বাড়ি ফেরা: এক পুনঃপৌণিক দুর্ভোগের বন্দোবস্ত

মানস চৌধুরী
Published : 20 Nov 2010, 02:31 PM
Updated : 20 Nov 2010, 02:31 PM

কয়েকটি জাতীয় দিবসে প্রায় নিয়ম করে কিছু লেখা পত্রপত্রিকাতে ছাপা হয়ে থাকে। ঈদকে সেরকম কিছু রাষ্ট্রীয় দিবস বলা যায় না। অন্তত রাষ্ট্রধর্মের মতো ফলাও করে এটা প্রচার না করা পর্যন্ত। আবার ব্যতিব্যস্ততায় যে কোন রাষ্ট্রীয় দিবস থেকে বরং কয়েকগুণ বেশি তৎপর একটা দিন ঈদ। আর ঈদে বাড়ি-ফেরার দুর্ভোগ নিয়েও কিছু রচনা প্রায় রুটিন করে প্রকাশিত হয়। এরকম একটি প্রবন্ধোদ্রেককারী বিষয়বস্তুর ইতোমধ্যেই সমাধিস্থ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে ফি বছর অন্তত দু'বার করে আম মানুষজন সমাধির আতঙ্ক বুকে করে নিয়ে বাড়ি যান (ও ক'দিন পর ফিরে আসেন)। সঙ্কটটির কোনো রাষ্ট্রীয় সুরাহা হয় না। সঙ্কটটি কোনোরকম চ্যারিটিমনস্ক উপায়-উপকারেরও মুখ দেখে না। বরং বাড়ি-ফেরার তাগিদ ব্যবসায়িক একটা ফাঁদ হিসেবে নতুন নতুন উদ্যমে আবিষ্কৃত। ফলে ঈদে ঢাকা থেকে মানুষজনের বাড়ি ফেরা একটা জলজ্যান্ত প্রসঙ্গ হিসেবে বেঁচে থাকছে।

সংবাদ-জরুরিত্ব আকছার বদলায়, এবং সচিত্র খবর ছাপানো চিরকালই সম্পাদকীয় নীতিমালা নির্ধারণের প্রসঙ্গ, সম্পাদক-সাংবাদিক মহলের পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়। এর মধ্যে নানাবিধ প্রসঙ্গ ছবির গুরুত্ব থেকে অপসৃত হয়েছে। বস্তিতে আগুন আর তেমন ছাপা হয় না, নিবিড় শ্রমনির্ভর কাজের ফোটো কম ছাপা হতে শুরু হয়েছে–এরকম আরও কিছু উদাহরণ অনায়াসেই দেয়া সম্ভব, গুরুতর কোনো গবেষণা ছাড়াই। পাশাপাশি, মে দিবসে শ্রমিকদের একটা ফোটো অগ্রগুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করবার রেওয়াজটা এখনো চালু আছে। ঈদে বাড়ি ফেরার দুর্ভোগের আলোকচিত্রও সংবাদপত্রে এসে থাকে। বাংলা মাধ্যমের পত্রিকাতে তো বটেই। পত্রপত্রিকা তরফে গুরুত্বপ্রদানের চালচিত্র কিংবা তাতে উল্লেখযোগ্য বদল প্রসঙ্গ হিসেবে আমার আগ্রহের, এবং স্বতন্ত্র মনোযোগের দাবিদার। আজকের আলোচ্য তা নয়। বাড়ি ফেরাই আজকের আলোচ্য।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর মায়ের কাছে যাবার জন্য যে দুর্ভোগকে বরণ করেছিলেন সেটা মাতৃভক্তির নিদর্শন হিসেবে পাঠ করা হয়ে থাকে। কথিত, কবে জানি পড়েছিলাম কোনো এক বইয়ে, মা তাঁকে দেখতে চেয়েছিলেন জানতে পেরে এক ঝড়ের রাত্রে মাকে দেখতে রওয়ানা হন বিদ্যাসাগর। গঙ্গার তীরে এসে যখন শেষ পারানির নৌকাও আর পেলেন না তিনি, তখন ঝড়ের ঐ খরস্রোতা নদীতে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার শুরু করে দিলেন। ইত্যাদি ইত্যাদি। যাহোক, বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তি বোঝানোর জন্য এই গল্পের প্রতি যতই না কেন আগ্রহ থাকুক লোকের, নিজেদের জীবনে পরিবার-পরিজনকে দেখার জন্য এরকম গল্প জন্ম দেয়া তাঁদের কর্তব্য ধরে নেয়ার কোনো কারণ নেই আমাদের।

পত্রিকার নিয়মিত পাঠক গা করুন আর নাই করুন ঈদে যাত্রীদের অশেষ ভোগান্তির চিত্রটা তাঁরা সবাই প্রায় জানেন: বাস, ট্রেন বা লঞ্চের টিকেট পাওয়া যায়না না, পাওয়া যখন যায় তখন চোরাই পথে কিনতে হয় বিস্তর দাম দিয়ে, কিনতে গিয়ে প্রায়শই প্রতারণার শিকার হতে হয়। কিংবা বাস, ট্রেন কিংবা লঞ্চে জানালা, পাটাতন, ছাদ উপচে মানুষজন জায়গা পাবার চেষ্টা করেছেন; ঝুঁকিপূর্ণভাবে যাতায়াত করতে গিয়ে অহেতু দুর্ঘটনায় পড়েছেন; অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারণে যানবাহন দুর্ঘটনার মুখে পড়েছে; নদী পারাপারের জন্য ফেরিঘাটে কিংবা বাস টার্মিনালের মুখে বিশ্রি যানজটের কারণে নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি ফেরা সম্ভব হয় নি। ঈদের আগের কয়েক দিন, ঈদের দিন এবং পরের কয়েকদিন সড়কপথে বা নৌপথে কতগুলো মানুষের মৃত্যু। এগুলো কোনো ব্যত্যয় ছাড়াই ঘটে চলেছে, ফি বছর এবং তেমন কোনো প্রতিবিধান ছাড়াই। অথচ মানুষের এই চলাচলগুলো কোনোমতেই আচানক নয়। পূর্বনির্ধারিত একটি ঘটনা। সংশ্লিষ্ট সকল মহলেই জানেন যে এই দিনগুলোতে ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহর থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ অন্যান্য ছোট শহর বা গ্রাম মুখে ছুটবেন। এবং কয়েকদিন বাদে তাঁরা আবার ঢাকায় ফিরবেন।

মানুষজনের ঈদে বাড়ি-ফেরা কেন বছরের পর বছর ব্যতিক্রমহীন একটা দুর্ভোগ হিসেবে রয়ে গেছে সেই প্রশ্নটার নিষ্পত্তি সম্ভব আসলে অন্যান্য প্রশ্নকে প্রশ্রয় দিয়ে। একটা হলো, মানুষ বাড়ি কেন ফেরেন? আর হলো, কোন মানুষ বাড়ি ফেরেন? সকলের তো আর বাড়ি-ফেরার তাড়া নেই! কিংবা বাড়ি-ফেরা মানে তো তাঁদের শহর ছেড়ে যেন তেন প্রকারেণ নশ্বর শরীরের ঝুঁকি নিয়ে কোনো একটা যানের উপর সওয়ার হওয়া নয়! অথবা, ঢাকার বাইরে যাওয়া তাঁদের বড়জোর এক প্রমোদ ভ্রমণ। বাড়ি-ফেরার উত্তুঙ্গ তাগিদ আর দুর্দমনীয় আকাংক্ষা, বিপরীতে গভীর হতাশাবোধের চেয়ে সেই বাস্তবতার আকাশ-পাতাল ভিন্নতা। প্রশ্নটা ঢাকা মহানগরের গোড়াপত্তন আর ব্যবস্থাপনার, সামাজিক বৈষম্য আর রাষ্ট্রীয় দায়-দায়িত্বহীনতার।

মাঝে মধ্যে কয়েকদিন যেখান থেকে সিগারেট কিনি, ধানমণ্ডি লেক পাড়ের সেই জায়গাতে ক'দিন ধরে আর ঠিকঠাক পাওয়া যাচ্ছে না তাদের। সেদিন প্রায় এক দেয়ালের পিছনে লুকিয়ে থাকা জায়গা থেকে একজন বেরোল। সিগারেট বেচল। এই পরিস্থিতির কারণ জিজ্ঞেস করাতে কোত্থেকে তার মা এসে ঘোষণা করলেন যে গরিব লোকগুলারে বানাইয়া আল্লা ঠিক করেন নাই। অথবা অন্তত বানানোর পরই তাদের মেরে ফেলা উচিৎ ছিল। এবং সবশেষে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে তাদের কোনো প্রয়োজন আদৌ ঢাকা শহরে আছে কিনা। বিষয় হলো, যা বুঝলাম, পুলিশ ধানমণ্ডির আশপাশ থেকে এই ধরনের ছিন্নমূলদের তুলে দিচ্ছে।। এই মহিলার প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো তাৎক্ষণিক কিছু খুঁজে আমি পেলাম না। একটু পর, সিগারেট ধরাতে ধরাতে, বলতে পারলাম যে তাদের প্রয়োজন তো দিব্যি আছে। তারা না থাকলে ক'দিন পর পর ময়লা আবর্জনা ফেলার লোকজন কই পাওয়া যাবে! এমনকি এই কুরবানির ভুড়ি-গোবর সাফ করার কাজটাও আমার মতো লোক করতে চাইবে না, তাদের লাগবেই। আমার কথায় আশ্বস্তি পেয়েই হয়তো, মহিলা কথা আর বাড়ালেন না।

মহিলার কথায় যেভাবেই উত্তর দিয়ে থাকি না কেন অশান্তিটা মনের মধ্যে চাগাড় দেবারই কথা। হয়তো সিগ্রেট বিক্রির অধিকন্তু তিনি সেটাই চেয়েছিলেন। তাঁর ভোগান্তির কিয়দংশ যেন আমার মধ্যে অশান্তি হিসেবে চালান হয়ে যায়। ঢাকা শহরের প্রধান স্থপতি আর রূপকারদের এর প্রবল অধিবাসীদের মধ্যকার জনমিতিক আকাংক্ষা আর এঁদের দৈনন্দিন প্রয়োজন কিছুতেই সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। এঁরা মনে মনে চাইতে থাকেন তামাম পাড়া জুড়ে যেন চকচকে মসৃণ চেহারার ফুরফুরে মানুষেরাই থাকেন। কিন্তু স্বাস্থ্য-সচেতন দৌড়টা শেষে গলির ধারে কদুওয়ালা বসে না থাকলেও এঁদের মেজাজ চড়ে যায়। ভাবতে শুরু করেন কদুওয়ালাদের তেল বড্ড বেড়ে গেছে ইদানীং। আবার অন্য চকচকে মসৃণ চেহারার প্রতিবেশী অধিকতর চকচকে গাড়ি নিয়ে পাড়ায় ঢুকলেও যে এঁরা অনেক শান্তি পান তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। ফলে, যেমনটা বলছিলাম, ঢাকা শহরের অধিপতি জনগণের আকাংক্ষা আর প্রয়োজনের কোনো সুবিধাজনক সমীকরণ সহজ নয়।

বাস্তবতা হল, আমাদের বাসনার দুনিয়া যাই হোক, ঢাকার জনমিতিক মানচিত্রটি ঠিক সমরূপ নয়। ঢাকা শহরে যাঁরা বাস করেন, যাঁদের সশ্রম উপস্থিতি ছাড়া গোটা শহরটাই অচল, এমনকি পুরা রাষ্ট্রকাঠামো, তাঁদের সিংহভাগই এই শহরে স্থাপিত নন। এই শহরের সঙ্গে তাঁদের দুই-তিন প্রজন্মের সম্পর্ক নয়। পেশাজীবী কিংবা শিল্পপতি পরিবারগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ন্যূন দু' তিন প্রজন্ম ধরে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত তাঁরা। এই শহরের তাঁরা অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঈদ উপলক্ষে তাঁদের বাড়ি-ফেরা তাঁদের অস্তিত্বের অবধারিত দিক। এমনকি, যদি নিষ্ঠুর একটা সামাজিক তাগিদ থেকেও বিচার করি, তাঁদের বাড়ি-ফেরা উৎপাদন প্রক্রিয়ার পরবর্তী গতিশীলতার জন্যও জরুরি।

অন্তত মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে। কিন্তু দুর্ভোগ তাঁদের সফরের জন্য পূর্ব-নির্ধারিত হয়ে আছে। সেটা দুশ্চিন্তার নয় কেবল, গভীর ক্রোধের।

আমি ঠিক তাঁদের দলে নেই যাঁরা নানাবিধ শোকপ্রস্তাব আর নিন্দাপ্রস্তাবে খুশি হতে পারেন। লিবেরেল রাজনীতির এসব বুজরুকিতে আমার আস্থা নেই। তদুপরি, আমার মনে পড়ে না, নেহায়েৎ কৌতূহলী অনুসন্ধানে, কখনো সংসদে ঈদে বাড়িমুখী কিংবা ফিরতি পথে শহরমুখী নিহত মানুষজনের জন্য সংসদে কখনো শোকপ্রস্তাব নেয়া হয়েছিল কিনা। কিংবা নিতান্ত দুর্যোগ-ভোগান্তি মাথায় নিয়ে সপ্রাণ ফিরতে পেরেছিলেন যাঁরা তাঁদের কোনো বাহ্বা প্রস্তাব নেয়া হয়েছিল কিনা। যদি না হয়ে থাকে, নানাবিধ রাজনৈতিক মেটাফরের কালে, আগামীতেও নেয়া হবে না তা নয়। কিন্তু আসলেই এসব আচার-অনুষ্ঠানে আমার সামান্যই আগ্রহ। কিন্তু আমি সুনিশ্চিত মনে করি, কয়েক লক্ষ লোকের বাড়িতে ক'দিনের জন্য বেড়াতে যাওয়া নেহায়েৎ সামান্য নাগরিক অধিকার। এটা নিশ্চিত করতে পারা কোনো সরকার বা ব্যবস্থাপনার কেবল কর্তব্যই নয়, অত্যন্ত সাধারণ পর্যায়ের সামর্থ্য হবার কথা। আমি পলিসি-সুপারিশকার নই। হতে পছন্দ করি না। অন্তত পত্রিকার পাতায়, হোক সে ওয়েব পত্রিকা। কিন্তু কতিপয় বিশেষজ্ঞ কিংবা একটা সংসদ কিংবা যুগপৎ ঈদের আগে একত্রে বসে, স্থানীয় 'জন'প্রতিনিধিদেরকে বিশেষ 'এ্যাসাইনমেন্ট' দিয়ে, পরিবহণ মালিক সমিতিকে একটা স্টেকহোল্ডার বানিয়ে, একটা কার্যকরী উপায় আবিষ্কার অসম্ভব নয় তা আমি মনে করি না। আর যাই হোক এটা অমরত্বের ওষুধ আবিষ্কারের মতো বড় কোনো চ্যালেঞ্জ নয়। স্রেফ একটা প্রায়োরিটিই এখানে যথেষ্ট। তা হচ্ছে, আম-মানুষের জীবনকে, প্রয়োজনকে এবং তাঁদের পারিবারিক-সামাজিক জীবনকে গুরুত্ব দিতে পারা।

প্রাণপ্রিয় পোষ্যকে ঈশ্বরের কাছে বলি দিতে পারাই নাকি কুরবানি ঈদের মূল শিক্ষা। আমার মনে হয় না যে রাষ্ট্র, সরকার আর এর চালিকাশক্তি এজেন্সিগুলো প্রাণপ্রিয় 'জনগণ'কে কুরবান করবার অনুপ্রেরণা থেকে এই অনাচার করে চলেন ফি বছর। যদি তা হতো, মৃত আর দুর্ভাগা মানুষজন অন্তত মরবার কালে, যন্ত্রণার কালে, গৌরববোধ করতে থাকতে পারতেন।

কী জানি হয়তো করেনও!

(১৫, ১৬ ও ১৭ ই নভেম্বর ২০১০॥ ঢাকা)