গণজাগরণ মঞ্চের বর্তমান অবস্থান ও ছয় দফা দাবি

আঞ্জুমান ইসলাম
Published : 24 April 2014, 03:37 AM
Updated : 24 April 2014, 03:37 AM

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর যে সব কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর বিচার চলছিল তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর যে শুধু বন্ধই করে দেওয়া হয় তা নয়, এই বিচার যেন আর করা না যায় তার জন্যে সংবিধানেও কাটাছেঁঁড়া করা হয়। আজ যে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি জোরদার, সেই দলটি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা আর যুদ্ধাপরাধের দায়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। সেই সঙ্গে নাগরিকত্ব বাতিল হয়েছিল দলটির শীর্ষনেতাদের।

স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষিত সেই জামায়াতে ইসলামী দলটিকে পুনরায় রাজনীতি করার সুযোগ করে দেওয়া হয় ১৯৭৫ সালের পর। একে একে ফিরে আসে নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজাকার, আলবদর নেতারা। শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় শাহ আজিজের মতো সর্বজনচিহ্নিত রাজাকারেরা স্থান পায়।

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে যে বিষক্রিয়া শুরু হয় ১৯৭৬ সালে, তার বিষবাস্প বাংলাদেশকে ছেয়ে গেছে তার পরবর্তী অনেক বছর ধরে। গুটিকয়েক মানুষ তারপরও চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন বাংলাদেশের জন্মলগ্নের নৃশংসতম অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআদালত গঠিত হয় রাজাকারদের বিচারের দাবিতে। তবে সেই প্রচেষ্টাও তৎকালীন বিএনপি সরকার বন্ধ করে দেয় এবং জাহানারা ইমামসহ আরও কয়েকজনকে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় জেলে পুরে দেওয়া হয়।

১৯৯২ এর সেই গণআদালতে শুধু যে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা সমর্থন দিয়েছিলেন তাই নয়, উনি জাহানারা ইমামের সঙ্গে মঞ্চেও ছিলেন।

[এ বিষয়ে একটি ভিডিও রিপোর্ট দেখুন–

এরপর, ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে, তখন থেকেই তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ আর মানবতাবিরোধী অপরাধে ক্ষতিগ্রস্ত জাতি হিসেবে বাংলাদেশ তার ত্রিশ লক্ষ ভিকটিমের কাছে দায়গ্রস্ত। সেই দায়বদ্ধতা থেকে তো বটেই, সে সঙ্গে সারাবিশ্বের তাবত মানবতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান জানাতেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার রোম স্ট্যাটুটে স্বাক্ষর করে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে।

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের পক্ষে শেখ হাসিনার অবিচল আস্থা থেকেই ভারত ও চীনের মতো প্রভাবশালী ও আমেরিকার মতো শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মতামত (ভারত ও চীন এখনও রোম স্ট্যাটুটে স্বাক্ষরই করেনি, আর আমেরিকা ২০০০ সালে স্বাক্ষর করলেও জানিয়ে দিয়েছে স্টেট পার্টি হিসেবে র‌্যাটিফাই করবে না) উপেক্ষা করেই তিনি এগিয়ে যান বিশ্বের কাছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিপক্ষে আমাদের জোরালো অবস্থান জানিয়ে দিতে।

শেষ পর্যন্ত ২০১০ সালে সেই রোম স্ট্যাটুটের র‌্যাটিফিকেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই স্ট্যাটুটের একটি স্টেট পার্টি হয়। যে কোনো দেশের যে কোনো যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধ ও অপরাধীর ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ় এবং এ নিয়ে সংশয় তৈরির কোনো সুযোগই নেই।

[Bangladesh Joins the International Criminal Court as 111the State Party; Dhaka makes history by putting its region on the map of countries committed to justice:

যাই হোক, এর মধ্যে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করে। কোনো রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে যখন একটি বিষয় অন্তর্ভূক্ত থাকে তখন সেটি আর অরাজনৈতিক তো থাকেই না, এমনকি সেটাকে রাজনীতির বাইরে ভাবাটা একেবারেই অন্যায্য।

আমার জানামতে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে দাবি করা অন্য কোনো বড় রাজনৈতিক দলই তাদের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করেনি। ছোট দলগুলোর মধ্যে সিপিবির ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি ছিল–

কিন্তু তারা সংসদে কোনো আসন লাভ করতে ব্যর্থ হয় ও ০.১ শতাংশেরও কম ভোট পায়। সুতরাং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে বড় দলগুলোর মধ্যে একমাত্র আওয়ামী লীগেরই প্রতিশ্রুতি ও ইচ্ছা ছিল এবং জনগণও অন্য দলের সঙ্গে তুলনায় তাদের উপরই বেশি আস্থা রেখেছিল।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এই ব্যাকগ্রাউন্ড সংক্ষেপে বললাম এ জন্য যে, গণজাগরণ মঞ্চ নামের 'অরাজনৈতিক' প্লাটফর্ম বলে দাবিকৃত একটি সংগঠন আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে ছয় দফা দাবি আদায়ে সোচ্চার। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে যে আন্দোলনের শুরু সেটির মরফোসিস বা রূপান্তর বিবেচনা করা এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ সেটা থেকেই বের হয়ে আসবে গণজাগরণ মঞ্চের বর্তমান গতিপথ কোনদিকে যাচ্ছে আর কার পারপাস সার্ভ করছে।

গত কয়েক দিনে এই সংগঠনের মুখপাত্র বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও মিডিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন যে, আওয়ামী লীগ সরকার কৌশলগত কারণে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া 'তাদের' আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিল এবং এখন প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়াতে সমর্থন উঠিয়ে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে মঞ্চের মুখপাত্র আর তার বর্তমান সহকর্মীদের প্রতি যে প্রাথমিক প্রশ্নটি জাগে তা হল– ঠিক কী কৌশলগত কারণে ওই সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার মঞ্চকে সমর্থন দিয়েছিল বলে মনে করছেন তারা? তখন তো মঞ্চ থেকে দবি করা হচ্ছিল যে, শেখ হাসিনার সরকার জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে আঁতাত করে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় দেয়নি এবং এ প্রেক্ষিতে বাদীপক্ষের আপিল সুবিধা দিয়ে আইন পরিবর্তনের দাবিও তোলা হয়।

তাহলে কি ব্যাপারটি এমন যে, আইনটি পরিবর্তন করতে আওয়ামী লীগই চেয়েছিল. আর শাহবাগ আন্দোলন সরকারের সেই আইন সংশোধনের কাজটিতে জনগণের প্রত্যক্ষ সাপোর্ট হিসেবে দেখা দিয়েছিল, আর সেটি-ই শাহবাগ আন্দোলনকে সমর্থনের 'কৌশলগত' কারণ, নাকি এখানে অন্য কোনো কৌশল-চিন্তা ছিল?

আর এখন কীসের প্রেক্ষিতে গণজাগরণ মঞ্চ বলছে যে, তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় তারা মাঠে থাকুক তা আওয়ামী লীগ সরকার চাইছে না? কোন প্রয়োজনটি আওয়ামী লীগ সরকার মনে করছে ফুরিয়েছে এবং মঞ্চ মনে করছে আসলে ফুরায়নি, আর এ কারণে মাঠে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া যৌক্তিক মনে করছে ওরা?

এ প্রসঙ্গে গণজাগরণ মঞ্চের ছয় দফা দাবির বিশ্লেষণ করে দেখা যাক যে উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় কিনা। তাদের ছয় দফা প্রসঙ্গে কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করার অবকাশ আছে বলেও আমি মনে করছি; কেননা তাদের এই দাবিগুলো (যুদ্ধাপরাধীদের সুষ্ঠু বিচার যার অন্যতম) শুধুমাত্র কি আওয়ামী লীগ নামক একটি রাজনৈতিক দলের কাছেই, নাকি বাংলাদেশে সরকার গঠনের ক্ষমতা রাখে এ রকম সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি, সেই বিষয়টি-ও পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা যদি মঞ্চের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়, তাহলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে কি বর্তমানে তারা কোনো দাবি পেশ করেছে?

ছয় দফা দাবির বিষয়ে আমার প্রশ্নগুলো আমি প্রতিটি দাবির নিচে দিয়ে দিচ্ছি–

১. একাত্তরের সকল ঘাতক-দালাল যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।

প্রশ্ন–

এখন কি যুদ্ধাপরাধীদের 'সর্বোচ্চ' শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধানটি নেই, নাকি এ ক্ষেত্রে কোনো আইন সংশোধনের প্রয়োজন? আইন সংশোধনের প্রয়োজন থাকলে দাবিটি সরকারের জন্যে প্রযোজ্য হতে পারে। আর যদি প্রয়োজন না থাকে সে ক্ষেত্রে এই দাবি বর্তমানে অমূলক, কারণ কেবল আইন সংশোধন ও পরবর্তীতে বিচারের শেষে চূড়ান্ত রায়টি আসার পর তা বাস্তবায়ন করা ছাড়া সরকারের নির্বাহী বিভাগ আর আইন প্রণয়নকারী অংশের (অর্থাৎ পার্লামেন্টের) এ ক্ষেত্রে আর কোনো ভূমিকা নেই।

২. আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে বিবাদীপক্ষের মতো বাদীপক্ষেরও আপিলের সুযোগ তৈরি করতে হবে এবং আপিল বিভাগে সর্বোচ্চ ৩ মাসের মাথায় আপিল নিষ্পত্তির আইনি বিধান রেখে আইন সংশোধন করতে হবে।

প্রশ্ন–

বাদীপক্ষের আপিলের সুবিধা দিয়ে আইনটি কি সংশোধন হয়েছে নাকি এখনও এ ক্ষেত্রে সরকারের কিছু করার আছে বলে মনে করছেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র? যদি আছে বলে মনে করেন তাহলে তা কী? আর যদি মনে করেন সরকার আইনটি সংশোধন করে ফেলেছে, সে ক্ষেত্রে এই দাবি কি আর ছয় দফার মধ্যে থাকা সমীচীন বা যুক্তিযুক্ত?

৩. যেসব রাজনৈতিক দল, শক্তি, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার চেষ্টা করছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করছে এবং তাদের সঙ্গে আঁতাত করছে, তাদেরও আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে।

প্রশ্ন–

দাবিটি আসলে কার কাছে? যেসব দল যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করছে বা যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করে তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক ও ভোটের জোট করেছে, সেসব দলের দলীয় নীতির ব্যাপারে কি আওয়ামী লীগ সরকারের নাক গলানো সম্ভব? একটি গণতান্ত্রিক দেশে কি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা সরকার এটি নির্ধারণ করে দেবার ক্ষমতা রাখে যে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দলের সঙ্গে কে জোটবদ্ধ হবে আর রাজনীতি করতে পারবে? বরং অন্য সকল রাজনৈতিক দলই যেন তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া চালিয়ে নেওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করে সেটি নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের দাবি থাকাটাই যুক্তিযুক্ত হত না?

৪. ধর্মকে ঢাল হিসেবে সামনে রেখে ঘাতক-দালালরা দেশ-ধ্বংসের যে রাজনীতি করে সেই রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। দেশে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহ করা এসব কুলাঙ্গারদের গ্রেফতার করে অবিলম্বে কঠোরতম শাস্তি দিতে হবে।

প্রশ্ন–

একটি দেশে কী ধরনের রাজনীতি চালু থাকবে আর কী ধরনের রাজনীতি পরিহার করা হবে তা নির্ধারিত হয় সংবিধান দ্বারা। যদি কোনো দল ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসে, অর্থাৎ নির্বাচনী ইশতেহারে যদি ধর্মকে ঢাল হিসেবে রাজনীতিতে ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হবে এই মর্মে একটি ঘোষণা থাকে এবং তারপর জনগণ যদি তাদেরকে ভোট দেয় এবং সংবিধান সংশোধন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাদের থাকে, তবেই কেবল সেই সরকারের পক্ষে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

এ ক্ষেত্রে তাই আবার প্রশ্ন আসছে যে, গণজাগরণ মঞ্চের দাবিটি আসলে কার কাছে? শুধু আওয়ামী লীগের কাছেই নাকি অন্য দলগুলোর কাছেও তাদের একই দাবি? আওয়ামী লীগের দলীয় ম্যান্ডেট কী হবে তা নির্ধারণ করবে দলের রাজনীতিতে জড়িত ব্যক্তিবর্গ আর কর্মী, সমর্থক, ভোটারেরা। একটি রাজনৈতিক দলের ম্যান্ডেট কী হবে তা কি একটি 'অরাজনৈতিক' সংগঠনের রাজপথের আন্দোলনের প্রতিপাদ্য হতে পারে?

আর তাছাড়া আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, কাল অন্য কোনো দল ক্ষমতায় যাবে– গণতন্ত্রের এটিই নিয়ম। সে ক্ষেত্রে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের কাছেই এই বিষয়ে দাবি তোলা আর অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতি কোনো প্রত্যাশা তৈরি না করাটা গণজাগরণ মঞ্চের উদ্দেশ্য (যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিতকরণ) হাসিলের জন্যে কতটা যুক্তিযুক্ত কিংবা দীর্ঘমেয়াদে ফলপ্রসূ?

'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আওয়ামী লীগ ভোটের রাজনীতি করছে'– কথাটা গণজাগরণ মঞ্চের বিভিন্ন নেতা-কর্মীর মুখে প্রায়ই শোনা যায়। এটি নিশ্চয়ই অবাক করা বিষয় নয় যে, প্রতিটি রাজনৈতিক দলই ভোটের হিসাব করে। ভোটের জন্যেই দেশের অন্য বড় রাজনৈতিক দলগুলো জামায়াতে ইসলামী তথা যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে জোট বেঁধেছে। সেটি ছাড়াও আদর্শগত দিক থেকেও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে অন্য বৃহৎ দলের যুগপৎ বাঁধনের ইতিহাস এবং বর্তমান রয়েছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা, সংবিধান সংশোধন করে ভবিষ্যতে বিচার না করতে পারার ব্যবস্থা করা, যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন আর সবশেষে তাদের সঙ্গে সরকার গঠন করার মাধ্যমে বার বার এই আদর্শিক সংশ্লিষ্টতা প্রতীয়মান। তাই প্রকাশ্যে যারা জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে থেকে তাদের হাত শক্তিশালী করছে, তাদের গৃহযুদ্ধের আস্পর্ধা উস্কে দিচ্ছে, সেখানে শুধু আওয়ামী লীগের ব্যাপারে 'ভোটের রাজনীতি' করার বিষয়টি টেনে আনা আর অন্য দলগুলোর ব্যপারে নিরব থাকা কি হাস্যকর নয়?

আর যে কথাটি বারবার বলতে শোনা যায়– 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দীর্ঘায়িত করে আওয়ামী লীগ
পরবর্তী ইলেকশনে ফায়দা লুটতে চাইবে'– সে ক্ষেত্রে শুধু 'আওয়ামী লীগ ফায়দা লুটছে ফায়দা লুটছে' এই বলে বক্তব্য না দিয়ে যেন একাই আওয়ামী লীগ ফায়দা লুটতে না পারে সে জন্যে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টিতে জাতীয় ঐক্যমতে পৌঁছানোতে বাধ্য করার জন্যে চাপ সৃষ্টিই কি বেশি গ্রহণযোগ্য হত না?

৫. পঁচাত্তর-পরবর্তীতে যে যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের প্রত্যেককে আবার গ্রেফতার করে বিচার করতে হবে।

প্রশ্ন–

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ সরকার কি দ্বিমত পোষণ করছে অর্থাৎ তারা কি কোথাও বলেছে যে, আমরা এই ছয় বা আট জন বা দশ জনের বিচারের পর ট্রাইব্যুনাল বন্ধ করে দিব? আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তো বরং বলছে যে, বিচারপ্রক্রিয়া চলতেই থাকবে, যতদিন না সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার শেষ হয়। অন্যদিকে পঁচাত্তর-পরবর্তী যে সরকার বা রাজনৈতিক দল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রহিত ও আটককৃতদের ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে জড়িত সেসব দলের ব্যাপারে কি গণজাগরণ মঞ্চের কোনো বক্তব্য আছে, নাকি পুরো দাবি শুধুই আওয়ামী লীগ সরকারের উপর বর্তায়?

অন্য যে সকল রাজনৈতিক দল 'স্বাধীনতার চেতনা'র কথা বলে বাংলাদেশে রাজনীতি করে, কিন্তু জামায়াতে ইসলামী ও এর রাজনৈতিক দোসররা ইলেকশনে না আসায় ইলেকশন বয়কট করে– সেই সকল দলের উপরও কি এসব দাবি প্রযোজ্য?

৬. যুদ্ধাপরাধীদের বিভিন্ন ব্যবসায়ী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করতে হবে।

প্রশ্ন–

যুদ্ধাপরাধী হিসেবে প্রমাণিত ও দণ্ডিত হবার আগে সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ব্যবসায়ী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে নিষিদ্ধ করা সম্ভব? দাবিটিতে তিন ধরনের সংগঠনের কথা উল্লেখ থাকলেও, যুদ্ধাপরাধীদের 'রাজনৈতিক' সংগঠনের কথা উল্লেখ নেই কেন? তারপরও যেহেতু যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নাম এসেছে এবং দলটির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনপূর্বক মামলা দেওয়া হয়েছে, এ ব্যাপারে গণজাগরণ মঞ্চের অবস্থান কী? কেন জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছে বলে করেন তারা? এখানেও কি তারা শুধুমাত্র রাজনৈতিক 'কৌশল' দেখতে পাচ্ছেন, যেমন কৌশলের কথা বার বার শোনা গিয়েছে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হবার পূর্ব পর্যন্ত?

ছয় দফা সংক্রান্ত উপরোক্ত প্রশ্নগুলো দাবিগুলোর বর্তমান অবস্থা, অবস্থান আর প্রয়োজনীয়তা পরিস্কার করতে সাহায্য করবে। সেই সঙ্গে আসলে দাবিগুলোর পরিমার্জন বা সংশোধন দরকার কিনা সেটাও বিবেচনায় আনতে সাহায্য করবে আশা করি। গত এক বছরেরও অধিক সময়ের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই ছয় দফা সংক্রান্ত প্রশ্নগুলো রাখার পাশাপাশি পরিশেষে শুরুর প্রশ্ন দুটিই আবার করতে চাই–

১. গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঠিক কী কৌশলগত কারণে আওয়ামী লীগ গণজাগরণ মঞ্চকে সমর্থন দিয়েছিল বলে মনে করে ওরা?

২. আওয়ামী লীগ কী কারণে হঠাৎ 'অ-কৌশলী' হয়ে গিয়ে মঞ্চ থেকে সমর্থন সরিয়ে নিচ্ছে? আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে আওয়ামী লীগের মনোভাবে কী পরিবর্তন এসেছে যে, আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া অপরিহার্য বলে মনে করছে ওরা?

গণজাগরণ মঞ্চ যদি আসলেই চায় যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারটি অরাজনৈতিকভাবে অব্যাহত থাকুক (অর্থাৎ কোনো একটি বা দুটি রাজনৈতিক দলের দলীয় এজেন্ডা না হয়ে এটি যেন একটি জাতীয় বিষয় হিসেবে সকল রাজনৈতিক দলের জন্যে সমান গুরুত্বের বিষয় হয়ে উঠুক), সে ক্ষেত্রে নিজেদের দাবিগুলোকে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ-কেন্দ্রিক না করা কি বাঞ্ছনীয় নয়?

যদি সত্যিই মঞ্চের মূল প্রতিপাদ্য হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাহীনভাবে এগিয়ে নেওয়া, তাহলে ক্ষমতার পালাবদলে যেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারটি বানচাল না হয়ে যায় সেটিকেও আমলে নেওয়া উচিত নয় কি? ২০০৮ সালে নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহারে 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করব' বলে উল্লেখ করেছে, অথচ ২০১৩ সালে এসে জামায়াত-বিএনপি জোট ইলেকশনে না আসায় নিজেরা ইলেকশন বয়কট করেছে এই বলে যে 'সব' দল না এলে তারাও ইলেকশনে আসবে না– এ ধরনের কিছু রাজনৈতিক দলের সমঝোতার রাজনীতিও কিন্তু প্রকাশ্যেই চলছে।

এ থেকে আবার প্রমাণিত হয়েছে যে, জনগণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে ২০০৮ সালে যে দলের উপর আস্থা রেখেছিল এখন পর্যন্ত সেটিই সঠিক প্রমানিত। গণজাগরণ মঞ্চ থেকে আওয়ামী লীগের দিকে আঁতাতের আঙুল তোলার আগে অন্য রাজনৈতিক দলের পূর্বাপর অবস্থান বিবেচনা করা উচিত নয় কি?

আর তাছাড়া আদালত থেকে দেওয়া কোনো একটি রায় যদি মনমতো না হয়, তাহলেই যে সরকার আঁতাত করছে বলে ধোঁয়া তোলে গণজাগরণ মঞ্চ, তাতে কি বিএনপি-জামায়াতের বক্তব্যই প্রতিধ্বনিত হয় না যে, আওয়ামী লীগ সরকার দ্বারা বিচার বিভাগ সম্পূর্ণরূপে প্রভাবিত এবং সরকার বিচারপতিদের বিচারের উপর হস্তক্ষেপ করে নিজেদের ইচ্ছােো রায় বানাচ্ছে?

যে বিচারকে আন্তর্জাতিক মহলে অবাধ ও নিরপেক্ষ বলে প্রতিষ্ঠিত করতে সারাবিশ্বের স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছেলেমেয়েরা অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে, সেই বিচারকে নিজেরাই যদি আপোস ও আঁতাতের রায় বলে বেড়ায় বিচারের দাবিতে সোচ্চার গণজাগরন মঞ্চ– তাহলে এই বিচারের গ্রহণযোগ্যতা থাকে কোথায়?

আসলেই এখন এটা ভাবার সময় এসেছে যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে সম্মত হওয়া ও বিচারের রায় কার্যকর করা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকেই বারবার প্রশ্নের মুখোমুখি করা আর অন্য কোনো রাজনৈতিক দলকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি দলীয় এজেন্ডাভুক্ত করার দাবি না তোলার বিষয়টি গণজাগরণ মঞ্চের গ্রহণযোগ্যতা ও 'অরাজনৈতিক' অবস্থানকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

যে রাজনৈতিক দলটি বিচারকার্য এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাদেরই একতরফা ও ঢালাওভাবে প্রতিপক্ষ বানানোটা মঞ্চের জন্যে কতটুকু যুক্তিযুক্ত হচ্ছে এবং এতে শেষ পর্যন্ত লাভ হচ্ছে কার?