্ষমতা নিয়ে তৈরি হওয়া এই যন্ত্রের আওতা বরং কম্পিউটারের চাইতে আরও একটু বেশি।

এক সময়ে আমরা ল্যাপটপ বা নোটবুক কম্পিউটারে যা ভাবতাম সেই ভাবনার বর্ধিত সংস্করণ হচ্ছে মোবাইল যন্ত্র। কেউ কেউ আদর করে এর নাম দেন স্মার্ট ফোন। যদি একে পিডিএ বলা হতো তবে কম্পিউটারের খুব কাছের মানুষ মনে হতো। এ্যাপল পিডিএ বানিয়ে একবার ভীষণভাবে ব্যর্থ হয়। কিন্তু সেই পিডিএর ধারণাতেই মোবাইল ফোনের তাকত এনে আইফোন নাম দিয়ে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। এ্যাপল আই-প্যাড বানিয়েও আরও সফলতা পেয়েছে। পিসির মতোই অনেক কিছুতেই এ্যাপল প্রথম পণ্য বাজারে এনে উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। আমারতো মনে হচ্ছে আই-ফোন এবং আই-প্যাডের একটি হাইব্রিড যন্ত্রই আগামী দিনের ব্যক্তিগত বহনযোগ্য কম্পিউটারের জায়গা দখল করবে।

আমার জীবনের প্রথম কম্পিউটারটি মেকিন্টোস প্লাস। ১৯৮৭ সালের ২৮ এপ্রিল সেটি আমি ব্যবহার করা শুরু করি। সেটি নয় ইঞ্চি পর্দার একটি মোটামুটি বহনযোগ্য পিসি ছিলো। এরপর আমি এ্যাপল এর পাওয়ার বুক১০০, ১৫০ ব্যবহার করি। সেখান থেকে এখন দশ ইঞ্চি মাপের একটি নেটবুক ব্যবহার করি। আমাকে এখন এর সাথে আরও অন্তত একটি যন্ত্র বহন করতে হয়-সেটি মোবাইল ফোন। আমি এমন দুটি ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করতে চাইনা। আমি ধারনা করি আমার মতো অনেকেই এমনটা চান। আমি ইচ্ছে করলে আমার বন্ধুদের মতো একটি স্মার্ট ফোন ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু তাতে সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো আমি আমার মতো করে বাংলা লিখতে পারিনা। কার্যত আমি একটি কম্পিউটার চাই যেটি মোবাইল ফোনও।

আমি যখন জীবনের প্রথম মোবাইল ফোন কিনি তখন আমার মনে হয়েছিলো এতে কেবল কথা বলা নয়, আরও কিছু নতুন বৈশিষ্ট যোগ হলে কি হতো? একেবারে সব সময়ে হাতে নিয়ে ঘুরি তেমন একটি যন্ত্র হাতের কাছে বা হাতে রেখে কাজ করা যায় এমন কিছু টুলসতো অবশ্যই থাকতে পারে। এতে নোট বুক বা ডাইরীর কাজটি হলে ভালো হয়। এতে গান শোনার ব্যবস্থা থাকলে অনেক উপকার হয়। এতে যদি রেডিও থাকে তবুও মন্দ হয়না। যদি এমন হতো যে সেই ফোনটাতে টিভি দেখতে পারা যেতো? এমন কি ক্ষতি হতো, যদি সেই ফোনটাতেই আমি লেখালেখি করতে পারতাম। সেই সময়ে ইন্টারনেটের তেমন প্রবল প্রতাপ ছিলোনা বলে আমি পরে ভেবেছি এই যন্ত্রটির একটি বড় কাজ হতে পারে ইন্টারনেট ব্যবহার করা। ঐ যন্ত্রটি আমার ছবি তোলার যন্ত্র হোক তেমনটা কখনও ভাবিনি। আমার দ্বিতীয় মোবাইল ফোনটাতে ক্যামেরা ছিলো-ছিলো ইন্টারনেট ব্রাউজ করার সুযোগ।

রেডিও ও গান শোনার ব্যবস্থা ছিলো। তাতে ছিলো অর্গানাইজার। তবে আমি ঐ ফোনটাকে ক্যামেরা হিসেবে কখনও খুব প্রিয় বলে মনে করিনি। আমার কাছে মোবাইলের ক্যামেরাকে এখনও খেলনাই মনে হয়। ঠেকায় পড়লে খেলনা ব্যবহার করা যায়-তবে ছবি তোলার জন্য একটি পেশাদারী ক্যামেরা না হলেই নয়। আমি ক্যামেরা নিয়ে তেমন ভাবিনা, কারণ কম্পিউটার দিয়ে ছবি তুলবো এবং সব সময়েই হাতের কাছে ক্যামেরা থাকবে সেটি এখন আর প্রয়োজন মনে হয়না। তবে ৭২ সালে যদি হাতে একটি ক্যামেরা থাকতো তবে আমি আমার পেশার প্রতি সুবিচার করতে পারতাম-সেটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। তখনকার মোবাইলের পর্দাটা এতো ছোট ছিলো যে এতে সিনেমা বা টিভি দেখার কথাও ভাবছিলাম না। লেখালেখির কথা তো এখনও ভাবতেই পারছিনা।

এখন স্মার্ট ফোনতো বটেই এমনকি সাধারণ মোবাইল মানেই আসলে গান শোনা, রেডিও শোনা, ছবি তোলা, ইন্টারনেট ব্রাউজ করা ইত্যাদি। কোন কোন ফোনে টিভি দেখা যায়। অফিস সফটওয়্যার চলে এমন স্মার্ট ফোন এখন বেশ জনপ্রিয়। আমাদের পরিচিত কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ এখন মোবাইলে এসেছে। এর সাথে আরও আছে সিমবিয়ান ও এন্ড্রয়েড নামের আরও দুটি জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেম। ধীরে ধীরে টাচ স্ক্রীন প্রযুক্তিও প্রসারিত হয়েছে। মোবাইলের মাঝে টাচস্ক্রিণ অতি সাধারণ ঘটনা। মাত্র ৫-৬ হাজার মোবাইল ফোনে টাচ স্ক্রিন পাওয়া যায়। পাশাপাশি এখন নেটবুক বা ল্যাপটপেও সেই প্রযুক্তি বিস্তৃত হয়েছে।

এমন একটি অবস্থায় আমাদের হাতে বহন করার ডিজিটাল যন্ত্রটি কি হতে পারে? আইএন ২০১৫ নামক একটি কর্মসূচির জন্য সিঙ্গাপুরের সরকারীভাবে তৈরী করা একটি ভিডিওতে আমি দেখেছি কাচের মতো স্বচ্ছ একটি যন্ত্র যাকে একটি ল্যাপটপ কম্পিউটার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আমার নিজের কাছে মনে হয় সেই যন্ত্রটির সাথে আরও একটি মোবাইল ফোন আমাদেরকে ব্যবহার করতে হবে। তবে আমি নিঃসন্দেহ নই যে আমরা দুটি যন্ত্র ব্যবহার করবো, না একটি যন্ত্র ব্যবহার করবো। আমি কেন জানি দুটির বদলে একটি যন্ত্র ব্যবহৃত হবে বলে মনে করছি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, তার মতে, যাদের কম্পিউটিং ক্ষমতার প্রয়োজন নেই, সেই সাধারণ মানুষের জন্য প্রচলিত মোবাইল ফোন আরও অনেক দিন ডিজিটাল যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এতে হয়তো টর্চ লাইট থেকে শুরু করে আরও অনেক প্রয়োজনীয় সুবিধা যুক্ত হবে। তবে আমার ধারণাটি হলো আমার মতো ব্যবসায়ী-শিক্ষক, ছাত্র, রাজনীতিক বা সব কিছুতেই সচল থাকতে চান এমন একজন মানুষের জন্য সেই যন্ত্রটির রূপরেখা হবে এমন:

১) এই যন্ত্রটির প্রথম কাজ হবে মোবাইল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া। তবে একেবারে হাতের মুঠোয় এখন যেভাবে ছোট যন্ত্রটি বহন করি সেটি তেমন নাও হতে পারে। দিনে দিনে টাচ স্ক্রিণ জনপ্রিয় হলেও এর একটি স্লাইডিং কীবোর্ড তার প্রয়োজনীয়তা হারাবে না। এর পর্দাটা সাত ইঞ্চির মতো হতে পারে। কখনও পাচ ইঞ্চি বা কখনও নয় ইঞ্চি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
২) এই যন্ত্রটির কেবল মাত্র সলিড স্টেট স্টোরেজ বা মেমোরি কার্ড থাকবেনা এতে হার্ডডিস্ক থাকবে। তবে কোন সময়ে ক্লাউড কম্পিউটিং জনপ্রিয় হলে হার্ডডিস্ক ডিভাইস কেউ এই যন্ত্রে নাও চাইতে পারেন।
৩) এই যন্ত্রের প্রসেসর অন্তত এটম গোত্রীয় হবে। এর গতি ২ গিগাহার্টজ-এর কাছাকাছি হতে পারে। এতে ক্যাশ মেমোরি ও উন্নত গ্রাফিক্স থাকবে।
৪) এতে থ্রি-জি/ ফোর জি/এনজিএন ইত্যাদি মোবাইল নেটওয়ার্ক, ব্লটুথ, ইভিডিও, ওয়াই ফাই, ওয়াই ম্যাক্স ইত্যাদি বিল্ট ইন থাকবে। এতে ইউএসবি পোর্ট তো থাকবেই-৩.০ সংস্করণও থাকতে পারে।
৫) এর কীবোর্ডটি স্থানীয় ভাষায় মুদ্রিত থাকবে এবং আকারটি কোনভাবেই একটি স্মার্ট ফোনের চাইতে বড় হবেনা।
৬) এর অপারেটিং সিস্টেমটি হবে গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস-যেমনটা ম্যাক ও.এস বা উইন্ডোজ-এর হয়ে থাকে। এতে এ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামগুলো থাকবে যা দিয়ে নেটওয়ার্ক বা ইন্টারনেটও মোবাইলের কাজতো করা যাবেই, তাছাড়া লেখালেখি-ছবি সম্পাদনা, ভিডিও সম্পাদনা, হিসাব নিকাশ ইত্যাদি করা যাবে। প্রিন্ট করার ব্যবস্থাতো থাকবেই। তবে তার জন্য তারের দরকার হবেনা। এতে গান শোনা, সিনেমা দেখা, টিভি দেখা এবং বই পড়ার ব্যবস্থা থাকবে।
৭) ডিভাইসটির দাম বিশ হাজার টাকার ওপরে হবেনা। এর ব্যাটারী লাইফ পাচ ঘন্টা থেকে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে। এর সাথে কার ও সোলার চার্জার যুক্ত হতে পারে।

এই ডিজিটাল যন্ত্রটির বেশ কটি ভিন্নতাসম্পন্ন সংস্করণও থাকবে। প্রথমত এই যন্ত্রটির আকার ৮/৯ বা ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। এতে স্লাইডিং কীবোর্ড না থেকে শুধু মাত্র টাচ স্ক্রিণ থাকতে পারে। এটি আকারে একটি বই-এর সমান হতে পারে। মানুষ যেভাবে একটি ডাইরী ব্যবহার করে যন্ত্রটি সেভাবে ব্যবহৃত হবে এবং ব্যবসায়ী বা অন্যরা যেভাবে সর্বত্র একটি বই আকারের ডাইরী ব্যবহার করেন তেমনভাবে ব্যবহার করতে পারেন। এই যন্ত্রটিতে ছাত্র-ছাত্রীরা তাদরে সকল পাঠ্যবই সংরক্ষণ করবে এবং পরীক্ষ দেওয়া থেকে ফলাফল পাওয়া পর্যন্ত সকল কিছুই এই যন্ত্রেই করা যাবে।

প্রশ্ন হতে পারে এখন ডিজিটাল যন্ত্রের বাজারে কি এমন ধরনের যন্ত্রের ধারণা রয়েছে? এমন যন্ত্র কি বাজার আছে? নাকি এমন যন্ত্র তৈরীর পর্যায়ে আমরা রয়েছি?
বাস্তবতাটি বেশ মজার। কার্যত এখনই এই ধরনের যন্ত্র আন্তর্জাতিক বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। আমি যে যন্ত্রের বিবরণ দিয়েছি সেই ধরনের যন্ত্র হুবহু না হলেও কাছাকাছি বা কোন কোন ফিচার ব্যতীত অন্য ফিচারসহ যন্ত্রতো এখনই বাজারে কেনা যেতে পারে। বাংলাদেশের বাজারে এখনও সেই পর্যায়ের পরিবর্তন না হলেও আমার নিজের বিবেচনায় ২০১১ সালের মাঝে এই ধরণের যন্ত্রের একটি বিশাল বাজার এই দেশেই গড়ে ওঠবে।

মোস্তাফা জব্বার: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর প্রণেতা।

ফেসবুক লিংক । মতামত-বিশ্লেষণ