খালেদা জিয়া ও নাজমুল হুদার ফ্রুটিকা বচন

মোজাম্মেল বাবু
Published : 21 Nov 2010, 03:45 PM
Updated : 21 Nov 2010, 03:45 PM

৬ মঈনুল রোডের বাড়ি ছাড়া নিয়ে যে আইনী ব্যাখ্যা খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা দিয়েছেন তা একেবারেই সত্য নয়। তারা মূল পিটিশনে হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চাইলেও, টি এইচ খানের অসুস্থতার কারণে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত শুনানী পেছানোর আর্জিতে তারা আর সে দাবি করেন নি। এমনকি, প্রধান বিচারপতি তাদেরকে স্থগিতাদেশ চান কিনা জানতে চাইলেও তারা কোন রা করেন নি। যেখানে ১২ নভেম্বর বাড়ি ছাড়তে হাইকোর্টের বেঁধে দেয়া সময় শেষ হচ্ছে, সেখানে সরকার পক্ষ টাইম প্রেয়ার দিতে পারে, খালেদা জিয়ার আইনজীবিরা শুনানী পেছালেন কোন আক্কেলে? তাদের 'সবোর্চ্চ আদালতে আপিল পেন্ডিং আছে' বক্তব্যটিও সঠিক নয়, কেননা এ্যাপিলেট ডিভিশনে 'লিভ টু এ্যাপিল' অর্থাৎ আদৌ আপিল গ্রহণ করা হবে কি না তারই এখনও শুনানী হয়নি। কেবল লীভ টু আপিল গ্রান্ট হলেই বলা যেতে পারে 'এ্যাপিল পেন্ডিং', এর আগে নয়।

একটা বিষয় ভুললে চলবে না, বাংলাদেশের সংবিধান ১০২ অনুচ্ছেদে 'রিট' মামলা নিষ্পত্তির ক্ষমতা কেবল হাইকোর্ট ডিভিশনকেই দিয়েছে, এটা তাদের অরিজিনাল জুরিসডিকশন, আপিল বিভাগের এখানে সামান্যই বলার আছে। কেবল গুরুতর আইনী ব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছু বিবেচনা করবার এখতিয়ার আপিল বিভাগের নেই। দরকার মনে হলে হাইকোর্টেই তাদের রায়ের সঙ্গে সার্টিফিকেট ইস্যু করে থাকে যাতে আপিল বিভাগ সরাসরি মামলাটি শুনতে পারে, তখন কোন লীভ টু এ্যাপিলেরও প্রয়োজন হয় না। কিন্তু খালেদা জিয়ার বাড়ির রায়ে হাইকোর্ট সে ধরনের কোন আইনী ব্যাখ্যারও প্রয়োজন বোধ করে নি। সে কারণেই নিশ্চিত আইনী পরাজয় জেনেই মওদুদ আহমদ বলেছিলেন, 'আদালতের রায় যাই হোক না কেন, ফয়সালা হবে রাজপথে।'

সেদিন প্রধান বিচারপতির বাড়ি ঘুরে এসে খন্দকার মাহাবুব গং যে আশ্বাসের দাবি করেছেন তা সর্বৈব মিথ্যা। এ মর্মে সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের প্যাডে সেদিন যে সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে তাও সম্পূর্ণ অনৈতিক। সেদিন তারা তাহলে প্রধান বিচারপতির কাছে ঝারা হাত পায়ে বেড়াতে না গিয়ে লিখিত পিটিশন নিয়ে গেলেন না কেন? পরের দিনই বা চেম্বার জজের কাছে প্রতিকার চাইলেন না কেন? এখন তারা নানা ভাবে ২৯ তারিখের শুনানী প্রভাবিত করতে চাচ্ছে। বিএনপির আরেক শীর্ষ আইনজীবি নাজমুল হুদা বলেছেন, 'আইনজীবিদের ভুলে পৃথক স্টে পিটিশন না থাকার কারণেই বেগম জিয়াকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে।' বস্তুত ভুলে নয়, ইচ্ছেকৃতভাবেই এ্যাডজয়েন্টমেন্ট আর্জিতে 'স্টে' কিংবা 'স্ট্যাটাসকো' না চেয়ে তারা সরকারকে 'প্রোভোক' করতে চেয়েছেন যাতে সেনাবাহিনী বাড়ি খালি করতে গেলে তারা 'আদালতে এ্যাপিল পেন্ডিং আছে' এমন ধূয়া তুলে মাঠ গরম করতে পারে। অন্যদিকে, খালেদা জিয়াকে মালামাল গুছিয়ে রাখতে পরামর্শও দেয়া হয়েছে, যাতে অপ্রস্তুত অবস্থায় বাড়ি ছাড়তে না হয়, যার আলামত থরে থরে রাখা বাক্স-পেটরা দেখলেই পাওয়া যায়।

সরকারের জন্য ফাঁদ পাতলেও সে গর্তে বিএনপি নিজেই পড়েছে। কারও বুঝতে বাকি নেই যে, আইন খালেদা জিয়ার পক্ষে নেই। ঈদের মাত্র ২ দিন আগে হরতাল ডেকে তারা জনগণের এতটুকু সিমপ্যাথি আদায় করতে পারেনি। ঈদের পরও বাড়ি নিয়ে আর কিছু করার উপায় নেই, কেননা এক মরা দুবার চিতায় পোড়ানো যায় না। বিএনপির সাবেক মহাসচিব ওবায়দুর রহমানের স্ত্রী শাহেদা ওবায়েদ খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তিনি যেন বিএনপির নেতা-কর্মীদের আর তার নিজের বাড়ি রক্ষার কাজে 'সেন্ট্রি' কিংবা 'সিকিউরিটি গার্ড' হিসেবে ব্যবহার না করেন। ২০০৮ সালে বিএনপির জিতে আসা মাত্র ৩০টি আসন মূলত নোয়াখালী এবং বগুড়ায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ায় দুর্জনরা 'বিএনপি'র এ্যাবরেবিয়েশন করেছিল 'বগুড়া-নোয়াখালী পাটি', এখন যা হয়ে দাঁড়িয়েছে 'বাড়ি নেয়ার পার্টি'!

খন্দকার দেলোয়ার মঈনুল রোডের বাড়ির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে অর্নথক ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘরের প্রসঙ্গ তুলে এনে চরম কাণ্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। জাতির পিতার ইন্টিগ্রিটি নিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ভাষায় কথা বললে বাংলার মানুষ 'মুখে গোবর পুড়ে দেবে'। কেউ সুধাসদনের মডেলটির সঙ্গে মঈনুল রোডের আতিশয্যের তুলনা করলে, দেশবাসী চ্যাংদোলা করে পাগলা গারদে পাঠিয়ে দেবে। ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভা বঙ্গবন্ধু কন্যার নিরাপত্তা বিবেচনায় আইনের মাধ্যমে তাকে গণভবনে থাকার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু খালেদা জিয়ার সরকার সিদ্ধান্তটি বাতিল করলে শেখ হাসিনা নিরবে গণভবন ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। তিনি এ নিয়ে আদালতেও যান নি কিংবা রাজপথও গরম করেন নি। বরং বিএনপিই সেদিন গণভবনের বিদ্যুৎ-পানি-টেলিফোন লাইন কেটে তাকে কষ্ট দিতে চেয়েছে। খালেদা জিয়া বাড়ি নিয়ে আন্দোলনে নেমে নিজের দলকে রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া করে তুলছেন কেন? দেশবাসীকেই বা কষ্ট দিচ্ছেন কেন?

তিনি বেইলী রোডের ঈদ সম্বর্ধনায় বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশকে ৪০ বছর পিছিয়ে নিয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ নিজেই তো এ কথা বলছে, তারা দেশকে বাহাত্তরের সংবিধান অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনায় ফেরত নিয়ে যেতে চায়! মঈনুল রোড থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি হঠাৎ এত ডাহা সত্য কথা বলতে শুরু করেছেন কেন? শামীম ইস্কান্দরের বাসায় ওয়াইন গ্লাসে কেউ ভুল করে তাকে 'ফ্রুটিকা' খাইয়ে দেয়নি তো? ইতোমধ্যে নাজমুল হুদাও 'একটু বেশিই পিওর' জুস খেয়ে অনেক গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। এক সময় ম্যাডাম নিশ্চয়ই মন খুলে বলে বসবেন– `মওদুদ আহমদ আমাকে বাড়ি নিয়ে গাছে তুলে শেষমেশ কিনা বলে 'ম্যাডাম আপনি ঝুইল্লা পড়েন, আমি তো আছিই…!' একই ধরনের কু-পরামর্শ ১৯৯০ সালে ব্যারিস্টার সাহেব হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদকেও দিয়েছিলেন।

পুনশ্চ: ইতোমধ্যে সত্য কথা বলার অপরাধে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনিই সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ফ্রুটিকা-বলি।

বি. দ্র.

পাঠকদের মতামতের প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনাভ নিরবে গণভবন ছেড়া সম্পর্কিত "কিন্তু খালেদা জিয়ার সরকার সিদ্ধান্তটি বাতিল করলে শেখ হাসিনা নিরবে গণভবন ছেড়ে বেরিয়ে আসেন।" –এই বাক্যটির সংশোধিত রূপ হচ্ছে "খালেদা জিয়া মদদ-পুষ্ট লতিফুর সরকার সিদ্ধান্তটি বাতিল করলে শেখ হাসিনা নিরবে গণভবন ছেড়ে বেরিয়ে আসেন।" এবং "বরং বিএনপিই"–এর সংশোধিত রূপ হচ্ছে "বরং তারাই"