রাষ্ট্র, সমান্তরাল রাষ্ট্র ও অনিরাপদ জনগণ

সেলিম খান
Published : 19 April 2014, 05:05 AM
Updated : 19 April 2014, 05:05 AM

সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা হত্যা মামলার আসামির লাশ পড়ে আছে বেতগাড়ি সেতুর পাশে। মেঘনায় বেশ কয়েকটি মানুষের লাশ ভাসছে। রাস্তার পাশ থেকে এক নারীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। অমুককে পাওয়া যাচ্ছে না।

গেল বেশ কিছুদিন ধরেই এ ধরনের খবর শিরোনাম হচ্ছে সংবাদপত্রে। তবে এগুলোতে যেন কেউ গা করছে না। না রাষ্ট্র, না সরকার, না রাষ্ট্রের মানুষ। সবশেষ গেল বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে কর্মস্থল থেকে বাসায় ফেরার পথে অপহৃত হলেন পরিবেশ আইনবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক। তাকে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ সড়কের একটি গ্যাসোলিন স্টেশনের কাছ থেকে অস্ত্রের মুখে মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় দিনের বেলায়।

স্বামীকে ফিরে পেতে অনেকটাই পরিমিত সোচ্চার রিজওয়ানা, স্বামী হারানোর ভয়ে। জানালেন, তার সম্পূর্ণ আস্থা রয়েছে সরকার ও রাষ্ট্রের প্রতি। বললেন, কাউকে দোষারোপ নয়, বরং সুস্থ অবস্থায় স্বামীকে ফিরে পাওয়াই তার কাছে সবথেকে জরুরি। সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বললেন, তারা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছেন আবু বকর সিদ্দিককে উদ্ধারের।

শেষতক সরকার কিম্বা রাষ্ট্র কেউই উদ্ধার করতে পারেনি এবি সিদ্দিককে। বরং অপহরণকারীরাই তাকে বৃহস্পতিবার রাতে ফেলে দিয়ে যায় রাজধানীর মিরপুরের আনসার ক্যাম্পের কাছে। তিনি এখন তার বাসায় স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে।

উপরের এটুকু লেখার অবতারণা মাত্র। একটি রাষ্ট্রের অন্যতম অনুষঙ্গ তার জনগণ। রাষ্ট্রপরিচালনার সনদ সংবিধানের শুরুতেই নিশ্চিত করা হয় জনগণের নিরাপত্তা, কল্যাণ, সবরকমের স্বাধীনতা এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রপরিচালনায় অংশ নেবার অধিকার। যদিও পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোতে এসব অধিকারের কতটা দেশের বেশিরভাগ মানুষের জন্য নিশ্চিত হয় তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বলা যেতে পারে, এ ক্ষেত্রে পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্র তার নিজের এগিয়ে চলার পথ নিরাপদ ও কন্টকমুক্ত রাখতে ঠিক যতটা প্রয়োজন, ততটাই নিশ্চিত করে সাধারণ মানুষের অধিকার ও নিরাপত্তা।

তার ওপর সেই রাষ্ট্রটির স্বীকৃতি যদি হয় একনায়কোচিত, সাংবিধানিক কিম্বা আইনি– তাহলে সাধারণের এসব অধিকার ও নিরাপত্তার ঘাটতি দেখা দেয় প্রচণ্ডভাবে। তবে শেষতক দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সাধারণের দিক থেকে অধিকার ও নিরাপত্তা আদায়ে সোচ্চার হবার নজির যে নেই তা কিন্তু নয়।

বহির্বিশ্বের অন্য রাষ্ট্রের কথা বাদই দিলাম। এ ধরনের নজির তো আমাদের এই বাংলাতেই রয়েছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতন, ভয়ভীতি, শোষণ, জনঅধিকারহরণ– এসবের বিরুদ্ধে এই বঙ্গের মানুষকে সোচ্চার হতে শিখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এ কথা তো মানতেই হবে। যাঁর নেতৃত্বে এদেশের অধিকারহীন মানুষগুলো শিখেছিল অধিকার আদায়ের সংগ্রাম কীভাবে করতে হয়। শুধু কি তাই, একটি সুসংগঠিত রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে চূড়ান্তভাবে অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কীভাবে জয়ী হতে হয় তাও একাত্তরে বিশ্বকে দেখিয়ে দেয় এই বদ্বীপের জনগোষ্ঠী।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে সুষ্ঠু বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কোনো কিছুই পায়নি এদেশের মানুষ। স্বাধীনতার কিছু সময় যেতে না যেতেই বাঙালির মুুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে ব্যবহারকারী এই রাষ্ট্র আবির্ভূত হয়েছে তার পুঁজিতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যে। যার পরিণতিতে এই রাষ্ট্র জনগণকে দিয়েছে একনায়কত্ব, সামরিক স্বৈরাচার, সাংবিধানিক গণতন্ত্রের নামে শোষণ, জনসম্পদের অবাধ লুটপাট। এমনি ধারাবাহিতায় আজ বাংলাদেশের মানুষ 'আপাত নির্বাচিত' একটি 'সাংবিধানিক' সরকারের অধীন রাষ্ট্রের অন্যতম অনুষঙ্গ মাত্র।

'আপাত নির্বাচিত', 'সাংবিধানিক' এই শব্দবন্ধ দুটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিছুটা হলেও বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে। আমরা যদি সময়ের দিক থেকে একটু পেছনে যাই, তাহলে দেখতে পাই, একটি অসাংবিধানিক, প্রলম্বিত তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালে তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ, যারা কি না এদেশের পুঁজির মালিকদের প্রথম প্রতিনিধিত্বকারী দল। ক্ষমতার অপব্যবহার ও জনবিচ্ছিন্নতার মতো অনুষঙ্গকে স্বাগত জানানোয় দেশের পুঁজির মালিকদের কাছে অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ে দেশের ইতিহাসে সবথেকে বেশি সময় সরকারে থাকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবার পরমুহূর্ত থেকেই বিএনপি নিজেদের সীমিত করে ফেলে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবার আন্দোলন কর্মসূচিতে। আর যে কারণেই গেল পাঁচ বছরের বেশি সময়েও ইসলামি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এই দলটি নিজেকে তেমন একটা গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারেনি দেশের পুঁজির মালিকদের কাছে। বরং বিদ্যুৎ, রামপাল, আইসিটি আইন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জনমানুষের নিরাপত্তাহীনতা, হত্যা, গুমের মতো জনসংশ্লিষ্ট ইস্যু পেয়েও ওরা গড়ে তুলতে পারেনি সর্বজনগ্রাহ্য কোনো আন্দোলন।

এই বিবেচনায় দেশের শাসকশ্রেণি ও পুঁজির নিরাপত্তা বিধানের দিক থেকে এগিয়ে থাকা দল আওয়ামী লীগের ফের ক্ষমতায় ফিরে আসা নিশ্চিত হয়ে যায় অনেকটাই। গেল ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রায় ভোটারবিহীন সংসদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা (!) নিয়ে সরকার গঠন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা নির্বাচনকালীন অন্তবর্তী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের পক্ষে বলা হয়, বিএনপি ভোট না করলেও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নির্বাচন অপরিহার্য। বর্তমান সরকারকে 'আপাত নির্বাচিত' বা 'সাংবিধানিক' সরকার বলাটাই তাই শ্রেয়।

এই ধরনের সাংবিধানিক সরকার জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয় না বলেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা (?) জনগণের পক্ষের হয়ে উঠতে পারেন না। তাদের থাকে না জনজবাবদিহিতা, থাকে না জনদায়বদ্ধতা। তারা হয়ে ওঠেন পুঁজির মালিকদের যথার্থই প্রতিনিধি। আর লুটেরা পুঁজির প্রতিযোগিতায় রাষ্ট্রিক সহায়তা দিতে গিয়ে ক্ষমতায়নের নানাবিধ সমীকরণে সাংবিধানিক এই জনপ্রতিনিধিদের (?) নিয়ে গঠিত সরকারে সমন্বয় থাকে না। জনকল্যাণমুখী কোনো প্রয়াসও দেখা যায় না।

বরং এমনি সরকারে প্রাধান্য পায় স্বেচ্ছাচার, কর্তৃত্ববাদ, ঔদ্ধত্য ও দেশদশবিরুদ্ধ সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা। সর্বোপরি, জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয় না বলেই জনগণকে তুচ্ছ জ্ঞান করার বিষয়টি তাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। সাংবিধানিক তথা আইনি এমনি সরকারের এসব বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ মেলে সরকারের তথা সরকারের প্রতিনিধিদের সমন্বয়হীন কাজকর্ম, কথাবার্তা আর স্বেচ্ছাচারী আচরণে।

এ ক্ষেত্রে আমাদের সামনে সবথেকে বড় উদাহরণ হচ্ছে এ শতকের প্রথমদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ডব্লিউ বুশ তথা রিপাবলিকান দলীয় সরকারের প্রথম মেয়াদের শাসন। ২০০০ থেকে ২০০৪ সালের মেয়াদে বুশ পপুলার ভোটে নয়, বরং নির্বাচিত ঘোষিত হন দেশটির সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তে–

Election results hinged on Florida, where the margin of victory triggered a mandatory recount. Litigation in select counties started additional recounts, and this litigation ultimately reached the United States Supreme Court. The Court's contentious decision in Bush v. Gore (in contrast to an equally contentious decision by the Florida State Supreme Court), announced on December 12, 2000, ended the recounts, effectively awarding Florida's votes to Bush and granting him the victory. This marked only the fourth election in U.S. history in which the eventual winner failed to win a plurality of the popular vote (after the elections of 1824, 1876, and 1888). Later studies have reached conflicting opinions on who would have won the recount had it been allowed to proceed.

[সূত্র: উইকিপিডিয়া]

আইনের মারপ্যাঁচে এমনিতর প্রেসিডেন্ট হবার পর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নিজের দেশ, জনগণ, এমনকি বিশ্ববাসীর ইচ্ছা বা অভিপ্রায় কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেননি জর্জ বুশ। হয়ে ওঠেন স্বেচ্ছাচারী এক মার্কিন অধিপতি। আক্রমণ করেন স্বাধীন সার্বভৌম দেশ ইরাক। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে অবস্থান নেন নিজ দেশ ও গোটা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে।

আর এসবের পেছনে 'নৈতিকতা'কে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম ভাষণে সদম্ভ ঘোষণা করেন, তার লক্ষ্য হচ্ছে আমেরিকাকে a single nation of justice and opportunity হিসেবে গড়ে তোলা। উত্তর কোরিয়া, ইরান ও ইরাককে 'এক্সিস অব ইভিল' দাবি করে নিজের দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে আখ্যায়িত করেন একটি নৈতিক রাষ্ট্র হিসেবে।

নিজের করনীতিকেও নৈতিকতার মোড়কে মুড়ে দেন এই বিশ্বমোড়ল; মুক্ত বাণিজ্যকে শুধুই আর্থিক না বলে, বলেন এটাও 'নৈতিকতাঋদ্ধ'। ইরাক আক্রমণ থেকে শুরু করে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে বিশ্বের দেশে দেশে মার্কিন আগ্রাসন আর নিজের স্বেচ্ছাচারিতাকে তিনি দাঁড় করান স্বঘোষিত 'নৈতিকতার' মানদণ্ডে।

জর্জ ডব্লিউ বুশকে উদাহরণ হিসেবে টানবার কারণ হচ্ছে, ইদানিং আমাদের এই দেশটিতেও 'সাংবিধানিক' সরকারের নামে বাড়ছে জনবিরুদ্ধতার মাত্রা। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও (?) হয়ে উঠেছেন বেপরোয়া। তাদের কাজকর্ম, কথাবার্তাতে প্রকাশ পাচ্ছে স্বেচ্ছাচারের বারতা।

আর সেই সুযোগে রাষ্ট্রের পাশাপাশি গড়ে ওঠার প্রবল সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে সমান্তরাল আরেকটি রাষ্ট্রের। প্রশাসনের পাশাপাশি আরেকটি প্রশাসনের। আর এমনটি হয়ে গেলে তাতে থাকবে না রাষ্ট্র ও সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ। জনগণ বঞ্চিত হবে তার অন্যতম আশ্রয় রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্যের জায়গা থেকে। আরও অনিরাপদ হয়ে উঠবে সাধারণের জীবন।

এমন কোনো রাষ্ট্র ও প্রশাসন কি আমরা চাইতে পারি?

সেলিম খান: সংবাদকর্মী।