ফিরতে হবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে

Published : 17 Dec 2009, 07:31 PM
Updated : 17 Dec 2009, 07:31 PM

পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট কোনো সাধারণ দুর্ঘটনার দিন ছিল না। ছিল কুটিল ও নৃশংস সন্ত্রাসের দিন –  বলতে গেলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ঘটনা। পনেরই আগস্ট ছিল এক গভীর ষড়যন্ত্রের দিন – একাত্তরের পরাজিত শত্রু বিদেশী রাষ্ট্র এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগীদের মিলিত কাপুরুষোচিত বর্বর আক্রমণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর, রাষ্ট্রের রাষ্ট্রচরিত্র ছিনতাই করার জন্য। লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে একাত্তর-পূর্ব রাষ্ট্রীয় চরিত্রে ফিরিয়ে নেয়া। প্রাথমিকভাবে এক পাকিস্তান থেকে দুই পাকিস্তানের সৃষ্টি। পরবর্তীতে সম্ভব হলে কনফেডারেশন জাতীয় কাঠামোর মধ্যে ঢুকিয়ে কার্যতঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনতাই করা।

একথা শুনে পরাজিত শত্রুরা সমস্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবে – 'এসবের প্রমাণ কী?' প্রমাণ আছে বৈকি! তবে তার আগে পাল্টা প্রশ্ন, 'এমন ষড়যন্ত্র যে ছিল না, তার প্রমাণ কী?' যখন কোনো অপরাধের চাক্ষুষ প্রমাণ না মেলে, তখন আইনবিদেরা পারিপার্শ্বিক প্রমাণ (সার্কামসট্যান্সিয়াল এভিডেন্স) খোঁজ করেন। শক্তিশালী পারিপার্শ্বিক প্রমাণ উপস্থাপন করা গেলে, বিচারক তা গ্রহণও করেন। আমাদের দেশের ঐ ষড়যন্ত্রের ঘটনার বিচারক দেশের জনগণ। আন্তর্জাতিক সুধী সমাজও নির্মোহ বিচার করতে পারেন।

রাষ্ট্র ছিনতাই-এর অভিযোগটির প্রমাণ পেতে হলে অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে, কিছু কিছু জবাব প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে থাকবে। নিবন্ধটির সীমাবদ্ধতার কথা মনে রেখে, কয়েকটি প্রশ্ন ও তার জবাব খোঁজার চেষ্টা করা যাক।

মৃত্যু অথবা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে, সংবিধান অনুযায়ী উপরাষ্ট্রপতি শূন্য পদে অধিষ্ঠিত হবেন। উপরাষ্ট্রপতিও না থাকলে জাতীয় সংসদের স্পিকার শূন্য পদে কর্মপরিচালনা করবেন। পঁচাত্তর সালের পনেরই আগস্ট বাংলাদেশে উপরাষ্ট্রপতিও ছিলেন, স্পিকারও ছিলেন। অথচ পদ ছিনতাই করে স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হলেন খোন্দকার মুশতাক নামক এক ব্যক্তি যার সাংবিধানিক যোগ্যতা ছিল না ওই পদে অধিষ্ঠিত হবার। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, এই খোন্দকার মুশতাক পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন করার জন্য মার্কিন মহলে দেনদরবার করেছিলেন। তাহলে কি একাত্তরের ওই ষড়যন্ত্রেরই রূপায়ণ প্রয়াসে পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল?

পঁচাত্তরে ছিনতাইকৃত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হলেন খোন্দকার মুশতাক, সেনাপ্রধান হলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং মুখ্য সচিবের দায়িত্ব পেলেন মাহবুবুল আলম চাষী। উল্লেখ্য, ঐ তিনজনই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে 'কনফেডারেশন ষড়যন্ত্রে'র সাথে জড়িত ছিলেন। 'শৃঙ্খলাবিরোধী' কাজের অভিযোগে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী তৎকালীন মেজর জিয়ার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। শুধুমাত্র ঐক্য বজায় রাখার অজুহাতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কঠোর ব্যবস্থা পরিহার করেছিলেন। তবে মেজর জিয়াকে সেক্টর কমান্ডারের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে শুধু জেড ফোর্স পরিচালনায় নিয়োজিত রাখা হয়। কনফেডারেশনের আরেক সমর্থক মাহবুবুল আলম চাষীকে সিভিল প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে নিয়োগ দান কী ইঙ্গিত বহন করে? প্রতীয়মান হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যে তিনজন কনফেডারেশন পরিকল্পনায় সরাসরি নিয়োজিত ছিলেন, তাদের একজন হলেন রাষ্ট্রপ্রধান আরেকজন হলেন সেনাপ্রধান এবং অন্যজন হলেন প্রশাসনের মূখ্য কর্মকর্তা। রাষ্ট্রপ্রধান যেমন অসংবিধানিকভাবে হয়েছেন, তেমনি জেনারেল শফিউল্লাহকে সরিয়ে সেনাপ্রধানের পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন জেনারেল জিয়া এবং মাহবুবুল আলম চাষীও অনিয়মতান্ত্রিকভাবেই প্রশাসনিক মূখ্য কর্মকর্তার পদে আসীন হয়েছিলেন। এটাকে কি 'কনফেডারেশন ষড়যন্ত্র' রূপায়ণের প্রাথমিক রূপ হিসাবে রাষ্ট্রযন্ত্র ছিনতাই হিসাবে চিহ্নিত করা অনুচিৎ হবে? কেন এবং কোন যুক্তিতে?

কয়েকজন 'বিপদগামী' সেনাসদস্যের দ্বারাই যদি আগস্টের হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, তাহলে এসব 'বিপথগামীদের' রক্ষা করার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হল কেন?  বিপথগামী হয়ে কেউ অন্যায় করলে, ন্যূনপক্ষে আইন তো নিজস্ব গতিতে পরিচালিত হয়ে অন্যায়ের বিচার করবে – এটাই তো স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে অন্যায়কারীদের তৎকালীন সরকার ছত্রছায়া প্রদান করে আইনের গতি বন্ধ করলো কেন? তাহলে কি ক্ষমতা দখলকারীদের উস্কানী বা নিদেনপক্ষে সম্মতিতেই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল? বেনিফিশিয়ারী সরকারের আমলে হত্যাকারীরা শুধু নিরাপত্তা পেল তাই না, বরং দূতাবাসসমূহে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হয়ে নিয়োজিত হয়েছে। এ ঘটনা কি হত্যাকারী ও ক্ষমতা দখলকারীদের সমঝোতার ফসল নয়?

রাষ্ট্রপ্রধানসহ এতগুলো হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করে, হত্যাকারীরা বিমানপথে ব্যাংকক হয়ে লিবিয়া, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে নির্বিঘ্নে যেতে পারলো কীভাবে?  লিবিয়া, পাকিস্তান প্রভৃতি রাষ্ট্র সন্ত্রাসীদের কেন আশ্রয় দিয়েছিল, কোন কোন রাষ্ট্র কূটনৈতিক সহায়তা দিয়েছিল এবং কেন দিয়েছিল সে বিশ্লেষণ এই হত্যাকাণ্ডে বিদেশী রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। কোন কোন দেশ সংশ্লিষ্ট ছিল এবং কোন কোন রাষ্ট্র ছাতা ধরেছিল, তাদের সাথে ক্ষমতা দখলকারীদের কী ধরনের বোঝাপড়া ছিল, তা ইতিহাসের স্বার্থেই প্রকাশিত হওয়া দরকার। কারণ, বাংলাদেশকে চলার পথে কে বন্ধু আর কে শত্রু, তা বুঝে নেবার প্রয়োজন আছে, যদিও চিরশত্রু বা চিরমিত্র বলে কিছু নেই।

জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড যদি বিপথগামীদের বিচ্ছিন্ন কাজই হয়ে থাকে, তাহলে প্রায় তিনমাস পরে ৩ নভেম্বরে জেলখানায় রাষ্ট্রীয় হেফাজতে রক্ষিত বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ চারজন নেতাকে কেন ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হল?  দু' হত্যাকাণ্ড কি একই সুতোয় বাঁধা নয়?  দু' হত্যাকাণ্ড মিলে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী শক্তিকেই কি সন্ত্রাসের মাধ্যমে হত্যা করা হলো না? তাহলে এটা কি শুধুই হত্যাকাণ্ড? একে কি বিদেশী শত্রুরাষ্ট্রের ছত্রছায়ার সাহায্যে দেশীয় সন্ত্রাসী পশুশক্তি কর্তৃক রাষ্ট্রযন্ত্র ছিনতাই বলে আখ্যায়িত করা যায়?

ক্ষমতা ছিনতাই করে দখলকারীরা রাষ্ট্রের পরিচিতিই পাল্টে ফেলেছিল। গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিই তারা উল্টে দিল, ফলে রাষ্ট্রও উল্টে গেল। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আর রইলো না। বাংলাদেশ নামের আড়ালে হয়ে উঠতে লাগলো এক 'নতুন বাংলাদেশ' (বাংলাস্তান?)। ক্ষমতা ছিনতাইয়ের সাথে রাষ্ট্রের এই পশ্চাদগমনের সম্পর্ক কী?

সর্বশেষ আইনের কাছে যাই। আইন কী বলে। একটি মামলার বিচারে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে – খোন্দকার মুশতাক, জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদ – এ তিনজনের ক্ষমতা দখলই ছিল অসংবিধানিক এবং অকার্যকর (ভয়েড)। রায়টি সুপ্রিম কোর্টে বাতিল হয়নি, স্থগিত রয়েছে। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু হত্যার রায়ও হাইকোর্ট পার হয়েছে – সুপ্রিম কোর্টে আটকে রয়েছে।

শোক প্রকাশ করা হয় সাধারণ মৃত্যুতে। শেরে বাংলার মৃত্যুতে বা মাওলানা ভাসানীর পরলোক গমনে দেশবাসী শোক প্রকাশ করেছে, কারণ তাঁরা চিরতরে আমাদের ছেড়ে গেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড কি সে রকম? বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল এক সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র। আমরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হারাইনি, হারিয়েছি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করা বাংলাদেশ। কাজেই পনেরই আগস্ট শুধু শোক প্রকাশের দিন নয়। নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ষড়যন্ত্রকারী বেনিফিশিয়ারীদের খপ্পর থেকে ছিনতাইকৃত বাংলাদেশ পুনরুদ্ধার করে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে কাজ শুরু করার দিন।

সদা সতর্ক থাকতে হবে, যেন নব্য ষড়যন্ত্রকারীরা রাষ্ট্র ছিনতাইয়ের সুযোগ আর না পায়। ক্যু, হত্যাকাণ্ড, গ্রেনেড-বোমা হামলা ও অন্যান্য সত্রাসী কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করা না গেলে দেশের কোনো মানুষই নিরাপদ থাকবে না। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই আমরা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিবসে শোক পালনের নৈতিক অধিকার অর্জন করতে পারি।