সেন্ট মার্টিনে মৃত্যু ও মিডিয়ার ভূমিকা

বৃন্দলেখক
Published : 22 April 2014, 05:24 AM
Updated : 22 April 2014, 05:24 AM

সেন্ট মার্টিনে পহেলা বৈশাখ পালন করতে গিয়ে আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ছাত্র মারা যান। এখনও নিঁখোজ রয়েছেন দুজন। এ ঘটনায় নিহত ও নিখোঁজদের স্বজনদের উৎকণ্ঠা এখনও কাটেনি। তারা কিছুতেই তাদের জীবনের সে 'দুঃসহ' স্মৃতি ভুলতে পারছেন না।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে ঘটনাটির ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। সেই দলে ছিলাম আমরা, কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের জাওদাত রহমান ও আশিফ মুজতবা। এখানে গণমাধ্যমের সে সময়কার ভূমিকা নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।

১৪ এপ্রিল, ২০১৪ এর সেন্ট মার্টিন ট্র্যাজিডির শিকার আমরা। ঘটনার ভয়াবহতা আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে আমাদের, প্রাণপ্রিয় বন্ধুদের হারানোর বেদনা সহ্য করতে হবে তাদের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে।

সবচেয়ে দুঃখজনক হল, সেদিনকার এই দুর্ঘটনা এবং এর পরের সময়গুলোতে আমাদের শিকার হতে হয় আরও নির্মম এক বাস্তবতার যা কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া অনেক কষ্টের। আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার সত্যটাকে বার বার ঘোলাটে করা হয়েছে সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল, মিডিয়া আর সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুকে। কিছু অর্ধসত্য, মিথ্যা আর ভুল তথ্য যা প্রকাশ করা হয়েছে– সেগুলো নিয়ে এখানে বলার চেষ্টা করব। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই হলুদ সাংবাদিকের সংখ্যা এতই বেশি ছিল যে এর সব বলাও হয়তো সম্ভব নয়!

প্রথমে ইনডিপেনডেন্ট টিভিতে বলা হয়, কোস্ট গার্ড বার বার মানা করার পরেও, সংকেত দেওয়ার পরও ছেলেরা পানিতে লাফালাফি করছিল এবং অনেক দূরে চলে যায়। সত্য কথা হচ্ছে, ওই সময় সেখানে কোনো কোস্ট গার্ডই ছিল না। যেখানে কোস্ট গার্ড ছিল না সেখানে তারা কীভাবে আমাদের নিষেধ করে? একজন কোস্ট গার্ডও ঘটনাস্থলে অথবা ঘটনা ঘটার ১০-১৫ মিনিটের সময় ব্যবধানে থাকলে, আমাদের একটি প্রাণও যেত না।

এটিএন বাংলাতে বলা হয়েছে, ঘটনাস্থলে লাল পতাকা দেওয়া ছিল, ছেলেরা তা খেয়াল করেনি। কিন্তু নির্মম সত্য হচ্ছে, লাল পতাকা দেওয়া হয়েছে ১৫ এপ্রিল সকাল ৮ ঘটিকায়; মানে দুর্ঘটনার একদিন পর আমাদের নিখোঁজ দুজনের মৃতদেহ পাওয়ার পর এবং আমাদেরই চাপে, আমাদেরই বলাবলির পর (নিশ্চিত করতে স্থানীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন)।

জনৈক বুদ্ধিজীবী ফেসবুকে প্রশ্ন তুলেছেন– "শিক্ষা সফরে শিক্ষক নেই কেন?"

এটা কোনো শিক্ষা সফর ছিল না। আমরা গত ৯ এপ্রিল আমাদের ভার্সিটি জীবনের অধ্যায় শেষ করি আমাদের শেষ পরীক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে। আগেই প্ল্যান ছিল, সবাই মিলে ঘুরতে যাব সেন্ট মার্টিন। তেইশ-চব্বিশ বছরের ভার্সিটি পাশ ছেলেদের এই ঘুরতে আসায় শিক্ষক বা গার্জিয়ানদের টেনে এনে কেন আসল ব্যাপারটা ঘোলাটে করা হচ্ছে?

আঙুল তুলতেই যদি হয় তবে আসল খবরে তুলুন। যদি এখানে একই ভার্সিটির একই ব্যাচের ছাত্ররা না হয়ে অনেকগুলো ভার্সিটির ছাত্র হত বা আমরাই ৬ মাসের ব্যবধানে সদ্য চাকরিতে ঢুকে বেড়াতে আসতাম তখন উনারা কী বলতেন?

ফারহান শোভন আর আশিফ মুজতবাকে মাত্রই তীরে ওঠানোর পর যখন মাটিতে শোয়ানো হল, তখন তাদের ছবি তুলে লেটেস্ট নিউজ হিসেবে ছাপানো হল যে, এরা মারা গেছে। এই হচ্ছে আমাদের দেশের সংবাদপত্র আর সাংবাদিকতার নমুনা! মানুষের মৃত্যু নিয়ে অন্তত একটু গুরুত্বের সঙ্গে লিখুন।

লাশ শনাক্ত করার জন্য আমাদের ছবি দেওয়া হল। অথচ আমরা তখনও লাশ শনাক্ত করিনি বা বলিনি। এর আগেই সকল খবরের চ্যানেল বলে দিল যে, এটা সাব্বির হাসানের লাশ। আসলে লাশটা ছিল শাহরিয়ার নোমানের। না জেনে এভাবে সকল খবরের চ্যানেল কীভাবে একটা ভুল সংবাদ প্রচার করতে পারে! কীভাবে সম্ভব?

আমরা নিজে মাছরাঙ্গাসহ আরও কিছু টিভি চ্যানেলে নিশ্চিত করেছিলাম যে, দয়া করে সত্য নাম ছাপান, বিভ্রান্ত করার মতো সংবাদ দিবেন না। এরও ঘন্টা দেড়েক পরে দেখি, মাছরাঙ্গাও বাকি সব চ্যানেলের মতো মৃতদেহের নাম দেখাচ্ছে 'সাব্বির'।

এত ভয়ঙ্কর একটা এলাকা– স্থানীয়রা পরে আমাদের বলল, এই একই এলাকায় প্রতি বছর লোক মারা যায়– বছর খানেক আগে এখানে নাকি লাল ফ্ল্যাগ ছিল– তাহলে কথায় গেল সেই ফ্ল্যাগ!

বাইরের মানুষ কীভাবে জানবে যে, এখানে একটা খাদ আছে? প্রশাসন থেকে কোনো প্রকার সতর্কতা দেওয়া হয়নি। হোটেল (sand shore) আমাদের সতর্ক করেনি। কেন হোটেল থেকে জানানো হল না? কেন এই রকম জায়গায় একটা সাইনবোর্ড নেই? কেন কোনো প্রকার রেসকিউ টিম নেই? হয়তো ১০ মিনিট পরও একটা রেসকিউ টিম পেলে আমাদের বন্ধুরা বেঁচে যেত।

স্থানীয়রা ছ'জনকে উদ্ধার না করলে বেঁচে ফিরতাম না আমরাও। অন্তত বারোজন ওখানে মারা যেতাম। তীরে কোনো টিউব ছিল না। কেন এত বড় পর্যটন স্থানে তীরের আশেপাশে কোনো রেসকিউ টিউব থাকবে না?

বলে নেওয়া ভালো যে, আমরা এমন কোনো তীরে যাইনি যেখানে আমরা একা ছিলাম কিংবা যেখানে সচরাচর মানুষ যায় না। সেন্ট মার্টিনে গেলে সবাই 'উত্তর বিচ' বলে ওই জায়গাটারই বিচে নামে। ঘাঁটির প্রান্তে কেউ নামে না। যারা সেন্ট মার্টিনে যান, তারা সবাই জানেন তীরের কোন দিকে মানুষ সাঁতার কাটতে নামে।

বন্ধুদের দেহ ভ্যানে তুলে সেন্টমার্টিনে কোনো চিকিৎসক বা হাসপাতাল পেলাম না! ন্যূনতম প্রাথমিক চিকিৎসা করার মতো কোনো সাহায্য পেলাম না। হয়তো ওই প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু পেলেও কিছু জীবন বাঁচে। একটি পর্যটন স্থানে কেন থাকবে না জরুরি চিকিৎসা সেবা ও ডাক্তার-নার্স? কেন থাকবে না কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা– যে কোনো গুরুতর ঘটনা ঘটার ঝুঁকি যেখানে রয়েছে?

আমরা ভাবি, এসব কথা লেখার বা ‍তুলে ধরার কি কেউ নেই!

আসল সংবাদ না ছাপিয়ে, নিহতদের নামও ঠিকমতো না ছাপিয়ে, ভুল সংবাদ দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার আর আমাদের পরিবার-শিক্ষকদের লাঞ্ছনা করার অধিকার মিডিয়াকে কে দিয়েছে?

আমাদের দুর্বলতা, আমাদের শিক্ষক, বাবা-মা নিয়ে সবাই কথা বলছে– অথচ কেউ প্রশাসনের চরম দুর্বলতা, অবহেলা আর দায়িত্বহীনতা নিয়ে নিউজ দিল না। কেউ নয়!

গত কয়েক বছরে এই একই জায়গায় চৌদ্দজন (আমাদের বন্ধুরাসহ) ছেলে মারা গেল। আর কতজন মায়ের বুক খালি হলে পরে বা আর কতজন স্বজন হারালে প্রশাসন ব্যাপারটা গুরুত্বের সঙ্গে নিবে? মিডিয়াকে বলব, যেসব খবর ছাপালে ভবিষ্যতে মানুষের জীবন বাঁচবে, আর আমরা কেউ হারাব না আমাদের ছেলে, মেয়ে, সন্তান, ভাই বা বন্ধুকে– সেগুলো আগে ছাপান। এরপর না হয় আমাদের দোষ, দুর্বলতা, কাণ্ডজ্ঞানহীনতা নিয়ে কথা বলবেন।

অবশ্যই আমাদের দোষ তো ছিলই। আমরা ভ্রমণপাগল তরুণরা সবসময় বাংলাদেশের সৌন্দর্যই দেখতে চাই। আমরা ভুলে যাই, বাংলাদেশ যে ভ্রমণের জন্য নয়! বাংলাদেশে যে পর্যটন বলতে কিছু নেই এটা জানা উচিত ছিল আমাদের। তাহলেই আমরা হারাতাম না বাপ্পি, সাব্বির, অঙ্কুর, নোমান, ইভান আর উদয়কে।

এক সাংবাদিক ভাই প্রশ্ন করেছিলেন, "ঘটনা ফলাও করে প্রচার করায় কর্তৃপক্ষ দ্রুত আপনাদের বন্ধুদের লাশ অন্তত উদ্ধার করেছে। মিডিয়া বিষয়টা নিয়ে আগ্রহ না দেখালে, বন্ধুদের তো হারিয়েছেন, তাদের লাশও শেষবারের মতো দেখতে পেতেন না।"

আগ্রহ না দেখানোর তো কোনো সুযোগই নেই! ধরুন আপনি ডাক্তারের কাছে গেলেন একটা রোগ নিয়ে। ডাক্তার আপনাকে ঔষধ দিলেন, আপনি তা খেয়ে সাইড অ্যাফেক্টে বিকলাঙ্গ হয়ে গেলেন। ডাক্তার বললেন, "ঔষধ না দিলে তো প্রাণে মরতেন! প্রাণে বাঁচসেন, শুকরিয়া করেন!" কেমন লাগবে তাহলে?

উনি ডাক্তার, রোগ নিরাময় করা উনার পেশা। আপনি সাংবাদিক, সত্য ছাপানো আপনার পেশা। আপনি কারও প্রতি দয়া করছেন না, তাই নয় কী?

সাংবাদিক ভাই-আপুদের প্রতি তাই আমাদের অনুরোধ, সংবাদকে পণ্য হিসেবে নয়, সেবা হিসেবে আমাদের কাছে তুলে দিন। এটি তো আপনাদের কর্তব্য– আর আমাদের অধিকার।

জাওদাত রহমান ও আশিফ মুজতবা: আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।